পঞ্চদশ সংশোধনী-জনগণের অধিকার ও ক্ষমতা উপেক্ষিত by শাহ্দীন মালিক

সংসদ আবার সংবিধান সংশোধন করেছে এবং ভালো হোক মন্দ হোক, সেটাকে আপাতত আমাদের মেনে চলতে হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, খুশি মনে মানব, নাফল বাধ্য হয়ে মানব? এই মুহূর্তে নিতান্ত সরকারদলীয় লোক না হলে অন্য সবাই বাধ্য হয়েই মানবে বলে আমার ধারণা। তবে সত্য যে, সরকার যা করে, সচরাচর আমরা তা ভালো চোখে দেখি না। আবার এটাও সত্য, সমালোচনা ছাড়া কাজ ভালো হয় না।


আমাদের সংবিধানের গায়ে অনেক ময়লা-কাদা এবং অনেক অগ্রহণযোগ্য বিধান ছিল। সমাজের সবচেয়ে অগণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, অর্থাৎ সেনা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এগুলো সংবিধানের মাধ্যমে রাষ্ট্রের ওপর চাপিয়ে দিয়েছিল। এগুলো থেকে সংবিধানকে মুক্ত করা ছিল অপরিহার্য। এই কাজটা সংসদের বদলে আদালত করে দিয়েছেন। এ জন্য আদালতের প্রতি শ্রদ্ধা-ভক্তি বৃদ্ধি পাওয়ার কথা। তবে আদালত তড়িঘড়ি করে অনেকগুলো রায় অতি অল্প সময়ে দিয়ে নিজেরাই নিজেদের প্রতি আস্থায় চিড় ধরিয়েছেন। এই সমালোচনা সত্ত্বেও বলতে হবে, আদালত সংবিধানকে অনেকাংশে কলুষমুক্ত করেছেন।
তবে আদালতের পূর্ণাঙ্গ রায়গুলো তাড়াতাড়ি পেলে জটিলতা ও অনিশ্চয়তা অনেক কম হতো। আশা থাকবে, ভবিষ্যতে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের প্রক্রিয়া যাতে দীর্ঘসূত্রতায় পর্যবসিত না হয়, আদালত সেদিকে মনোযোগী হবেন। এ ছাড়া বারবার একই রায় বদলিয়ে সুপ্রিম কোর্ট আইন ও বিচারব্যবস্থার স্থিতিশীলতাকে ক্ষুণ্ন করেছেন। কোনো ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্ট একবার রায় দিয়ে ফেলার পর সেই রায়টি বারবার পরিবর্তন করা বিচারব্যবস্থার জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক। এবং অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের পেশা ও চাকরিগত সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির জন্য যদি রায় পরিবর্তন করা হয়, তাতে রায়ের আইনি ও নৈতিক—উভয় গ্রহণযোগ্যতাই প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
বারবার বলা হয়েছে যে এই পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আদালতের রায় বাস্তবায়িত হয়েছে এবং আমরা বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে গেছি। আসলে এই দুটির কোনোটাই ভালোভাবে হয়নি এবং ক্ষমতায় থাকা, আবার ক্ষমতায় ফিরে আসা আর বিরোধী দলকে দুর্বল করাই হয়ে দাঁড়িয়েছে পঞ্চদশ সংশোধনীর মুখ্য দিক। আমাদের প্রত্যাশা ছিল বেশি, কিন্তু সংসদ অর্থাৎ ক্ষমতাসীন দল হতাশও করেছে বেশি। আর বরাবরের মতো বিরোধী দল গঠনমূলক কোনো প্রস্তাব বা আলোচনা না করে বিরোধিতার জন্যই বিরোধিতায় লিপ্ত ছিল অনেক বেশি। বিরোধী দলের সংবিধানসংক্রান্ত বক্তব্যে ইচ্ছাকৃতভাবে ভুল ব্যাখ্যা ও ভুল তথ্য দেওয়ার প্রবণতাটা ছিল অনেক বেশি। এটা প্রধান বিরোধী দলের আইন বিষয়ে দীর্ঘ সময়ের পারদর্শী নেতাদের কাছে মোটেই কাম্য ছিল না।

