নারী দিবসের ভাবনা by প্রফেসর ড. দিলারা হাফিজ
'৮ মার্চ বিশ্ব নারী দিবস'- এই বাক্যটি লিখতে গিয়ে আমার ভেতরে এক ধরনের আনন্দ-বেদনার অনুরণন অনুভব করছি। আনন্দ এ কারণে যে, একজন গর্বিত নারী হিসেবে এই দিবসটি শুধুই আমার এবং আমার মতো অগণিত নারীর জীবনে সদা সঞ্চারমান। বেদনা অনুভব করছি এই ভেবে যে, ৩৬৫ দিনের একটি বছরের মধ্যে শুধু একটি দিবসই নারীর জন্য নিবেদিত, অবশিষ্ট ৩৬৪ দিনই পুরুষের আধিপত্যে বন্দি।
হায় পিতৃতান্ত্রিক সমাজ- কবে তুমি জ্ঞানী হবে। রবীন্দ্রনাথের মতে বলবে- 'নারী-পুরুষের মিলনেই জীবন ও জগত সুন্দর, অর্থময়।'
হে আমার পুরুষ সহকর্মী, কবে বলবে তুমি এসো নারী- আমরা দুই মানব সন্তান ভাগ করে নিই আমাদের সম-অধিকার। এসো এই দুর্গম পথে ভাগ করে নিই আমাদের সব সত্য সুন্দর আর মাঙ্গলিক কর্মের পরিধিকে। এসো নারী, লিঙ্গীয় দৃষ্টিতে বিরাজমান বৈষম্যমূলক সব সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক এবং অন্যান্য আরো বৈষম্যমূলক প্রথা-ব্যবস্থাকে একত্রে আমরা আজ বিলুপ্ত ঘোষণা করি।
র্যাডিকেল নারীবাদী শার্লিট পারকিস গিলম্যান আপনাকে ধন্যবাদ। আপনি তো বলেছিলেন, 'নারীরা পায়ের শৃঙ্খলমুক্ত হয়ে, কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে, মুক্ত মানুষের মতো, এক মুক্ত মানবীর মতো বের হয়ে আসছে। নারীবাদ হলো সচেতনতার আন্দোলন; নারীবাদ হলো নারীত্বের পরাধীনতার ও দাসত্ব অবসানের আন্দোলন। ভোটাধিকার আন্দোলন এই দাসত্ব ও পরাধীনতা মোচনের আন্দোলনের একটা মঞ্চ তৈরি করে দিয়েছে।' যার ফলে ১৯০৬ সালে ইউরোপের প্রথম দেশ ফিনল্যান্ডে সর্বপ্রথম কোনো ধরনের শর্ত ছাড়াই নারীদের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই ভোটাধিকার আন্দোলনের মাধ্যমে যে সাংগঠনিক ভিত্তিভূমি ও জনসংযোগ তৈরি হয়েছিল, সেই ভিত্তিভূমি ও জনসংযোগ ব্যবহার করে নারীবাদ আজ আরো সম্পূর্ণ, আরো অগ্রসর, আরো বহুমাত্রিক ভাবনার ধারা ও কর্মভাবনায় ঋদ্ধ। এ কথা বলা বাহুল্য যে, শত শত বছরের অক্লান্ত সাহসী আত্মত্যাগী স্বাপি্নক দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী চিন্তক নর-নারীর সুদূরপ্রসারী ভাবনার ফলেই আমরা আজ নারী-পুরুষের মিলিত এক সমন্বিত উন্নত বিশ্বের স্বপ্ন দেখি, যে বিশ্বের নারী নিজের লিঙ্গের ওপর আস্থা রাখেন এবং গর্ববোধ করেন। আপন লিঙ্গীয় পরিচয় নিয়েই পুরুষের সঙ্গে জীবনের ক্ষেত্রে সম-অধিকারের ভিত্তিতে জীবন পরিচালনা করে বলতে চান:
বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।
সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকে নারীর কর্মের এই স্বীকৃতি কাব্যে কথনে ও সাহিত্যের পাতায় যতটা শোভা পায়, বাস্তবে ততটাই তা উপেক্ষিত।
নারীর উন্নয়ন কী উন্নত বিশ্বে; কী বা অনুন্নত দেশে- চিত্র প্রায় কাছাকাছি পর্যায়ে। পৃথিবীতে ধর্মে ধর্মে যত না বিদ্বেষ, নারী-পুরুষের তার চেয়ে অধিক। অথচ নারী-পুরুষের দুজনের সম্মিলন ছাড়া যেখানে সৃষ্টি ব্যর্থ- সেখানে আজো কত অনাসৃষ্টি, কতটা অসমতল ভূমির ফারাক। নারীর সৃজনশক্তি অপরিমেয়, অগাধ। তাই কি নারী নির্যাতনের শিকার? কারো মতে, লিঙ্গীয় ভিন্নতাই নারীর শোষণ ও বৈষম্যের মূল কারণ। কারো মতে, অর্থনৈতিকভাবে পরনির্ভরশীলতাই মূল কারণ। আর চর্যার পদকর্তার মতে, 'আপনা মাংসে হরিণা বৈরী'।
এই মীমাংসা আদৌ কোনো দিন শেষ হবে কি না, জানি না। তবে সর্বংসহা ধরিত্রীর মতো যে নারীমূর্তি তার কি রূপান্তর খুব আসন্ন? নারী আজ তাই নিজেকে দেখে আপন আয়নায়। তাঁর কাব্য ভাষায় ফুটে ওঠে প্রদীপ্ত ঘোষণা- আমি জানি, আমাকে ছাড়া পৃথিবী এগোবে না এক পা...
