নারী দিবস এবং মিডিয়ায় নারী by সঞ্জীব রায়
নারী দিবস আসে নারী দিবস যায়। কী বদলায়? নারীর প্রতি সহিংসতার নিত্যনতুন পন্থা ও পদ্ধতি শিখছি আমরা। যে সামন্তবাদী সংস্কৃতিকে শেকড়ে নিয়ে বেড়ে ওঠা এই জাতির, সেই জাতি আজ মেট্রোপলিশ-কর্পোরেট কালচারের সিগ্রেটটা টানতেই পছন্দ করছে।
আর এখনো যারা গ্রামীণ জীবনযাত্রাকে ধারণ করছেন, তাদের কাছে লৈঙ্গিক সম্পর্কটা অনেকাংশে ইতিবাচকভাবে বদলেছে। বরং তার প্রেক্ষিতে শহুরে জীবনকে জড়িয়ে ধরা আধুনিক বাঙ্গালির জীবনে নারী-পুরুষ সম্পর্কটা বহুরূপী এক আকার নিয়েছে। এই আকারকে এক এক সময় এক এক রকম মনে হতে পারে যে কারো কাছে।
নারী জাতির ঐতিহাসিক মহাপরাজয়ের পটভূমি বলতে গিয়ে এঙ্গেলস বলেছিলেন, জগতের সমস্ত মানবিক বৈষম্যের মূলে রয়েছে পুরুষাধিপত্য ও নারীর অধীনতা। লৈঙ্গিক রাজনীতির ভিত্তির ওপরই দাঁড়িয়ে আছে সব সামাজিক, রাজনীতিক, অর্থনৈতিক সংগঠন। তাই আজ বিশেষভাবেই লৈঙ্গিক সম্পর্ক, লিঙ্গ বৈষম্য, এই সম্পর্ক চর্চার নতুন ধারা এবং তার ব্যবহারিক দিকগুলো নিয়ে ভাববার, কথা বলবার প্রয়োজন অনুধাবন করা দরকার একটা বৃহৎ পরিসরে।
সমাজের অগ্রসরমান শ্রেণী হিসেবে সব সময়ই বিবেচনা করা হয়েছে শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের। শিক্ষক-শিক্ষার্থী, শিক্ষানুরাগী তথা শিক্ষিত শ্রেণী। আজ আমরা এই নারী দিবসকে ঘিরে যতো তত্ত¡-তথ্য, সেমিনার-পর্যালোচনা দেখছি, সবকিছুর মূলেই কিন্তু এই শিক্ষিত শ্রেণীর অবদান।
নারী অধিকার, সম অধিকার ও নারীর ক্ষমতায়নের যতো তত্ত্বায়ন আমরা দেখছি, সবকিছুই আসছে শিক্ষিত অগ্রবর্তীশীল শ্রেণীর মস্তিষ্ক থেকে। অথচ, এই শিক্ষিত-জ্ঞানচর্চাকারী শ্রেণীতে নারী-পুরুষের যে সম্পর্ক বিরাজমান তার মুখোশহীন রূপটা কী? পূঁজিবাদকে আলিঙ্গন করে যে আধুনিক সমাজ গড়ার নেশায় বুদ সমাজ, তার অংশ হিসেবে নিজেদের মধ্যকার লৈঙ্গিক কাঠামোটিকে কিভাবে পরিচালনা করা হচ্ছে, সেটা একটু ঘেটে দেখবার তাগিদ তৈরি হয়েছে।
এই তাগিদটাকে পূরণ করতে যদি এই মুহূর্তে ক্ষেত্র হিসেবে মিডিয়াকে বেছে নেওয়া হয়, নিশ্চয়ই অনেকে নাক সিঁটকাবেন। নিশ্চয়ই অনেকে বিরক্ত হবেন! কিন্তু একই সঙ্গে শিক্ষিত, আধুনিক, পরিবর্তনকামী, প্রগতিবাদী, সমাজ সচেতন, মানবিক (আরো অনেকগুলো বিশেষণ দেওয়া সম্ভব) হিসেবে এই মিডিয়াকর্মীদের বিবেচনা করে সবচেয়ে ভালো অনুসন্ধানটা এখান থেকে হতে পারে।
