প্রাতঃভ্রমণ আর সকালের বাজার by এমএম ইসলাম

১৯৯৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর সাফ গেমসের জন্য উদ্বোধন করার পর থেকে মাঝে মধ্যে কিছু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অনুষ্ঠানের কাজে ব্যবহার হলেও বছরের বেশির ভাগ সময় ইনডোর স্টেডিয়ামটি অলসভাবে পড়ে থাকলেও মিরপুরবাসী কিন্তু এর সদ্ব্যবহার করছে প্রতিদিনই! কীভাবে? আসুন, সেটাই জানা যাক_
ভোরে ইনডোর স্টেডিয়ামে গেলে দেখা যাবে অভূতপূর্ব এক দৃশ্য।


নানা বয়সী শত শত নারী ও পুরুষ সেখানে প্রাতঃভ্রমণে নিয়োজিত রয়েছেন। কেউ হাঁটছেন আবার অন্যদিকে একেক জন একেক ভঙ্গিতে শরীর চর্চায় নিয়োজিত রয়েছেন। কেউ বিশ্রাম নিচ্ছেন, পরিচিতদের মধ্যে চলছে আড্ডা আবার কেউবা পড়ছেন পত্রিকা। ফজরের নামাজের পর থেকেই নিকটবর্তী এলাকা থেকে সপরিবারে নারী ও পুরুষরা এখানে সমবেত হওয়া শুরু করেন এবং বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে আগতদের সংখ্যাও বাড়তে থাকে উল্লেখযোগ্য হারে এবং তা চলে সকাল ৯টা পর্যন্ত। মিরপুর এলাকায় কোনো পার্ক নেই। এক বোটানিক্যাল গার্ডেন; কিন্তু সেখানকার পরিবেশ সপরিবারে প্রাতঃভ্রমণ বা ব্যায়ামের জন্য অনুকূল নয়। ইনডোর স্টেডিয়ামের পরিসর ততটা বড় না হলেও প্রাতঃভ্রমণকারীরা এটিকে ঘিরে চক্কর দিতে থাকেন। মোট আট চক্কর দিলে প্রায় ৩০ মিনিট হাঁটা হয়ে যায়। কথা হলো নিয়মিত প্রাতঃভ্রমণকারী কানিজ ফেরদৌসীর সঙ্গে। তিনি তার স্বামী অথবা ছেলেকে নিয়ে আসেন হাঁটতে। তিনি বললেন, নানা কারণে রাস্তায় হাঁটা যায় না। খোলা ড্রেন, রাস্তার ওপর ডাস্টবিনের কারণে পূতিগন্ধময় পরিবেশ, রাস্তার পাশে নির্মাণসামগ্রী স্তূপ করে রাখা, বেওয়ারিশ কুকুরের উপদ্রব, দ্রুতগামী যানবাহনের আধিক্য, ধুলাবালি, ছিনতাইকারী দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার ভয় ইত্যাদি কারণে সড়কের পরিবর্তে তিনি ইনডোর স্টেডিয়ামকে বেছে নিয়েছেন। প্রাতঃভ্রমণকারীদের অনেকেই এখানকার টয়লেট সুবিধা উন্মুক্ত করার প্রয়োজনীয়তার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করলেন। প্রয়োজনে টিকিট বা ফির বিনিময়ে টয়লেট ব্যবহারে কোনো আপত্তি নেই। এ ছাড়াও এখানে স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও পুষ্টি বিশারদের পরামর্শসহ জিম সুবিধা স্থাপন করে হেলথ ক্লাব গঠন ও মেম্বারশিপ ফি পরিশোধ সাপেক্ষে তা প্রাতঃভ্রমণকারীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হলে স্টেডিয়াম কর্তৃপক্ষের আয়ের ব্যবস্থার পাশাপাশি এলাকাবাসীও দারুণভাবে উপকৃত হবে।
