জাতির মনোজগতে ঐকতান দরকার by সেজান মাহমুদ
স্বাধীন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ দক্ষ এবং অদক্ষ জনশক্তি। দেশের মূল অর্থনীতির স্তম্ভ বলা যায় একে। একটি গণতান্ত্রিক সরকারই একমাত্র পারেন সেই জনশক্তিকে পরিকল্পিতভাবে কাজে লাগিয়ে দেশের অর্থনীতির ভিত শক্ত করতে।
এই গণতান্ত্রিক পদ্ধতির সূচনা হয়েছে বাংলাদেশে। দেশের মানুষ নারী নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে প্রমাণ করেছে বাংলাদেশের মানুষ অনেক উন্নত দেশের চেয়েও নারীর সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল
একটি যুদ্ধ সংগঠনের পেছনে দীর্ঘ ইতিহাস থাকে। বাঙালি জাতি হিসেবে চিরকাল বঞ্চনার শিকার হয়েছে; নির্যাতন, নিষ্পেষণের শিকার হয়েছে এ কথা বললে অত্যুক্তি হয় না। যে ভাষা এই জাতিকে যূথবদ্ধ করে রেখেছিল আদিকাল থেকেই, তা শাসকের পৃষ্ঠপোষকতা তো পায়ইনি বরং তার ওপরও এসেছে নির্যাতন। এভাবে সম্মিলিত বঞ্চনা, সম্মিলিত প্রত্যাশার এক সন্ধিক্ষণে এই ঐতিহাসিক যুদ্ধ, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধ আসলে কিসের জন্য ছিল? যদি এ প্রশ্ন দিয়ে শুরু করি তাহলে এর প্রাপ্তি, সফলতা, ব্যর্থতা চিহ্নিত করা বোধকরি সহজ হবে। বাঙালি হিসেবে আমাদের স্বতন্ত্র, স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রয়োজন ছিল, ছিল জাতি হিসেবে বিশ্বের কাছে আত্মপরিচয় তুলে ধরার। সে সঙ্গে শাসন-শোষণ থেকে অর্থনৈতিক মুক্তি লাভ করাও ছিল অন্যতম দাবি। আজ আমরা স্বাধীন ভূখণ্ড পেলাম, পৃথিবীর মানচিত্রে আমাদের আলাদা জায়গা হলো, আলাদা পতাকা, আলাদা পরিচয়ও হলো। কিন্তু সে পরিচয় আমাদের কী এনে দিচ্ছে তা নির্মোহভাবে বিচার করা সবচেয়ে জরুরি। আমরা বিশ্বের দরবারে আলাদা জাতি, যে জাতি দুর্নীতিতে সেরা; আলাদা জাতি যে জাতি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে পদদলিত করে, আলাদা জাতি যে জাতি স্বয়ংসম্পূর্ণতায় ব্যর্থ। এই স্বতন্ত্র পরিচয় কি আমাদের কাম্য ছিল, কিংবা এই কি ছিল মুক্তিযুদ্ধের উদ্দেশ্য? তাহলে কিসের গলদ যা স্বাধীনতার ৪০ বছর পরও আমাদের তৃপ্তি এনে দেয় না, পরিপূর্ণতা তো দূরের কথা, স্বাধীন দেশ হিসেবে কিছুটা স্বস্তিও এনে দেয় না?