আমরা যে পুরুষতান্ত্রিক তরীটাতে ভেসে চলেছি, সেখানে নারী অবদমিত, নারী পীড়িত এবং অধীনস্ত। অতএব, লৈঙ্গিক বৈষম্যের স্বরূপ উন্মোচন করতে গেলে নারীর অবস্থানকে আমরা পুরুষতান্ত্রিক চিন্তাকাঠামো, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, সামাজিক মর্যাদাগতভাবে নিচের দিকে খুঁজে পাবো। মিডিয়াকে অনেকেই বলছেন, সমাজের দর্পণ। এই দর্পণে কেমন দেখছেন নারীকে? মিডিয়ায় নারীর অবস্থান বলি আর অংশগ্রহণ বলি, তা কখনো একটি দিক থেকে বিবেচনা করা যাবে না। একদিকে যেমন মিডিয়া নারীকে উপস্থাপনের দায়িত্ব পালন করছে, অন্যদিকে তেমনি মিডিয়া ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশে কাজ করছে নারী। উপস্থাপন এবং অংশগ্রহণের দ্বিবিধ এলাকা থেকে নারীর বাস্তবতাকে পর্যালোচনা করা যেতে পারে।
উপস্থাপিত নারী একটি পণ্য, যে পণ্যকে যতো বেশি রংচং মেখে হাজির করা যাবে, ততো ভালো হবে ব্যবসা। কাঁচাবাজারে গেলে যেমন দেখি, লাউ-কুমড়া-শিম অথবা গতদিনের লালশাক-পুঁইয়ে পানি ছিটিয়ে টসটসে করে তোলার চেষ্টা চলছে, তেমনি আমাদের মিডিয়া বাজারে একটা অদম্য-অসম্ভব সৃজনশীল চেষ্টা আছে উপস্থাপনের। এই সৃজনশীলতা পরিদর্শনে যে যতো বেশি সফল তার বাণিজ্য ততোটাই চাঙ্গা। এই উপস্থাপনবাদিতা নিয়ে ঢের আলাপ পারছেন সমালোচকরা। বোধ করি একটু আলাপ হওয়া উচিৎ, ভেতরের জগৎটা নিয়ে যেখানে নারী মিডিয়াকর্মীরা কাজ করছেন।
বেশি দূরে নয়, শুরু করি প্রিয় শিক্ষক রুমানা মঞ্জুরের ঘটনা দিয়ে। খুব স্বাভাবিকভাবেই রুমানা মঞ্জুরের ঘটনা কভার করতে পাঠানো হলো আমার অফিসের নারী সহকর্মীকে। সেই নারী সহকর্মী রুমানা আপার সংবাদ সম্মেলন থেকে বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহ কভার করার পরবর্তী সময়ে আমার আগ্রহ-আকাঙ্খা থেকে জানতে চাইলাম, আসলে এখন কী অবস্থা! গোটা আলাপের পর সেই নারী সহকর্মীর কাছ থেকে এমন কিছু অভিমত পেলাম, মন্তব্য-মতামত পেলাম, যা আমাকে যারপরনাই হতাশ করলো, মানসিকভাবে অত্যাচারিত করলো।
অনেকটা ঠাট্টা-মশকরার সুরে আমার সেই সহকর্মী নারীটি নির্যাতনের শিকার রুমানা মঞ্জুরের পরকীয়া সম্পর্ক, অসততা, স্বামী কর্তার প্রতি দায়িত্বশীলতা নিয়ে বিস্তর দোষারোপ করতে শুরু করেছিলেন। কাউকে কিছু বলার নেই, শুধু ভাবলাম, শিক্ষিত-মেধাবী-প্রগতিবাদী একজন গণমাধ্যমকর্মী যে নিজে এই পুরুষতন্ত্রের বৈষম্য ব্যবস্থার শিকার, একজন নারী হয়েও যখন স্বামী কর্তৃক আক্রান্ত রুমানা মঞ্জুরের পরকীয়া নিয়ে রসিয়ে খিস্তি করতে পারেন, তখন নারী-পুরুষের সম্পর্ক নিয়ে ভাবনার জায়গাটি আসলেই কোথায় আটকে আছে!
