ওদের শাস্তি দিন by ড. তুলসী কুমার দাস

ওরা কারা, যারা রাতের অন্ধকারে কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করে রামু, পটিয়া, উখিয়া ও টেকনাফে বসবাসরত শান্তিপ্রিয় ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর বন্য পশুর মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের সর্বস্ব ধ্বংস করল, তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিল, মন্দির পুড়িয়ে দিল, দেবতাকে অপমান করল? এ সবই তারা করল ধর্মের নামে, ঠিক যেমনটি ঘটেছিল একাত্তরে, আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়।


পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর ও আলশামস ধর্মের নামে লাখ লাখ বাঙালিকে হত্যা করেছিল; অগণিত মা-বোনের সম্ভ্রম তারা ভূলুণ্ঠিত করেছিল। একই সঙ্গে তাদের লক্ষ্য ছিল ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নির্মূল করা। সেই একই ধারায় তারা এখনো চলছে। তাই ওরা সুযোগ পেলেই সামান্য অজুহাতে সংখ্যালঘুদের আক্রমণ করে, নির্যাতন করে, এমনকি নৃশংসভাবে হত্যা করতে কুণ্ঠিত হয় না। ওরা অন্ধ, মানসিকভাবে অসুস্থ। ওরা মানুষ নামের কলঙ্ক। কিন্তু আমরা? আমরা যাঁরা নিজেদের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন, বিবেকবান, উদার বলে দাবি করি, তাঁরা কি শুধু মানববন্ধনে অংশগ্রহণ করে আর পত্রিকায় দুটো প্রবন্ধ লিখে দায়িত্ব শেষ করব? আমাদের কি আর কিছুই করার নেই? অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ। এসব কি শুধুই বাহারি স্লোগান?
কার কাছে অনুযোগ করব? সরকারের কাছে? মহাজোট সরকার অসাম্প্রদায়িক সরকার, ধর্মনিরপেক্ষ সরকার। সংখ্যালঘুদের শেষ আশ্রয় তো এই মহাজোট সরকারই। কিন্তু এই সরকারের আমলেই সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ এবং চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর জঘন্য অত্যাচার চালানো হলো। এবারের মতো তখনো অভিযোগ ছিল- প্রশাসন নিষ্ক্রিয় ও নীরব। তাহলে কি প্রশাসনের এই দুর্বলতাই দুষ্কৃতকারীরা গ্রহণ করছে?
সাতক্ষীরা ও চট্টগ্রামের সংখ্যালঘু নির্যাতনের সঙ্গে যারা জড়িত ছিল, তাদের কী শাস্তি দেওয়া হয়েছে দেশবাসী তা জানে না। রামু, পটিয়া, উখিয়া ও টেকনাফের ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের শাস্তি হবে তো? ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই দেশের বিভিন্ন স্থানে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর এক গভীর অমানিশা নেমে এসেছিল। সে সময় নির্যাতনের মাত্রা একাত্তর সালের নির্যাতনের মতোই ভয়াবহ ছিল। সে সময়কার প্রশাসন ও সরকার ইচ্ছা করেই সেটিকে গুরুত্ব দেয়নি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভয়ংকর সব ঘটনা ধামাচাপা দিয়েছে। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০১ সালের সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিষয়টি তদন্তের যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে, তা দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মনে ক্ষীণ আশার জন্ম দিয়েছে। কিন্তু সে তদন্ত হবে তো? প্রকৃত অপরাধীরা ধরা পড়বে তো? তাদের শাস্তি দেওয়া যাবে তো? এ সরকারের আমলেও সংখ্যালঘু নির্যাতনের এতগুলো ঘটনা ঘটল! সরকার কি হামলাকারীদের চিহ্নিত করতে পেরেছে? সরকার কি দুষ্কৃতকারীদের আইনগতভাবে শাস্তি দিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ? নাকি অপরাধীরা বুঝে গেছে, সংখ্যালঘুদের নির্যাতন করলে শাস্তি হয় না। কাজেই সুযোগ পেলেই সংখ্যালঘুদের নির্যাতন করো। তাদের অনেকেই হয়তো এও ভাবে, বাংলাদেশ তাদের অর্থাৎ একটি বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের। অন্য কেউ এখানে থাকবে কেন? এসব যদি সত্যি হয়, তাহলে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কী?
শুধু ভিন্ন ধর্মের কারণে যাদের ঘর পুড়িয়ে দেওয়া হলো, নিঃস্ব করে দেওয়া হলো, তারা সান্ত্বনা খুঁজবে কোথায়? তাদের হৃদয়ের গভীরের ক্ষত কি আমরা অনুভব করি? এসব মানুষ কি তাদের বুকের মধ্যে পরম মমতায় সেই চিরন্তন বাণী এখনো অনুভব করে... 'আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি?' তাদের ক্ষতবিক্ষত হৃদয়ের হাহাকার কি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশকে ব্যথিত করে, বিক্ষুব্ধ করে? আমরা কি সত্যিই বিচলিত? আমরা কি উদ্বিগ্ন? আমাদের কি ইচ্ছা করে ক্রোধে ফেটে পড়তে? আমরা কি ওই সব পিশাচকে পরাজিত করতে পারি না? শাস্তি দিতে পারি না? কঠিন শাস্তি? বাঁচাতে পারি না বাংলাদেশকে?
রুখে দাঁড়াও বাংলাদেশ। গর্জে ওঠো। ঠিক একাত্তরের মতো।

লেখক : অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও
প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
tulshikumardas@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.