চারদিক- আবার দেখা হবে তো? by আলতাফ শাহনেওয়াজ
সাধারণত শুক্রবারের ছুটির দিনে যানজটের হাত থেকে খানিকটা নিস্তার পায় ব্যস্ত নগর ঢাকা, চলাফেরায় একধরনের স্বাচ্ছন্দ্য মেলে। কিন্তু গত শুক্রবার বিকেলে ভয়াবহ যানজট ফেঁড়েফুঁড়ে যখন নীলক্ষেতে বৃহত্তর যশোর সমিতির আহাদ মিলনায়তনে পৌঁছানো গেল,
তখন দেখি যানজটের কারণে গুণীজন সম্মাননা অনুষ্ঠানেও জট লেগেছে! অভ্যাগতদের অনেকেই তখনো পৌঁছাতে পারেননি। তাই বিকেল পাঁচটার অনুষ্ঠান খানিকটা দেরিতেই শুরু হলো।
যশোর সরকারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রী সংঘের আয়োজনে যশোরের মানুষ, পরবর্তীকালে বিভিন্ন ক্ষেত্রে যাঁরা কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন, তাঁদের মধ্য থেকে পাঁচজনকে প্রথমবারের মতো সম্মাননা দেওয়া হয় ১২ অক্টোবর শুক্রবার। আগেই জানা ছিল, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব কোহিনূর আক্তার সুচন্দা পাচ্ছেন এই সম্মাননা। সেই অছিলায় অনুষ্ঠানে এসে খোঁজ মিলল আরও গুণীজনের—সুচন্দা ছাড়াও চিকিৎসায় সম্মাননা পেলেন ডা. চৌধুরী হাবিবুর রহমান, সমাজকল্যাণে সালমা শহীদ চৌধুরী, সাহিত্যে রহমান মোহাম্মদ লুৎফর এবং শিক্ষাক্ষেত্রে মরণোত্তর সম্মাননা পেয়েছেন মাহমুদা রহমান।
অনুষ্ঠানের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হতে দেরি হচ্ছে। তবে পুরো মিলনায়তন ততক্ষণে যশোরের হইচইয়ে ভরপুর, নানা রকম কথামালায় স্থানে স্থানে চলছে তুমুল আড্ডা। এ রকম এক আড্ডায় সুচন্দাকে ঘিরে গল্পে মেতেছেন কয়েকজন। নীল শাড়ি পরা সুচন্দা যেন নিজের স্কুলের মানুষজনকে পেয়ে এর মধ্যেই হয়ে উঠেছেন কিশোরী, একসময় যে নীল-সাদা পোশাকে মাথার দুই বেণি দোলাতে দোলাতে যশোরের রাস্তা দিয়ে স্কুলে যেত প্রতিদিন।
আড্ডায় হঠাৎ একজন সুচন্দাকে বললেন, ‘চাটনি, তোর মনে আছে, প্রায় দিনই তোকে দেখার জন্য স্কুলের গেটে দাঁড়িয়ে থাকত ছেলেরা। কিন্তু কাউকে পাত্তা দিতি না তুই?’
এবার ইতিউতি তাকাই আমরা—চাটনি কে? গুমর ফাঁস করলেন সুচন্দার স্কুল-বান্ধবী রেহানা ইমাম, ‘আরে চাটনি তো সুচন্দার ডাকনাম। আমরা তো ওকে এই নামেই চিনি। একসঙ্গে সিভিল ডিফেন্সের প্রশিক্ষণ, গার্লস গাইড, কত কিছু করেছি। অনেক স্মৃতি আমাদের!’
