নগর পরিকল্পনা-ঢাকাকে বদলে দেওয়া সম্ভব by মাহমুদুর রহমান মান্না

আমাদের সমস্যা নেতৃত্বের। আমি বলব মূলত রাজনৈতিক নেতৃত্বের। সংসদীয় ব্যবস্থা চালু রয়েছে দুই যুগ ধরে। নির্বাচনের ফলে বলা যায়, জনগণ দ্বিদলীয় ব্যবস্থার পক্ষে ভোট দিচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে চলছে দ্বিদলীয় লড়াই। ঠেকাও ও ঠকানোর লড়াই। ক্ষমতাসীনরা ক্ষমতা কুক্ষিগত, কেন্দ্রীভূত করে রাখতে চায়। বিকেন্দ্রীকরণে তাদের প্রচণ্ড অনীহা।


সিটি করপোরেশনের যেভাবে কাজ করা উচিত, এ মনোভাবের কারণে সেটা সম্ভব হয়ে ওঠে ন
রাজধানী ঢাকার জনসংখ্যা কত_ ১ কোটি, নাকি আরও বেশি? অন্তত দেড় কোটি? কিছুদিন আগেও একটি সিটি করপোরেশনের অধীনে ছিল রাজধানী ঢাকা। সরকার করেছে দুটি সিটি করপোরেশন_ উত্তর ও দক্ষিণ নাম পেয়েছে তারা। ঘোষিত লক্ষ্য নাগরিক সুবিধা ও সেবা বৃদ্ধি। উত্তরে ভোটার ২২ লাখ, দক্ষিণে ১৮ লাখ_ মোট ৪০ লাখ। জনসংখ্যা এর তিন গুণ ধরলে ১ কোটি ২০ লাখ একটি গ্রহণযোগ্য সংখ্যা হতে পারে। বিশ্বের জনবহুল মহানগরগুলোর একটি এখন ঢাকা। মেগাসিটি নামেও তা অভিহিত হচ্ছে। আয়তন সীমিত হওয়ায় ঢাকা ঘনবসতিপূর্ণও বটে। মানুষ গিজগিজ করা এমন নগর বা মহানগর বিশ্বে খুব কম পাওয়া যাবে। ঢাকার আয়তন অবশ্য বাড়ছে। কিন্তু লোকসংখ্যা বৃদ্ধির হারের কাছে তা হার মানছে।
উত্তর কিংবা দক্ষিণ_ উভয় ঢাকাতেই নাগরিক সুবিধা অপ্রতুল। বিদ্যুৎ-গ্যাস-পানির সরবরাহ কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় নেই। সরকারি এসব সেবার মাশুল বা চার্জ নিয়েও আপত্তি নাগরিকদের। তাদের বিবেচনায়, এর হার এখনই বেশি। কিন্তু সরকার মনে করছে, চার্জ আরও বাড়ানো দরকার। অনেক বছর ধরেই যানজট প্রধান সমস্যা। আর লেখার শুরুতেই বলেছি, ঢাকার লোকসংখ্যাও ধারণক্ষমতার চাইতে ঢের বেশি। এককথায় বলা যায়, ঢাকা এখন যান ও জনজটের মহানগর। বাংলাদেশের বাইরে থাকেন এমন অনেক বাংলাদেশি পরিবারের সদস্যরা যখন ছুটি কাটাতে দীর্ঘ সময় নিয়ে ঢাকায় আসেন কিংবা কয়েক দিনের জন্য জরুরি প্রয়োজনে এখানে পা রাখেন, তাদের অভিন্ন উপলব্ধি_ এখানে ধুলাবালি বড্ড বেশি। বিদেশি নাগরিকরাও এ সমস্যার কথা বলেন। শিশুদের নিয়ে বিশেষ সমস্যায় পড়ে প্রায় সব পরিবার। উন্নত বিশ্বের নাগরিক সুবিধা বিশ্বের স্বল্পোন্নত দেশগুলোর সারিতে থাকা ঢাকায় মিলবে না_ এটা তারা মানেন। কিন্তু এতটা খারাপ পরিস্থিতি কেন হবে, সেটা কিছুতেই তাদের বোধগম্য হয় না। ঢাকার মশার দংশনও বড় যন্ত্রণার। মশা নির্মূলের জন্য একটি সংস্থা রয়েছে। তবে নাগরিকরা মনে করেন, এ দায়িত্ব মূলত সিটি করপোরেশনের। কিন্তু নাগরিকদের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তিতে বিস্তর ফারাক। তারা চায় বাসোপযোগী একটি আধুনিক সুন্দর শহর। এটা কি সম্ভব? আমি মনে করি, এটা সম্ভব।
