গতকাল সমকাল-বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও বহির্বিশ্ব by ফারুক চৌধুরী

যুদ্ধের অথবা সশস্ত্র সংগ্রামের প্রতিক্রিয়া, তার সঙ্গে প্রত্যক্ষ, এমনকি পরোক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট সমাজেও গভীরভাবে অনুভূত হয়। আমাদের সমসাময়িক ইতিহাসে দুটি মহাযুদ্ধ তার প্রমাণই বহন করে। ক্রমশ ছোট হয়ে আসা বর্তমান পৃথিবীতে মানুষের জীবনযাত্রার পটই পাল্টে দিল এই দুই মহাযুদ্ধ।


একটি জাতির ইতিহাসে সশস্ত্র সংগ্রামের বেলায়ও তা-ই। কথায় বলে, ইট ইজ নেভার দ্য সেইম আফটার এ ওয়ার। যুদ্ধোত্তর অবস্থা তার আগের মতো কখনো হয় না। অবশ্য সেই অবস্থা ইতিবাচক অথবা নেতিবাচক, কিংবা দুই-ই হতে পারে।
আফগানিস্তানের বিষাদময় ইতিহাসের কথা মনে আসে। সেই দেশে কোন লগ্নে যুদ্ধ আর সংঘাতের সূত্রপাত হয়েছিল, তার ‘তারিখ-সাল’ নিয়ে ‘পণ্ডিতেরা বিবাদ’ করতেই পারেন। ২০০১ সালের অক্টোবরে বুশ সাহেব ৯/১১-এর তথাকথিত প্রতিক্রিয়ায় উষ্মাভরে ‘শ্রাবণের বর্ষণের মতো’ বোমা ফেলছিলেন। তখন ২০০১ সালের অক্টোবরে একজন সাংবাদিকের দায়িত্বে আমি পেশোয়ার তথা আফগানিস্তান-পাকিস্তান সীমান্তে বোমা-আক্রান্ত অনেক আফগান বাস্তুহারার সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। তাঁদের একজন ছিলেন প্রফেসর দোস্ত মোহাম্মদ। প্রায় আমারই বয়সী, অর্থাৎ ১০ বছর আগে তাঁর বয়স ছিল প্রায় ৬৫ বছর। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াইওমিংয়ের পিএইচডি ডিগ্রিধারী এই মানুষটি আফগানিস্তানের জালালাবাদ ইউনিভার্সিটিতে মাইক্রোবায়োলজি পড়াতেন। তিনি আফগানিস্তানের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান, আর আফগানিস্তানের ভাগ্য নিয়ে ১০০ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রসুদ্ধ বহির্বিশ্বের হস্তক্ষেপের কথা বর্ণনা করে বলেছিলেন, ‘তবে বুশ সাহেব কী করছেন, তা জানেন না। তিনি আস্ত একজন ইডিয়ট।’ তিনি বলেছিলেন, ‘আমি চাই আপনি আপনার পত্রিকার মারফত পৃথিবীকে বলুন যে আমি মনে করি, বুশ সাহেব একজন “আস্ত” ইডিয়ট। বলতে পারবেন তো আপনি? স্বাধীনতা আছে আপনাদের মত প্রকাশের...?’ সাক্ষাৎকারটি সেই অক্টোবরেই প্রথম আলোতে প্রকাশিত হয়েছিল।
দোস্ত মোহাম্মদের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের পর একটি কথা বারবারই মনে এসেছে। আফগানিস্তানে এমনটি হওয়ার প্রধান কারণ দুটি। প্রথম হলো, দেশটির গুরুত্বপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান এবং দ্বিতীয়টি হলো, দেশ পরিচালনায় শাসকদের চরম ব্যর্থতা।