সৌদি দূতাবাস কর্মকর্তা খুন-গুলিবিদ্ধ অবস্থায় প্রাইভেট কার থেকে ফেলে দেওয়া হয় by রেজোয়ান বিশ্বাস
ঢাকায় সৌদি আরব দূতাবাসের কর্মকর্তা খালাফ আল আলী হত্যার কারণ এখন পর্যন্ত নিশ্চিত না হলেও কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছে পুলিশ। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় খালাফকে একটি প্রাইভেট কার থেকে রাস্তার পাশে ফেলে দেওয়া হয় বলে জানতে পেরেছেন ঘটনার তদন্তে যুক্ত পুলিশসহ অন্যান্য সংস্থার কর্মকর্তারা।
এ বিষয়ে তথ্যদানকারী আনোয়ার হোসেন নামের এক ব্যক্তিকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশের একটি বিশেষ দল।
পুলিশের তদন্তদল বলেছে, গভীর রাতে খালাফ নিয়মিত হাঁটাহাঁটির জন্য বাইরে অন্যত্র সময় দিতেন কি না সেটা
যাচাই করা হচ্ছে। তাঁর দেশি-বিদেশি বন্ধুদের সহায়তায় পুলিশ ও র্যাব হত্যার কারণ অনুসন্ধানে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছে। এদিকে খালাফের মৃত্যুর ঘটনায় গতকাল বুধবার অজ্ঞাতপরিচয় দুষ্কৃতকারীদের আসামি করে গুলশান থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। হত্যা মামলাটির বাদী হয়েছে পুলিশ। ঘটনাটি তদন্ত করছে পুলিশের পাশাপাশি র্যাব ও অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থা।
গতকাল দুপুরে সৌদি দূতাবাসের কূটনীতিকসহ সাত সদস্যের একটি দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। এ সময় র্যাব ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সৌদি কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও তদন্তকারীদের সঙ্গে কথা বলে ঘটনার বিষয়ে প্রাথমিক ধারণা নিচ্ছেন বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান।
গত সোমবার মধ্যরাতে রাজধানীর গুলশানে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় খালাফকে উদ্ধার করে দ্রুত ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি করে পুলিশ। গতকাল মঙ্গলবার ভোর সোয়া ৫টার দিকে তাঁর মৃত্যু হয়।
প্রত্যক্ষদর্শী খোঁজা হচ্ছে : আনোয়ার হোসেন নামের এক ব্যক্তিকে গতকাল দুপুর ২টার দিকে আটক করেছে র্যাব। তিনি গুলির ঘটনার সম্ভাব্য প্রত্যক্ষদর্শী বলে মনে করা হচ্ছে।
আটকের আগে আনোয়ার সাংবাদিকদের জানান, গত সোমবার দিবাগত রাতে তিনি গুলশান-২-এর ১১৭ নম্বর সড়কের কনস্যুলেট অব পর্তুগাল ভবনের ভেতরে ছিলেন। রাত ১টার পর তিনি ভবনের ভেতরে পানির কল ছেড়ে চেয়ারে গিয়ে বসেন। এ সময় হঠাৎ বিকট শব্দ শুনতে পান। তাঁর কাছে মনে হয়, গাড়ির টায়ারের বিস্ফোরণ হয়েছে। এর পরপরই 'ও-মা' বলে একটি শব্দ পান। শব্দের উৎস খুঁজতে তিনি প্রাচীরের পাশে এগিয়ে যান। দেখতে পান প্রাচীরের পাশে একটি সাদা প্রাইভেটকার দাঁড়িয়ে আছে। ওই প্রাইভেটকারের সামনের দরোজা খোলা। একজন লোক প্রাইভেটকার থেকে অপর একজনকে রাস্তায় ফেলে দেয়। এরপর দ্রুত গাড়ি চালিয়ে চলে যায়। পরে রাস্তায় পড়ে থাকা ওই ব্যক্তির কাছে যান তিনি।
আনোয়ার জানান, একটি হাত উঁচু করে রাখা লোকটি তখন জীবিত বলে বোঝা যাচ্ছিল। এরপর তিনি চিৎকার করলে আরো কয়েকজন ঘটনাস্থলে ছুটে আসে এবং ভবন নিরাপত্তার সাইরেন বেজে ওঠে। পরে টেলিফোনে খবর দেওয়া হয়।
আনোয়ার জানান, পরে তিনি জেনেছেন গুলিবিদ্ধ লোকটি মারা গেছেন। পেশায় টিউবওয়েল মিস্ত্রি আনোয়ার কনস্যুলেট অব পর্তুগাল ভবনের ভেতর সংস্কারকাজে নিয়োজিত ছিলেন।
তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, এ ঘটনার এখন পর্যন্ত প্রত্যক্ষদর্শী পাওয়া যায়নি। সে কারণে রহস্য উদ্ঘাটন জটিল হয়ে পড়েছে। হত্যার কারণ সম্পর্কেও ধারণা মিলছে না।
ঘটনাস্থল পরিদর্শনে সৌদি রাষ্ট্রদূত : বাংলাদেশে নিযুক্ত সৌদি রাষ্ট্রদূত ড. আবদুল্লাহ আল বুশাইরিসহ সৌদি দূতাবাসের আরো কয়েকজন কর্মকর্তা গতকাল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। র্যাব ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাঁদের সঙ্গে ছিলেন।
ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে সৌদি রাষ্ট্রদূতের কাছে সার্বিক বিষয়ে সাংবাদিকরা জানতে চান। তিনি বলেন, 'আমাদের একজন কূটনৈতিক কর্মী গুলশানে তাঁর বাসার সামনে নিহত হয়েছেন। এটি দুঃখজনক। আমরা প্রথমে ধারণা করেছিলাম, তাঁকে ছিনতাইকারীরা হত্যা করেছে। তবে এখন মনে হচ্ছে ঘটনার পেছনে অন্য কারণও থাকতে পারে।'
সৌদি রাষ্ট্রদূত আরো বলেন, 'বাংলাদেশ পুলিশের তদন্তের ওপর আমাদের আস্থা আছে। আমরা তাদের বিশ্বাস করি। আমি আশা করি, বাংলাদেশ পুলিশ এর রহস্য বের করতে পারবে।' তিনি মনে করেন, বাংলাদেশ সরকারকে বিপদে ফেলতেও কেউ এ ঘটনা ঘটাতে পারে। তবে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি তাঁদের আস্থা রয়েছে বলে তিনি জানান।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত র্যাব-১-এর পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল রাশিদুল আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা সৌদি রাষ্ট্রদূতকে বিষয়টি সম্পর্কে ধারণা দিয়েছি। তিনি আমাদের কাছে তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে ধারণা নিয়েছেন।'
র্যাবের এ কর্মকর্তা বলেন, তাঁরা (সৌদি কর্মকর্তারা) প্রথমে মনে করেছিলেন ছিনতাইকারীরা খালাফকে হত্যা করেছে। কিন্তু পরে তাঁরা বুঝতে পেরেছেন এ ঘটনার আরো অনেক কারণ থাকতে পারে। সরকারকে হেয় করতেও কেউ খালাফকে হত্যা করতে পারে। দেশে ও দেশের বাইরে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে কেউ এ ঘটনা ঘটাতে পারে।
জিজ্ঞাসাবাদ : ঘটনার পর আটক করা আনোয়ার ছাড়াও খালাফের গাড়িচালক, আশপাশের ভবনের বাসিন্দা, ওই এলাকার বিভিন্ন ভবনের নিরাপত্তাকর্মীহ আরো অনেককে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন তদন্তকারীরা। হত্যার কারণ ও খুনিদের পরিচয় নিশ্চিত না হলেও তাঁরা অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছেন বলে দাবি করেছেন। তবে তদন্তে প্রকাশযোগ্য কোনো অগ্রগতি নেই বলে জানিয়েছেন তাঁরা।
গ্রেপ্তার নেই : পুলিশের গুলশান বিভাগের সহকারী কমিশনার শাহনেওয়াজ খালেদ গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, এ ঘটনায় এখনো কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। ঘটনার কারণ ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় কে বা কারা জড়িত, কেন তাঁকে হত্যা করা হয়েছে, সে বিষয়গুলো নিয়ে তদন্ত চলছে। তদন্তকারী সংস্থাগুলো শিগগিরই ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনতে সক্ষম হবে বলে তিনি দাবি করেন।
পুলিশ বাদী হয়ে মামলা : গতকাল দুপুর ১টার দিকে পুলিশ বাদী হয়ে গুলশান থানায় একটি মামলা দায়ের করেছে। এতে আসামি করা হয়েছে অজ্ঞাতপরিচয় দুষ্কৃতকারীদের।
