অর্থনীতি-‘সিন্দুকতত্ত্ব’ ও কালো টাকার ‘বর্তমান বাস্তবতা’ by জায়েদ বখ্ত
২০১১-১২ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট ঘোষণার আগে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি ৪৮টি বাজেট প্রস্তাব জনসমক্ষে উপস্থাপন করে। এগুলোর একটিতে বাজেটে কালো টাকা সাদা করার বিধান না রাখার প্রস্তাবও ছিল। অতীতেও অর্থনীতি সমিতি কালো টাকা সাদা করার বিধানের বিরুদ্ধে সব সময় সোচ্চার ছিল।
কিন্তু গত ২৬ জুন অর্থনীতি সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এক অনুষ্ঠানে বাজেট নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে ১০ শতাংশ হারে কর দিয়ে অবকাঠামো তহবিল ও ট্রেজারি বন্ডে কালো টাকা বিনিয়োগের যে সুযোগ বাজেটে রাখা হয়েছে, তা সমর্থন করেন। তাঁরা যুক্তি হিসেবে বলেন যে যদিও অর্থনীতি সমিতি কালো টাকা বৈধ করাকে কখনোই নীতিগতভাবে সমর্থন করে না, কিন্তু বিষয়টি ‘বর্তমান বাস্তবতা’ বিবেচনায় নিয়ে দেখতে হবে। বর্তমান বাস্তবতার বিষয়টি ব্যাখ্যার আগে কালো টাকা নিয়ে সরকারি পর্যায়ে বিভ্রান্তির দিকটি আগে একটু উল্লেখ করা যাক।
সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের একটি সমীক্ষা প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, বাংলাদেশে আন্ডারগ্রাউন্ড বা কালো অর্থনীতির ব্যাপ্তি জিডিপির সর্বনিম্ন ৪৫ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ৮১ শতাংশ পর্যন্ত। অর্থমন্ত্রী তাঁর বাজেট-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনেও এ পরিসংখ্যান উল্লেখ করেছেন। এই প্রতিবেদন বিবেচনায় নিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কালো টাকা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়ার জন্য সুপারিশ করেছে বলে পত্রিকান্তরে খবর বেরিয়েছে। শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর সমর্থনের ভিত্তিতে অর্থমন্ত্রী বাজেটে এ সুযোগ অন্তর্ভুক্ত করার কথা সংসদে জানিয়েছেন। অর্থনীতি সমিতির ‘বাস্তবতা’ বিবেচনায় এই বিষয়টিও এসেছে বলে প্রতীয়মান হয়।
যেকোনো দেশের মতো বাংলাদেশের জাতীয় আয়ের হিসাবেও অনেক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হয় না। ‘নিজস্ব ভোগের জন্য উৎপাদন’ ও ‘অবৈধ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড’ অন্য দেশের মতো আমাদের দেশেও জাতীয় আয়ের হিসাবের বাইরে রাখা হয়। তা ছাড়া ইনফরমাল বা অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত ও সেবা খাতের কর্মকাণ্ডের একটা বড় অংশ পরিসংখ্যানব্যবস্থার দুর্বলতায় হিসাবের বাইরে থেকে যায়। কর প্রশাসনের দুর্বলতা ও দুর্নীতির সুযোগে করযোগ্য আয় আছে, এমন বহু লোক কর-জালের আওতার বাইরে থাকেন। অর্থাৎ, বৈধ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত আছেন, এমন অনেকে জাতীয় আয়ের হিসাব ও কর-জাল উভয়ের বাইরে অবস্থান করেন। এতে জাতীয় আয়, ভোগ ও সঞ্চয়ের যে হিসাব সরকারি সূত্রে পাওয়া যায়, প্রকৃত আয়, ভোগ ও সঞ্চয় তার চেয়ে নিশ্চিতভাবে অনেক বেশি। কিন্তু অর্থ বিভাগের সমীক্ষায় কালো অর্থনীতির যে ব্যাপ্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তা আঁতকে ওঠার মতো। আমাদের দেশে