‘নখদন্তহীন’ প্রতিষ্ঠান দুর্নীতি দমনে কী ভূমিকা রাখবে ভারাক্রান্ত দুদক

রোগ মহামারি হতে থাকলে প্রতিকারের ব্যবস্থাও জুতসই হওয়া প্রয়োজন। অথচ বড় বড় রুই-কাতলার দুর্নীতির ভয়াবহতার তুলনায় দুদককে চুনোপুঁটিই বলা যায়। সংস্থাটির চেয়ারম্যান একসময় আক্ষেপ করে বলেছিলেন


‘নখদন্তহীন’। দুর্নীতি ঠেকানো কিংবা শাস্তি দেওয়ার বদলে দুদক মামলা দায়ের ও তদন্তেই সময় পার করে দিচ্ছে। এই অবস্থায় প্রশ্ন জাগে, দুদক কি তার নামের সার্থকতা দেখাতে পারছে, নাকি ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দার হয়ে বসে আছে? দুর্নীতির মাত্রার সঙ্গে সমান তালে দুদকের দক্ষতা ও দৃঢ়তা বাড়ানোয় সরকারের গড়িমসিকে তাই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত না বলে উপায় নেই।
সাম্প্রতিক কালে আলোচিত বড় বড় দুর্নীতির তদন্তের ভার দুদকের ওপর অর্পিত হয়েছে। দুর্নীতিগুলো ব্যক্তিবিশেষের ব্যাপার নয়। শেয়ারবাজার ও হলমার্কের মতো বড় দুর্নীতির ঘটনাগুলোয় সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে ব্যাংক ও ব্যবসায়ী মহল জড়িত। আবার পদ্মা সেতুর দুর্নীতির বিষয়টি রাষ্ট্রীয়ভাবে স্পর্শকাতর। কোনো কোনো দুর্নীতির মাত্রা আবার আন্তর্জাতিক। এর বাইরে দুদকের ওপর অর্পিত রয়েছে সরকারি কর্মকর্তা, বিচার বিভাগ, পুলিশ বাহিনী, সাংসদ ও রাজনীতিবিদদের মাধ্যমে করা অনেক দুর্নীতির তদন্তের ভার। সুষ্ঠুভাবে এসব ঘটনার তদন্ত করায় যে লোকবল, তহবিল, আইনি শক্তি এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন ছিল, তার কোনোটিই দুদক পায়নি।
সারা দেশে দুদকের তদন্তকারী কর্মকর্তা মাত্র ৩৫০ জন। দুর্নীতির সমুদ্রে এই লোকবল হাবুডুবু খেতে বাধ্য। কথা ছিল, সম্পূর্ণ নতুন ও দক্ষ লোকবল নিয়ে দুদক গঠিত হবে। কিন্তু কার্যত আগের দুর্নীতি দমন ব্যুরোকেই নাম বদলে কমিশন করা হয়েছে। অন্যদিকে বর্তমান সরকারের সাড়ে তিন বছরেও চূড়ান্ত হয়নি দুদক আইন। বর্তমান আইনে অনুসন্ধানকালে দুদক কর্মকর্তারা আলামত জব্দ, ব্যাংক হিসাব তলব বা প্রয়োজনে কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেন না। ব্যাংক, এনবিআর বা সরকারি সংস্থা থেকে তথ্য চেয়েও পাওয়া যায় না। অন্যদিকে সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুদক কোনো মামলা করতে গেলে সরকারের পূর্বানুমতি নেওয়ার কথা বলা আছে আইনে। কোনো সংশোধনী ব্যতিরেকে আইনের খসড়াটি পাস হলে দুদক আক্ষরিক অর্থেই নখদন্তহীন প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে।
সবচেয়ে বড় বাধা রাজনৈতিক চাপ। এ ব্যাপারে টিআইবির চেয়ারম্যানের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, ‘সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের সঙ্গে দুদকের অনুসন্ধানের সিদ্ধান্তের মিলটা কাকতালীয়, নাকি বুঝেশুনে, সে প্রশ্ন আমাদেরও।’ পৃথিবীর অনেক দেশেই গুরুতর আর্থিক দুর্নীতি তদন্তে ‘অ্যান্টি-ফাইন্যান্সিয়াল ফ্রড’ নামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিশেষ বিভাগ থাকে। তা না থাকায়, অনেক ক্ষেত্রে দুদক হয়ে পড়ছে দুর্নীতির অভিযোগ থেকে দুর্নীতিবাজদের সাফাই যন্ত্র।
সরকারকে বুঝতে হবে, দুর্নীতি ও অপরাজনীতির তল্পি বহনের দায় থেকে দুদককে মুক্ত করাই এখন জাতীয় দাবি।

No comments

Powered by Blogger.