গুলশান থানার ওসি রফিকুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে অজ্ঞাতপরিচয় দুষ্কৃতকারীরা খালাফকে গুলি করে হত্যা করেছে।
ওসি বলেন, খালাফের ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন গতকাল দুপুরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছেন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একটি গুলিতে খালাফের মৃত্যু হয়েছে। তাঁর শরীরে অন্য কোনো আঘাত বা জখমের চিহ্ন পাওয়া যায়নি।
পুলিশ জানায়, মামলা দায়েরের আগে এ নিয়ে সৌদি দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাদের কয়েক দফা বৈঠক হয়েছে।
সৌদি রাষ্ট্রদূতের লিগ্যাল অ্যাডভাইজার অ্যাডভোকেট জসিম উদ্দিন মামলার লিখিত অভিযোগ তৈরি করেন। সেটি সৌদি দূতাবাসের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করার পর তাদের পরামর্শ অনুযায়ী পুলিশ মামলাটি দায়ের করে।
আরব নেতাদের নিন্দা : আমাদের কূটনৈতিক প্রতিবেদক জানান, ঢাকায় সৌদি দূতাবাসের কর্মকর্তা খালাফ আল আলীকে হত্যার ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছেন আরব দেশগুলোর নেতারা। তাঁরা পৃথক বিবৃতি ও বার্তায় দূতাবাস কর্মকর্তার ওপর গুলি চালানোকে 'সন্ত্রাসবাদী কাজ' বলে অভিহিত করেছেন। এ ছাড়া আরব নেতারা নিহত খালাফ আল আলীকে 'কূটনীতিক' হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
কুয়েত নিউজ এজেন্সি প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, কুয়েতের আমির শেখ সাবাহ গত মঙ্গলবার সৌদি বাদশাহর কাছে শোকবার্তা পাঠান। তাতে তিনি শোক প্রকাশের পাশাপাশি গুলি চালানোর নিন্দা জানান।
কুয়েতের যুবরাজ শেখ নাওয়াফ আল-আহমাদ আল-জাবের আল-সাবাহ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ জাবের মুবারাক আল-হামাদ আল-সাবাহও সৌদি বাদশাহর কাছে অনুরূপ বার্তা পাঠিয়েছেন।
বাহরাইনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ খালিদ বিন আহমাদ আল খলিফা ওই হত্যাকাণ্ডকে 'যুদ্ধের অংশ' হিসেবে উল্লেখ করেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টুইটারে এক বার্তায় তিনি লিখেছেন, ওই হত্যার পেছনে অশুভ অপশক্তি ও অপরাধীদের হাত রয়েছে।
জর্দানের বার্তা সংস্থা পেট্রা নিউজ এজেন্সি বলেছে, জর্দান বাংলাদেশে সৌদি দূতাবাসের কর্মকর্তা হত্যাকাণ্ডকে 'ঘৃণ্য' ও 'সন্ত্রাসবাদী কাজ' হিসেবে দেখছে। জর্দান সরকারের মুখপাত্র ও যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী রাকান আল-মাজালি বলেছেন, তাঁর দেশ বাংলাদেশে ওই দূতাবাস কর্মকর্তা হত্যার তীব্র নিন্দা জানায়। সংযুক্ত আরব আমিরাতও খালাফ আল আলী হত্যার নিন্দা জানিয়েছে।
জর্দানে বদলির অপেক্ষায় ছিলেন খালাফ : সৌদি দূতাবাস সূত্র জানিয়েছে, খালাফ আল আলী আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই ঢাকা থেকে জর্দানের রাজধানী আম্মানে সৌদি দূতাবাসে বদলির অপেক্ষায় ছিলেন। ঢাকায় তিনি প্রায় দুই বছর দায়িত্ব পালন করেছেন। এর আগে তিনি আজারবাইজানে দায়িত্ব পালন করেন।
কর্মীদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দেওয়ার আহ্বান : সৌদি সরকার ঢাকায় সে দেশের দূতাবাস ও সংশ্লিষ্ট অফিসের সব কর্মীর প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। গতকাল সৌদি আরবের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত বিবৃতিতে এ আহ্বান জানানো হয়।