একটা এমন চিন্তা কাঠামো আমাদের এই চলতি ব্যবস্থায় তৈরি করা হয়েছে, যে কাঠামোর পুরোটাতে অধিপতিশীল পুরুষ। দোষ বলি, ভুল বলি, পরকীয়া বলি, চোখ খুবলে অন্ধ হওয়া বলি, ধর্ষণের শিকার বলি, খোলামেলা পোশাক চর্চা বলি, প্রেম প্রেম খেলা বলি, সব অপরাধই যেনো নারীর! পুরুষ যেভাবে, যে মাত্রায়ই এখানে জড়িত বা সম্পৃক্ত থাকুক না কেনো, সে নিরপরাধ! সবচেয়ে দুর্ভাগ্য আমাদের নারীকে এই অপরাধী ভাবার মানাসিকতাটা নারীর মধ্যেও প্রবলভাবে গ্রোথিত।
অফিস থেকে বের হচ্ছিলাম, হঠাৎ আমাকে একদিকে ডেকে নিয়ে নীচুস্বরে আমার এক সহকর্মী বড় আপা(গণমাধ্যমকর্মী) জিজ্ঞেস করলেন, ‘কিরে, তোর বান্ধবীর নামে কি শুনলাম? ওর নাকি ভিডিও বাইর হইছে? এরপর তার উপচেপড়া আগ্রহ! এখানে এই নারী সহকর্মীর দোষারোপ-আকাঙ্খা-অভিযোগ সবকিছুর তীর আমার বান্ধবী মিডিয়াকর্মীর ওপর। সেই মেয়েটি এখন একটি টেলিভিশনে সংবাদ উপস্থাপন করছেন। তারও ক্যারিয়ার শুরু এই মিডিয়ায় আজ থেকে পাঁচ বছর আগে সংবাদ উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে। অনেক রুঢ় বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়েছে, এই সময়ের মধ্যে। এখনো নিজের সম্মান এবং আত্মমর্যাদা ধরে রেখেছেন বলেই শুধু আমার নারী সংবাদকর্মী সহকর্মীটিই নয়, মিডিয়ায় কাজ করছেন অনেকেই মজা পেয়েছেন তাকে নিয়ে নানা কথা বলে।
সেদিন আমার সেই বন্ধুটি বলছিলেন যে, তার প্রথম স্টেশনে যখন এমডি তাকে কুপ্রস্তাব দিলেন তখনই তিনি মনে মনে দুটি বিকল্প চিন্তা করেছিলেন। প্রথমত, মিডিয়া ছেড়ে দেওয়া এবং দ্বিতীয়ত, এসব মুখোশধারীদের চ্যালেঞ্জ করে-এড়িয়ে মিডিয়ায় টিকে থাকা। একটা লড়াকু মনোভাব ছিলো তার। তাই দ্বিতীয় সিদ্ধান্তটি নিয়েছিলেন আমার সেই বন্ধু। চারদিকের চাপে আর বিরক্তিতে দেশ ছেড়ে চলে যাবার সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী সেই বন্ধুটি খুব আক্ষেপ করে বলছিলেন, ‘সেদিন আমার প্রথম সিদ্ধান্তটা নেওয়াই ভালো হতো। এখন মনে হয় ভুল করেছি।’
সত্যিই জানি না, আমার সেই বন্ধু ভুল করেছিলেন কি না! কিন্তু এটুকু জানি, মিডিয়ায় নারীর জন্য সুস্থ-সুন্দর পরিবেশ ফেরাতে হবে। নারী-পুরুষের বৈষম্য যে বহুমুখী বৈষম্যের জন্ম দেয়, সেই বৈষম্যের বৃত্ত ভাঙ্গতে হবে। মিডিয়ায় কি সুস্থ মানসিকতার মানুষেরা কাজ করবেন না? মিডিয়ায় যে মেয়েটা কাজ করতে আসবেন, তিনি কি আমার বান্ধবীর মতো দুটি বিকল্প সিদ্ধান্ত থেকে একটি বেছে নেবেন? নাকি এর কোনোটাই না নিয়ে আত্মমর্যাদা বিলিয়ে দেবেন, পুরুষতন্ত্রের নোংরা খায়েস চরিতার্থ করবেন?