বান্ধবীর কথায় সায় দিলেন সুচন্দা। বললেন, ‘হ্যাঁ, আজকের আমি, সেই চাটনি নামের মেয়েটির স্মৃতির শেষ নেই। আমার দাদা রেখেছিলেন এই নামটি। আমার চাচাতো ভাইবোনের নামও মজার—ফিরনি, জর্দা, লুচি।’
এতক্ষণে আরেক প্রাক্তন শিক্ষার্থী সৈয়দা মাহমুদা রহমান এসে যোগ দিয়েছেন আড্ডায়। তিনি বললেন, ‘স্কুলে আমি ছিলাম চাটনি আপার জুনিয়র। তখন থেকে দেখতাম, তিনি খুব ধীরস্থির স্বভাবের, আস্তে আস্তে কথা বলেন। আমাদের স্কুলের পাশে ফুল বাগানের ধারে বান্ধবীদের নিয়ে আড্ডা দিচ্ছেন তিনি—এই স্মৃতি এখনো চোখে ভাসে। নাচ-গান-কবিতা আবৃত্তি-অভিনয় সবকিছুতেই আপা ছিলেন দুর্দান্ত।’
‘আর শকুন্তলা নৃত্যনাট্যে অভিনয়ের পর যশোর শহরে অনেকেই যে ওকে “শকুন্তলা” নামে ডাকতে শুরু করেছিল, সে কথাটাও বল।’ মাহমুদা রহমানকে উদ্দেশ করে সুচন্দার আরেক বান্ধবী আসিয়া বললেন কথাটি।
এত কথার মাঝে সুচন্দা তবে চুপ থাকবেন কেন? তিনিও বললেন, ‘স্কুলে আমি, লাইলী ও মঞ্জু—এই তিনজন ছিলাম হরিহর আত্মা। লাইলীর এল, সুচন্দার এস ও মঞ্জুর এম—তিনে মিলে আমাদের তখন ডাকা হতো “এলসিএম” নামে। তবে লাইলী ও মঞ্জু দুজনই মারা গেছে। আজ খুব মনে পড়ছে ওদের। এ ছাড়া লুটু, কুমু, পরী, তাহেরা, অর্চনা, বেবী—আমার এই বান্ধবীদেরও ভীষণ মিস করছি।’ এরপর আড্ডার অন্যদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘মোমিন গার্লস স্কুলের দিনগুলো আসলেই ভোলা যাবে না, তাই না রে?’
১৯৩৮ সালে প্রতিষ্ঠিত মোমিন গার্লস স্কুল যশোর সরকারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের আগের নাম। ১৯৬১ সালে এটি সরকারি হয়। এটি যশোরের প্রাচীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যতম।
আড্ডার শোরগোল কাটিয়ে ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে সালমা শহীদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি পরমাণু বিজ্ঞানী এম শমসের আলী। বিশেষ অতিথি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ আকরম হোসেন, বিচারপতি আবদুল আজিজ, নূর মোহাম্মদ ও ডা. এম এ রশিদ।
অনুষ্ঠানে গুণীজনদের একে একে সম্মাননা ক্রেস্টের পাশাপাশি উত্তরীয় পরিয়ে দেওয়া হয়। সম্মাননা পাওয়ার পর নিজের অনুভূতি প্রকাশ করে সালমা শহীদ চৌধুরী বলেন, ‘জন্মস্থানের মানুষের দেওয়া এই সম্মান পেয়ে খুব ভালো লাগছে।’
