যুক্তি তর্ক গল্প- সাম্রাজ্যবাদবিরোধী রাজনীতি কেন জরুরি by আবুল মোমেন
৯/১১-এর ঘটনার পর থেকে এক যুগ ধরে যুক্তরাষ্ট্রের এজেন্ডায় সন্ত্রাসবিরোধী কার্যক্রম শীর্ষে রয়েছে। সেই সুবাদে বিভিন্ন মুসলিম দেশে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি হস্তক্ষেপ করে চলেছে। কিন্তু মার্কিন হস্তক্ষেপের ফলে সংশ্লিষ্ট কোনো দেশেই গণতন্ত্র বা শান্তির পথ সুগম না হলেও যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে তাদের নীতি সংশোধনের কোনো প্রয়াস বা সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।
এমনকি এ কথাও বলা যায়, মার্কিন নীতি ও হস্তক্ষেপের ফলে অনেক দেশে তরুণদের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা বাড়ছে এবং তা পরিণতিতে সন্ত্রাসের ঝুঁকিও বাড়িয়ে দিচ্ছে।
৯/১১-এর বিমান হামলা নিঃসন্দেহে একটি হঠকারী ঘটনা। এ থেকে শান্তির প্রত্যাশা কেউ করেনি। এ হলো দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা বহুকাল ধরে দ্বৈতনীতি চালিয়ে আসছে। সেটা শুরু হয়েছিল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে। ইসরায়েলের প্রতি তাদের পক্ষপাত ও ফিলিস্তিনের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণে কোনো ঢাকাঢাকি ছিল না, এখনো নেই।
ইসরায়েল ইহুদি রাষ্ট্র আর ফিলিস্তিনসহ প্রতিবেশী আরব দেশগুলোর সিংহভাগ মানুষ মুসলমান। তাতে এই দ্বৈতনীতিজাত পক্ষপাতের একটি সাম্প্রদায়িক পরিচয়ও পাওয়া যায়। ইসরায়েল বিভিন্ন সময় জঙ্গি ইহুদিবাদী নীতির পথ ধরে সম্প্রসারণবাদী আগ্রাসন চালিয়ে আসছে। তাতে প্রতিবেশী আরব রাষ্ট্রের সঙ্গে একাধিক যুদ্ধে তারা লিপ্ত হয়েছে এবং প্রতিটি যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্র দেশগুলো অন্ধ সমর্থন দিয়ে গেছে ইসরায়েলকে। প্রতিবারই যুদ্ধ থেমেছে বিভিন্ন আরব দেশের ভূমি হারানো আর ইসরায়েলের ভূমি লাভের মধ্য দিয়ে। ৬০ বছর পরও ফিলিস্তিন সমস্যার কোনো চূড়ান্ত সমাধান আজ পর্যন্ত হলো না। কিন্তু এটা যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্রদের একটি নৈতিক দায়, যা তারা কোনোভাবেই এড়াতে পারে না।
আমরা লক্ষ করব ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ও তার পরের কয়েক বছরে সমাজতান্ত্রিক দ্বিতীয় বিশ্বের অবসান ঘটার পর থেকে এক মেরু বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা অনেক বেশি আগ্রাসী হয়ে উঠেছে। গত শতাব্দীর ষাট ও সত্তরের দশকেও উন্নয়নশীল দেশগুলোয় সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয় মুক্তির আন্দোলন বেশ জোরদার ছিল। কিন্তু নব্বইয়ের দশকের পরে সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের অনুপস্থিতিতে এই আন্দোলন স্তিমিত হয়ে গেছে। অথচ পুঁজিবাদী অর্থনীতির রথটিকে টেনে নিয়ে যায় সাম্রাজ্যবাদী অশ্বশক্তি। যুক্তরাষ্ট্রে সেই পাঁচের দশক থেকে ম্যাকার্থিবাদের জোয়ারে কমিউনিজমের যে ভূত সৃষ্টি করা হয়েছিল, তার কার্যকারিতা সোভিয়েতের পতন ও সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব ভেঙে পড়ার দুই দশক পর আজও প্রায় একই রকম রয়েছে। এর বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র, মানবাধিকার, উদারতা, আইনের শাসন ইত্যাদি অত্যন্ত আকর্ষণীয় নিশান ঊর্ধ্বে তুলে ধরে পৃথিবীর দেশে দেশে, বিশেষত উন্নয়নশীল বিশ্বে এসব প্রসার-প্রচারে বিস্তর মেহনত করছে। কিন্তু এখানেও যুক্তরাষ্ট্রের দ্বৈতনীতিই বহাল থাকায় সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ সিদ্ধি হলেও সেসব দেশের কোনো উপকার হচ্ছে না।
মধ্যপ্রাচ্যের কোনো মুসলিম দেশে সংগত কারণেই পশ্চিমা মানদণ্ডের গণতন্ত্র নেই, ইরাকেও ছিল না। তবে পশ্চিমের মানদণ্ডে উন্নয়নের যেসব মাপকাঠি আছে, যেমন শিক্ষার হার, নারীমুক্তি, কর্মসংস্থান, জীবনযাপনের মান ইত্যাদি বিচার করলে ইরাক ছিল আরব বিশ্বে সবচেয়ে এগিয়ে। অন্যান্য আরব দেশের মতো বিশেষত যেসব দেশ ছিল যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র—ইরাকের শাসক সাদ্দাম হোসেনও ছিলেন একনায়ক এবং অন্য অনেকের মতো যুক্তরাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় তাঁর উত্থান হলেও তত দিনে সাদ্দাম যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী ও স্বাধীনচেতা শাসক। তাই ইরাকে পরিবর্তন আনা জরুরি হয়ে পড়ল। একদিকে যুক্তরাষ্ট্র অভিযোগ তুলল ইরাকে ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্রের মজুদ আছে আর অন্যদিকে আওয়াজ তুলল একনায়কত্বের অবসান ঘটিয়ে ইরাকে গণতন্ত্র আনতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক ইরাকে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর পর শাসক পরিবর্তন হলো বটে কিন্তু ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্র যেমন পাওয়া গেল না, তেমনি প্রতিষ্ঠিত হলো না গণতন্ত্র কিংবা শান্তি। বরং মার্কিন ধ্বংসযজ্ঞের মাধ্যমে ইরাক ফিরে যাচ্ছে জাতিগত বিভেদ ও হানাহানির বর্বর যুগে।
আফগানিস্তানেও মার্কিন হস্তক্ষেপের পরিণতি একই হয়েছে। হামিদ কারজাইয়ের শিখণ্ডি সরকার বসিয়ে ন্যাটো বাহিনীর বন্দুকের তলায় পদানত থেকে গণতন্ত্রচর্চা যে হয় না, সেটা বুঝতে আর কত বছর লাগবে উন্নত বিশ্বের কে জানে! কিন্তু এতে সন্ত্রাস যে বাড়ে তা ইরাক-আফগানিস্তান ভালোভাবে প্রমাণ দিচ্ছে।
৯/১১-এর আক্রমণটি একটি সন্ত্রাসী হামলাই ছিল। আর সেটিকে অজুহাত হিসেবে ধরে যুক্তরাষ্ট্র যা করছে, তার ফলে সারা বিশ্বে সন্ত্রাসবাদ ছড়িয়ে পড়ছে। যুক্তরাষ্ট্র নিজেও আর নিরাপদ থাকছে না।
আমরা লক্ষ করলে দেখব, সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের পতনের পর থেকে মাঝেমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলোয় এমন কিছু ঘটনা ঘটছে বা ঘটানো হচ্ছে, যাতে মুসলিম সমাজে ও দেশে দেশে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। এর জন্য তারা ইসলামের নবী, পবিত্র কোরআন কিংবা এ রকমই কোনো বিষয় নিয়ে অবমাননাকর কিছু আঁকছে, লিখছে বা ছবি তৈরি করছে, যাতে মুসলমানদের সম্মানবোধে আঘাত লাগে। স্বভাবতই এতে সাধারণ মানুষ তীব্র প্রতিবাদে ফেটে পড়ছে। দেশে দেশে এভাবে অস্থিরতা ও উত্তেজনা সৃষ্টি হচ্ছে।