অবৈধ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড মূলত দুই ধরনের হয়ে থাকে—সীমান্ত চোরাচালান ও দেশি-বিদেশি পণ্যের নকল উৎপাদনের কার্যক্রম। এগুলোর ওপর নির্ভরযোগ্য তথ্য খুব একটা নেই। তবে বিআইডিএস ও অন্যান্য যে গবেষণা হয়েছে, তাতে এ ধরনের অবৈধ কর্মকাণ্ডের পরিমাণ বেশ বড় হলেও জাতীয় আয়ের শতকরা ৪৫ থেকে ৮১ ভাগ, এমন পরিসংখ্যান বাংলাদেশের অর্থনীতির সঙ্গে পরিচিত যে-কারোর জন্য মেনে নেওয়া কঠিন। স্পষ্টত, এখানে আন্ডারগ্রাউন্ড বা অবৈধ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং পুঞ্জীভূত কালো টাকার পরিমাণ—এই দুটি ভিন্ন বিষয়কে একসঙ্গে গুলিয়ে ফেলা হয়েছে।
কালো টাকার উৎস মূলত তিনটি—অবৈধ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, দুর্নীতির মাধ্যমে পাওয়া অর্থ এবং কর দেওয়া হয়নি, এমন বৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ বা অপ্রদর্শিত বৈধ আয়। কালো টাকা সাদা করার অর্থ হচ্ছে, এ ধরনের টাকার মালিককে অর্থসংক্রান্ত আইনি দায়দেনা থেকে অব্যাহতি দেওয়া।
অতীতে একসময় কালো টাকার ব্যাপ্তি সীমিত ছিল। কালো টাকার হাতে গোনা মালিকদের সমাজে কিছুটা হেয় চোখে দেখা হতো। এখন কালো টাকার ব্যাপ্তি অনেক বেড়ে যাওয়ায় সামাজিক অগ্রহণযোগ্যতা অনেক কমে এসেছে। কালো টাকার মালিকেরা অসংকোচে এ টাকা ভোগে ব্যবহার করেন। কালো টাকার একটা বড় অংশ এভাবে ভোগে ব্যবহূত হওয়ায় তা অর্থনীতির নিয়মিত অংশে পরিণত হয়ে যায়। তাই কালো টাকার বিশালত্বসংক্রান্ত ‘বাস্তবতা’র যুক্তিও প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
ভোগের পর যে টাকা অবশিষ্ট থাকে, তা হচ্ছে সঞ্চয়। কালো টাকার মালিকেরা এর একটা অংশ বিদেশে পাচার করেন বিদেশভ্রমণ, কেনাকাটা, বিনোদন, চিকিৎসা, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া ও কালো টাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য। এ ধরনের অর্থ পাচার ব্যাংকের মাধ্যমে ছাড়া বড়ভাবে করার সুযোগ নেই। এই অবৈধ অর্থ পাচারের বিষয়টিও অর্থনীতি সমিতির সভাপতির ‘বাস্তবতা’ বিবেচনায় এসেছে। কিন্তু একটি অবৈধ কার্যক্রমকে সীমিত করার জন্য আরেকটি অবৈধ কাজ মেনে নেওয়ার যুক্তি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। তা ছাড়া বড় পরিমাণের অর্থ পাচার যেহেতু ব্যাংকের মাধ্যমেই সম্ভব, তাই এটি ব্যাংক-নজরদারিরই সমস্যা। ব্যাংক-নজরদারি শক্তিশালী করেই এ সমস্যা সামাল দিতে হবে।
সঞ্চিত কালো টাকার বড় অংশই ব্যাংকে নামে ও বেনামে স্থায়ী আমানত হিসেবে থাকে। আর ব্যাংকে গচ্ছিত সব টাকাই অর্থনীতির মূল ধারায় থাকে। কেননা, ব্যাংক থেকে এই টাকা ঋণ নিয়েই বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করেন। অনেক ক্ষেত্রে কালো টাকার মালিকেরা স্থায়ী ভোগ্যপণ্য যেমন স্বর্ণালংকার, হীরা ইত্যাদি ও স্থায়ী সম্পদ যেমন জমিজমা, ফ্ল্যাট ও বাড়ি নামে-বেনামে কেনেন। এই বাড়তি চাহিদার কারণে স্বাভাবিকভাবেই বাজারে এসব সম্পদের মূল্য বেড়ে যায়। এই ‘বাস্তবতা’কে বিবেচনায় নিয়েও কালো টাকা সাদা করার পক্ষে এখন যুক্তি দেখানো হচ্ছে।