দুই.
আশা ছিল যে সংসদীয় বিশেষ কমিটির প্রতিবেদনটি একটি শ্বেতপত্র আকারে প্রকাশিত হবে। অর্থাৎ সংবিধানের প্রতিটি অনুচ্ছেদের সংশোধন প্রস্তাবগুলো কেন তাঁরা চাইছেন, এতে জনগণের কী সুবিধা হবে, অধিকার কীভাবে সুরক্ষিত হবে; সেসব যুক্তি ও কারণ এই শ্বেতপত্রে থাকাটাই প্রত্যাশিত ও বাঞ্ছিত ছিল। কিন্তু শ্বেতপত্র প্রকাশিত হয়নি। খুঁজে পেতে সংসদে উপস্থাপিত বিলের কপি পাওয়া গিয়েছিল, তাতে কোন অনুচ্ছেদ কীভাবে সংশোধিত হবে, অথবা কোন অনুচ্ছেদের বদলে নতুন কী বসানো হবে, শুধু সেগুলোরই উল্লেখ ছিল। এবং প্রস্তাবিত এই সংশোধনী বিল প্রকাশিত হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যেই সেটা সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আইন হিসেবে পাস হয়ে গেল। এত তাড়াহুড়োর কারণটি মোটেও বোধগম্য হয়নি।
বাহাত্তরের সংবিধানে রাষ্ট্রের ধর্মসংক্রান্ত কোনো বিধান ছিল না। রাজনৈতিক স্বার্থে এবং ক্ষমতার জন্য ধর্মপ্রাণ জনগণের ধর্মীয় বিশ্বাস, অনুভূতির অপব্যবহার ও অপপ্রয়োগ যাতে না করা যায়, সেটা নিশ্চিত করা হয়েছিল এবং আমার জানামতে, বাহাত্তরের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিটি এসেছিল বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে। অন্যদিকে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ এসেছিল জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনামলে। আর আমাদের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম এসেছিল সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নির্দেশে। স্পষ্টত, বর্তমান সরকারি দল ও এই সংসদের কাছে বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক অবস্থানের চেয়ে জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মতো ধর্ম নিয়ে সুবিধাবাদী রাজনীতি করাটা বেশি গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে। এবং সম্ভবত সে জন্যই তারা তথাকথিত ধর্মীয় ভোটের আশায় সংবিধানে ধর্মের ব্যবস্থা বহাল রেখেছে, যদিও দু-চারটা এদিক-সেদিক করে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি কিছুটা হলেও সহানুভূতি দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। এই লেজেগোবরে অবস্থা সংবিধানের জন্যও ভালো হলো না এবং আমাদের রাজনীতি ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্যও প্রভূত অমঙ্গলের উৎস হিসেবে রয়ে গেল। ভবিষ্যতে আমাদের এই রাষ্ট্র কোন দিকে যাবে, সে ব্যাপারে অনিশ্চয়তা রইল এবং ধর্মাশ্রয়ী রাজনৈতিক দল ও আওয়ামী লীগের মধ্যে যে সুস্পষ্ট পার্থক্য ছিল, সেটাও এখন ম্লান হয়ে গেল।
একইভাবে আগামী নির্বাচন বর্তমান সরকারি দলের অধীনে হবে, না অন্য কোনো ব্যবস্থায় হবে, সেই অনিশ্চয়তাটা পঞ্চদশ সংশোধনী দূর করতে পারেনি। একদিকে এই সংশোধনী অনুযায়ী যদি এ বছরই নির্বাচন হতো, তাহলে সেই নির্বাচনটা হতে হতো বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের অধীনে। আবার অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী বলছেন, কোনো নির্দলীয় ব্যবস্থায় পরবর্তী নির্বাচন করার পথ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়নি। প্রয়োজনে আবার সংবিধান সংশোধন করা যাবে। রাষ্ট্রধর্মের মতো পরবর্তী নির্বাচন কী ব্যবস্থায় হবে, সেটা নিয়েও এই দোদুল্যমানতা বা অনিশ্চয়তা দেশকে নিঃসন্দেহে আরও স্থিতিশীল হতে দেবে না।
দেশ পরিচালনার ব্যাপারে স্থিতিশীলতা ও ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করাই হলো সংবিধানের প্রধান কাজ। এই স্থিতিশীলতা ও ধারাবাহিকতা—এই দুই মাপকাঠিতে পঞ্চদশ সংশোধনী ফেল মেরেছে।
সংবিধানের মূল নীতিতে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য, সর্বস্তরে নারীদের অংশগ্রহণ ও সুযোগের সমতা ইত্যাদি কিছু প্রশংসনীয় বিধান যুক্ত হয়েছে। তবে অন্যদিকে জাতির পিতার প্রতিকৃতি, সংবিধান বাতিল-স্থগিতকরণ ইত্যাদির জন্য দণ্ডের বিধানের মতো অপ্রয়োজনীয় অনুচ্ছেদ সংযুক্ত করে সংবিধানকে খেলো করা হয়েছে।
বিচার বিভাগসংক্রান্ত সংবিধানের ষষ্ঠ অংশের কিছুটা ভালো সংশোধন হয়েছে, তবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও পৃথক্করণ নিশ্চিত করার জন্য এগুলো যথেষ্ট নয়। বিশেষত, ৯৯ অনুচ্ছেদে অবসরের পর বিচারপতিদের জন্য চাকরিবাকরি কাজকর্মের সুযোগ উন্মুক্ত রাখা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। অন্যান্য সাংবিধানিক পদে আসীন ব্যক্তিরা; যেমন—প্রধান নির্বাচন কমিশনার, সরকারি কর্মকমিশনের চেয়ারম্যানের জন্য তাঁদের অবসরের পর প্রজাতন্ত্রের কোনো কর্মে নিযুক্ত হওয়ার সুযোগের সব দরজা বাহাত্তরের সংবিধানে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। সেটা এখনো বন্ধ আছে। একইভাবে বাহাত্তরের সংবিধানে অবসরের পর চাকরিবাকরির ব্যাপারে বিচারপতিদেরও সব দরজা বন্ধ ছিল। বিচারপতিদের ব্যবহার করার জন্য সামরিক শাসনামলে এই দরজা খোলা হয়েছিল। আশা ছিল, পঞ্চদশ সংশোধনী অন্তত এ ব্যাপারে বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাবে। দুঃখের কথা, সেটা হয়নি। বর্তমানে, অর্থাৎ সংবিধান অর্পিত দায়িত্ব পালনকালে তাঁদের পেশাগত নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার জন্যই ভবিষ্যৎ প্রাপ্তির দরজাটা বন্ধ রাখাই যথাযথ হতো। কিন্তু তা না হওয়ায় অবসরের পরও বিচারপতিদের প্রলুব্ধ করার একটা সুযোগ বা হাতিয়ার সরকারের কাছে রয়ে গেল।