এসব কাজ কেউ ব্যক্তিগতভাবে করে বলে এর প্রতিক্রিয়া ব্যাপক ও ধ্বংসাত্মক হলেও ঢালাওভাবে বলা যাবে না যে যুক্তরাষ্ট্র ইসলামবিরোধী। দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র নানাভাবে মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে জড়িয়ে আছে—সেটা উন্নয়ন-সহযোগী হিসেবে যেমন, তেমনি দ্বিপক্ষীয় ব্যবসায়িক অংশীদার হিসেবেও। ফলে অত্যন্ত কৌশুলী হয়েই প্রতিক্রিয়া প্রকাশ ও প্রতিকারের উদ্যোগ নেওয়া উচিত।
যুক্তরাষ্ট্র পুঁজিবাদী বিশ্বের মুরব্বি এবং পুঁজিবাদ প্রয়োজনে অত্যন্ত আগ্রাসী, তাই অবশ্যম্ভাবী তার সাম্রাজ্যবাদী রূপ। আমরা যে দ্বৈতনীতির কথা বলেছি, তা পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদী নীতি থেকেই গ্রহণ করে থাকে। ইরাকে গণতন্ত্রের নামে তারা আক্রমণ চালিয়েছে, আর তা করেছে ইরাকেরই প্রতিবেশী মুসলিম দেশ রাজতন্ত্রী কুয়েত ও সৌদি আরবের ওপর নির্ভর করে। সেখানে সেনা রেখেছে, অস্ত্রাগার গড়েছে এবং আক্রমণ পরিচালনার যাবতীয় ব্যবস্থা করেছে। সৌদি আরব ও কুয়েতে রাজতন্ত্র চলছে, জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার সুদূরপরাহত বিষয় আর মানবাধিকার বা আইনের শাসনের পশ্চিমা ধারণা থেকে তারা যোজন যোজন দূরে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এরা মিত্র, কারণ ওদের তেলখনিগুলো মার্কিন ও পাশ্চাত্যের মালিকানাধীন বহুজাতিক কোম্পানির হাতে। কেবল যে তারা কম দামে তেল পায় তা নয়, এসব দেশের তেলের উপার্জন সঞ্চিত থাকে পশ্চিমা ব্যাংকে, বিনিয়োগ হয় তাদের দেশে এবং ভোগবিলাসের ব্যয়টাও তাদের ওখানে হয়।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন বলেছেন, ইসলামের অবমাননাকর চলচ্চিত্রের নির্মাতার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব নয়। কারণ, তাতে যুক্তরাষ্ট্রের আইনে ব্যক্তিগত মত প্রকাশের যে স্বাধীনতা সুরক্ষিত আছে, তা লঙ্ঘিত হবে। কিন্তু আমরা জানি, ট্রুম্যান ডকট্রিনের অজুহাত দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ভিন্নমতের কারণে অন্য দেশের নাগরিককে তুলে নিয়ে শাস্তি দিতে পারে। নাগরিক তো তুচ্ছ ব্যাপার, খোদ পানামার প্রেসিডেন্টকে চোরাচালানের অভিযোগে তুলে নিয়ে শাস্তি দিয়েছে দীর্ঘদিন কারাবন্দী রেখে। তথ্য প্রকাশের জন্য জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে শাস্তি দেওয়ার কৌশল খুঁজছে তারা। নিজের স্বার্থে অন্য দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব তছনছ করতে তারা ভ্রূক্ষেপ করে না।
যুক্তরাষ্ট্র বলবে না ভিন্নমতের জন্য তারা কাউকে শাস্তি দিচ্ছে। অন্যান্য অভিযোগ তুলবে যেমন সাদ্দামের ক্ষেত্রে ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্র মজুদের অভিযোগ তুলেছিল। পরে তা ভুল প্রমাণিত হলেও (যুক্তরাষ্ট্র তা আগে থেকেই জানত এমন ভাবা ভুল হবে না) তারা কি একই রকম কাজ করে চলেছে না?