মূলত আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে আমাদের কোনো মৌলিক পরিবর্তন ঘটেনি। এর প্রধান কারণ, স্বাধীনতা-উত্তর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কোনো গুণগত পরিবর্তন ঘটানোর ব্যর্থতা। একটি দেশের রাজনীতিক নেতারা নিয়ন্ত্রণ করেন সে দেশের ভবিষ্যৎ গতি-প্রকৃতি। এই গতি-প্রকৃতি নিয়ন্ত্রণের পেছনে থাকতে হয় রাজনৈতিক দর্শন। সাম্য, ভারসাম্য, সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক মুক্তি এসব শুধুই রাজনৈতিক বুলি আওড়ে যাওয়ার মতো শুনতে পারা যায়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে একজন রাজনীতিবিদ হবেন সবচেয়ে মেধাবী, সৎ, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন বিবেকবান মানুষ। লক্ষ্য করলে দেখা যায়, স্বাধীনতার পর থেকেই রাজনীতিতে এক অশুভ, আত্মধ্বংসী, চক্রাকার ঘটনাক্রমের সূত্রপাত ঘটেছে। মেধার বদলে রাজনীতিতে আসার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হয়ে দঁাঁড়াল পেশিশক্তি, দুর্নীতিপরায়ণতা, ন্যায়হীনতা। দেশের অধিকাংশ মানুষের শিক্ষাবঞ্চনার সুযোগে বিদেশি শক্তিও কলুষিত করার সুযোগ পেল এ দেশের সামরিক ব্যক্তিদের, উচ্চস্তরের নেতাদের। এ কারণেই দীর্ঘ সময় দেশের কোথাও, কোনো ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের কোনো চিহ্ন নেই, কোনো পরিকল্পনাও নেই। রাজনীতিতে নেই জবাবদিহিতা, দেশের মানুষের আত্মপরিচয়, আত্মঅহংকারের কোনো মিনার ক্রমবর্ধনশীলতা নিয়ে সৃষ্টি হলো না আজও। অর্থনৈতিক মুক্তি তো দূরের কথা, যে পাকিস্তানি শোষকদের হাত থেকে মুক্তি ছিনিয়ে আনার উদাত্ত বাণী ছিল সংগ্রামের অন্যতম মূলমন্ত্র, সেই বাণী পরিণত হলো প্রহসনে। দেশীয় লুটেরা, ধনিক-বণিক শ্রেণীর হাতে সম্পদের পাহাড়, রাষ্ট্রীয় সম্পদের যথেচ্ছ লুটপাট চলছে করপোরেট পরাশক্তিদের অপতৎপরতার মধ্য দিয়ে। মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে রাজনীতির কলকব্জা আর অর্থনীতির চাবিকাঠি। রাজনীতি যেখানে কলুষিত সেখানে তার প্রভাব দেশের প্রতিটি সেক্টরে থাকবেই। কেউ বলতে পারেন যে, পুঁজির বিকাশের প্রাকলগ্নে এই কেন্দ্রীভূত বণিকশ্রেণীর সৃষ্টি হবেই। কিন্তু সেখানেও থাকতে হয় দেশপ্রেমিক পুঁজিচক্র, সুষম বণ্টন এবং ন্যায়নিষ্ঠতা। অন্যদিকে স্বাধীনতার মূলমন্ত্রে বিশ্বাসী গোষ্ঠীর দুর্বলতার সুযোগে নতুন করে সংগঠিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছে স্বাধীনতাবিরোধী চক্র। এ কারণে রাজনীতিতে নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে ধর্মান্ধতা, বিদ্বেষ! দেশের সর্বজনীন জাতীয়তাবোধ নিয়ে জেগে ওঠার ক্ষেত্রে সৃষ্টি হয়েছে দর্শনগত বিভেদ। যে বাঙালি জাতীয়তাবোধ এক করে নিয়েছিল সব মানুষকে তা থেকে ক্রমাগত সরে গিয়ে এক দ্বন্দ্বময়, আত্মভেদী দোদুল্যমানতা ভেঙে দিচ্ছে জাতীয় ঐক্য। একটি জাতি যখন মনোজগতে সমসুরে সম্মিলনের পথ খুঁজে পায় না, সে জাতির পক্ষে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোও খুব সহজ নয়।
