মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও স্থানীয় সরকার by এ এম এম শওকত আলী

সরকারি মহলের একটি নতুন উদ্যোগ, যা আগে কখনো হয়নি বা দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের কোনো দেশেও প্রস্তাবিত উদ্যোগ তো দূরের কথা, চিন্তাভাবনাও কখনো করা হয়নি। প্রস্তাবিত উদ্যোগের ফলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে একটি স্থানীয় সরকার সেকশন স্থাপন করা হবে।


সংশ্লিষ্ট সচিবপর্যায়ের কর্মকর্তারা বিষয়টি সমর্থন করেন। এ বিষয়ে তাঁদের ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া একটি দৈনিক পত্রিকায় ২৩ সেপ্টেম্বর প্রকাশ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সচিবরা সমর্থন করলেও উপজেলা চেয়ারম্যানরা প্রস্তাবিত উদ্যোগকে সমর্থন করেননি। তাঁদের মতে, উপজেলা পরিষদ সংসদ সদস্য ও আমলাদের দ্বারা প্রভাবিত। নির্বাচিত পরিষদের কোনো অস্তিত্ব নেই; যা আছে তা শুধু লোক দেখানোর জন্য। এহেন অভিযোগ নতুন নয়। এ অভিযোগের যে কোনো সত্যতা নেই তা ঠিক নয়। তবে মাঠপর্যায়ে কর্মরত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদেরও রয়েছে পাল্টা অভিযোগ। তাঁদের পাল্টা অভিযোগের মূল বিষয় হলো বেআইনি বা নিয়মমাফিক নয়- এমন সব কাজ করা থেকে বিরত থাকলেই চেয়ারম্যান ও কর্মকর্তাদের মধ্যে সংঘাতের সৃষ্টি হয়। পত্রিকান্তরে এর কিছু সংবাদও মাঝেমধ্যে পাওয়া যায়। বিশেষ করে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর খাদ্যদ্রব্যের অনিয়মিত ব্যবহারের কথা।
মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা প্রস্তাবিত উদ্যোগ নিয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া এখনো ব্যক্ত করেননি। হয়তো বা দু-এক দিনের মধ্যে বিষয়টি জানার পর তাঁরা সুযোগসাপেক্ষে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবেন। জানা যায়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সংশ্লিষ্ট কমিশনারদের সঙ্গে সভা করে প্রস্তাবটি পরীক্ষা করছে। চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি। তবে এ সভায় উপস্থিত একজন সিনিয়র কর্মকর্তা এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগ ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। মন্ত্রিপরিষদ সচিব এ বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন। তাঁর মতে, কোনো দ্বৈত শাসন কাঠামোর সৃষ্টি যাতে না হয়, সে বিষয়টি তিনি পরীক্ষা করে দেখবেন।
সরকারি কার্য সম্পাদন বিধিমালার দুটি অংশ। প্রথমটি মূলত মন্ত্রিপরিষদ এবং এর জন্য আন্তমন্ত্রণালয় সভার বাধ্যবাধকতার বিষয়। দ্বিতীয় অংশ হলো বিদ্যমান মন্ত্রণালয়ের কার্য বণ্টন-সংক্রান্ত। মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিয়োগ ও শৃঙ্খলার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ক্ষমতাবান। তবে কিছু ক্ষেত্রে কোনো প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুমোদনের জন্য পেশ করতে হয়। এর মধ্যে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা-সংক্রান্ত কোনো বিষয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নেই। যা আছে তা হলো এ বিভাগের অধীনস্থ দপ্তরের তদারকি। ডিসি বা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কোনো অধস্তন দপ্তরের সঙ্গে যুক্ত নয়। কিন্তু প্রয়োজন অনুসারে সব মন্ত্রণালয়ের সঙ্গেই তাঁরা যুক্ত হয়ে থাকেন। অর্থাৎ সার্বিকভাবে তাঁরা সরকার কাঠামোর সঙ্গেই যুক্ত। মাঠপর্যায়ে তাঁদের মূল কাজ হলো বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকাণ্ডের সমন্বয় সাধন, যার জন্য বিষয়ভিত্তিক কমিটিও বিদ্যমান। তবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে একটি কাজ হলো আন্তমন্ত্রণালয় সমন্বয় সাধন। সেটি সচিবালয় পর্যায়েই হয়।