করবে, এটাই সাম্রাজ্যবাদের নিয়ম। অতীতে এভাবেই চলে এসেছে, আজও চলবে। পলাশীর আমল থেকেই আমরা তাদের ষড়যন্ত্র, মিথ্যা প্রচারণা, দ্বৈতনীতি, চরম নৃশংসতার পরিচয় পেয়ে আসছি।
আজ যখন তারা মুসলিম সমাজকে উত্তেজিত করে রাখার কৌশল নেয়, তখন সেই ফাঁদে পা দিয়ে নিজের দেশে অস্থিরতা সৃষ্টি ও ভাঙচুর চালালে কোনো লাভ হবে না। এটাও মনে রাখতে হবে, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রাম নিছক ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী চেতনা থেকে দীর্ঘ মেয়াদে চালানো সম্ভব নয়। বিভিন্ন সময় মৌলবাদী শক্তিকে সৃষ্টি ও কাজে লাগিয়েছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। আফগানিস্তানে তালেবানের সৃষ্টি, এমনকি বিন লাদেনকে তৈরি করা কিংবা পাকিস্তানে জামায়াতে ইসলামীকে মদদ দেওয়া, একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধে ধর্মান্ধ অপশক্তির পৃষ্ঠপোষকতা—সব ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র সহায়ক ভূমিকা নিয়েছিল।
সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতা একটি রাজনৈতিক সংগ্রাম, জনগণের ক্ষমতা ও অধিকার আদায়ের সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত বিষয়। এই আন্দোলনের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আরবসহ যেসব দেশ সাম্রাজ্যবাদের দোসরের কাজ করছে, সেসব সরকারকে তা থেকে নিবৃত্ত করার জন্য চাপ তৈরি করতে হবে। ওআইসি, ন্যাম ও জাতিসংঘের মতো ফোরাম থেকে দেশে দেশে সাম্রাজ্যবাদী হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধেও আওয়াজ তোলা যায়। দেশে দেশে শান্তির সংগ্রাম, মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের সংগ্রামকে জোরদার করতে হবে—সব ধরনের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্ল্যাটফর্মকে কাজে লাগিয়ে, প্রয়োজনে নতুনভাবে সংগঠিত করে।
বাস্তবতা বারবার প্রমাণ দিচ্ছে যে এসব সংগ্রামকে অবশ্যই যেমন অন্ধবিশ্বাসের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হয়, তেমনি তাকে নিতে হবে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ভূমিকা।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
৯/১১-এর বিমান হামলা নিঃসন্দেহে একটি হঠকারী ঘটনা। এ থেকে শান্তির প্রত্যাশা কেউ করেনি। এ হলো দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা বহুকাল ধরে দ্বৈতনীতি চালিয়ে আসছে। সেটা শুরু হয়েছিল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে। ইসরায়েলের প্রতি তাদের পক্ষপাত ও ফিলিস্তিনের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণে কোনো ঢাকাঢাকি ছিল না, এখনো নেই।
ইসরায়েল ইহুদি রাষ্ট্র আর ফিলিস্তিনসহ প্রতিবেশী আরব দেশগুলোর সিংহভাগ মানুষ মুসলমান। তাতে এই দ্বৈতনীতিজাত পক্ষপাতের একটি সাম্প্রদায়িক পরিচয়ও পাওয়া যায়। ইসরায়েল বিভিন্ন সময় জঙ্গি ইহুদিবাদী নীতির পথ ধরে সম্প্রসারণবাদী আগ্রাসন চালিয়ে আসছে। তাতে প্রতিবেশী আরব রাষ্ট্রের সঙ্গে একাধিক যুদ্ধে তারা লিপ্ত হয়েছে এবং প্রতিটি যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্র দেশগুলো অন্ধ সমর্থন দিয়ে গেছে ইসরায়েলকে। প্রতিবারই যুদ্ধ থেমেছে বিভিন্ন আরব দেশের ভূমি হারানো আর ইসরায়েলের ভূমি লাভের মধ্য দিয়ে। ৬০ বছর পরও ফিলিস্তিন সমস্যার কোনো চূড়ান্ত সমাধান আজ পর্যন্ত হলো না। কিন্তু এটা যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্রদের একটি নৈতিক দায়, যা তারা কোনোভাবেই এড়াতে পারে না।