আমি কয়েকটি প্রধান সমস্যার সমাধান কীভাবে সম্ভব, সেটা নিয়ে আলোচনা করব। প্রথমেই বলব যানজট নিয়ে। যানজটের সঙ্গে 'নাকাল' শব্দটি অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত হয়ে আছে। আবার এটাও তো বেশিরভাগ নাগরিকের অভিজ্ঞতা যে, এত যানবাহন যে মহানগরে সেখানে রাস্তায় বের হয়ে বাস, সিএনজি-অটোরিকশা, ট্যাক্সি কিংবা রিকশা_ এসবের কোনোটিই মিলবে না। অনেক সময় অতিক্রম হওয়ার পর একটা কিছু পেলেও পছন্দেরটি পাবেন না এবং ভাড়াও গুনতে হবে বেশি। যানবাহনের মধ্যে প্রাইভেট কারের সংখ্যা বেশি এবং বাস-মিনিবাসের সংখ্যা তুলনামূলক কম। এ কারণে নিত্যদিনের সাধারণ যাত্রীদের ভোগান্তির শেষ থাকে না। আর যানজটে নাকাল হওয়ার দুর্ভাগ্য তো সব ধরনের যানবাহনের যাত্রীদের। মিরপুর বা উত্তরা থেকে সচিবালয় বা মতিঝিল এলাকায় যারা যাতায়াত করেন তাদের দিনে কমপক্ষে ৪ ঘণ্টা অপচয় হয় রাজপথে। এই অলস সময় অবশ্যই কমিয়ে আনা সম্ভব এবং এটা করতেই হবে। এজন্য ট্রান্সপোর্ট প্লানিংয়ের ওপর আমি সর্বাধিক জোর দিতে চাই।
রাজধানী ঢাকার বয়স এখন চারশ' বছর। দক্ষিণ পাশে বুড়িগঙ্গা নদীকে রেখে যারা এর পরিকল্পনা করেছিলেন তারা সম্ভবত দৃষ্টি বেশি দূর নিক্ষেপ করেননি। কিন্তু অতীতে কী হয়নি, সে জন্য নিজের কাজ ফেলে রেখে লাভ নেই। এখন নগর পরিকল্পনাবিদ, স্থপতি, রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতৃত্ব, জনপ্রতিনিধি সবাইকে ভাবতে হবে অনেক দূরের প্রতি দৃষ্টি রেখে। একই সঙ্গে সাময়িক ব্যবস্থাও গ্রহণ করতে হবে। আমি সংশ্লিষ্ট অনেকের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলেছি। তাদের অভিন্ন অভিমত_ কেবল প্রশাসনিক সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ এবং দায়িত্বপ্রাপ্তদের সক্রিয়তা বৃদ্ধি করেই যানজট ৩০ শতাংশ কমিয়ে আনা সম্ভব। এখানে দুটি সিটি করপোরেশন। কিন্তু যানবাহন চলাচলে এ বিভাজন মানার সুযোগ নেই। একইভাবে, নতুন যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হবে তাও বিচ্ছিন্নভাবে নেওয়া হলে কাঙ্ক্ষিত ফল মিলবে না। এখন সমন্বয়ের প্রয়োজন আগের চেয়ে বেশি অনুভূত হবে এবং ভালো ফল পেতে তার বিকল্প নেই। এক সময়ে দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউল, থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংকক, হংকং, পাশের দেশের কলকাতা_ এ ধরনের আরও অনেক মহানগরের নাম করা যায়, যেখানে ভ্রমণে গিয়ে যানজটে আমাদের অনেক নাগরিককেও নাকাল হতে হয়েছে। এটাও মনে রাখতে হবে যে, গত শতাব্দীর ষাট ও সত্তরের দশকে সিউল ও ব্যাংকক ঢাকার মতোই পিছিয়ে থাকা দেশের রাজধানী ছিল। কিন্তু এখন অর্থনীতিতে তারা এগিয়েছে এবং এ কারণে যানবাহনও বেড়েছে। একই কারণে বেড়েছে মহানগরের অধিবাসী। কিন্তু বিদায় নিয়েছে যানজট। আমরাও নিশ্চয়ই পারব এ সমস্যা থেকে মুক্ত হতে।