শেষ করবো আমার এক বড় ভাইয়ের একটা মানসিকতার ছোট্ট উদাহরণ দিয়ে। সেই বড় ভাই মিডিয়ায় পার করছেন দীর্ঘদিন। জনপ্রিয় একটি টেলিভিশনের মুখচেনা সিনিয়র সাংবাদিক তিনি। অ্যাসাইনমেন্টে গেলেই নানা গল্পের ফাঁকে তিনি বলেন এবং বিশ্বাস করতে বলেন, যে নারী মিডিয়াকর্মীর চেহারাই টিভি পর্দায় দেখা যায়, তিনিই মালিক বা কোনো বসকে খুশি করে সেই জায়গাটি অর্জন করেছেন। যার হাতে টেলিভিশনের বুম উঠেছে, তিনিই নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন। লজ্জায় নিজেকে আর ভাবতে ইচ্ছে করে না, একজন গণমাধ্যমকর্মী। কিন্তু লড়াইয়ের তীব্র নেশায় শেষে ভাবি, এইসব পুরুষাধিপত্যশীল অপচিন্তা অসুস্থ চিন্তার পরাজয় হবেই। পরাজয় ঘটাতে হবে।
নারীর প্রতি পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতাকে কঠোর হাতে লড়তে হবে। তার জন্য চাই, নারী মিডিয়াকর্মীর সাহসী মনোভাব, পুরুষতন্ত্রের সৃষ্ট মানসিক কাঠামোকে ভেঙ্গে ফেলার প্রত্যয়। বিশ্বাস করি, সমাজকে এগিয়ে নিতে বৈষম্যের এই নষ্ট ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়বেই। পুরুষাধিপত্য কিংবা নারীর নয়, আমরা জিতে নেবোই নেবো একটি মানুষের পৃথিবী, একটা মানবিক সমাজ।
সঞ্জীব রায়: রিপোর্টার, সময় টেলিভিশন
royratan.sanjib@gmail.com
নারী জাতির ঐতিহাসিক মহাপরাজয়ের পটভূমি বলতে গিয়ে এঙ্গেলস বলেছিলেন, জগতের সমস্ত মানবিক বৈষম্যের মূলে রয়েছে পুরুষাধিপত্য ও নারীর অধীনতা। লৈঙ্গিক রাজনীতির ভিত্তির ওপরই দাঁড়িয়ে আছে সব সামাজিক, রাজনীতিক, অর্থনৈতিক সংগঠন। তাই আজ বিশেষভাবেই লৈঙ্গিক সম্পর্ক, লিঙ্গ বৈষম্য, এই সম্পর্ক চর্চার নতুন ধারা এবং তার ব্যবহারিক দিকগুলো নিয়ে ভাববার, কথা বলবার প্রয়োজন অনুধাবন করা দরকার একটা বৃহৎ পরিসরে।
সমাজের অগ্রসরমান শ্রেণী হিসেবে সব সময়ই বিবেচনা করা হয়েছে শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের। শিক্ষক-শিক্ষার্থী, শিক্ষানুরাগী তথা শিক্ষিত শ্রেণী। আজ আমরা এই নারী দিবসকে ঘিরে যতো তত্ত¡-তথ্য, সেমিনার-পর্যালোচনা দেখছি, সবকিছুর মূলেই কিন্তু এই শিক্ষিত শ্রেণীর অবদান।