আমরা লক্ষ করব ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ও তার পরের কয়েক বছরে সমাজতান্ত্রিক দ্বিতীয় বিশ্বের অবসান ঘটার পর থেকে এক মেরু বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা অনেক বেশি আগ্রাসী হয়ে উঠেছে। গত শতাব্দীর ষাট ও সত্তরের দশকেও উন্নয়নশীল দেশগুলোয় সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয় মুক্তির আন্দোলন বেশ জোরদার ছিল। কিন্তু নব্বইয়ের দশকের পরে সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের অনুপস্থিতিতে এই আন্দোলন স্তিমিত হয়ে গেছে। অথচ পুঁজিবাদী অর্থনীতির রথটিকে টেনে নিয়ে যায় সাম্রাজ্যবাদী অশ্বশক্তি। যুক্তরাষ্ট্রে সেই পাঁচের দশক থেকে ম্যাকার্থিবাদের জোয়ারে কমিউনিজমের যে ভূত সৃষ্টি করা হয়েছিল, তার কার্যকারিতা সোভিয়েতের পতন ও সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব ভেঙে পড়ার দুই দশক পর আজও প্রায় একই রকম রয়েছে। এর বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র, মানবাধিকার, উদারতা, আইনের শাসন ইত্যাদি অত্যন্ত আকর্ষণীয় নিশান ঊর্ধ্বে তুলে ধরে পৃথিবীর দেশে দেশে, বিশেষত উন্নয়নশীল বিশ্বে এসব প্রসার-প্রচারে বিস্তর মেহনত করছে। কিন্তু এখানেও যুক্তরাষ্ট্রের দ্বৈতনীতিই বহাল থাকায় সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ সিদ্ধি হলেও সেসব দেশের কোনো উপকার হচ্ছে না।
মধ্যপ্রাচ্যের কোনো মুসলিম দেশে সংগত কারণেই পশ্চিমা মানদণ্ডের গণতন্ত্র নেই, ইরাকেও ছিল না। তবে পশ্চিমের মানদণ্ডে উন্নয়নের যেসব মাপকাঠি আছে, যেমন শিক্ষার হার, নারীমুক্তি, কর্মসংস্থান, জীবনযাপনের মান ইত্যাদি বিচার করলে ইরাক ছিল আরব বিশ্বে সবচেয়ে এগিয়ে। অন্যান্য আরব দেশের মতো বিশেষত যেসব দেশ ছিল যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র—ইরাকের শাসক সাদ্দাম হোসেনও ছিলেন একনায়ক এবং অন্য অনেকের মতো যুক্তরাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় তাঁর উত্থান হলেও তত দিনে সাদ্দাম যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী ও স্বাধীনচেতা শাসক। তাই ইরাকে পরিবর্তন আনা জরুরি হয়ে পড়ল। একদিকে যুক্তরাষ্ট্র অভিযোগ তুলল ইরাকে ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্রের মজুদ আছে আর অন্যদিকে আওয়াজ তুলল একনায়কত্বের অবসান ঘটিয়ে ইরাকে গণতন্ত্র আনতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক ইরাকে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর পর শাসক পরিবর্তন হলো বটে কিন্তু ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্র যেমন পাওয়া গেল না, তেমনি প্রতিষ্ঠিত হলো না গণতন্ত্র কিংবা শান্তি। বরং মার্কিন ধ্বংসযজ্ঞের মাধ্যমে ইরাক ফিরে যাচ্ছে জাতিগত বিভেদ ও হানাহানির বর্বর যুগে।
