নারী দিবস এবং বাংলাদেশের চিত্র by ড. নিয়াজ আহম্মেদ
আশির দশকের গোড়ার দিকে বাংলাদেশে নারীদের প্রতি নির্যাতন বন্ধের জন্য যৌতুকনিরোধ ও নারী নির্যাতন প্রতিরোধ আইন প্রণয়ন করা হয়। উদ্দেশ্য ছিল, নারী নির্যাতন বন্ধ করা এবং নারীদের উন্নয়ন ও সমাজে স্বাভাবিকভাবে চলাফেরার পথ কণ্টকমুক্ত করা। তখনকার সময়ে নারী নির্যাতন তেমনটি সহিংস ছিল না।
নির্যাতনের ধরন ও প্রকৃতি কম-বেশি মারধর, গালিগালাজ ইত্যাদির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। আমাদের গ্রামীণ ক্ষমতাকাঠামো তখন নারী নির্যাতনের ঘটনাগুলো কম-বেশি কঠোরভাবে মোকাবিলা করতে সক্ষম হতো। কিন্তু সময়ের আবর্তে এ-সংক্রান্ত অনেক কিছুর মধ্যে পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। নারী নির্যাতন এখন আর ছোটখাটো ঘটনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না, বরং ক্রমান্বয়ে বড় বড় সহিংস ঘটনায় রূপ নিচ্ছে। অধিকন্তু আগে নির্যাতন বেশি মাত্রায় দেখা যেত অপেক্ষাকৃত দরিদ্র ও অসহায় নারীদের মধ্যে। এখন আর নারী নির্যাতন শুধু দরিদ্র ও অসহায় নারীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং উচ্চ শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত ও চাকরিজীবী নারীরা শুধু নির্যাতনই নয়; স্বামী ও পরিবারের অন্যদের দ্বারা সহিংস আচরণের শিকারও হচ্ছে। ঘরে-বাইরে এমন কোনো স্থান নেই, যেখানে নারীরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে না। নারী নির্যাতনের এ বহুমাত্রিকতার বিষয়গুলোকে দৃষ্টি দিয়ে নতুন নতুন আইন প্রণীত এবং পুরনো আইনের মধ্যে সংস্কার আনা হচ্ছে।
নারীদের প্রতি নির্যাতন আচরণের নিত্যনতুন ধরনের আবির্ভাবের দিক বিবেচনায় এনে বর্তমান সরকার কয়েকটি আইন এবং নীতিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, গৃহকর্মী সুরক্ষা নীতিমালা-২০০৯, পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন-২০১০, পর্নোগ্র্যাফি নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১১। মজার বিষয় হলো, প্রতিটি আইন ও নীতিমালা এখন পর্যন্ত খসড়া পর্যায়ে আছে। আইন ও নীতিমালায় রূপান্তরিত হয়নি। বিভিন্ন মহল থেকে এগুলোর চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। তবে আইনে যা-ই থাকুক না কেন, এর বাস্তবায়নই মূল কাজ। এটি করতে না পারলে আইন প্রণয়ন বৃথা থেকে যাবে। গৃহকর্তা-কর্ত্রীদের কর্তৃক গৃহকর্মী নির্যাতন হরহামেশাই ঘটে থাকে। নির্যাতনের মাত্রা কখনো কখনো সহিংস আচরণে রূপ নেয়। গৃহকর্তা দ্বারা যৌন লালসার শিকার, শারীরিক নির্যাতন, এমনকি মেরে ফেলার মতো ঘটনাও আমরা লক্ষ করি। এ বিষয়গুলোকে সামনে রেখে সরকার ক্ষমতায় আসার পর পরই গৃহকর্মী সুরক্ষা নীতিমালা প্রণয়নের কাজে হাত দেয় এবং নীতিমালা চূড়ান্ত করে। কিন্তু নীতিমালায় অনেক ভালো ভালো বিধিবিধান থাকলেও প্রশ্ন থেকে যায়, কেন এ আইনে ১৪ বছর বয়সী শিশুকে শিশু হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। সরকার যেখানে ১৮ বছর পর্যন্ত কিশোর-কিশোরীকে শিশু হিসেবে গণ্য করেছে, সেখানে এ নীতিমালা একটি দ্বন্দ্ব