যানজট সমস্যা সমাধানে আমার আরেকটি প্রস্তাব ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা-সাভার-মানিকগঞ্জ, ঢাকা-মুন্সীগঞ্জ, ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-গাজীপুরের মধ্যে ঘণ্টায় ঘণ্টায় রেল চলুক। রাজধানীতে কাজের জন্য প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষ আসবে এবং কাজ শেষে যতটা সময়ে মতিঝিল-সেগুনবাগিচা থেকে মোহাম্মদপুর বা সূত্রাপুর যাবে, তার আগেই চলে যাবে ট্রেনে 'উপশহরের' গন্তব্যে, পরিবারের সদস্যদের সানি্নধ্যে।
আমি মনে করি, নগরবাসীর জন্য সুপেয় পানির ব্যবস্থাও সিটি করপোরেশন করতে পারে। এ কাজ ওয়াসারই করা উচিত। তারা না পারলে সিটি করপোরেশন সে দায়িত্ব নেবে এবং অবশ্যই করতে পারবে বলে আমি মনে করি। সিটি করপোরেশন যদি রাজধানীর সর্বত্র বিপণি বিতান নির্মাণ ও পরিচালনা করতে পারে তাহলে অবশ্যই স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল এসবও পরিচালনা করতে পারে। নগরবাসীর প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজও সিটি করপোরেশন করতে পারে। এখন কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বিদ্যুৎ উৎপাদন করে সরকারের কাছে বিক্রি করছে। কয়েকটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানও এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত। সিটি করপোরেশনও পুরো শহরের দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিতে পারে। সরকারকে কেবল সঞ্চালন-বিতরণ ব্যবস্থার ভার নিতে হবে। গ্যাস, কয়লা, ডিজেল, ফার্নেস অয়েল_ জ্বালানি হিসেবে যেটা ব্যবহারের নীতি হোক, সেটাই করপোরেশন করতে পারে। কয়লাভিত্তিক কেন্দ্র হলে কয়লার মজুদ ভাণ্ডার করপোরেশনই গড়ে তুলবে। সরকারের কেবল দিতে হবে সিদ্ধান্ত এবং প্রয়োজনের সময় সহায়তা।
এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে অর্থ সহায়তা চাওয়ার দরকার নেই। নিজেদের পক্ষেই তা ব্যবস্থা করা সম্ভব। সরকার যেমন এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক বা বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করে, তেমনি সিটি করপোরেশনও করবে। এ জন্য সুযোগ করে দিতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখেছি, এখন ব্যাংকগুলোতে প্রায় ২৫ হাজার অ্যাকাউন্ট রয়েছে, যার প্রতিটিতে এক কোটি টাকা বা তারও বেশি অর্থ জমা রয়েছে। সরকার নীতিগতভাবে পাবলিক-প্রাইভেট অংশীদারিত্ব মেনে নিয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এখনও তা গতি পায়নি। ব্যাংকে যারা ব্যক্তিগত বা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বড় অঙ্কের অর্থ জমা রাখছেন, তাদের একটি অংশের কাছ থেকেই নাগরিক সুবিধা বাড়ানোর জন্য অর্থের জোগান আসতে পারে।