আফগানিস্তানেও মার্কিন হস্তক্ষেপের পরিণতি একই হয়েছে। হামিদ কারজাইয়ের শিখণ্ডি সরকার বসিয়ে ন্যাটো বাহিনীর বন্দুকের তলায় পদানত থেকে গণতন্ত্রচর্চা যে হয় না, সেটা বুঝতে আর কত বছর লাগবে উন্নত বিশ্বের কে জানে! কিন্তু এতে সন্ত্রাস যে বাড়ে তা ইরাক-আফগানিস্তান ভালোভাবে প্রমাণ দিচ্ছে।
৯/১১-এর আক্রমণটি একটি সন্ত্রাসী হামলাই ছিল। আর সেটিকে অজুহাত হিসেবে ধরে যুক্তরাষ্ট্র যা করছে, তার ফলে সারা বিশ্বে সন্ত্রাসবাদ ছড়িয়ে পড়ছে। যুক্তরাষ্ট্র নিজেও আর নিরাপদ থাকছে না।
আমরা লক্ষ করলে দেখব, সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের পতনের পর থেকে মাঝেমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলোয় এমন কিছু ঘটনা ঘটছে বা ঘটানো হচ্ছে, যাতে মুসলিম সমাজে ও দেশে দেশে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। এর জন্য তারা ইসলামের নবী, পবিত্র কোরআন কিংবা এ রকমই কোনো বিষয় নিয়ে অবমাননাকর কিছু আঁকছে, লিখছে বা ছবি তৈরি করছে, যাতে মুসলমানদের সম্মানবোধে আঘাত লাগে। স্বভাবতই এতে সাধারণ মানুষ তীব্র প্রতিবাদে ফেটে পড়ছে। দেশে দেশে এভাবে অস্থিরতা ও উত্তেজনা সৃষ্টি হচ্ছে।
এসব কাজ কেউ ব্যক্তিগতভাবে করে বলে এর প্রতিক্রিয়া ব্যাপক ও ধ্বংসাত্মক হলেও ঢালাওভাবে বলা যাবে না যে যুক্তরাষ্ট্র ইসলামবিরোধী। দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র নানাভাবে মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে জড়িয়ে আছে—সেটা উন্নয়ন-সহযোগী হিসেবে যেমন, তেমনি দ্বিপক্ষীয় ব্যবসায়িক অংশীদার হিসেবেও। ফলে অত্যন্ত কৌশুলী হয়েই প্রতিক্রিয়া প্রকাশ ও প্রতিকারের উদ্যোগ নেওয়া উচিত।
যুক্তরাষ্ট্র পুঁজিবাদী বিশ্বের মুরব্বি এবং পুঁজিবাদ প্রয়োজনে অত্যন্ত আগ্রাসী, তাই অবশ্যম্ভাবী তার সাম্রাজ্যবাদী রূপ। আমরা যে দ্বৈতনীতির কথা বলেছি, তা পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদী নীতি থেকেই গ্রহণ করে থাকে। ইরাকে গণতন্ত্রের নামে তারা আক্রমণ চালিয়েছে, আর তা করেছে ইরাকেরই প্রতিবেশী মুসলিম দেশ রাজতন্ত্রী কুয়েত ও সৌদি আরবের ওপর নির্ভর করে। সেখানে সেনা রেখেছে, অস্ত্রাগার গড়েছে এবং আক্রমণ পরিচালনার যাবতীয় ব্যবস্থা করেছে। সৌদি আরব ও কুয়েতে রাজতন্ত্র চলছে, জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার সুদূরপরাহত বিষয় আর মানবাধিকার বা আইনের শাসনের পশ্চিমা ধারণা থেকে তারা যোজন যোজন দূরে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এরা মিত্র, কারণ ওদের তেলখনিগুলো মার্কিন ও পাশ্চাত্যের মালিকানাধীন বহুজাতিক কোম্পানির হাতে। কেবল যে তারা কম দামে তেল পায় তা নয়, এসব দেশের তেলের উপার্জন সঞ্চিত থাকে পশ্চিমা ব্যাংকে, বিনিয়োগ হয় তাদের দেশে এবং ভোগবিলাসের ব্যয়টাও তাদের ওখানে হয়।