নারী অধিকার, সম অধিকার ও নারীর ক্ষমতায়নের যতো তত্ত্বায়ন আমরা দেখছি, সবকিছুই আসছে শিক্ষিত অগ্রবর্তীশীল শ্রেণীর মস্তিষ্ক থেকে। অথচ, এই শিক্ষিত-জ্ঞানচর্চাকারী শ্রেণীতে নারী-পুরুষের যে সম্পর্ক বিরাজমান তার মুখোশহীন রূপটা কী? পূঁজিবাদকে আলিঙ্গন করে যে আধুনিক সমাজ গড়ার নেশায় বুদ সমাজ, তার অংশ হিসেবে নিজেদের মধ্যকার লৈঙ্গিক কাঠামোটিকে কিভাবে পরিচালনা করা হচ্ছে, সেটা একটু ঘেটে দেখবার তাগিদ তৈরি হয়েছে।
এই তাগিদটাকে পূরণ করতে যদি এই মুহূর্তে ক্ষেত্র হিসেবে মিডিয়াকে বেছে নেওয়া হয়, নিশ্চয়ই অনেকে নাক সিঁটকাবেন। নিশ্চয়ই অনেকে বিরক্ত হবেন! কিন্তু একই সঙ্গে শিক্ষিত, আধুনিক, পরিবর্তনকামী, প্রগতিবাদী, সমাজ সচেতন, মানবিক (আরো অনেকগুলো বিশেষণ দেওয়া সম্ভব) হিসেবে এই মিডিয়াকর্মীদের বিবেচনা করে সবচেয়ে ভালো অনুসন্ধানটা এখান থেকে হতে পারে।
আমরা যে পুরুষতান্ত্রিক তরীটাতে ভেসে চলেছি, সেখানে নারী অবদমিত, নারী পীড়িত এবং অধীনস্ত। অতএব, লৈঙ্গিক বৈষম্যের স্বরূপ উন্মোচন করতে গেলে নারীর অবস্থানকে আমরা পুরুষতান্ত্রিক চিন্তাকাঠামো, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, সামাজিক মর্যাদাগতভাবে নিচের দিকে খুঁজে পাবো। মিডিয়াকে অনেকেই বলছেন, সমাজের দর্পণ। এই দর্পণে কেমন দেখছেন নারীকে? মিডিয়ায় নারীর অবস্থান বলি আর অংশগ্রহণ বলি, তা কখনো একটি দিক থেকে বিবেচনা করা যাবে না। একদিকে যেমন মিডিয়া নারীকে উপস্থাপনের দায়িত্ব পালন করছে, অন্যদিকে তেমনি মিডিয়া ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশে কাজ করছে নারী। উপস্থাপন এবং অংশগ্রহণের দ্বিবিধ এলাকা থেকে নারীর বাস্তবতাকে পর্যালোচনা করা যেতে পারে।
উপস্থাপিত নারী একটি পণ্য, যে পণ্যকে যতো বেশি রংচং মেখে হাজির করা যাবে, ততো ভালো হবে ব্যবসা। কাঁচাবাজারে গেলে যেমন দেখি, লাউ-কুমড়া-শিম অথবা গতদিনের লালশাক-পুঁইয়ে পানি ছিটিয়ে টসটসে করে তোলার চেষ্টা চলছে, তেমনি আমাদের মিডিয়া বাজারে একটা অদম্য-অসম্ভব সৃজনশীল চেষ্টা আছে উপস্থাপনের। এই সৃজনশীলতা পরিদর্শনে যে যতো বেশি সফল তার বাণিজ্য ততোটাই চাঙ্গা। এই উপস্থাপনবাদিতা নিয়ে ঢের আলাপ পারছেন সমালোচকরা। বোধ করি একটু আলাপ হওয়া উচিৎ, ভেতরের জগৎটা নিয়ে যেখানে নারী মিডিয়াকর্মীরা কাজ করছেন।
বেশি দূরে নয়, শুরু করি প্রিয় শিক্ষক রুমানা মঞ্জুরের ঘটনা দিয়ে। খুব স্বাভাবিকভাবেই রুমানা মঞ্জুরের ঘটনা কভার করতে পাঠানো হলো আমার অফিসের নারী সহকর্মীকে। সেই নারী সহকর্মী রুমানা আপার সংবাদ সম্মেলন থেকে বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহ কভার করার পরবর্তী সময়ে আমার আগ্রহ-আকাঙ্খা থেকে জানতে চাইলাম, আসলে এখন কী অবস্থা! গোটা আলাপের পর সেই নারী সহকর্মীর কাছ থেকে এমন কিছু অভিমত পেলাম, মন্তব্য-মতামত পেলাম, যা আমাকে যারপরনাই হতাশ করলো, মানসিকভাবে অত্যাচারিত করলো।