তৈরি করেছে। তবে নীতিমালায় ১৪ বছরের কম বয়সী কোনো শিশুকে গৃহকাজে নিয়োগ করা যাবে না, কোনো গৃহকর্মীকে তালাবদ্ধ করে রাখা যাবে না, বয়স ও সামর্থ্যের সঙ্গে অসামঞ্জস্য বিবেচিত ভারী ও বিপজ্জনক কাজে কিশোর-কিশোরীদের নিয়োগ করা যাবে না- ইত্যাদি ধারা গৃহকর্মীদের সুরক্ষার ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে আমরা মনে করি। কিন্তু আজ পর্যন্ত নীতিমালাটি আলোর মুখ দেখেনি। আমরা চাইব, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় নীতিমালাটি প্রণয়নে দ্রত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
সাম্প্রতিক সময়ে নারী নির্যাতনের মাত্রা সহিংসতার চরম পর্যায়ে পেঁৗছে গেছে। এ থেকে রেহাই পাচ্ছে না উচ্চশিক্ষিত চাকরিজীবী নারীরাও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রুমানার প্রতি সহিংস আচরণ আমাদের সবাইকে নাড়া দেয়। আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে, কোনো নারীই কি আজ সমাজে নিরাপদ নয়? তিনি শিক্ষিত, অশিক্ষিত, চাকরিজীবী, গৃহিণী- যেই হোন না কেন। নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন-২০১০ প্রণীত হয়। আইনটি গতানুগতিক ধারা থেকে একটু ভিন্ন, যেখানে সহিংসতা প্রতিরোধকল্পে সুরক্ষার কথা বলা হয়েছে। নির্যাতিত নারী আইনি লড়াইয়ের সময় নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হন। এ পর্যায়ে তার সুরক্ষার জন্য বিবিধ ব্যবস্থা গ্রহণের কথা আইনে উল্লেখ রয়েছে। জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপ সনদ-১৯৭৯ ও শিশু অধিকার সনদ-১৯৮৯ এবং এর স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্র হিসেবে এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে বর্ণিত নারী ও শিশুর সম-অধিকার প্রতিষ্ঠার নিমিত্তে পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ, পারিবারিক সহিংসতা থেকে নারী ও শিশু সুরক্ষা নিশ্চিত করা এবং আনুষঙ্গিক বিষয়াদি সম্পর্কে বিধান প্রণয়নকল্পে এ আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। এখানে শিশু ও নারী উভয়কে নিয়ে এসে পারিবারিক সম্পর্ক, অর্থাৎ রক্তসম্বন্ধীয় বা বৈবাহিক কারণে অথবা দত্তক বা যৌথ পরিবারের সদস্য হওয়ার কারণে প্রতিষ্ঠিত সম্পর্ককে বোঝানো হয়েছে, যা সম্পকের্র একটি পরিপূর্ণ রূপ পেয়েছে। আর সহিংসতা অর্থে শারীরিক, মানসিক, যৌন নির্যাতন অথবা আর্থিক ক্ষতিকে বোঝানো হয়েছে। সাধারণত দেখা যায়, সংক্ষুব্ধ নারী প্রতিকারের জন্য আদালতে বিচারের সম্মুখীন হলে অংশীদারি গৃহে তার আশ্রয় হয় না। কিন্তু আইনের ১০ ধারায় সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির পারিবারিক সম্পর্ক থাকার কারণে অংশীদারি বাসগৃহে বসবাসের অধিকার থাকবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে, যা সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির অধিকারের শামিল। আইনের ১৪ এবং ১৫ নম্বর ধারায় যথাক্রমে বলা হয়েছে, সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে শুনানির সুযোগ প্রদান করে আদালত যদি এ মর্মে সন্তুষ্ট হন যে