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন বলেছেন, ইসলামের অবমাননাকর চলচ্চিত্রের নির্মাতার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব নয়। কারণ, তাতে যুক্তরাষ্ট্রের আইনে ব্যক্তিগত মত প্রকাশের যে স্বাধীনতা সুরক্ষিত আছে, তা লঙ্ঘিত হবে। কিন্তু আমরা জানি, ট্রুম্যান ডকট্রিনের অজুহাত দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ভিন্নমতের কারণে অন্য দেশের নাগরিককে তুলে নিয়ে শাস্তি দিতে পারে। নাগরিক তো তুচ্ছ ব্যাপার, খোদ পানামার প্রেসিডেন্টকে চোরাচালানের অভিযোগে তুলে নিয়ে শাস্তি দিয়েছে দীর্ঘদিন কারাবন্দী রেখে। তথ্য প্রকাশের জন্য জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে শাস্তি দেওয়ার কৌশল খুঁজছে তারা। নিজের স্বার্থে অন্য দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব তছনছ করতে তারা ভ্রূক্ষেপ করে না।
যুক্তরাষ্ট্র বলবে না ভিন্নমতের জন্য তারা কাউকে শাস্তি দিচ্ছে। অন্যান্য অভিযোগ তুলবে যেমন সাদ্দামের ক্ষেত্রে ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্র মজুদের অভিযোগ তুলেছিল। পরে তা ভুল প্রমাণিত হলেও (যুক্তরাষ্ট্র তা আগে থেকেই জানত এমন ভাবা ভুল হবে না) তারা কি একই রকম কাজ করে চলেছে না?
করবে, এটাই সাম্রাজ্যবাদের নিয়ম। অতীতে এভাবেই চলে এসেছে, আজও চলবে। পলাশীর আমল থেকেই আমরা তাদের ষড়যন্ত্র, মিথ্যা প্রচারণা, দ্বৈতনীতি, চরম নৃশংসতার পরিচয় পেয়ে আসছি।
আজ যখন তারা মুসলিম সমাজকে উত্তেজিত করে রাখার কৌশল নেয়, তখন সেই ফাঁদে পা দিয়ে নিজের দেশে অস্থিরতা সৃষ্টি ও ভাঙচুর চালালে কোনো লাভ হবে না। এটাও মনে রাখতে হবে, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রাম নিছক ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী চেতনা থেকে দীর্ঘ মেয়াদে চালানো সম্ভব নয়। বিভিন্ন সময় মৌলবাদী শক্তিকে সৃষ্টি ও কাজে লাগিয়েছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। আফগানিস্তানে তালেবানের সৃষ্টি, এমনকি বিন লাদেনকে তৈরি করা কিংবা পাকিস্তানে জামায়াতে ইসলামীকে মদদ দেওয়া, একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধে ধর্মান্ধ অপশক্তির পৃষ্ঠপোষকতা—সব ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র সহায়ক ভূমিকা নিয়েছিল।
সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতা একটি রাজনৈতিক সংগ্রাম, জনগণের ক্ষমতা ও অধিকার আদায়ের সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত বিষয়। এই আন্দোলনের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আরবসহ যেসব দেশ সাম্রাজ্যবাদের দোসরের কাজ করছে, সেসব সরকারকে তা থেকে নিবৃত্ত করার জন্য চাপ তৈরি করতে হবে। ওআইসি, ন্যাম ও জাতিসংঘের মতো ফোরাম থেকে দেশে দেশে সাম্রাজ্যবাদী হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধেও আওয়াজ তোলা যায়। দেশে দেশে শান্তির সংগ্রাম, মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের সংগ্রামকে জোরদার করতে হবে—সব ধরনের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্ল্যাটফর্মকে কাজে লাগিয়ে, প্রয়োজনে নতুনভাবে সংগঠিত করে।
বাস্তবতা বারবার প্রমাণ দিচ্ছে যে এসব সংগ্রামকে অবশ্যই যেমন অন্ধবিশ্বাসের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হয়, তেমনি তাকে নিতে হবে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ভূমিকা।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
No comments