ঢাকায় পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, সৌদি দূতাবাসের পক্ষ থেকেও তাদের কর্মীদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য অনুরোধ এসেছে।
পুলিশের তদন্তদল বলেছে, গভীর রাতে খালাফ নিয়মিত হাঁটাহাঁটির জন্য বাইরে অন্যত্র সময় দিতেন কি না সেটা
যাচাই করা হচ্ছে। তাঁর দেশি-বিদেশি বন্ধুদের সহায়তায় পুলিশ ও র্যাব হত্যার কারণ অনুসন্ধানে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছে। এদিকে খালাফের মৃত্যুর ঘটনায় গতকাল বুধবার অজ্ঞাতপরিচয় দুষ্কৃতকারীদের আসামি করে গুলশান থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। হত্যা মামলাটির বাদী হয়েছে পুলিশ। ঘটনাটি তদন্ত করছে পুলিশের পাশাপাশি র্যাব ও অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থা।
গতকাল দুপুরে সৌদি দূতাবাসের কূটনীতিকসহ সাত সদস্যের একটি দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। এ সময় র্যাব ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সৌদি কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও তদন্তকারীদের সঙ্গে কথা বলে ঘটনার বিষয়ে প্রাথমিক ধারণা নিচ্ছেন বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান।
গত সোমবার মধ্যরাতে রাজধানীর গুলশানে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় খালাফকে উদ্ধার করে দ্রুত ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি করে পুলিশ। গতকাল মঙ্গলবার ভোর সোয়া ৫টার দিকে তাঁর মৃত্যু হয়।
প্রত্যক্ষদর্শী খোঁজা হচ্ছে : আনোয়ার হোসেন নামের এক ব্যক্তিকে গতকাল দুপুর ২টার দিকে আটক করেছে র্যাব। তিনি গুলির ঘটনার সম্ভাব্য প্রত্যক্ষদর্শী বলে মনে করা হচ্ছে।
আটকের আগে আনোয়ার সাংবাদিকদের জানান, গত সোমবার দিবাগত রাতে তিনি গুলশান-২-এর ১১৭ নম্বর সড়কের কনস্যুলেট অব পর্তুগাল ভবনের ভেতরে ছিলেন। রাত ১টার পর তিনি ভবনের ভেতরে পানির কল ছেড়ে চেয়ারে গিয়ে বসেন। এ সময় হঠাৎ বিকট শব্দ শুনতে পান। তাঁর কাছে মনে হয়, গাড়ির টায়ারের বিস্ফোরণ হয়েছে। এর পরপরই 'ও-মা' বলে একটি শব্দ পান। শব্দের উৎস খুঁজতে তিনি প্রাচীরের পাশে এগিয়ে যান। দেখতে পান প্রাচীরের পাশে একটি সাদা প্রাইভেটকার দাঁড়িয়ে আছে। ওই প্রাইভেটকারের সামনের দরোজা খোলা। একজন লোক প্রাইভেটকার থেকে অপর একজনকে রাস্তায় ফেলে দেয়। এরপর দ্রুত গাড়ি চালিয়ে চলে যায়। পরে রাস্তায় পড়ে থাকা ওই ব্যক্তির কাছে যান তিনি।
আনোয়ার জানান, একটি হাত উঁচু করে রাখা লোকটি তখন জীবিত বলে বোঝা যাচ্ছিল। এরপর তিনি চিৎকার করলে আরো কয়েকজন ঘটনাস্থলে ছুটে আসে এবং ভবন নিরাপত্তার সাইরেন বেজে ওঠে। পরে টেলিফোনে খবর দেওয়া হয়।
আনোয়ার জানান, পরে তিনি জেনেছেন গুলিবিদ্ধ লোকটি মারা গেছেন। পেশায় টিউবওয়েল মিস্ত্রি আনোয়ার কনস্যুলেট অব পর্তুগাল ভবনের ভেতর সংস্কারকাজে নিয়োজিত ছিলেন।
তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, এ ঘটনার এখন পর্যন্ত প্রত্যক্ষদর্শী পাওয়া যায়নি। সে কারণে রহস্য উদ্ঘাটন জটিল হয়ে পড়েছে। হত্যার কারণ সম্পর্কেও ধারণা মিলছে না।