পারিবারিক সহিংসতা ঘটেছে বা ঘটার আশঙ্কা রয়েছে, তাহলে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির পক্ষে সুরক্ষা আদেশ প্রদান করতে পারবেন এবং সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত বসবাস আদেশ প্রদান করতে পারবেন। এখানে বসবাসের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যা সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির সুরক্ষার জন্য সহায়ক হবে বলে ধারণা করা হয়।
সহিংসতার শিকার নারীর সুরক্ষার প্রতি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে আইনে বলা হয়েছে, যদি আদালতের এই মর্মে বিশ্বাস করার যুত্তিসংগত কারণ থাকে যে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রতিপক্ষকে অংশীদারি বাসগৃহ থেকে সাময়িকভাবে উচ্ছেদ করা প্রয়োজন, তাহলে আদালত প্রতিপক্ষকে অংশীদারি বাসগৃহ থেকে সাময়িক উচ্ছেদের আদেশ প্রদান করতে পারবেন। আমরা এ ধারাকে সঠিক মনে করি, কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, কেউ যেন এর মাধ্যমে অহেতুক হয়রানির শিকার না হন। এ থেকে উত্তরণের জন্য পর্নোগ্র্যাফি নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১১ খসড়া প্রণয়ন করা হয়েছে। আইনটি বর্তমান সময়ের জন্য প্রয়োজনীয় এ কারণে যে যুুবসমাজকে পর্নোগ্র্যাফির কবল থেকে রক্ষা করার জন্য আইনের বিকল্প নেই, যখন প্রযুক্তির সব আবহ আমাদের হাতের মুঠোয়। এ আইনে বলা হয়েছে, কোনোভাবেই পর্নোগ্র্যাফি উৎপাদন, সংরক্ষণ, বাজারজাতকরণ, বহন, আমদানি, রপ্তানি, ক্রয়-বিক্রয় ও প্রদর্শন করা যাবে না। যদি কোনো ব্যক্তি পর্নোগ্র্যাফি উৎপাদন করে এবং এ কাজে কোনো নারী, পুরুষ বা শিশুকে অংশগ্রহণে বাধ্য করে অথবা তাদের প্রলোভন দেখিয়ে স্থিরচিত্র, ভিডিওচিত্র বা চলচ্চিত্র ধারণ করে, তবে ওই ব্যক্তিকে সর্বোচ্চ ১০ বছর কারাদণ্ড ও পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করা হবে। যদি কোনো ব্যক্তি পর্নোগ্র্যাফি তৈরি করে কারো সামাজিক মানহানি ঘটায় এবং তাকে ভয়ভীতি দেখিয়ে আর্থিক সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করে, তাহলে তাকেও একই শাস্তি দেওয়া হবে। আইনের এ ধারাগুলো পর্নোগ্র্যাফি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে আমাদের বিশ্বাস। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি একদিকে যেমন আমাদের উন্নতির শিখরে পেঁৗছে দিতে কাজ করছে, তেমনি এর দ্বারা কিছু কিছু জটিল সামাজিক সমস্যায় আমরা আক্রান্ত হচ্ছি। আমরা যদি প্রযুক্তির ইতিবাচক দিকগুলো ভালোভাবে গ্রহণ করতে পারতাম, তাহলে লাভ বেশি হতো। কিন্তু কখনো কখনো প্রযুক্তির নেতিবাচক ব্যবহার আমাদের বিপদে ফেলে। একে নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজন হয় আইনের। নতুন নতুন আইন প্রণয়নের মাধ্যমে আমরা নতুন নতুন অপরাধ মোকাবিলা করার দিকনির্দেশনা পেয়ে থাকি। এর মাধ্যমে অপরাধীদের জানান দিতে চাই যে অপরাধের ধরনের মধ্যে পরিবর্তন এসেছে। অর্থাৎ কিছু কিছু আচরণকে আমরা বর্তমানে অপরাধ মনে করছি, যাতে ব্যক্তিবর্গ ওই সব আচরণ করা থেকে এখন নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখে। আর নিজের জ্ঞাতে অথবা অজ্ঞাতে ওই সব আচরণ করলে তাকে কী পরিমাণ শাস্তি ভোগ করতে হবে, সেটাও বলে দেয়। প্রতিকার ও প্রতিরোধ দুটোই জানান দেয়। সমাজ মানুষের অনুভূত প্রয়োজনকে সামনে রেখে আইন বা নীতিমালা প্রণয়ন করে, যার একমাত্র উদ্দেশ্য হলো, মানুষের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করা। আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে আমাদের কামনা থাকল নারী উন্নয়ন ও নির্যাতন বন্ধে প্রচলিত আইনগুলোর বাস্তবায়ন। আইনের বাস্তবায়ন ও জনগণের সচেতনতা পারবে পারিবারিক সহিংসতাকে সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসতে।
লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
neazahmed_2002@yahoo.com
নারীদের প্রতি নির্যাতন আচরণের নিত্যনতুন ধরনের আবির্ভাবের দিক বিবেচনায় এনে বর্তমান সরকার কয়েকটি আইন এবং নীতিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, গৃহকর্মী সুরক্ষা নীতিমালা-২০০৯, পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন-২০১০, পর্নোগ্র্যাফি নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১১। মজার বিষয় হলো, প্রতিটি আইন ও নীতিমালা এখন পর্যন্ত খসড়া পর্যায়ে আছে। আইন ও নীতিমালায় রূপান্তরিত হয়নি। বিভিন্ন মহল থেকে এগুলোর চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। তবে আইনে যা-ই থাকুক না কেন, এর বাস্তবায়নই মূল কাজ। এটি করতে না পারলে আইন প্রণয়ন বৃথা থেকে যাবে। গৃহকর্তা-কর্ত্রীদের কর্তৃক গৃহকর্মী নির্যাতন হরহামেশাই ঘটে থাকে। নির্যাতনের মাত্রা কখনো কখনো সহিংস আচরণে রূপ নেয়। গৃহকর্তা দ্বারা যৌন লালসার শিকার, শারীরিক নির্যাতন, এমনকি মেরে ফেলার মতো ঘটনাও আমরা লক্ষ করি। এ বিষয়গুলোকে সামনে রেখে সরকার ক্ষমতায় আসার পর পরই গৃহকর্মী সুরক্ষা নীতিমালা প্রণয়নের কাজে হাত দেয় এবং নীতিমালা চূড়ান্ত করে। কিন্তু নীতিমালায় অনেক ভালো ভালো বিধিবিধান থাকলেও প্রশ্ন থেকে যায়, কেন এ আইনে ১৪ বছর বয়সী শিশুকে শিশু হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। সরকার যেখানে ১৮ বছর পর্যন্ত কিশোর-কিশোরীকে শিশু হিসেবে গণ্য করেছে, সেখানে এ নীতিমালা একটি দ্বন্দ্ব তৈরি করেছে। তবে নীতিমালায় ১৪ বছরের কম বয়সী কোনো শিশুকে গৃহকাজে নিয়োগ করা যাবে না, কোনো গৃহকর্মীকে তালাবদ্ধ করে রাখা যাবে না, বয়স ও সামর্থ্যের সঙ্গে অসামঞ্জস্য বিবেচিত ভারী ও বিপজ্জনক কাজে কিশোর-কিশোরীদের নিয়োগ করা যাবে না- ইত্যাদি ধারা গৃহকর্মীদের সুরক্ষার ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে আমরা মনে করি। কিন্তু আজ পর্যন্ত নীতিমালাটি আলোর মুখ দেখেনি। আমরা চাইব, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় নীতিমালাটি প্রণয়নে দ্রত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