স্বাধীন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ দক্ষ এবং অদক্ষ জনশক্তি। দেশের মূল অর্থনীতির স্তম্ভ বলা যায় একে। একটি গণতান্ত্রিক সরকারই একমাত্র পারেন সেই জনশক্তিকে পরিকল্পিতভাবে কাজে লাগিয়ে দেশের অর্থনীতির ভিত শক্ত করতে। এই গণতান্ত্রিক পদ্ধতির সূচনা হয়েছে বাংলাদেশে। দেশের মানুষ নারী নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে প্রমাণ করেছে বাংলাদেশের মানুষ অনেক উন্নত দেশের চেয়েও নারীর সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আমি মনে করি, বাংলাদেশের সবচেয়ে সক্রিয় যে অংশ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রেখে যাচ্ছে তা হলো সুশীল সমাজ। এই সুশীল সমাজ কারা তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে, কিংবা এই সুশীল সমাজের মধ্যেও মেধা ও বিবেক বিক্রীত গোষ্ঠী দেখা গেলেও একটি দ্বন্দ্বময়, শক্তিশালী মিথস্ক্রিয়ার মধ্যে আমরা বাংলাদেশের সামাজিক উন্নয়নের ইঙ্গিত খুঁজে পাই। বাংলাভাষার সাহিত্য, শিল্প, সব মিলিয়ে নান্দনিক প্রকাশের ক্ষেত্রগুলোতে এক অভিনব পরিবর্তনের আভাস মেলে, যা স্বাধীন দেশেই একমাত্র সম্ভব। এখানেও প্রতিষ্ঠান এবং রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে সংঘাত অনিবার্য। কিন্তু আমি তা কোনোভাবেই পরাধীন দেশের সংঘাতের সঙ্গে এক করে দেখব না। এই যে ভাষার ক্ষেত্রেও প্রতিষ্ঠান আর প্রতিষ্ঠানবিরোধী দ্বন্দ্ব দেখতে পাই। এই দ্বন্দ্ব স্বাস্থ্যকর এবং শুধু স্বাধীন দেশেই এই লব্ধিমুখী দ্বন্দ্ব দেখতে পাওয়া যায়। এর মধ্য দিয়েই নির্মিত হবে আমাদের আত্মপরিচয়ের নতুন বিশ্বজনীন মাত্রা। বাংলাদেশে যে গণতান্ত্রিক পদ্ধতির সূত্রপাত ঘটেছে তা যদি সর্বস্তরের জনগণের অংশগ্রহণকে ধীরে ধীরে হলেও নিশ্চিত করে তবে মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। রাজনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতা ধরে রাখা, বাকস্বাধীনতা, মুক্ত ও অবাধ তথ্যপ্রবাহ, নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা, আইনের সুস্থ ও সুষ্ঠু প্রয়োগ, এর যে প্রাথমিক সূচনা তাকে আরও উন্নত স্তরে নিয়ে যাওয়া একটি স্বাধীন দেশের মোক্ষধাম। এ ক্ষেত্রে খুব সামান্য অর্জন হলেও অন্ততপক্ষে যে শুভসূচনা দেখতে পাওয়া যায় তাকে স্বাগত জানানো উচিত।
এ সময়ের একজন অন্যতম রাজনৈতিক দার্শনিক জন রউলস তার 'জাস্টিস তত্ত্বে' (থিওরি অব জাস্টিস) মানবজীবনের উপকরণ বা পণ্যগুলোকে দু'ভাগে ভাগ করেছিলেন_ সামাজিক পণ্য বা সোস্যাল গুডস (যেমন শিক্ষা, চিকিৎসা) এবং প্রাকৃতিক পণ্য বা ন্যাচারাল গুডস (যেমন মেধা)। অন্যদিকে অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন এই পণ্য বা উপাদানগুলোর সুষম বণ্টনের নীতিমালা নিয়ে নতুন করে ন্যায় প্রতিষ্ঠার দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। একটি ওয়েলফেয়ার অর্থনীতি তথা রাষ্ট্র বিনির্মাণে এই তাত্তি্বক ও দার্শনিক নীতি প্রয়োগের জন্য ন্যায়পরায়ণ রাজনৈতিক শক্তির কোনো বিকল্প নেই। স্বাধীনতা অর্জনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি এই যে, আমরা এই কলকব্জাগুলো আমাদের হাতের মুঠোয় পেয়েছি। কিন্তু তা