নাগরিক সেবা বাড়ানোর দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের হাতে তুলে দিলে কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা কমবে না, বরং বাড়বে নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্য। সরকারের আয় বাড়ারও নতুন নতুন সুযোগ সৃষ্টি হবে।
আমি মনে করি, বাঙালিরা জাতি হিসেবে অসাধারণ প্রতিভাবান, প্রায় অতুলনীয় ধৈর্যশীল ও পরিশ্রমী। তাদের সৃজনী ক্ষমতা সর্বত্র প্রশংসা পায় এবং নিষ্ঠা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে না। সততা ও চরিত্রগত মান বিবেচনায় তারা যে কোনো উন্নত ও সভ্য দেশের মতোই আদর্শ হিসেবে গণ্য হয়। বিশ্বের নানা দেশে বাঙালিরা কাজ করছে। কে তাদের প্রশংসা করছে না, বলুন? জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীতে এখন বাংলাদেশের অবস্থান এক নম্বরে। তাদের কাজে মুগ্ধ সবাই। যে দেশে তাদের দায়িত্ব পড়ে, সেখানকার সরকার এবং জনগণের বন্ধু ও প্রিয়জন হয়ে ওঠে তারা। এমনকি বিবদমান পক্ষগুলোর সমান শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় তারা সিক্ত হয়।
আমাদের সমস্যা নেতৃত্বের। আমি বলব মূলত রাজনৈতিক নেতৃত্বের। সংসদীয় ব্যবস্থা চালু রয়েছে দুই যুগ ধরে। নির্বাচনের ফলে বলা যায়, জনগণ দ্বিদলীয় ব্যবস্থার পক্ষে ভোট দিচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে চলছে দ্বিদলীয় লড়াই। ঠেকাও ও ঠকানোর লড়াই। ক্ষমতাসীনরা ক্ষমতা কুক্ষিগত, কেন্দ্রীভূত করে রাখতে চায়। বিকেন্দ্রীকরণে তাদের প্রচণ্ড অনীহা। সিটি করপোরেশনের যেভাবে কাজ করা উচিত, এ মনোভাবের কারণে সেটা সম্ভব হয়ে ওঠে না। আমি মনে করি, পরিচ্ছন্ন ও সুন্দর নগর গড়ে তোলাও সম্ভব। এজন্য সিটি করপোরেশনের হাতে অধিক ক্ষমতা প্রয়োজন। নগর সরকার গঠনের দাবি আগেও উঠেছে এবং আমি তা সমর্থন করি। নগরবাসীর সেবাদানকারী সংস্থাগুলোর কাজে অবশ্যই সমন্বয়সাধন করতে হবে। আর এর সার্বিক তত্ত্বাবধানে থাকতে হবে সিটি করপোরেশনকে। এক এক বিভাগ একেক সময়ে সড়ক খোঁড়াখুঁড়ি করে জনদুর্ভোগ বাড়াবে_ এটা কোনোমতেই হওয়া চলবে না।
বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি জনগণের অশেষ আত্মদানে অর্জিত। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এখন অনেকের মনে সৃষ্টি হয়েছে আস্থার অভাব। দেশের ভালো কিছু হবে_ এমন ভরসা তারা রাখতে পারছে না। রাজনৈতিক দলের অনেক ইশতেহার তারা দেখেছে। অনেক প্রতিশ্রুতি সভা-সমাবেশে কিংবা সংবাদপত্র-টেলিভিশনে জানছে বা শুনছে। এসব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হলে দেশের অনেক সমস্যার সমাধান হতে পারে। মানুষ আগের চেয়ে ভালো থাকতে পারে। রাজধানীবাসী বসবাস করতে পারে একটি বদলে যাওয়া মেগাসিটিতে। আমি দেখাতে চাই যে এটা সম্ভব। স্বপ্ন কেবল স্বপ্ন নয়, তার বাস্তবায়ন অবশ্যই হতে পারে।

মাহমুদুর রহমান মান্না : রাজনীতিবিদ ও কলাম লেখক

No comments

Powered by Blogger.