সামষ্টিক অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে নতুন বাড়ি বা ফ্ল্যাট নির্মাণ বা ক্রয় বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচিত হয়। কেননা, এটা অর্থনীতিতে আবাসনক্ষমতা বাড়ায় এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে সহায়তা করে। অন্যদিকে জমিজমা কিংবা পুরোনো বাড়ি ক্রয়ে শুধু মালিকানার পরিবর্তন হয় কিন্তু উৎপাদনক্ষমতা অপরিবর্তিত থাকায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখে না। আবার প্রাথমিক পুঁজিবাজারের (আইপিও) ক্ষেত্রেও প্রায় সব সময়ই পুঁজি সরবরাহের আধিক্য দেখা যায়। তাই কালো টাকা পুঁজিবাজারে আকৃষ্ট করার পদক্ষেপ মূলত সেকেন্ডারি বা দ্বিতীয় স্তরের বাজারকে চাঙা করার জন্য। কিন্তু জমিজমা ও পুরোনো বাড়ি বা ফ্ল্যাট ক্রয়ের মতো সেকেন্ডারি পুঁজিবাজার থেকে শেয়ার কেনা অর্থনীতির উৎপাদনক্ষমতায় কোনো অবদান রাখে না।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে কালো টাকার মালিকেরা নিজেরাই শিল্প বা অন্য উৎপাদনশীল খাতে কালো টাকা বিনিয়োগ করেন। যেমন কয়েক বছর আগে পত্রিকায় দেখা গিয়েছিল, তিতাস গ্যাসের একজন মিটার রিডার ঘুষের টাকায় একাধিক টেক্সটাইল মিল স্থাপন করেছেন। কিন্তু কালো টাকা অর্থনীতির মূল ধারায় রাখার জন্য কালো টাকার মালিকদের নিজের বিনিয়োগকারী হওয়ার প্রয়োজন নেই। অর্থনীতিতে সঞ্চয় করেন অনেকে। কিন্তু বিনিয়োগ করেন গুটি কয়েক লোক। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য যা দরকার, তা হচ্ছে সব সঞ্চয়—সেটা কালো বা সাদা যা-ই হোক—তা যেন বিনিয়োগকারীর প্রয়োজনে ব্যবহার করা যায়।
এটা আগেই বলা হয়েছে, বর্ধিত ভোগ, স্থায়ী ভোগ্যপণ্য ও অন্যান্য সম্পদ ক্রয় ও ব্যাংকে স্থায়ী আমানতে রাখার মাধ্যমে কালো টাকা ইতিমধ্যেই অর্থনীতির মূল ধারায় রয়েছে। তাই কালো টাকাকে সাদা করার সুযোগ দিয়ে কালো টাকার মালিককে দায়মুক্ত করা ছাড়া ও সরকারের কিছু রাজস্ব পাওয়া ছাড়া অর্থনীতিতে আর বেশি সুফল পাওয়ার খুব একটা সুযোগ নেই। বরং অনৈতিকতাকে সমর্থনের মাধ্যমে ভবিষ্যতে অর্থনীতিতে আরও কালো টাকা সৃষ্টির প্রচেষ্টাকেই এটা উৎসাহিত করবে।
অর্থনীতি সমিতির সভাপতি আরেকটি ‘বাস্তবতা’কে বিবেচনায় নিতে বলেছেন। সেটি হলো ব্যাংকে তারল্য-সংকট। তাঁর মতে, এর জন্য মূলত কালো টাকার মালিকেরাই দায়ী। তাঁর ব্যাখ্যাটি এ রকম, কালো টাকার মালিকেরা গত ছয় মাসে আগের তুলনায় তিন গুণ বেশি সিন্দুক বাজার থেকে কিনে সেগুলোয় কালো টাকা বোঝাই করে রাখছেন। আর এ জন্যই ব্যাংকে তারল্য-সংকট দেখা দিয়েছে। অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য মেনে ধরে নেওয়া যায়, ২০১০ সালে জিডিপির সর্বোচ্চ ৮১ শতাংশ কালো টাকা; অর্থাৎ প্রায় পাঁচ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা। এর এক-চতুর্থাংশও যদি নগদ অবস্থায় থাকে, তা হলে প্রায় এক লাখ ৩৭ হাজার কোটি টাকা অর্থনীতি সমিতির সভাপতির বক্তব্য অনুসারে সিন্দুকে বোঝাই করা হয়েছে। তিনি অবশ্য বলেননি, তিন গুণ সিন্দুক বিক্রির তথ্য কটি প্রতিষ্ঠান থেকে নেওয়া হয়েছে বা এই প্রতিষ্ঠান সব ঢাকায় অবস্থিত কি না এবং বিক্রীত সিন্দুকের মাপ কী। তাই এই এক লাখ ৩৭ হাজার কোটি টাকা নতুন কেনা সিন্দুকে রাখার জন্য স্থানের সংকুলান হবে কি না, তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না!
তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের উপাত্ত থেকে এই ‘সিন্দুকতত্ত্বের’র সমর্থনে কোনো তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। রিজার্ভ মুদ্রা মূলত তিনটি জায়গায় অবস্থান করে: ১. ব্যাংকের ভল্টে ২. ব্যাংকের আমানত হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকে এবং ৩. ব্যাংকের বাইরে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের উপাত্ত অনুসারে, ডিসেম্বর ২০১০ থেকে ফেব্রুয়ারি ২০১১—এই তিন মাসে ব্যাংকের ভল্টে রক্ষিত অর্থ চার হাজার ৯৬৪ কোটি থেকে বেড়ে পাঁচ হাজার ৪২৬ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। একই সময়ে ব্যাংকের বাইরে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে থাকা টাকার পরিমাণ ৫২ হাজার ৯১৮ কোটি থেকে কমে ৫১ হাজার ৯১৮ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।
ব্যাংকের বর্তমান তারল্য-সংকটের প্রধান কারণ হচ্ছে, ঋণ-আমানতের অনুপাত ঠিক করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের চাপ। যেহেতু অনেক ব্যাংকই অনুমোদিত অনুপাতের চেয়ে বেশি ঋণ ইতিপূর্বেই দিয়ে ফেলেছে, তাই এখন তারা বাংলাদেশ ব্যাংকে অতিরিক্ত ডিপোজিট রাখা সত্ত্বেও ঋণযোগ্য তহবিল না থাকায় তারল্য-সংকটে ভুগছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের উপাত্ত অনুসারে, আলোচ্য তিন মাসে ব্যাংকের অতিরিক্ত আমানত হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকে রক্ষিত অর্থের পরিমাণ সাত হাজার ১৮৩ কোটি থেকে বেড়ে আট হাজার ২২৫ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।
সুতরাং, কালো টাকা সাদা করার ব্যাপারে অর্থনীতি সমিতির এই অবস্থান পরিবর্তনের পেছনে ‘সিন্দুকতত্ত্বের’ ব্যাখ্যা সঠিক বলে মনে হয় না। একইভাবে, বিপুল পরিমাণে কালো টাকা অর্থনীতির মূল ধারার বাইরে আছে এবং সাদা করার সুযোগ দিয়ে এই টাকা উৎপাদনশীল খাতে নিয়ে আসতে হবে—এ যুক্তিও ‘বাস্তবতার’ বিচারে সঠিক প্রতীয়মান হয় না।
জায়েদ বখ্ত: গবেষণা পরিচালক, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)।
rzbakht@yahoo.com
সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের একটি সমীক্ষা প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, বাংলাদেশে আন্ডারগ্রাউন্ড বা কালো অর্থনীতির ব্যাপ্তি জিডিপির সর্বনিম্ন ৪৫ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ৮১ শতাংশ পর্যন্ত। অর্থমন্ত্রী তাঁর বাজেট-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনেও এ পরিসংখ্যান উল্লেখ করেছেন। এই প্রতিবেদন বিবেচনায় নিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কালো টাকা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়ার জন্য সুপারিশ করেছে বলে পত্রিকান্তরে খবর বেরিয়েছে। শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর সমর্থনের ভিত্তিতে অর্থমন্ত্রী বাজেটে এ সুযোগ অন্তর্ভুক্ত করার কথা সংসদে জানিয়েছেন। অর্থনীতি সমিতির ‘বাস্তবতা’ বিবেচনায় এই বিষয়টিও এসেছে বলে প্রতীয়মান হয়।