ঘটনাস্থল পরিদর্শনে সৌদি রাষ্ট্রদূত : বাংলাদেশে নিযুক্ত সৌদি রাষ্ট্রদূত ড. আবদুল্লাহ আল বুশাইরিসহ সৌদি দূতাবাসের আরো কয়েকজন কর্মকর্তা গতকাল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। র্যাব ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাঁদের সঙ্গে ছিলেন।
ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে সৌদি রাষ্ট্রদূতের কাছে সার্বিক বিষয়ে সাংবাদিকরা জানতে চান। তিনি বলেন, 'আমাদের একজন কূটনৈতিক কর্মী গুলশানে তাঁর বাসার সামনে নিহত হয়েছেন। এটি দুঃখজনক। আমরা প্রথমে ধারণা করেছিলাম, তাঁকে ছিনতাইকারীরা হত্যা করেছে। তবে এখন মনে হচ্ছে ঘটনার পেছনে অন্য কারণও থাকতে পারে।'
সৌদি রাষ্ট্রদূত আরো বলেন, 'বাংলাদেশ পুলিশের তদন্তের ওপর আমাদের আস্থা আছে। আমরা তাদের বিশ্বাস করি। আমি আশা করি, বাংলাদেশ পুলিশ এর রহস্য বের করতে পারবে।' তিনি মনে করেন, বাংলাদেশ সরকারকে বিপদে ফেলতেও কেউ এ ঘটনা ঘটাতে পারে। তবে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি তাঁদের আস্থা রয়েছে বলে তিনি জানান।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত র্যাব-১-এর পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল রাশিদুল আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা সৌদি রাষ্ট্রদূতকে বিষয়টি সম্পর্কে ধারণা দিয়েছি। তিনি আমাদের কাছে তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে ধারণা নিয়েছেন।'
র্যাবের এ কর্মকর্তা বলেন, তাঁরা (সৌদি কর্মকর্তারা) প্রথমে মনে করেছিলেন ছিনতাইকারীরা খালাফকে হত্যা করেছে। কিন্তু পরে তাঁরা বুঝতে পেরেছেন এ ঘটনার আরো অনেক কারণ থাকতে পারে। সরকারকে হেয় করতেও কেউ খালাফকে হত্যা করতে পারে। দেশে ও দেশের বাইরে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে কেউ এ ঘটনা ঘটাতে পারে।
জিজ্ঞাসাবাদ : ঘটনার পর আটক করা আনোয়ার ছাড়াও খালাফের গাড়িচালক, আশপাশের ভবনের বাসিন্দা, ওই এলাকার বিভিন্ন ভবনের নিরাপত্তাকর্মীহ আরো অনেককে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন তদন্তকারীরা। হত্যার কারণ ও খুনিদের পরিচয় নিশ্চিত না হলেও তাঁরা অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছেন বলে দাবি করেছেন। তবে তদন্তে প্রকাশযোগ্য কোনো অগ্রগতি নেই বলে জানিয়েছেন তাঁরা।
গ্রেপ্তার নেই : পুলিশের গুলশান বিভাগের সহকারী কমিশনার শাহনেওয়াজ খালেদ গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, এ ঘটনায় এখনো কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। ঘটনার কারণ ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় কে বা কারা জড়িত, কেন তাঁকে হত্যা করা হয়েছে, সে বিষয়গুলো নিয়ে তদন্ত চলছে। তদন্তকারী সংস্থাগুলো শিগগিরই ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনতে সক্ষম হবে বলে তিনি দাবি করেন।
পুলিশ বাদী হয়ে মামলা : গতকাল দুপুর ১টার দিকে পুলিশ বাদী হয়ে গুলশান থানায় একটি মামলা দায়ের করেছে। এতে আসামি করা হয়েছে অজ্ঞাতপরিচয় দুষ্কৃতকারীদের।
গুলশান থানার ওসি রফিকুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে অজ্ঞাতপরিচয় দুষ্কৃতকারীরা খালাফকে গুলি করে হত্যা করেছে।