পরিচালনা করার জন্য যোগ্য, ন্যায়নিষ্ঠ নেতৃত্বের বড় অভাব। মেধাবী, যোগ্য, ন্যায়নিষ্ঠ নেতৃত্বের জন্য বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন নিয়ে আসা প্রয়োজন। একমাত্র স্বাধীনতার চেতনা, ঐক্য দিয়েই আমরা আমাদের সেই পরিবর্তনের সংস্কৃতিকে ধারণ করতে পারি। স্বাধীনতা অর্জনের মতোই একে লালন করে নতুন মাত্রায় উন্নীত করা আরেকটি যুদ্ধের শামিল। সেই যুদ্ধে জয়ী হওয়াই হোক আমাদের ব্রত, হোক এই স্বাধীনতার অঙ্গীকার। এ অর্জনের মাত্রাকে গল্গাসের অর্ধেক ভরতি আর অর্ধেক খালির সঙ্গেও তুলনা করা যায়। আমি চিরকাল অর্ধেক ভর্তির পক্ষে।
স সেজান মাহমু্দ : লেখক, সহযোগী অধ্যাপক জনস্বাস্থ্য, ফ্লোরিডা স্টেট ইউনিভার্সিটি, ইউএসএ
একটি যুদ্ধ সংগঠনের পেছনে দীর্ঘ ইতিহাস থাকে। বাঙালি জাতি হিসেবে চিরকাল বঞ্চনার শিকার হয়েছে; নির্যাতন, নিষ্পেষণের শিকার হয়েছে এ কথা বললে অত্যুক্তি হয় না। যে ভাষা এই জাতিকে যূথবদ্ধ করে রেখেছিল আদিকাল থেকেই, তা শাসকের পৃষ্ঠপোষকতা তো পায়ইনি বরং তার ওপরও এসেছে নির্যাতন। এভাবে সম্মিলিত বঞ্চনা, সম্মিলিত প্রত্যাশার এক সন্ধিক্ষণে এই ঐতিহাসিক যুদ্ধ, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধ আসলে কিসের জন্য ছিল? যদি এ প্রশ্ন দিয়ে শুরু করি তাহলে এর প্রাপ্তি, সফলতা, ব্যর্থতা চিহ্নিত করা বোধকরি সহজ হবে। বাঙালি হিসেবে আমাদের স্বতন্ত্র, স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রয়োজন ছিল, ছিল জাতি হিসেবে বিশ্বের কাছে আত্মপরিচয় তুলে ধরার। সে সঙ্গে শাসন-শোষণ থেকে অর্থনৈতিক মুক্তি লাভ করাও ছিল অন্যতম দাবি। আজ আমরা স্বাধীন ভূখণ্ড পেলাম, পৃথিবীর মানচিত্রে আমাদের আলাদা জায়গা হলো, আলাদা পতাকা, আলাদা পরিচয়ও হলো। কিন্তু সে পরিচয় আমাদের কী এনে দিচ্ছে তা নির্মোহভাবে বিচার করা সবচেয়ে জরুরি। আমরা বিশ্বের দরবারে আলাদা জাতি, যে জাতি দুর্নীতিতে সেরা; আলাদা জাতি যে জাতি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে পদদলিত করে, আলাদা জাতি যে জাতি স্বয়ংসম্পূর্ণতায় ব্যর্থ। এই স্বতন্ত্র পরিচয় কি আমাদের কাম্য ছিল, কিংবা এই কি ছিল মুক্তিযুদ্ধের উদ্দেশ্য? তাহলে কিসের গলদ যা স্বাধীনতার ৪০ বছর পরও আমাদের তৃপ্তি এনে দেয় না, পরিপূর্ণতা তো দূরের কথা, স্বাধীন দেশ হিসেবে কিছুটা স্বস্তিও এনে দেয় না?
মূলত আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে আমাদের কোনো মৌলিক পরিবর্তন ঘটেনি। এর প্রধান কারণ, স্বাধীনতা-উত্তর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কোনো গুণগত পরিবর্তন ঘটানোর ব্যর্থতা। একটি দেশের রাজনীতিক নেতারা নিয়ন্ত্রণ করেন সে দেশের ভবিষ্যৎ গতি-প্রকৃতি। এই গতি-প্রকৃতি নিয়ন্ত্রণের পেছনে থাকতে হয় রাজনৈতিক দর্শন। সাম্য, ভারসাম্য, সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক মুক্তি এসব শুধুই রাজনৈতিক বুলি আওড়ে যাওয়ার মতো শুনতে পারা যায়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে একজন রাজনীতিবিদ হবেন সবচেয়ে মেধাবী, সৎ, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন বিবেকবান মানুষ। লক্ষ্য করলে দেখা যায়, স্বাধীনতার পর থেকেই রাজনীতিতে এক অশুভ, আত্মধ্বংসী, চক্রাকার ঘটনাক্রমের সূত্রপাত ঘটেছে। মেধার বদলে রাজনীতিতে আসার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হয়ে দঁাঁড়াল পেশিশক্তি, দুর্নীতিপরায়ণতা, ন্যায়হীনতা। দেশের অধিকাংশ মানুষের শিক্ষাবঞ্চনার সুযোগে বিদেশি শক্তিও কলুষিত করার সুযোগ পেল এ দেশের সামরিক ব্যক্তিদের, উচ্চস্তরের নেতাদের। এ কারণেই দীর্ঘ সময় দেশের কোথাও, কোনো ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের কোনো চিহ্ন নেই, কোনো পরিকল্পনাও নেই। রাজনীতিতে নেই জবাবদিহিতা, দেশের মানুষের আত্মপরিচয়, আত্মঅহংকারের কোনো মিনার ক্রমবর্ধনশীলতা নিয়ে সৃষ্টি হলো না আজও। অর্থনৈতিক মুক্তি তো দূরের কথা, যে পাকিস্তানি শোষকদের হাত থেকে মুক্তি ছিনিয়ে আনার উদাত্ত বাণী ছিল সংগ্রামের অন্যতম মূলমন্ত্র, সেই বাণী পরিণত হলো প্রহসনে। দেশীয় লুটেরা, ধনিক-বণিক শ্রেণীর হাতে সম্পদের পাহাড়, রাষ্ট্রীয় সম্পদের যথেচ্ছ লুটপাট চলছে করপোরেট পরাশক্তিদের অপতৎপরতার মধ্য দিয়ে। মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে রাজনীতির কলকব্জা আর অর্থনীতির চাবিকাঠি। রাজনীতি যেখানে কলুষিত সেখানে তার প্রভাব দেশের প্রতিটি সেক্টরে থাকবেই। কেউ বলতে পারেন যে, পুঁজির বিকাশের প্রাকলগ্নে এই কেন্দ্রীভূত বণিকশ্রেণীর সৃষ্টি হবেই। কিন্তু সেখানেও থাকতে হয় দেশপ্রেমিক পুঁজিচক্র, সুষম বণ্টন এবং ন্যায়নিষ্ঠতা। অন্যদিকে স্বাধীনতার মূলমন্ত্রে বিশ্বাসী গোষ্ঠীর দুর্বলতার সুযোগে নতুন করে সংগঠিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছে স্বাধীনতাবিরোধী চক্র। এ কারণে রাজনীতিতে নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে ধর্মান্ধতা, বিদ্বেষ! দেশের সর্বজনীন জাতীয়তাবোধ নিয়ে জেগে ওঠার ক্ষেত্রে সৃষ্টি হয়েছে দর্শনগত বিভেদ। যে বাঙালি জাতীয়তাবোধ এক করে নিয়েছিল সব মানুষকে তা থেকে ক্রমাগত সরে গিয়ে এক দ্বন্দ্বময়, আত্মভেদী দোদুল্যমানতা ভেঙে দিচ্ছে জাতীয় ঐক্য। একটি জাতি যখন মনোজগতে সমসুরে সম্মিলনের পথ খুঁজে পায় না, সে জাতির পক্ষে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোও খুব সহজ নয়।
স্বাধীন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ দক্ষ এবং অদক্ষ জনশক্তি। দেশের মূল অর্থনীতির স্তম্ভ বলা যায় একে। একটি গণতান্ত্রিক সরকারই একমাত্র পারেন সেই জনশক্তিকে পরিকল্পিতভাবে কাজে লাগিয়ে দেশের অর্থনীতির ভিত শক্ত করতে। এই গণতান্ত্রিক পদ্ধতির সূচনা হয়েছে বাংলাদেশে। দেশের মানুষ নারী নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে প্রমাণ করেছে বাংলাদেশের মানুষ অনেক উন্নত দেশের চেয়েও নারীর সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আমি মনে করি, বাংলাদেশের সবচেয়ে সক্রিয় যে অংশ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রেখে যাচ্ছে তা হলো সুশীল সমাজ। এই সুশীল সমাজ কারা তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে, কিংবা এই সুশীল সমাজের