যেকোনো দেশের মতো বাংলাদেশের জাতীয় আয়ের হিসাবেও অনেক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হয় না। ‘নিজস্ব ভোগের জন্য উৎপাদন’ ও ‘অবৈধ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড’ অন্য দেশের মতো আমাদের দেশেও জাতীয় আয়ের হিসাবের বাইরে রাখা হয়। তা ছাড়া ইনফরমাল বা অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত ও সেবা খাতের কর্মকাণ্ডের একটা বড় অংশ পরিসংখ্যানব্যবস্থার দুর্বলতায় হিসাবের বাইরে থেকে যায়। কর প্রশাসনের দুর্বলতা ও দুর্নীতির সুযোগে করযোগ্য আয় আছে, এমন বহু লোক কর-জালের আওতার বাইরে থাকেন। অর্থাৎ, বৈধ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত আছেন, এমন অনেকে জাতীয় আয়ের হিসাব ও কর-জাল উভয়ের বাইরে অবস্থান করেন। এতে জাতীয় আয়, ভোগ ও সঞ্চয়ের যে হিসাব সরকারি সূত্রে পাওয়া যায়, প্রকৃত আয়, ভোগ ও সঞ্চয় তার চেয়ে নিশ্চিতভাবে অনেক বেশি। কিন্তু অর্থ বিভাগের সমীক্ষায় কালো অর্থনীতির যে ব্যাপ্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তা আঁতকে ওঠার মতো। আমাদের দেশে অবৈধ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড মূলত দুই ধরনের হয়ে থাকে—সীমান্ত চোরাচালান ও দেশি-বিদেশি পণ্যের নকল উৎপাদনের কার্যক্রম। এগুলোর ওপর নির্ভরযোগ্য তথ্য খুব একটা নেই। তবে বিআইডিএস ও অন্যান্য যে গবেষণা হয়েছে, তাতে এ ধরনের অবৈধ কর্মকাণ্ডের পরিমাণ বেশ বড় হলেও জাতীয় আয়ের শতকরা ৪৫ থেকে ৮১ ভাগ, এমন পরিসংখ্যান বাংলাদেশের অর্থনীতির সঙ্গে পরিচিত যে-কারোর জন্য মেনে নেওয়া কঠিন। স্পষ্টত, এখানে আন্ডারগ্রাউন্ড বা অবৈধ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং পুঞ্জীভূত কালো টাকার পরিমাণ—এই দুটি ভিন্ন বিষয়কে একসঙ্গে গুলিয়ে ফেলা হয়েছে।
কালো টাকার উৎস মূলত তিনটি—অবৈধ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, দুর্নীতির মাধ্যমে পাওয়া অর্থ এবং কর দেওয়া হয়নি, এমন বৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ বা অপ্রদর্শিত বৈধ আয়। কালো টাকা সাদা করার অর্থ হচ্ছে, এ ধরনের টাকার মালিককে অর্থসংক্রান্ত আইনি দায়দেনা থেকে অব্যাহতি দেওয়া।
অতীতে একসময় কালো টাকার ব্যাপ্তি সীমিত ছিল। কালো টাকার হাতে গোনা মালিকদের সমাজে কিছুটা হেয় চোখে দেখা হতো। এখন কালো টাকার ব্যাপ্তি অনেক বেড়ে যাওয়ায় সামাজিক অগ্রহণযোগ্যতা অনেক কমে এসেছে। কালো টাকার মালিকেরা অসংকোচে এ টাকা ভোগে ব্যবহার করেন। কালো টাকার একটা বড় অংশ এভাবে ভোগে ব্যবহূত হওয়ায় তা অর্থনীতির নিয়মিত অংশে পরিণত হয়ে যায়। তাই কালো টাকার বিশালত্বসংক্রান্ত ‘বাস্তবতা’র যুক্তিও প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
ভোগের পর যে টাকা অবশিষ্ট থাকে, তা হচ্ছে সঞ্চয়। কালো টাকার মালিকেরা এর একটা অংশ বিদেশে পাচার করেন বিদেশভ্রমণ, কেনাকাটা, বিনোদন, চিকিৎসা, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া ও কালো টাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য। এ ধরনের অর্থ পাচার ব্যাংকের মাধ্যমে ছাড়া বড়ভাবে করার সুযোগ নেই। এই অবৈধ অর্থ পাচারের বিষয়টিও অর্থনীতি সমিতির সভাপতির ‘বাস্তবতা’ বিবেচনায় এসেছে। কিন্তু একটি অবৈধ কার্যক্রমকে সীমিত করার জন্য আরেকটি অবৈধ কাজ মেনে নেওয়ার যুক্তি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। তা ছাড়া বড় পরিমাণের অর্থ পাচার যেহেতু ব্যাংকের মাধ্যমেই সম্ভব, তাই এটি ব্যাংক-নজরদারিরই সমস্যা। ব্যাংক-নজরদারি শক্তিশালী করেই এ সমস্যা সামাল দিতে হবে।