তিন.
আরও সময় নিয়ে চিন্তাভাবনা করে এবং বিরোধী দলকে অন্তর্ভুক্ত করে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় অধিকতর গ্রহণযোগ্য সংবিধান সংশোধনী পাস হলে সবার জন্য মঙ্গলজনক হতো। রাষ্ট্রধর্ম, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইত্যাদির আবর্তে পড়ে এই সংশোধনীতে জনগণের ক্ষমতা ও অধিকারের ব্যাপারটা উপেক্ষিতই থেকে গেছে। বাহাত্তরের সংবিধানের প্রায় ৪০ বছর পরে এসে জনগণের অধিকার সুদৃঢ় ও সংরক্ষিত করাই হতে পারত এই সংশোধনীর অন্যতম একটা প্রধান দিক। কিন্তু দলীয় ক্ষমতা বহাল রাখা, যাতে ভবিষ্যতেও সহজতরভাবে সেই ক্ষমতা বহাল থাকে ইত্যাদি ব্যাপারই দুর্ভাগ্যজনকভাবে হয়ে পড়েছে সরকারের মুখ্য বিবেচনা। আর আমরাও মন্তব্য করতে গিয়ে বা কলাম লিখতে বসে সেই একই ফাঁদে পড়ে রাষ্ট্রধর্ম ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মধ্যেই সীমিত থাকছি। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান—এসব ন্যূনতম অধিকারের কথা, ধনী-গরিবের মধ্যকার আকাশ-পাতাল বৈষম্য, দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য সম্পদের পুনর্বণ্টন ইত্যাদি জরুরি প্রসঙ্গ সংবিধান-আলোচনার ধারেকাছেও আসতে পারেনি। এখন হরতাল হবে, হবে বয়কট, মিটিং-মিছিল, গ্রেপ্তার, আইনের বিকট ও বীভৎস প্রয়োগ। ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে জনগণ ও তাদের অধিকার।
সব মিলিয়ে রাষ্ট্রের আদর্শিক অবস্থায় যে অনিশ্চয়তা ছিল, সেটার সর্বগ্রহণযোগ্য সুরাহা বা সমাধান এই সংশোধনীর মাধ্যমে আসেনি, বরং অস্থিরতার নতুন বীজ রোপিত হলো। আর জনগণের ক্ষমতা ও অধিকার সংবিধান নিয়ে আলোচনার মাঠেই থাকল না আর। সংবিধানে এগুলো আরও জোরালোভাবে গ্রথিত হওয়ার রাস্তাতেই আমরা উঠতে পারছি না। জনগণের ক্ষমতার মালিকানার দলিল হলো সংবিধান, কিন্তু এখন সেটা দলীয় ক্ষমতার মালিকানার দলিল হিসেবে পর্যবসিত হতে যাচ্ছে। সংবিধানকে দলীয় মালিকানার দলিলে পর্যবসিত করতে বড় সব রাজনৈতিক দলের সমান উৎসাহ ও ব্যাকুলতা—এই দলীয় ক্ষমতালিপ্সু স্বার্থ থেকে যদি প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো বেরিয়ে আসতে না পারে, তাহলে যারা তাদের অধিকারের কথা বলবে, সে রকম নতুন রাজনৈতিক দলকে জনগণ আজ হোক কাল হোক, খুঁজে পাবেই।
শাহ্দীন মালিক: জ্যেষ্ঠ আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।

No comments

Powered by Blogger.