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ স্বাধীনতার সম্পূরক হিসেবে আমাদের নিয়ে এল একটি আধুনিক রাষ্ট্র গঠনের সম্ভাবনাময় একটি ভুবনে। সেই সম্ভাবনা আমরা কতটুকু বাস্তবায়ন করতে পেরেছি, তা প্রশ্নসাপেক্ষ। একটি ভাবনা তো রয়েছেই, এবং যুক্তিযুক্ত সেই ভাবনা যে স্বাধীনতার চার দশক পরও আমাদের জন্য গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ একটি কল্পনাবিলাস। স্বাধীনতার চার দশক পরও আমরা কাঙ্ক্ষিত রাজনীতির, গ্রহণযোগ্য জীবনযাত্রার, আর স্থিতিশীল উন্নয়নমুখী সমাজ সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা যেন অনুভব করছি না। চক্রান্ত আর হত্যার রাজনীতি, দফায় দফায় স্বৈরাচার, নানা ঢঙের সামরিক শাসন, রকমারি নির্বাচন, আর সংবিধান নিয়ে দাবা খেলা—আমাদের অপ্রিয় অভিজ্ঞতার যেন অন্ত নেই। তার জন্য কোনো দল বা গোষ্ঠীকে এককভাবে দায়ী করা হবে রাজনৈতিক অপরিপক্বতা। তার জন্য দায়ী আমরা, আমাদের প্রজন্ম। এই ভয়াবহ অবস্থা থেকে উত্তরণের দায়িত্বও আমাদের, আমাদের প্রজন্মের।
এই নিবন্ধ আমি লিখতে বসেছি আজ ১৭ আষাঢ়, ১৪১৮ বঙ্গাব্দ, ১ জুলাই ২০১১ সালের মুষলধারে বৃষ্টিস্নাত প্রভাতে। লিখতে বসেছি আজকের সংবাদপত্রে তিনটি খবর পড়ে, গভীরভাবেই বিচলিত চিত্তে।
প্রথম খবরটি হলো, ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের একটি উক্তি। তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশের ২৫ শতাংশ মানুষ জামায়াতের সমর্থক এবং তারা প্রচণ্ড ভারতবিদ্বেষী। তাদের নিয়ে আইএসআই নানা রকম চক্রান্ত করছে। কাজেই যেকোনো সময় বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পাল্টে যেতে পারে।’
উক্তিটি আমাকে বিস্মিত ও হতবাক করেছে কয়েকটি কারণে। প্রথম হলো, উক্তিটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অবস্থার ওপর। একজন প্রতিবেশী বন্ধুরাষ্ট্রের সরকারপ্রধানের প্রকাশিত এই উক্তি কি ‘মহারথী প্রথা’; দ্বিতীয় হলো, কোনো রাজনৈতিক দলের সমর্থক ভোটারদের কত শতাংশ, তা জানার একমাত্র গ্রহণযোগ্য উপায় হলো নির্বাচনের পরিসংখ্যান। আমাদের কোনো নির্বাচনের পরিসংখ্যান কি তাই বলে? তৃতীয়ত, অন্য অনেক দেশের প্রথার মতো ভারতেও সিনিয়র সম্পাদকদের উচ্চপর্যায়ে ‘ব্যাকগ্রাউন্ড ব্রিফিং’ দেওয়া হয়ে থাকে। কিন্তু তা সাধারণত প্রকাশিত হয় না, কারণ সম্পাদকেরা রিপোর্টার নন। তাহলে এ ক্ষেত্রে কেন তা প্রকাশিত হলো? চতুর্থত, এতে লাভবান হবে কে বা কারা? পঞ্চমত, আমাদের দুই দেশের মধ্যে সুসম্পর্ক, যা বিবর্তমান, তা যদি আমরা পারস্পরিক অভ্যন্তরীণ অবস্থা সম্বন্ধে প্রকাশ্য মন্তব্যের পর্যায়ে টেনে নামাই, তাহলে আমরা কোন পথে চলেছি?