নারী
বহু ঝড়-জলোচ্ছ্বাস আর অগি্ন মাড়িয়ে
আজ আমি এখানে এসে দাঁড়িয়েছি একা....
সম্পূর্ণ একলা
নৈঃসঙ্গ্য ছাড়া কোনো বন্ধু ছিলো না আমার;
করতলে হাত রেখে
গোপন কোনো বেদনা জানাতে পারি অকপটে
এ রকম কোনো বন্ধু কখনো ছিলো না
অতিক্রান্ত এই দীর্ঘ যাত্রায়
কিছু শব্দ, বাক্য আর ছন্দের মিলমিশে
এক মেঘাবৃত্ত আকাশ ছায়া দিয়েছে মাথায়
ঝড় বিদ্যুৎ, তুষারপাত অগ্ন্যুৎপাত
আমার নিত্যসঙ্গী...
আমি এক অখ্যাত কন্যা সন্তান
আমার শারীরিক মূল্য দস্তা ও তামার দরের চেয়ে বেশি নয়
আমি ভুলে যাইনি
আইয়ামে জাহিলিয়া যুগে জন্মমাত্রই
আমাকে হত্যা করা হতো গলা টিপে
আমার জন্য গর্বিত হয় না কখনো
আমার পিতৃকুলের কেউ;
আমার ভাই সোনার দরে বিকোয় আজো
এই পড়ন্ত যৌবনেও
অলংকার গড়াবার মতো খাঁটি সোনা সে
বংশ রক্ষার প্রধান কবচ
আমি কেউ নই, কোথাও থাকি না আমি
কোথাও স্থিতি নেই আমার
তবু বহু ঝড় জলোচ্ছ্বাস আর অগি্ন মাড়িয়ে
আজ আমি এখনো এসে দাঁড়িয়েছি একা;
আমি জানি আমাকে ছাড়া
পৃথিবী এগোবে না এক পা...
লেখক : কবি, অধ্যক্ষ
সরকারি তিতুমীর কলেজ, ঢাকা
হে আমার পুরুষ সহকর্মী, কবে বলবে তুমি এসো নারী- আমরা দুই মানব সন্তান ভাগ করে নিই আমাদের সম-অধিকার। এসো এই দুর্গম পথে ভাগ করে নিই আমাদের সব সত্য সুন্দর আর মাঙ্গলিক কর্মের পরিধিকে। এসো নারী, লিঙ্গীয় দৃষ্টিতে বিরাজমান বৈষম্যমূলক সব সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক এবং অন্যান্য আরো বৈষম্যমূলক প্রথা-ব্যবস্থাকে একত্রে আমরা আজ বিলুপ্ত ঘোষণা করি।
র্যাডিকেল নারীবাদী শার্লিট পারকিস গিলম্যান আপনাকে ধন্যবাদ। আপনি তো বলেছিলেন, 'নারীরা পায়ের শৃঙ্খলমুক্ত হয়ে, কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে, মুক্ত মানুষের মতো, এক মুক্ত মানবীর মতো বের হয়ে আসছে। নারীবাদ হলো সচেতনতার আন্দোলন; নারীবাদ হলো নারীত্বের পরাধীনতার ও দাসত্ব অবসানের আন্দোলন। ভোটাধিকার আন্দোলন এই দাসত্ব ও পরাধীনতা মোচনের আন্দোলনের একটা মঞ্চ তৈরি করে দিয়েছে।' যার ফলে ১৯০৬ সালে ইউরোপের প্রথম দেশ ফিনল্যান্ডে সর্বপ্রথম কোনো ধরনের শর্ত ছাড়াই নারীদের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই ভোটাধিকার আন্দোলনের মাধ্যমে যে সাংগঠনিক ভিত্তিভূমি ও জনসংযোগ তৈরি হয়েছিল, সেই ভিত্তিভূমি ও জনসংযোগ ব্যবহার করে নারীবাদ আজ আরো সম্পূর্ণ, আরো অগ্রসর, আরো বহুমাত্রিক ভাবনার ধারা ও কর্মভাবনায় ঋদ্ধ। এ কথা বলা বাহুল্য যে, শত শত বছরের অক্লান্ত সাহসী আত্মত্যাগী স্বাপি্নক দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী চিন্তক নর-নারীর সুদূরপ্রসারী ভাবনার ফলেই আমরা আজ নারী-পুরুষের মিলিত এক সমন্বিত উন্নত বিশ্বের স্বপ্ন দেখি, যে বিশ্বের নারী নিজের লিঙ্গের ওপর আস্থা রাখেন এবং গর্ববোধ করেন। আপন লিঙ্গীয় পরিচয় নিয়েই পুরুষের সঙ্গে জীবনের ক্ষেত্রে সম-অধিকারের ভিত্তিতে জীবন পরিচালনা করে বলতে চান:
বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।
সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকে নারীর কর্মের এই স্বীকৃতি কাব্যে কথনে ও সাহিত্যের পাতায় যতটা শোভা পায়, বাস্তবে ততটাই তা উপেক্ষিত।
নারীর উন্নয়ন কী উন্নত বিশ্বে; কী বা অনুন্নত দেশে- চিত্র প্রায় কাছাকাছি পর্যায়ে। পৃথিবীতে ধর্মে ধর্মে যত না বিদ্বেষ, নারী-পুরুষের তার চেয়ে অধিক। অথচ নারী-পুরুষের দুজনের সম্মিলন ছাড়া যেখানে সৃষ্টি ব্যর্থ- সেখানে আজো কত অনাসৃষ্টি, কতটা অসমতল ভূমির ফারাক। নারীর সৃজনশক্তি অপরিমেয়, অগাধ। তাই কি নারী নির্যাতনের শিকার? কারো মতে, লিঙ্গীয় ভিন্নতাই নারীর শোষণ ও বৈষম্যের মূল কারণ। কারো মতে, অর্থনৈতিকভাবে পরনির্ভরশীলতাই মূল কারণ। আর চর্যার পদকর্তার মতে, 'আপনা মাংসে হরিণা বৈরী'।
এই মীমাংসা আদৌ কোনো দিন শেষ হবে কি না, জানি না। তবে সর্বংসহা ধরিত্রীর মতো যে নারীমূর্তি তার কি রূপান্তর খুব আসন্ন? নারী আজ তাই নিজেকে দেখে আপন আয়নায়। তাঁর কাব্য ভাষায় ফুটে ওঠে প্রদীপ্ত ঘোষণা- আমি জানি, আমাকে ছাড়া পৃথিবী এগোবে না এক পা...
নারী
বহু ঝড়-জলোচ্ছ্বাস আর অগি্ন মাড়িয়ে
আজ আমি এখানে এসে দাঁড়িয়েছি একা....
সম্পূর্ণ একলা
নৈঃসঙ্গ্য ছাড়া কোনো বন্ধু ছিলো না আমার;
করতলে হাত রেখে
গোপন কোনো বেদনা জানাতে পারি অকপটে
এ রকম কোনো বন্ধু কখনো ছিলো না
অতিক্রান্ত এই দীর্ঘ যাত্রায়
কিছু শব্দ, বাক্য আর ছন্দের মিলমিশে
এক মেঘাবৃত্ত আকাশ ছায়া দিয়েছে মাথায়
ঝড় বিদ্যুৎ, তুষারপাত অগ্ন্যুৎপাত
আমার নিত্যসঙ্গী...
আমি এক অখ্যাত কন্যা সন্তান
আমার শারীরিক মূল্য দস্তা ও তামার দরের চেয়ে বেশি নয়
আমি ভুলে যাইনি
আইয়ামে জাহিলিয়া যুগে জন্মমাত্রই
আমাকে হত্যা করা হতো গলা টিপে
আমার জন্য গর্বিত হয় না কখনো
আমার পিতৃকুলের কেউ;
আমার ভাই সোনার দরে বিকোয় আজো
এই পড়ন্ত যৌবনেও
অলংকার গড়াবার মতো খাঁটি সোনা সে
বংশ রক্ষার প্রধান কবচ
আমি কেউ নই, কোথাও থাকি না আমি
কোথাও স্থিতি নেই আমার
তবু বহু ঝড় জলোচ্ছ্বাস আর অগি্ন মাড়িয়ে
আজ আমি এখনো এসে দাঁড়িয়েছি একা;
আমি জানি আমাকে ছাড়া
পৃথিবী এগোবে না এক পা...
লেখক : কবি, অধ্যক্ষ
সরকারি তিতুমীর কলেজ, ঢাকা
No comments