অনেকটা ঠাট্টা-মশকরার সুরে আমার সেই সহকর্মী নারীটি নির্যাতনের শিকার রুমানা মঞ্জুরের পরকীয়া সম্পর্ক, অসততা, স্বামী কর্তার প্রতি দায়িত্বশীলতা নিয়ে বিস্তর দোষারোপ করতে শুরু করেছিলেন। কাউকে কিছু বলার নেই, শুধু ভাবলাম, শিক্ষিত-মেধাবী-প্রগতিবাদী একজন গণমাধ্যমকর্মী যে নিজে এই পুরুষতন্ত্রের বৈষম্য ব্যবস্থার শিকার, একজন নারী হয়েও যখন স্বামী কর্তৃক আক্রান্ত রুমানা মঞ্জুরের পরকীয়া নিয়ে রসিয়ে খিস্তি করতে পারেন, তখন নারী-পুরুষের সম্পর্ক নিয়ে ভাবনার জায়গাটি আসলেই কোথায় আটকে আছে!
একটা এমন চিন্তা কাঠামো আমাদের এই চলতি ব্যবস্থায় তৈরি করা হয়েছে, যে কাঠামোর পুরোটাতে অধিপতিশীল পুরুষ। দোষ বলি, ভুল বলি, পরকীয়া বলি, চোখ খুবলে অন্ধ হওয়া বলি, ধর্ষণের শিকার বলি, খোলামেলা পোশাক চর্চা বলি, প্রেম প্রেম খেলা বলি, সব অপরাধই যেনো নারীর! পুরুষ যেভাবে, যে মাত্রায়ই এখানে জড়িত বা সম্পৃক্ত থাকুক না কেনো, সে নিরপরাধ! সবচেয়ে দুর্ভাগ্য আমাদের নারীকে এই অপরাধী ভাবার মানাসিকতাটা নারীর মধ্যেও প্রবলভাবে গ্রোথিত।
অফিস থেকে বের হচ্ছিলাম, হঠাৎ আমাকে একদিকে ডেকে নিয়ে নীচুস্বরে আমার এক সহকর্মী বড় আপা(গণমাধ্যমকর্মী) জিজ্ঞেস করলেন, ‘কিরে, তোর বান্ধবীর নামে কি শুনলাম? ওর নাকি ভিডিও বাইর হইছে? এরপর তার উপচেপড়া আগ্রহ! এখানে এই নারী সহকর্মীর দোষারোপ-আকাঙ্খা-অভিযোগ সবকিছুর তীর আমার বান্ধবী মিডিয়াকর্মীর ওপর। সেই মেয়েটি এখন একটি টেলিভিশনে সংবাদ উপস্থাপন করছেন। তারও ক্যারিয়ার শুরু এই মিডিয়ায় আজ থেকে পাঁচ বছর আগে সংবাদ উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে। অনেক রুঢ় বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়েছে, এই সময়ের মধ্যে। এখনো নিজের সম্মান এবং আত্মমর্যাদা ধরে রেখেছেন বলেই শুধু আমার নারী সংবাদকর্মী সহকর্মীটিই নয়, মিডিয়ায় কাজ করছেন অনেকেই মজা পেয়েছেন তাকে নিয়ে নানা কথা বলে।