আমি বিশ্বাস করি যে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠেয় বাংলাদেশ সফর আমাদের দুই দেশের সম্পর্ককে একটি সত্যিকারের গঠনমূলক পর্যায়ে উন্নীত করার সুযোগ এনে দেবে। তা দুই দেশের মানুষের জন্যই কল্যাণকর হবে। আমি সর্বান্তঃকরণে আশা করব যে এ ধরনের প্রকাশ্য উক্তি আমাদের আশার গুড়ে বালি ফেলবে না।
দ্বিতীয় খবর হলো, ভারতে নিযুক্ত বিদায়ী মার্কিন রাষ্ট্রদূত টিমোথি রোমার বলেছেন যে ‘বাংলাদেশ বিষয়ে তাঁরা (যুক্তরাষ্ট্র আর ভারত) ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছেন।’ এটা যুক্তরাষ্ট্র আর ভারতের একান্ত বিষয়। এতে আমাদের মর্মাহত হওয়ার কোনো কারণ নেই। তবে বাংলাদেশ সম্বন্ধে ভারতকে জ্ঞানদান করবে যুক্তরাষ্ট্র? এই সংকুচিত পৃথিবীও তাতে অবাক হবে। যুক্তরাষ্ট্র যে দেশের বন্ধু, তার কি শত্রুর প্রয়োজন রয়েছে? প্রশ্নটি জিজ্ঞেস করুন পাকিস্তানে? যে দেশ যুক্তরাষ্ট্রনির্ভরতার কারণে আজ একটি ভঙ্গুর রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে, যে দেশ গতকালই যুক্তরাষ্ট্রকে তাদের বেলুচিস্তানের একটি বিমানঘাঁটি ব্যবহার করতে নিষেধ করেছে। প্রশ্নটি জিজ্ঞেস করুন সবাইকে বাদ দিয়ে, আফগানিস্তানের ক্রীড়নক প্রেসিডেন্ট কারজাইকে, যিনি সম্প্রতি বলেছেন যে আমেরিকানরা ‘তাদের নিজের স্বার্থে এবং নিজের লক্ষ্যে আমাদের ভূখণ্ড ব্যবহার করছে।’
তৃতীয় খবরটিও পীড়াদায়ক। ব্রিটিশ আন্তর্জাতিক উন্নয়নবিষয়ক মন্ত্রী অ্যালান ডানকান লন্ডনে তাঁর মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফ করার সময় বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি যথার্থভাবেই বলেছেন, যুক্তরাজ্য বাংলাদেশের রাজনৈতিক কার্যক্রমের উন্নয়ন এবং অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কামনা করে।
আফগানিস্তানের মতোই বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এবং চীনসমেত উত্তর এশিয়ার মধ্যকার সেতুবন্ধ। ১৬ কোটি মানুষের অমিত সম্ভাবনার দেশ বাংলাদেশ। আমরা একই ভাষায় কথা বলি, উন্নয়নের একই স্বপ্ন আমাদের চোখে। যে দেশের মানুষ স্বাধীনতা অর্জনের জন্য প্রাণ দিয়েছে, তারা স্বাধীনতা রক্ষার জন্যও প্রাণ দেবে। আমাদের গত ছয়-সাত দশকের ইতিহাস ধাপে ধাপে সামনে এগোনোর রোমাঞ্চকর ইতিহাস। যুক্তিসংগত কারণেই বাংলাদেশের প্রতি প্রতিবেশী ও আঞ্চলিক দেশসমেত বহির্বিশ্বের গভীর আগ্রহ রয়েছে। এই অঞ্চলেও বাংলাদেশের বিশেষ একটি ভূমিকা রয়েছে। আমাদের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের যে বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে, আমাদের নীতিনির্ধারকদের তা অনুধাবন করতে হবে। অভ্যন্তরীণ রাজনীতির টানাপোড়েন যাতে বহির্বিশ্বের সঙ্গে আমাদের আন্তরাষ্ট্রীয় সম্পর্কে প্রতিফলিত না হয়, আমরা যাতে এমন কোনো অবস্থার সৃষ্টি না করি, যা বহির্বিশ্বকে হস্তক্ষেপ ও খবরদারির সুযোগ এনে দেয়—অন্যান্য বিবেচনা ছাড়াও ১/১১-এর কথা স্মরণে রেখেই আমি এই সাবধানবাণী উচ্চারণ করছি। আমাদের রাজনীতিবিদেরা যদি দেশ পরিচালনায় ব্যর্থ হন, তাহলে এত অর্জন আর আশা নিয়েও আমরা আফগানিস্তানের মতো একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারি।
আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বাইরের কারও হস্তক্ষেপ কোনোভাবেই কাম্য নয়। অতএব এই দেশের পরিচালনা আমাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা দূরদর্শিতার সঙ্গেই করবেন—এই আশা আমাদের রয়েছে। এই কথাগুলো নিছক আবেগ উচ্চারিত নয়, সাড়ে তিন দশকেরও বেশি সময়ের অভিজ্ঞ একজন প্রবীণ কূটনীতিকের চেতনাঋদ্ধ এবং হূদয়নিংড়ানো উপলব্ধি।
ফারুক চৌধুরী: সাবেক পররাষ্ট্রসচিব। কলাম লেখক।
zaaf@bdmail.net

No comments

Powered by Blogger.