মাত্র কয়েক বছর আগের কথা। যখন দু'একজন বিক্রেতা সকালে ইনডোর স্টেডিয়ামের গেটে শরবতসহ হাতে করে কিছু আইটেম বিক্রয় করত। সময়ের পরিক্রমায় ধীরে ধীরে এ স্টেডিয়ামের গেট সংলগ্ন এলাকা হয়ে পড়েছে একটি সুসংগঠিত, ক্ষণস্থায়ী এক সকালের বাজার। কোনো প্রকার ঘোষণা, ইজারা ও পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া কীভাবে যে এত চমৎকার একটি বাজার গড়ে উঠতে পারে তা এখানে না এলে বোঝা সম্ভব নয়! কী নেই এ বাজারে? ভ্যানের ওপর বিক্রি হচ্ছে নানা ধরনের আইটেম। ফজরের নামাজের পর থেকে ভ্যানগুলো আসা শুরু হয়। বাজার চলে সকাল ৯টা পর্যন্ত। ৯টার পর সেখানে গেলে বাজারের কোনো চিহ্নও পাওয়া যাবে না। কেউ বিক্রি করছে নানা সবজি, কেউ বিক্রি করছে শুধু বিভিন্ন ধরনের শাক। রয়েছে সব ধরনের মৌসুমি ফল। আরও আছে পোলাওর চাল থেকে শুরু করে বিভিন্ন জাতের চাল। একটি ভ্যানের ওপর শুধু বিভিন্ন পদের ডাল, আবার অন্য একটি ভ্যানে শুধু বিভিন্ন ধরনের মসলা। রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ছোট-বড় মাছ, সঙ্গে কাটার ব্যবস্থা। আছে দেশি মুরগি আর ভ্যানের ওপর ব্রয়লার মুরগি। মুরগি জবাই করে চামড়া ছাড়ানোর ব্যবস্থাও একই সঙ্গে পাবেন। সম্প্রতি এ বাজারে সংযোজিত হয়েছে দেশি গরুর মাংস। শাকসবজি ও নিত্যপ্রয়োজনীয় বাজার সামগ্রীর মধ্যে এমন কোনো আইটেম নেই, যা এ বাজারে পাওয়া যাবে না। শুধু তাই নয়, এখানে আরও আছে ওজন ও ডায়াবেটিস মাপা এবং রক্তের কোলেস্টেরল পরীক্ষার ব্যবস্থা। বিক্রি হচ্ছে মাশরুমসহ বিভিন্ন আইটেম। রয়েছে পত্রিকার ভ্রাম্যমাণ স্টল আর চা-পানি পানের ব্যবস্থা। প্রাতঃভ্রমণ শেষে দম্পতিদের একত্রে নিজেদের প্রয়োজনীয় বাজার করতে দেখা যায়। সম্ভবত এটাই ঢাকার একমাত্র কাঁচাবাজার, যেখানে নারীদের সমাগম বেশি। কথা হলো ওয়ালিউর রহমান রানার সঙ্গে। যিনি আশুলিয়া এলাকায় এক গার্মেন্টে জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত। তিনি বলেন, 'ভাই, সকাল ৭টায় ফ্যাক্টরির উদ্দেশে বের হই। তখন কোনো বাজার খোলে না। রাতে যখন ফিরি তখন সব বাজার বন্ধ হয়ে যায়। শাকসবজি একদিনে কিনে তো আর সপ্তাহ পার করা যায় না। এ সমস্যার চমৎকার সমাধান দিয়েছে ইনডোর স্টেডিয়ামের সামনের এ বাজার। ফজরের নামাজ পড়ে এখানে আসি স্ত্রীকে নিয়ে হাঁটতে। ফেরার পথে দু'জন মিলে দরকারি সবজি ও অন্যান্য আইটেম নিয়ে নিই। সব কিছু তাজা। ফ্রিজে রাখার দরকার হয় না। কেননা প্রতিদিনই বাজার করতে আসি। তার কথার প্রমাণ পেতে স্টেডিয়ামের গেটে কিছুক্ষণ দাঁড়ালে দেখা যায় অনেক দম্পতি প্রাতঃভ্রমণ সেরে দু'হাতে করে বাজার নিয়ে বাসায় ফিরছেন। কারও হাতে শাকের আঁটি অথবা লাউ, তো আবার কারও হাতে পটোল, বেগুন, আলুসহ অন্যান্য আইটেম।
এক সবজি বিক্রেতা জানান, প্রতিদিনই তিনি এখানে সবজি নিয়ে আসেন। সব বিক্রি হয়ে যায়। এখানে কোনো ঝুট-ঝামেলা নেই। সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের তারা প্রতিদিন দোকানপ্রতি ৫ টাকা করে দেন। বিনিময়ে বাজার শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিষ্কার হয়ে যায় এলাকা। আছে র‌্যাব, পুলিশের টহল ভ্যান। তাই অত্যন্ত নির্বিঘ্ন পরিবেশে প্রাতঃভ্রমণ আর সকালের বাজার করার জন্য ভেন্যু হিসেবে জাতীয় ইনডোর স্টেডিয়াম, মিরপুর সত্যিই তুলনাহীন।
islam3150@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.