ওসি বলেন, খালাফের ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন গতকাল দুপুরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছেন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একটি গুলিতে খালাফের মৃত্যু হয়েছে। তাঁর শরীরে অন্য কোনো আঘাত বা জখমের চিহ্ন পাওয়া যায়নি।
পুলিশ জানায়, মামলা দায়েরের আগে এ নিয়ে সৌদি দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাদের কয়েক দফা বৈঠক হয়েছে।
সৌদি রাষ্ট্রদূতের লিগ্যাল অ্যাডভাইজার অ্যাডভোকেট জসিম উদ্দিন মামলার লিখিত অভিযোগ তৈরি করেন। সেটি সৌদি দূতাবাসের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করার পর তাদের পরামর্শ অনুযায়ী পুলিশ মামলাটি দায়ের করে।
আরব নেতাদের নিন্দা : আমাদের কূটনৈতিক প্রতিবেদক জানান, ঢাকায় সৌদি দূতাবাসের কর্মকর্তা খালাফ আল আলীকে হত্যার ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছেন আরব দেশগুলোর নেতারা। তাঁরা পৃথক বিবৃতি ও বার্তায় দূতাবাস কর্মকর্তার ওপর গুলি চালানোকে 'সন্ত্রাসবাদী কাজ' বলে অভিহিত করেছেন। এ ছাড়া আরব নেতারা নিহত খালাফ আল আলীকে 'কূটনীতিক' হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
কুয়েত নিউজ এজেন্সি প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, কুয়েতের আমির শেখ সাবাহ গত মঙ্গলবার সৌদি বাদশাহর কাছে শোকবার্তা পাঠান। তাতে তিনি শোক প্রকাশের পাশাপাশি গুলি চালানোর নিন্দা জানান।
কুয়েতের যুবরাজ শেখ নাওয়াফ আল-আহমাদ আল-জাবের আল-সাবাহ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ জাবের মুবারাক আল-হামাদ আল-সাবাহও সৌদি বাদশাহর কাছে অনুরূপ বার্তা পাঠিয়েছেন।
বাহরাইনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ খালিদ বিন আহমাদ আল খলিফা ওই হত্যাকাণ্ডকে 'যুদ্ধের অংশ' হিসেবে উল্লেখ করেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টুইটারে এক বার্তায় তিনি লিখেছেন, ওই হত্যার পেছনে অশুভ অপশক্তি ও অপরাধীদের হাত রয়েছে।
জর্দানের বার্তা সংস্থা পেট্রা নিউজ এজেন্সি বলেছে, জর্দান বাংলাদেশে সৌদি দূতাবাসের কর্মকর্তা হত্যাকাণ্ডকে 'ঘৃণ্য' ও 'সন্ত্রাসবাদী কাজ' হিসেবে দেখছে। জর্দান সরকারের মুখপাত্র ও যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী রাকান আল-মাজালি বলেছেন, তাঁর দেশ বাংলাদেশে ওই দূতাবাস কর্মকর্তা হত্যার তীব্র নিন্দা জানায়। সংযুক্ত আরব আমিরাতও খালাফ আল আলী হত্যার নিন্দা জানিয়েছে।
জর্দানে বদলির অপেক্ষায় ছিলেন খালাফ : সৌদি দূতাবাস সূত্র জানিয়েছে, খালাফ আল আলী আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই ঢাকা থেকে জর্দানের রাজধানী আম্মানে সৌদি দূতাবাসে বদলির অপেক্ষায় ছিলেন। ঢাকায় তিনি প্রায় দুই বছর দায়িত্ব পালন করেছেন। এর আগে তিনি আজারবাইজানে দায়িত্ব পালন করেন।
কর্মীদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দেওয়ার আহ্বান : সৌদি সরকার ঢাকায় সে দেশের দূতাবাস ও সংশ্লিষ্ট অফিসের সব কর্মীর প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। গতকাল সৌদি আরবের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত বিবৃতিতে এ আহ্বান জানানো হয়।
ঢাকায় পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, সৌদি দূতাবাসের পক্ষ থেকেও তাদের কর্মীদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য অনুরোধ এসেছে।
No comments