রহমান মোহাম্মদ লুৎফরের কথায় ভেসে উঠল জন্মশহরের মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা। অন্যদিকে সম্মাননা গ্রহণ করে সুচন্দার চোখেমুখে সেই সময় বর্ণিল উচ্ছ্বাস। অনুভব প্রকাশ করতে গিয়ে বললেন, ‘জীবনে অনেক পুরস্কার পেয়েছি। তবে আমার স্কুল থেকে আজ যে সম্মাননা দেওয়া হলো, তা আমার কাছে যেকোনো পুরস্কারের চেয়েই বড়। আসলেই খুব আনন্দ লাগছে। মনে হচ্ছে, আমি যেন আবার যশোরের সেই চাটনি হয়ে গেছি।’
কথায় কথায় এর মধ্যে শেষ হয়েছে অনুষ্ঠানের কারবার। কিন্তু আহাদ মিলনায়তনে সুপরিসর ঘরটি ছেড়ে কারোরই যেন উঠতে ইচ্ছে করছে না। সবার চোখেমুখেই তখন ফিরে ফিরে আসছে মোমিন গার্লস স্কুল, আজকের যশোর সরকারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের সোনাঝরা দিনগুলো।
‘আবার কবে দেখা হবে, দেখা হবে তো?’—সব মুখেই এই অভিব্যক্তি।
আর সবার প্রিয় চাটনি আপার চোখ ছলছল। অন্যদের মতো মোমিন গার্লস স্কুলের সবুজ মাঠ যেন সে মুহূর্তে ডাকছে তাঁকে।
আলতাফ শাহনেওয়াজ
যশোর সরকারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রী সংঘের আয়োজনে যশোরের মানুষ, পরবর্তীকালে বিভিন্ন ক্ষেত্রে যাঁরা কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন, তাঁদের মধ্য থেকে পাঁচজনকে প্রথমবারের মতো সম্মাননা দেওয়া হয় ১২ অক্টোবর শুক্রবার। আগেই জানা ছিল, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব কোহিনূর আক্তার সুচন্দা পাচ্ছেন এই সম্মাননা। সেই অছিলায় অনুষ্ঠানে এসে খোঁজ মিলল আরও গুণীজনের—সুচন্দা ছাড়াও চিকিৎসায় সম্মাননা পেলেন ডা. চৌধুরী হাবিবুর রহমান, সমাজকল্যাণে সালমা শহীদ চৌধুরী, সাহিত্যে রহমান মোহাম্মদ লুৎফর এবং শিক্ষাক্ষেত্রে মরণোত্তর সম্মাননা পেয়েছেন মাহমুদা রহমান।
অনুষ্ঠানের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হতে দেরি হচ্ছে। তবে পুরো মিলনায়তন ততক্ষণে যশোরের হইচইয়ে ভরপুর, নানা রকম কথামালায় স্থানে স্থানে চলছে তুমুল আড্ডা। এ রকম এক আড্ডায় সুচন্দাকে ঘিরে গল্পে মেতেছেন কয়েকজন। নীল শাড়ি পরা সুচন্দা যেন নিজের স্কুলের মানুষজনকে পেয়ে এর মধ্যেই হয়ে উঠেছেন কিশোরী, একসময় যে নীল-সাদা পোশাকে মাথার দুই বেণি দোলাতে দোলাতে যশোরের রাস্তা দিয়ে স্কুলে যেত প্রতিদিন।
আড্ডায় হঠাৎ একজন সুচন্দাকে বললেন, ‘চাটনি, তোর মনে আছে, প্রায় দিনই তোকে দেখার জন্য স্কুলের গেটে দাঁড়িয়ে থাকত ছেলেরা। কিন্তু কাউকে পাত্তা দিতি না তুই?’
এবার ইতিউতি তাকাই আমরা—চাটনি কে? গুমর ফাঁস করলেন সুচন্দার স্কুল-বান্ধবী রেহানা ইমাম, ‘আরে চাটনি তো সুচন্দার ডাকনাম। আমরা তো ওকে এই নামেই চিনি। একসঙ্গে সিভিল ডিফেন্সের প্রশিক্ষণ, গার্লস গাইড, কত কিছু করেছি। অনেক স্মৃতি আমাদের!’