সঞ্চিত কালো টাকার বড় অংশই ব্যাংকে নামে ও বেনামে স্থায়ী আমানত হিসেবে থাকে। আর ব্যাংকে গচ্ছিত সব টাকাই অর্থনীতির মূল ধারায় থাকে। কেননা, ব্যাংক থেকে এই টাকা ঋণ নিয়েই বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করেন। অনেক ক্ষেত্রে কালো টাকার মালিকেরা স্থায়ী ভোগ্যপণ্য যেমন স্বর্ণালংকার, হীরা ইত্যাদি ও স্থায়ী সম্পদ যেমন জমিজমা, ফ্ল্যাট ও বাড়ি নামে-বেনামে কেনেন। এই বাড়তি চাহিদার কারণে স্বাভাবিকভাবেই বাজারে এসব সম্পদের মূল্য বেড়ে যায়। এই ‘বাস্তবতা’কে বিবেচনায় নিয়েও কালো টাকা সাদা করার পক্ষে এখন যুক্তি দেখানো হচ্ছে।
সামষ্টিক অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে নতুন বাড়ি বা ফ্ল্যাট নির্মাণ বা ক্রয় বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচিত হয়। কেননা, এটা অর্থনীতিতে আবাসনক্ষমতা বাড়ায় এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে সহায়তা করে। অন্যদিকে জমিজমা কিংবা পুরোনো বাড়ি ক্রয়ে শুধু মালিকানার পরিবর্তন হয় কিন্তু উৎপাদনক্ষমতা অপরিবর্তিত থাকায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখে না। আবার প্রাথমিক পুঁজিবাজারের (আইপিও) ক্ষেত্রেও প্রায় সব সময়ই পুঁজি সরবরাহের আধিক্য দেখা যায়। তাই কালো টাকা পুঁজিবাজারে আকৃষ্ট করার পদক্ষেপ মূলত সেকেন্ডারি বা দ্বিতীয় স্তরের বাজারকে চাঙা করার জন্য। কিন্তু জমিজমা ও পুরোনো বাড়ি বা ফ্ল্যাট ক্রয়ের মতো সেকেন্ডারি পুঁজিবাজার থেকে শেয়ার কেনা অর্থনীতির উৎপাদনক্ষমতায় কোনো অবদান রাখে না।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে কালো টাকার মালিকেরা নিজেরাই শিল্প বা অন্য উৎপাদনশীল খাতে কালো টাকা বিনিয়োগ করেন। যেমন কয়েক বছর আগে পত্রিকায় দেখা গিয়েছিল, তিতাস গ্যাসের একজন মিটার রিডার ঘুষের টাকায় একাধিক টেক্সটাইল মিল স্থাপন করেছেন। কিন্তু কালো টাকা অর্থনীতির মূল ধারায় রাখার জন্য কালো টাকার মালিকদের নিজের বিনিয়োগকারী হওয়ার প্রয়োজন নেই। অর্থনীতিতে সঞ্চয় করেন অনেকে। কিন্তু বিনিয়োগ করেন গুটি কয়েক লোক। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য যা দরকার, তা হচ্ছে সব সঞ্চয়—সেটা কালো বা সাদা যা-ই হোক—তা যেন বিনিয়োগকারীর প্রয়োজনে ব্যবহার করা যায়।
এটা আগেই বলা হয়েছে, বর্ধিত ভোগ, স্থায়ী ভোগ্যপণ্য ও অন্যান্য সম্পদ ক্রয় ও ব্যাংকে স্থায়ী আমানতে রাখার মাধ্যমে কালো টাকা ইতিমধ্যেই অর্থনীতির মূল ধারায় রয়েছে। তাই কালো টাকাকে সাদা করার সুযোগ দিয়ে কালো টাকার মালিককে দায়মুক্ত করা ছাড়া ও সরকারের কিছু রাজস্ব পাওয়া ছাড়া অর্থনীতিতে আর বেশি সুফল পাওয়ার খুব একটা সুযোগ নেই। বরং অনৈতিকতাকে সমর্থনের মাধ্যমে ভবিষ্যতে অর্থনীতিতে আরও কালো টাকা সৃষ্টির প্রচেষ্টাকেই এটা উৎসাহিত করবে।
