মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য-কৃষক ও ভোক্তার স্বার্থ নিশ্চিত করা হোক

রাজধানী শহর ঢাকায়ই শুধু নয়, অন্যান্য নগর-মহানগরে এখন সবজির দাম রীতিমতো আকাশছোঁয়া। ৪০ টাকার নিচে কোনো সবজিই পাওয়া যায় না। আগাম মৌসুমের সবজি উচ্চমূল্যের কারণে সাধারণ মানুষের পক্ষে কেনা সম্ভব নয়।


তার পরও কোনো কোনো ক্রেতা হয়তো মনে মনে এই ভেবে সান্ত্বনা খোঁজেন যে দুটো পয়সা বাড়তি গেলেও তা যাচ্ছে গরিব কৃষকের হাতে, যাঁরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে এই সবজি ফলান। যে কৃষক সবজি লাগিয়ে দুরু দুরু বুকে অপেক্ষা করেন বন্যা, খরা, পোকার আক্রমণ বাঁচিয়ে বাজারে নেওয়া পর্যন্ত, তাঁর হাতে দুটো পয়সা না হয় গেলই বা। কিন্তু না, সে পয়সা কৃষকের হাতে যায় না। কৃষক তাঁর মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ফলানো সবজি বা ফসলের উপযুক্ত মূল্য পান না। ঝিনাইদহ জেলার নগরবাথান বাজারে কৃষক যে লাউ বিক্রি করেন ৮ থেকে ১০ টাকায়, ঢাকার কাঁচাবাজারে সে লাউই বিক্রি হয় ৪০ থেকে ৫০ টাকায়। মাত্র ৩০ মাইল দূরে নরসিংদীর বাজারে কৃষক ২০ টাকা কেজি দরে যে শসা বিক্রি করেন, ঢাকার বাজারে তারই দাম কেজিপ্রতি ৬০ টাকা কিংবা তারও বেশি। তাহলে এ বাড়তি পয়সা যায় কোথায়? যায় অতিমুনাফালোভী কিছু ব্যবসায়ী ও উটকো লোকের হাতে, যারা মধ্যস্বত্বভোগী বা ফড়িয়া নামে পরিচিত। পুলিশ কিংবা স্থানীয় মাস্তানরাও এই মধ্যস্বত্বের অংশীদার হয় বলে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। কেন এমনটি হচ্ছে? কারণ কৃষকের স্বার্থ রক্ষা করা কিংবা ভোক্তার অধিকার বা স্বার্থ দেখার মতো কার্যকর কোনো ব্যবস্থা আমাদের দেশে নেই। তাই যে যার মতো সুযোগ পেলেই লুটেপুটে খাচ্ছে।
কৃষকরা প্রাথমিক পণ্য উৎপাদন করেন। আমাদের দেশে অতীতে 'গ্রোয়ার্স লেভেলে'র এই কৃষকরা সংঘবদ্ধ থাকলেও এখন প্রাথমিক পণ্যের এই উৎপাদকরা খুব একটা সংঘবদ্ধ নন। ফলে তাঁরা উৎপাদিত পণ্যের মূল্য আদায়ে দরকষাকষি করার মতো যথেষ্ট শক্তি বা কৌশল প্রয়োগ করতে পারেন না। পৃথিবীর অনেক দেশেই কৃষকের স্বার্থ দেখার জন্য নানা রকম ব্যবস্থা থাকলেও এখানে তাঁদের স্বার্থ দেখার কেউ নেই। অন্যান্য দেশে যেসব ব্যবস্থা আছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সমবায়ভিত্তিক বিপণন ব্যবস্থা। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশে সমবায় ব্যবস্থার স্বাভাবিক বিকাশের পরিবর্তে অসুস্থ বিকাশ ঘটেছে। রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে কোটি কোটি টাকা খরচ করে সমবায় বিভাগ পরিচালিত হলেও আর দশটা সরকারি অফিসের মতোই এখানেও এক শ্রেণীর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারী সমবায় ব্যবস্থার আসল উদ্দেশ্যকে বিপথগামী করছেন। এ কারণে ব্রিটিশ আমলে সূচিত সমবায় আন্দোলন বাংলাদেশ আমলে এসে মূল উদ্দেশ্যই হারিয়ে ফেলেছে। কৃষক, জেলে, কামার, কুমারের মতো প্রাথমিক উৎপাদকরা এখন সমবায় ব্যবস্থার বাইরে রয়ে গেছেন। অন্যদিকে ভোক্তার অধিকার সংরক্ষণ ও ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করার কার্যকর কোনো উদ্যোগও নেই। এখানে বিক্রেতা ইচ্ছা করলেই যেকোনো পণ্যের যেকোনো মূল্য হাঁকতে পারেন। ক্রেতার 'পকেট কাটা' কিংবা 'গলা কাটা' তাঁর নৈতিকতায় বাধে না। কিন্তু কোনো সভ্য দেশে এ রকমটি হওয়া উচিত নয়। আইনের শাসন রয়েছে- এমন যেকোনো দেশে এ রকমটি হলে সঙ্গে সঙ্গে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক যে আমাদের দেশের গণতান্ত্রিক সরকারের শীর্ষ নেতারাও কখনো বিষয়গুলো ভেবে দেখেছেন কি না সন্দেহ। আর সে কারণেই মধ্যস্বত্বভোগীদের দাপট এখানে বরাবরই বেশি। আমরা চাই, প্রাণান্ত পরিশ্রম করে কৃষক যে পণ্য উৎপাদন করেন, তার উপযুক্ত মূল্যপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা হোক, মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য বন্ধ হোক এবং যৌক্তিক মূল্যে ভোক্তারা যাতে সেসব পণ্য কিনতে পারেন, তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হোক।

No comments

Powered by Blogger.