স্থানীয় সরকার বিভাগের জন্য কার্য সম্পাদন বিধিমালার দ্বিতীয় অংশে ১৮টি বিষয়ের উল্লেখ করা আছে। এর মধ্যে প্রথমটিই হলো স্থানীয় সরকার। এর ১৪ ক্রমিকে রয়েছে বিভাগের অধীনস্থ দপ্তরের তদারকি। এর মধ্যে ডিসিসহ ইউএনওরা অন্তর্ভুক্ত নয়। এ সত্ত্বেও প্রস্তাবিত উদ্যোগের বিষয়টি কেন উত্থাপিত হলো তা বোধগম্য নয়। বিধিমালার দ্বিতীয় অংশের দুই ক্রমিকে স্থানীয় সরকারের দায়িত্ব হলো স্থানীয় সরকার ও গ্রামীণ প্রশাসনের জন্য অর্থায়ন ও নিয়ন্ত্রণ ইনসপেকশন-সংক্রান্ত। ইংরেজিতে বিধিমালায় Regulation-এর বিষয়টি সঠিক অর্থ সরাসরি নিয়ন্ত্রণ নয়। যদি সংশ্লিষ্ট আইন বা বিধি লঙ্ঘিত হয়, তাহলেই এ বিষয়ে নিয়মমাফিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধিতে এর পদ্ধতি বলা আছে। আইন বা বিধিতে কোনো কাজের কথা বলা না থাকলে স্থানীয় সরকারের ওপর প্রভাব বিস্তারের বা কার্যক্রমে প্রতিবন্ধক হওয়ার কোনো সুযোগই ডিসি বা নির্বাহী কর্মকর্তার নেই। তবে প্রায় সব মন্ত্রণালয় দাপ্তরিক আদেশ-নির্দেশের মাধ্যমে ডিসিদের সাহায্য কামনা করে। অন্যদিকে জেলা পর্যায়ে বিভিন্ন সমন্বয় কমিটির সভায় আলোচনাক্রমে সার্বিক কর্মকাণ্ড জানতে পারে এবং এ বিষয়ে প্রয়োজনবোধে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে করণীয় বিষয়ে কিছু পরামর্শও দিয়ে থাকে। স্মরণ করা যেতে পারে, বিগত ডিসিদের কনফারেন্সে এ বিষয়টি উত্থাপিত হয়নি। কমিশনাররা কেন বিষয়টি নিয়ে সুপারিশ বা মত প্রকাশ করেছেন তা অজানা। তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেওয়া যায়, মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা ও নির্বাচিত উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানদের কাজের অধিকতর সমন্বয়ের জন্য এ ধরনের উদ্যোগ প্রয়োজন, তাহলেও বলা যায় এতে সমস্যার কোনো সমাধান হবে না; বরং সমস্যা ঘনীভূত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আইন ও বিধি দ্বারা নির্ধারিত গণ্ডির মধ্যে সবাই নিয়মমাফিক কাজ করলে সমন্বয় কোনো বড় সমস্যা নয়। এ পথ অবলম্বন না করে আবার নতুন সেকশন কেন? এর বাংলা অর্থ শাখা, যা কোনো মন্ত্রণালয় বা বিভাগের সর্বনিম্ন স্তর। এ স্তরের প্রধান একজন সহকারী সচিব বা সিনিয়র সহকারী সচিব। সচিবালয় নির্দেশমালায় এ সংজ্ঞাই দেওয়া হয়েছে।
শাখার ওপরের ধাপ অধিশাখা, যার প্রধান উপসচিব। এর ওপরে অনুবিভাগ, যার প্রধান যুগ্ম অথবা ক্ষেত্রবিশেষে একজন অতিরিক্ত সচিব। একটিমাত্র শাখা খোলার কথা। এর পরে কী হবে? স্থানীয় সরকার-বিষয়ক কর্মকাণ্ডে কিছু স্পর্শকাতরতা রয়েছে, বিশেষ করে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা ও উপজেলা চেয়ারম্যানের পরস্পরবিরোধী সম্পর্কের কারণে। এ জন্য শাখাপ্রধানকে সিদ্ধান্তের জন্য উপরস্থ স্তরে পাঠাতে হবে সম্ভাব্য বিপদ এড়ানোর জন্য। অনুমান করা সম্ভব যে নতুন কোনো অধিশাখা ও অনুবিভাগ খোলা হবে না। বিদ্যমান কাঠামোর মাধ্যমেই সমন্বয় সাধনের কাজের জন্য শাখার উপরস্থ কোনো অতিরিক্ত জনবলের প্রয়োজন হবে না। কিন্তু কাজ কী? এ কাজের প্রয়োজন বা যুক্তি কী? কী এমন কাজ, যা স্থানীয় সরকার বিভাগ করতে অক্ষম। সমন্বয়ের অজুহাতে কেন এই জটিলতা। বিদ্যমান প্রশাসনিক কালচারে সব নথিই মন্ত্রিপরিষদ সচিবের কাছে যাবে নিষ্পত্তির জন্য। ফলে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের অহেতুক কাজ বাড়বে। তাঁর মূল কাজ বাধাগ্রস্ত হবে। যেকোনো আদেশ-নির্দেশ দিতে হলে স্থানীয় সরকার বিভাগের সঙ্গে আলোচনা করার প্রয়োজন হবে। ফলে সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতার সূচনা হবে।