সাম্প্রতিক সময়ে নারী নির্যাতনের মাত্রা সহিংসতার চরম পর্যায়ে পেঁৗছে গেছে। এ থেকে রেহাই পাচ্ছে না উচ্চশিক্ষিত চাকরিজীবী নারীরাও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রুমানার প্রতি সহিংস আচরণ আমাদের সবাইকে নাড়া দেয়। আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে, কোনো নারীই কি আজ সমাজে নিরাপদ নয়? তিনি শিক্ষিত, অশিক্ষিত, চাকরিজীবী, গৃহিণী- যেই হোন না কেন। নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন-২০১০ প্রণীত হয়। আইনটি গতানুগতিক ধারা থেকে একটু ভিন্ন, যেখানে সহিংসতা প্রতিরোধকল্পে সুরক্ষার কথা বলা হয়েছে। নির্যাতিত নারী আইনি লড়াইয়ের সময় নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হন। এ পর্যায়ে তার সুরক্ষার জন্য বিবিধ ব্যবস্থা গ্রহণের কথা আইনে উল্লেখ রয়েছে। জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপ সনদ-১৯৭৯ ও শিশু অধিকার সনদ-১৯৮৯ এবং এর স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্র হিসেবে এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে বর্ণিত নারী ও শিশুর সম-অধিকার প্রতিষ্ঠার নিমিত্তে পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ, পারিবারিক সহিংসতা থেকে নারী ও শিশু সুরক্ষা নিশ্চিত করা এবং আনুষঙ্গিক বিষয়াদি সম্পর্কে বিধান প্রণয়নকল্পে এ আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। এখানে শিশু ও নারী উভয়কে নিয়ে এসে পারিবারিক সম্পর্ক, অর্থাৎ রক্তসম্বন্ধীয় বা বৈবাহিক কারণে অথবা দত্তক বা যৌথ পরিবারের সদস্য হওয়ার কারণে প্রতিষ্ঠিত সম্পর্ককে বোঝানো হয়েছে, যা সম্পকের্র একটি পরিপূর্ণ রূপ পেয়েছে। আর সহিংসতা অর্থে শারীরিক, মানসিক, যৌন নির্যাতন অথবা আর্থিক ক্ষতিকে বোঝানো হয়েছে। সাধারণত দেখা যায়, সংক্ষুব্ধ নারী প্রতিকারের জন্য আদালতে বিচারের সম্মুখীন হলে অংশীদারি গৃহে তার আশ্রয় হয় না। কিন্তু আইনের ১০ ধারায় সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির পারিবারিক সম্পর্ক থাকার কারণে অংশীদারি বাসগৃহে বসবাসের অধিকার থাকবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে, যা সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির অধিকারের শামিল। আইনের ১৪ এবং ১৫ নম্বর ধারায় যথাক্রমে বলা হয়েছে, সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে শুনানির সুযোগ প্রদান করে আদালত যদি এ মর্মে সন্তুষ্ট হন যে পারিবারিক সহিংসতা ঘটেছে বা ঘটার আশঙ্কা রয়েছে, তাহলে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির পক্ষে সুরক্ষা আদেশ প্রদান করতে পারবেন এবং সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত বসবাস আদেশ প্রদান করতে পারবেন। এখানে বসবাসের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যা সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির সুরক্ষার জন্য সহায়ক হবে বলে ধারণা করা হয়।