মধ্যেও মেধা ও বিবেক বিক্রীত গোষ্ঠী দেখা গেলেও একটি দ্বন্দ্বময়, শক্তিশালী মিথস্ক্রিয়ার মধ্যে আমরা বাংলাদেশের সামাজিক উন্নয়নের ইঙ্গিত খুঁজে পাই। বাংলাভাষার সাহিত্য, শিল্প, সব মিলিয়ে নান্দনিক প্রকাশের ক্ষেত্রগুলোতে এক অভিনব পরিবর্তনের আভাস মেলে, যা স্বাধীন দেশেই একমাত্র সম্ভব। এখানেও প্রতিষ্ঠান এবং রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে সংঘাত অনিবার্য। কিন্তু আমি তা কোনোভাবেই পরাধীন দেশের সংঘাতের সঙ্গে এক করে দেখব না। এই যে ভাষার ক্ষেত্রেও প্রতিষ্ঠান আর প্রতিষ্ঠানবিরোধী দ্বন্দ্ব দেখতে পাই। এই দ্বন্দ্ব স্বাস্থ্যকর এবং শুধু স্বাধীন দেশেই এই লব্ধিমুখী দ্বন্দ্ব দেখতে পাওয়া যায়। এর মধ্য দিয়েই নির্মিত হবে আমাদের আত্মপরিচয়ের নতুন বিশ্বজনীন মাত্রা। বাংলাদেশে যে গণতান্ত্রিক পদ্ধতির সূত্রপাত ঘটেছে তা যদি সর্বস্তরের জনগণের অংশগ্রহণকে ধীরে ধীরে হলেও নিশ্চিত করে তবে মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। রাজনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতা ধরে রাখা, বাকস্বাধীনতা, মুক্ত ও অবাধ তথ্যপ্রবাহ, নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা, আইনের সুস্থ ও সুষ্ঠু প্রয়োগ, এর যে প্রাথমিক সূচনা তাকে আরও উন্নত স্তরে নিয়ে যাওয়া একটি স্বাধীন দেশের মোক্ষধাম। এ ক্ষেত্রে খুব সামান্য অর্জন হলেও অন্ততপক্ষে যে শুভসূচনা দেখতে পাওয়া যায় তাকে স্বাগত জানানো উচিত।
এ সময়ের একজন অন্যতম রাজনৈতিক দার্শনিক জন রউলস তার 'জাস্টিস তত্ত্বে' (থিওরি অব জাস্টিস) মানবজীবনের উপকরণ বা পণ্যগুলোকে দু'ভাগে ভাগ করেছিলেন_ সামাজিক পণ্য বা সোস্যাল গুডস (যেমন শিক্ষা, চিকিৎসা) এবং প্রাকৃতিক পণ্য বা ন্যাচারাল গুডস (যেমন মেধা)। অন্যদিকে অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন এই পণ্য বা উপাদানগুলোর সুষম বণ্টনের নীতিমালা নিয়ে নতুন করে ন্যায় প্রতিষ্ঠার দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। একটি ওয়েলফেয়ার অর্থনীতি তথা রাষ্ট্র বিনির্মাণে এই তাত্তি্বক ও দার্শনিক নীতি প্রয়োগের জন্য ন্যায়পরায়ণ রাজনৈতিক শক্তির কোনো বিকল্প নেই। স্বাধীনতা অর্জনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি এই যে, আমরা এই কলকব্জাগুলো আমাদের হাতের মুঠোয় পেয়েছি। কিন্তু তা পরিচালনা করার জন্য যোগ্য, ন্যায়নিষ্ঠ নেতৃত্বের বড় অভাব। মেধাবী, যোগ্য, ন্যায়নিষ্ঠ নেতৃত্বের জন্য বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন নিয়ে আসা প্রয়োজন। একমাত্র স্বাধীনতার চেতনা, ঐক্য দিয়েই আমরা আমাদের সেই পরিবর্তনের সংস্কৃতিকে ধারণ করতে পারি। স্বাধীনতা অর্জনের মতোই একে লালন করে নতুন মাত্রায় উন্নীত করা আরেকটি যুদ্ধের শামিল। সেই যুদ্ধে জয়ী হওয়াই হোক আমাদের ব্রত, হোক এই স্বাধীনতার অঙ্গীকার। এ অর্জনের মাত্রাকে গল্গাসের অর্ধেক ভরতি আর অর্ধেক খালির সঙ্গেও তুলনা করা যায়। আমি চিরকাল অর্ধেক ভর্তির পক্ষে।
স সেজান মাহমু্দ : লেখক, সহযোগী অধ্যাপক জনস্বাস্থ্য, ফ্লোরিডা স্টেট ইউনিভার্সিটি, ইউএসএ
No comments