প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছে যে এরশাদ সরকারের আমলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে জেলা প্রশাসন বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আসলে এ সিদ্ধান্ত হয় জিয়া সরকার আমলে। তখন বর্তমান বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটদের ক্ষমতা জেলার ম্যাজিস্ট্রেটরাই প্রয়োগ করতেন। বিচারিক কাজের মানসহ মামলা নিষ্পত্তির জন্য জেলা প্রশাসন অধিশাখায় নিয়মিত পরিবীক্ষণ করা হতো। এরশাদ সরকারের সময় উপজেলা পদ্ধতি প্রবর্তনের পর নতুন জেলা সৃষ্টি নিয়ে জটিলতা দূর করার কাজসহ উপজেলা ম্যানুয়াল প্রণয়ন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগই করেছিল। উপজেলা পদ্ধতি বাস্তবায়নের জন্য যে উচ্চপর্যায়ের নিকার কমিটি গঠিত হয়, এ কমিটিরও সাচিবিক সহায়তা এ অধিশাখাই সম্পাদন করে। নিকার এখনো বিদ্যমান। যদি মাঠ প্রশাসনের নীতি-সংক্রান্ত কোনো বিষয় থাকে, তা নিকারের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা যায়। অন্যদিকে নতুন কোনো থানা বা উপজেলা সৃষ্টির প্রস্তাবের বিষয়েও নিকার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত প্রদান করে। তবে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় অর্থাৎ থানার ক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্র এবং উপজেলার ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার বিভাগ প্রস্তাব মন্ত্রিপরিষদে প্রেরণ করে।
প্রস্তাবিত উদ্যোগে নীতি-সংক্রান্ত কোনো বিষয় থাকলে সে বিষয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগ প্রয়োজনীয় প্রস্তাব মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠাতে পারে। এর জন্য কোনো নতুন শাখার প্রয়োজন নেই। নিকারের বিদ্যমান কাঠামোর আওতায় এসব কাজ করা সম্ভব। উপজেলা পরিষদ শক্তিশালীকরণের জন্য অবশ্যই উদ্যোগ প্রয়োজন। তবে উপজেলার জবাবদিহিতাও নিশ্চিত করা প্রয়োজন। জবাবদিহিতা ছাড়া ক্ষমতায়ন প্রক্রিয়া আশঙ্কাজনক। এতে জনস্বার্থ ক্ষুণ্ন হয়। নির্বাচিত প্রতিনিধিরা জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে নন। বিশেষ করে বিদ্যমান আইনি কাঠামোর উর্ধ্বে নন।
অন্যদিকে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও নির্বাহী কর্মকর্তার সম্পর্কের অবনতি সব উপজেলায় বিরাজ করছে- এমনটিও ভাবা ঠিক নয়। কিছু উপজেলায় এটা হতে পারে। বাংলাদেশের ফৌজদারি আইনে একটা কথা আছে, জেনেশুনে কোনো বেআইনি আদেশ মেনে কাজ করলে, যে সে কাজটি করে, সে সমভাবে দোষী। যেসব উপজেলায় বেতনভুক্ত ও নির্বাচিত প্রতিনিধির মধ্যে দ্বন্দ্ব হয়েছে বা এখনো তার অবসান হয়নি সে বিষয়টি খতিয়ে দেখার অবকাশ আছে। প্রয়োজনে কেন্দ্রের হস্তক্ষেপ করার প্রয়োজন আছে। তবে এ ধরনের হস্তক্ষেপ হবে আইনি কাঠামোর মাধ্যমে। সুশাসন প্রতিষ্ঠাই হবে একমাত্র উদ্দেশ্য। উপজেলা পরিষদকে বাদ দিয়ে একমাত্র উপজেলা চেয়ারম্যানকেই ক্ষমতাবান করা নির্বাচিত স্থানীয় সরকারের উদ্দেশ্য হতে পারে না। পরিষদকেই প্রাধান্য দিতে হবে, কোনো ব্যক্তিবিশেষকে নয়। পরিষদের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র সুসংহত করাই হবে মূল উদ্দেশ্য।
২০০৯ সালে প্রণীত অধ্যাদেশের মাধ্যমে স্থায়ী সরকার কমিশন গঠন করা হয়। কিন্তু অধ্যাদেশটি আইনে পরিণত হয়নি। এ ধরনের কমিশনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কমিশন স্থানীয় সরকার-বিষয়ক যেকোনো প্রশ্নের সমাধানের জন্য সরকারকে নিরপেক্ষ মতামত দিতে পারত। কমিশন না থাকায় সরকারের কাজ অহেতুক বৃদ্ধি পেয়েছে।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা

No comments

Powered by Blogger.