বান্ধবীর কথায় সায় দিলেন সুচন্দা। বললেন, ‘হ্যাঁ, আজকের আমি, সেই চাটনি নামের মেয়েটির স্মৃতির শেষ নেই। আমার দাদা রেখেছিলেন এই নামটি। আমার চাচাতো ভাইবোনের নামও মজার—ফিরনি, জর্দা, লুচি।’
এতক্ষণে আরেক প্রাক্তন শিক্ষার্থী সৈয়দা মাহমুদা রহমান এসে যোগ দিয়েছেন আড্ডায়। তিনি বললেন, ‘স্কুলে আমি ছিলাম চাটনি আপার জুনিয়র। তখন থেকে দেখতাম, তিনি খুব ধীরস্থির স্বভাবের, আস্তে আস্তে কথা বলেন। আমাদের স্কুলের পাশে ফুল বাগানের ধারে বান্ধবীদের নিয়ে আড্ডা দিচ্ছেন তিনি—এই স্মৃতি এখনো চোখে ভাসে। নাচ-গান-কবিতা আবৃত্তি-অভিনয় সবকিছুতেই আপা ছিলেন দুর্দান্ত।’
‘আর শকুন্তলা নৃত্যনাট্যে অভিনয়ের পর যশোর শহরে অনেকেই যে ওকে “শকুন্তলা” নামে ডাকতে শুরু করেছিল, সে কথাটাও বল।’ মাহমুদা রহমানকে উদ্দেশ করে সুচন্দার আরেক বান্ধবী আসিয়া বললেন কথাটি।
এত কথার মাঝে সুচন্দা তবে চুপ থাকবেন কেন? তিনিও বললেন, ‘স্কুলে আমি, লাইলী ও মঞ্জু—এই তিনজন ছিলাম হরিহর আত্মা। লাইলীর এল, সুচন্দার এস ও মঞ্জুর এম—তিনে মিলে আমাদের তখন ডাকা হতো “এলসিএম” নামে। তবে লাইলী ও মঞ্জু দুজনই মারা গেছে। আজ খুব মনে পড়ছে ওদের। এ ছাড়া লুটু, কুমু, পরী, তাহেরা, অর্চনা, বেবী—আমার এই বান্ধবীদেরও ভীষণ মিস করছি।’ এরপর আড্ডার অন্যদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘মোমিন গার্লস স্কুলের দিনগুলো আসলেই ভোলা যাবে না, তাই না রে?’
১৯৩৮ সালে প্রতিষ্ঠিত মোমিন গার্লস স্কুল যশোর সরকারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের আগের নাম। ১৯৬১ সালে এটি সরকারি হয়। এটি যশোরের প্রাচীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যতম।
আড্ডার শোরগোল কাটিয়ে ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে সালমা শহীদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি পরমাণু বিজ্ঞানী এম শমসের আলী। বিশেষ অতিথি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ আকরম হোসেন, বিচারপতি আবদুল আজিজ, নূর মোহাম্মদ ও ডা. এম এ রশিদ।
অনুষ্ঠানে গুণীজনদের একে একে সম্মাননা ক্রেস্টের পাশাপাশি উত্তরীয় পরিয়ে দেওয়া হয়। সম্মাননা পাওয়ার পর নিজের অনুভূতি প্রকাশ করে সালমা শহীদ চৌধুরী বলেন, ‘জন্মস্থানের মানুষের দেওয়া এই সম্মান পেয়ে খুব ভালো লাগছে।’
রহমান মোহাম্মদ লুৎফরের কথায় ভেসে উঠল জন্মশহরের মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা। অন্যদিকে সম্মাননা গ্রহণ করে সুচন্দার চোখেমুখে সেই সময় বর্ণিল উচ্ছ্বাস। অনুভব প্রকাশ করতে গিয়ে বললেন, ‘জীবনে অনেক পুরস্কার পেয়েছি। তবে আমার স্কুল থেকে আজ যে সম্মাননা দেওয়া হলো, তা আমার কাছে যেকোনো পুরস্কারের চেয়েই বড়। আসলেই খুব আনন্দ লাগছে। মনে হচ্ছে, আমি যেন আবার যশোরের সেই চাটনি হয়ে গেছি।’
কথায় কথায় এর মধ্যে শেষ হয়েছে অনুষ্ঠানের কারবার। কিন্তু আহাদ মিলনায়তনে সুপরিসর ঘরটি ছেড়ে কারোরই যেন উঠতে ইচ্ছে করছে না। সবার চোখেমুখেই তখন ফিরে ফিরে আসছে মোমিন গার্লস স্কুল, আজকের যশোর সরকারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের সোনাঝরা দিনগুলো।
‘আবার কবে দেখা হবে, দেখা হবে তো?’—সব মুখেই এই অভিব্যক্তি।
আর সবার প্রিয় চাটনি আপার চোখ ছলছল। অন্যদের মতো মোমিন গার্লস স্কুলের সবুজ মাঠ যেন সে মুহূর্তে ডাকছে তাঁকে।
আলতাফ শাহনেওয়াজ
No comments