সহিংসতার শিকার নারীর সুরক্ষার প্রতি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে আইনে বলা হয়েছে, যদি আদালতের এই মর্মে বিশ্বাস করার যুত্তিসংগত কারণ থাকে যে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রতিপক্ষকে অংশীদারি বাসগৃহ থেকে সাময়িকভাবে উচ্ছেদ করা প্রয়োজন, তাহলে আদালত প্রতিপক্ষকে অংশীদারি বাসগৃহ থেকে সাময়িক উচ্ছেদের আদেশ প্রদান করতে পারবেন। আমরা এ ধারাকে সঠিক মনে করি, কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, কেউ যেন এর মাধ্যমে অহেতুক হয়রানির শিকার না হন। এ থেকে উত্তরণের জন্য পর্নোগ্র্যাফি নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১১ খসড়া প্রণয়ন করা হয়েছে। আইনটি বর্তমান সময়ের জন্য প্রয়োজনীয় এ কারণে যে যুুবসমাজকে পর্নোগ্র্যাফির কবল থেকে রক্ষা করার জন্য আইনের বিকল্প নেই, যখন প্রযুক্তির সব আবহ আমাদের হাতের মুঠোয়। এ আইনে বলা হয়েছে, কোনোভাবেই পর্নোগ্র্যাফি উৎপাদন, সংরক্ষণ, বাজারজাতকরণ, বহন, আমদানি, রপ্তানি, ক্রয়-বিক্রয় ও প্রদর্শন করা যাবে না। যদি কোনো ব্যক্তি পর্নোগ্র্যাফি উৎপাদন করে এবং এ কাজে কোনো নারী, পুরুষ বা শিশুকে অংশগ্রহণে বাধ্য করে অথবা তাদের প্রলোভন দেখিয়ে স্থিরচিত্র, ভিডিওচিত্র বা চলচ্চিত্র ধারণ করে, তবে ওই ব্যক্তিকে সর্বোচ্চ ১০ বছর কারাদণ্ড ও পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করা হবে। যদি কোনো ব্যক্তি পর্নোগ্র্যাফি তৈরি করে কারো সামাজিক মানহানি ঘটায় এবং তাকে ভয়ভীতি দেখিয়ে আর্থিক সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করে, তাহলে তাকেও একই শাস্তি দেওয়া হবে। আইনের এ ধারাগুলো পর্নোগ্র্যাফি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে আমাদের বিশ্বাস। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি একদিকে যেমন আমাদের উন্নতির শিখরে পেঁৗছে দিতে কাজ করছে, তেমনি এর দ্বারা কিছু কিছু জটিল সামাজিক সমস্যায় আমরা আক্রান্ত হচ্ছি। আমরা যদি প্রযুক্তির ইতিবাচক দিকগুলো ভালোভাবে গ্রহণ করতে পারতাম, তাহলে লাভ বেশি হতো। কিন্তু কখনো কখনো প্রযুক্তির নেতিবাচক ব্যবহার আমাদের বিপদে ফেলে। একে নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজন হয় আইনের। নতুন নতুন আইন প্রণয়নের মাধ্যমে আমরা নতুন নতুন অপরাধ মোকাবিলা করার দিকনির্দেশনা পেয়ে থাকি। এর মাধ্যমে অপরাধীদের জানান দিতে চাই যে অপরাধের ধরনের মধ্যে পরিবর্তন এসেছে। অর্থাৎ কিছু কিছু আচরণকে আমরা বর্তমানে অপরাধ মনে করছি, যাতে ব্যক্তিবর্গ ওই সব আচরণ করা থেকে এখন নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখে। আর নিজের জ্ঞাতে অথবা অজ্ঞাতে ওই সব আচরণ করলে তাকে কী পরিমাণ শাস্তি ভোগ করতে হবে, সেটাও বলে দেয়। প্রতিকার ও প্রতিরোধ দুটোই জানান দেয়। সমাজ মানুষের অনুভূত প্রয়োজনকে সামনে রেখে আইন বা নীতিমালা প্রণয়ন করে, যার একমাত্র উদ্দেশ্য হলো, মানুষের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করা। আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে আমাদের কামনা থাকল নারী উন্নয়ন ও নির্যাতন বন্ধে প্রচলিত আইনগুলোর বাস্তবায়ন। আইনের বাস্তবায়ন ও জনগণের সচেতনতা পারবে পারিবারিক সহিংসতাকে সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসতে।
লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
neazahmed_2002@yahoo.com
No comments