অর্থনীতি সমিতির সভাপতি আরেকটি ‘বাস্তবতা’কে বিবেচনায় নিতে বলেছেন। সেটি হলো ব্যাংকে তারল্য-সংকট। তাঁর মতে, এর জন্য মূলত কালো টাকার মালিকেরাই দায়ী। তাঁর ব্যাখ্যাটি এ রকম, কালো টাকার মালিকেরা গত ছয় মাসে আগের তুলনায় তিন গুণ বেশি সিন্দুক বাজার থেকে কিনে সেগুলোয় কালো টাকা বোঝাই করে রাখছেন। আর এ জন্যই ব্যাংকে তারল্য-সংকট দেখা দিয়েছে। অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য মেনে ধরে নেওয়া যায়, ২০১০ সালে জিডিপির সর্বোচ্চ ৮১ শতাংশ কালো টাকা; অর্থাৎ প্রায় পাঁচ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা। এর এক-চতুর্থাংশও যদি নগদ অবস্থায় থাকে, তা হলে প্রায় এক লাখ ৩৭ হাজার কোটি টাকা অর্থনীতি সমিতির সভাপতির বক্তব্য অনুসারে সিন্দুকে বোঝাই করা হয়েছে। তিনি অবশ্য বলেননি, তিন গুণ সিন্দুক বিক্রির তথ্য কটি প্রতিষ্ঠান থেকে নেওয়া হয়েছে বা এই প্রতিষ্ঠান সব ঢাকায় অবস্থিত কি না এবং বিক্রীত সিন্দুকের মাপ কী। তাই এই এক লাখ ৩৭ হাজার কোটি টাকা নতুন কেনা সিন্দুকে রাখার জন্য স্থানের সংকুলান হবে কি না, তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না!
তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের উপাত্ত থেকে এই ‘সিন্দুকতত্ত্বের’র সমর্থনে কোনো তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। রিজার্ভ মুদ্রা মূলত তিনটি জায়গায় অবস্থান করে: ১. ব্যাংকের ভল্টে ২. ব্যাংকের আমানত হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকে এবং ৩. ব্যাংকের বাইরে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের উপাত্ত অনুসারে, ডিসেম্বর ২০১০ থেকে ফেব্রুয়ারি ২০১১—এই তিন মাসে ব্যাংকের ভল্টে রক্ষিত অর্থ চার হাজার ৯৬৪ কোটি থেকে বেড়ে পাঁচ হাজার ৪২৬ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। একই সময়ে ব্যাংকের বাইরে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে থাকা টাকার পরিমাণ ৫২ হাজার ৯১৮ কোটি থেকে কমে ৫১ হাজার ৯১৮ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।
ব্যাংকের বর্তমান তারল্য-সংকটের প্রধান কারণ হচ্ছে, ঋণ-আমানতের অনুপাত ঠিক করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের চাপ। যেহেতু অনেক ব্যাংকই অনুমোদিত অনুপাতের চেয়ে বেশি ঋণ ইতিপূর্বেই দিয়ে ফেলেছে, তাই এখন তারা বাংলাদেশ ব্যাংকে অতিরিক্ত ডিপোজিট রাখা সত্ত্বেও ঋণযোগ্য তহবিল না থাকায় তারল্য-সংকটে ভুগছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের উপাত্ত অনুসারে, আলোচ্য তিন মাসে ব্যাংকের অতিরিক্ত আমানত হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকে রক্ষিত অর্থের পরিমাণ সাত হাজার ১৮৩ কোটি থেকে বেড়ে আট হাজার ২২৫ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।
সুতরাং, কালো টাকা সাদা করার ব্যাপারে অর্থনীতি সমিতির এই অবস্থান পরিবর্তনের পেছনে ‘সিন্দুকতত্ত্বের’ ব্যাখ্যা সঠিক বলে মনে হয় না। একইভাবে, বিপুল পরিমাণে কালো টাকা অর্থনীতির মূল ধারার বাইরে আছে এবং সাদা করার সুযোগ দিয়ে এই টাকা উৎপাদনশীল খাতে নিয়ে আসতে হবে—এ যুক্তিও ‘বাস্তবতার’ বিচারে সঠিক প্রতীয়মান হয় না।
জায়েদ বখ্ত: গবেষণা পরিচালক, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)।
rzbakht@yahoo.com
No comments