সেদিন আমার সেই বন্ধুটি বলছিলেন যে, তার প্রথম স্টেশনে যখন এমডি তাকে কুপ্রস্তাব দিলেন তখনই তিনি মনে মনে দুটি বিকল্প চিন্তা করেছিলেন। প্রথমত, মিডিয়া ছেড়ে দেওয়া এবং দ্বিতীয়ত, এসব মুখোশধারীদের চ্যালেঞ্জ করে-এড়িয়ে মিডিয়ায় টিকে থাকা। একটা লড়াকু মনোভাব ছিলো তার। তাই দ্বিতীয় সিদ্ধান্তটি নিয়েছিলেন আমার সেই বন্ধু। চারদিকের চাপে আর বিরক্তিতে দেশ ছেড়ে চলে যাবার সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী সেই বন্ধুটি খুব আক্ষেপ করে বলছিলেন, ‘সেদিন আমার প্রথম সিদ্ধান্তটা নেওয়াই ভালো হতো। এখন মনে হয় ভুল করেছি।’
সত্যিই জানি না, আমার সেই বন্ধু ভুল করেছিলেন কি না! কিন্তু এটুকু জানি, মিডিয়ায় নারীর জন্য সুস্থ-সুন্দর পরিবেশ ফেরাতে হবে। নারী-পুরুষের বৈষম্য যে বহুমুখী বৈষম্যের জন্ম দেয়, সেই বৈষম্যের বৃত্ত ভাঙ্গতে হবে। মিডিয়ায় কি সুস্থ মানসিকতার মানুষেরা কাজ করবেন না? মিডিয়ায় যে মেয়েটা কাজ করতে আসবেন, তিনি কি আমার বান্ধবীর মতো দুটি বিকল্প সিদ্ধান্ত থেকে একটি বেছে নেবেন? নাকি এর কোনোটাই না নিয়ে আত্মমর্যাদা বিলিয়ে দেবেন, পুরুষতন্ত্রের নোংরা খায়েস চরিতার্থ করবেন?
শেষ করবো আমার এক বড় ভাইয়ের একটা মানসিকতার ছোট্ট উদাহরণ দিয়ে। সেই বড় ভাই মিডিয়ায় পার করছেন দীর্ঘদিন। জনপ্রিয় একটি টেলিভিশনের মুখচেনা সিনিয়র সাংবাদিক তিনি। অ্যাসাইনমেন্টে গেলেই নানা গল্পের ফাঁকে তিনি বলেন এবং বিশ্বাস করতে বলেন, যে নারী মিডিয়াকর্মীর চেহারাই টিভি পর্দায় দেখা যায়, তিনিই মালিক বা কোনো বসকে খুশি করে সেই জায়গাটি অর্জন করেছেন। যার হাতে টেলিভিশনের বুম উঠেছে, তিনিই নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন। লজ্জায় নিজেকে আর ভাবতে ইচ্ছে করে না, একজন গণমাধ্যমকর্মী। কিন্তু লড়াইয়ের তীব্র নেশায় শেষে ভাবি, এইসব পুরুষাধিপত্যশীল অপচিন্তা অসুস্থ চিন্তার পরাজয় হবেই। পরাজয় ঘটাতে হবে।
নারীর প্রতি পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতাকে কঠোর হাতে লড়তে হবে। তার জন্য চাই, নারী মিডিয়াকর্মীর সাহসী মনোভাব, পুরুষতন্ত্রের সৃষ্ট মানসিক কাঠামোকে ভেঙ্গে ফেলার প্রত্যয়। বিশ্বাস করি, সমাজকে এগিয়ে নিতে বৈষম্যের এই নষ্ট ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়বেই। পুরুষাধিপত্য কিংবা নারীর নয়, আমরা জিতে নেবোই নেবো একটি মানুষের পৃথিবী, একটা মানবিক সমাজ।
সঞ্জীব রায়: রিপোর্টার, সময় টেলিভিশন
royratan.sanjib@gmail.com
No comments