নারী পুলিশ সম্মেলন-নেতৃত্ব চায় নারী পুলিশ

দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের পথ বেয়ে ক্রমশ এগিয়ে চলেছেন বাংলাদেশের নারীরা। ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে সমাজের নানা স্তরে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করছেন তাঁরা। শিক্ষায়, শ্রমে এবং সরকারি-বেসরকারি নানা কাজে নারীদের উপস্থিতি এখন প্রবলভাবেই দৃশ্যমান। পুলিশের মতো চ্যালেঞ্জিং পেশায়ও নারীরা এখন সক্রিয়।


‘নারী পুলিশ কোথায় নেই—থানা, কোর্ট-কাছারি, ইমিগ্রেশন, রাজনৈতিক বা যেকোনো উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিরাপত্তায়, জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কমিটিসহ সব জায়গায় আছেন তাঁরা। পুলিশের নানা গুরুত্বপূর্ণ পদে এবং র‌্যাবেও রয়েছেন নারী পুলিশের সদস্যরা।’
পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) উপমহাপরিদর্শক ইয়াসমিন গফুর প্রথম আলোর কাছে এভাবেই নারী পুলিশের ভূমিকার কথা তুলে ধরেন। ১৯৮৮ সালে পুলিশে যোগ দেওয়া এই নারী আরও বলেন, নারী পুলিশ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দক্ষতার সঙ্গে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
নেতৃত্বে দেশের নারী পুলিশ অনেকটাই এগিয়ে, তার প্রমাণও পাওয়া গেল। বাংলাদেশ পুলিশ উইমেন্স নেটওয়ার্ক ঢাকায় আয়োজন করেছে ‘প্রথম এশিয়া অঞ্চল নারী পুলিশ’ শীর্ষক সম্মেলনের। ‘এশিয়ায় নারী পুলিশের নেতৃত্ব’ স্লোগান সামনে রেখে গতকাল বুধবার নগরের একটি অভিজাত হোটেলে অনুষ্ঠিত হয় এ সম্মেলন। দুই দিনব্যাপী এ সম্মেলনে মোট ১১টি দেশের ৩৯ জন নারী পুলিশের সদস্য অংশ নিচ্ছেন।
আন্তর্জাতিক নারী পুলিশ সংস্থাটির ১৫তম অঞ্চলের সদস্য বাংলাদেশ। সম্মেলনে পুলিশিং ব্যবস্থাপনা, নারী পুলিশদের অবস্থান, নেতৃত্ব তৈরি, পেশাদারি ও মান উন্নয়ন, পারিবারিক নির্যাতন, নারী পাচারসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা, অভিজ্ঞতা বিনিময় ও প্রশিক্ষণে অংশ নেবেন বিভিন্ন দেশের নারী পুলিশের সদস্যরা। একটি বৈশ্বিক নারী পুলিশ কৌশল গঠন এবং সম্মেলনের আলোচনা ও মতবিনিময়ের ওপর ভিত্তি করে ‘ঢাকা ঘোষণা’ দেওয়া হবে।
গতকাল আনুষ্ঠানিকভাবে এ সম্মেলনের উদ্বোধন ঘোষণা করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেন, নারী পুলিশ সদস্যদের নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা আছে। তাঁরা এমন একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করবেন, যেখানে শুধু নারী সদস্যরা নন, পুরুষ পুলিশ সদস্যও মন খুলে সমস্যার কথা বলতে পারবেন। এ ছাড়া এ ধরনের সম্মেলন দেশের নারী পুলিশদের দক্ষতা বাড়াতেও সহায়তা করবে।
ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব উইমেন পুলিশের প্রেসিডেন্ট জেন টাউনসলি বলেন, নারী পুলিশ অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করা এখনো চ্যালেঞ্জিং বিষয়। নারী পুলিশ সদস্যরা সমাজে রোল মডেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারেন, যা দেখে অন্যরা উৎসাহিত হবেন।
পুলিশের মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার বলেন, নারী পুলিশ সমাজ পরিবর্তনের বাহক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারেন। কীভাবে আরও ভালো সেবা দেওয়া যায়, সে লক্ষ্য নিয়ে নারী পুলিশকে কাজ করতে হবে।
দেশের নারী পুলিশ সদস্যরা অনেক দিক থেকেই এগিয়ে গেছেন। তবে সংখ্যার দিক থেকে পুরুষের তুলনায় পিছিয়ে থাকায় এই পুলিশ সদস্যরা তেমন একটা দৃশ্যমান নন। দেশে বর্তমানে পুরুষ পুলিশ আছেন সোয়া লাখের বেশি। অন্যদিকে নারী পুলিশের সংখ্যা চার হাজার ৪১৭। এর মধ্যে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে নারী পুলিশের সংখ্যা আরও কম।
গতকাল সম্মেলনে উদ্বোধনী পর্বের পর নারী পুলিশের সদস্যরা প্রথম আলোর কাছে কর্মক্ষেত্রে তাঁদের কিছু সমস্যার কথাও তুলে ধরেন। তাঁদের মতে, থানায় নারী পুলিশদের জন্য আলাদা একটি টয়লেটের চিন্তা নীতিনির্ধারকদের মাথায় আসেনি। একইভাবে নারী পুলিশ সদস্যরা ট্রাফিক পুলিশ হিসেবে দায়িত্ব নিয়েও পালন করতে পারেননি। সন্তান লালনপালনের জন্য সময় ব্যয় করাটা অনেক ক্ষেত্রেই ভালো চোখে দেখা হয় না। গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রেও নারীরা বৈষম্যের শিকার হন।
দেশে নারী পুলিশদের নেটওয়ার্কটি গঠনে সহায়তা করেছে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) পুলিশ সংস্কার প্রকল্প। প্রকল্পের জেন্ডার বিশেষজ্ঞ ফৌজিয়া খোন্দকার বলেন, পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় প্রথাগত ধারণার বাইরে এসে পুলিশ হিসেবে দায়িত্ব পালন করার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা কাটাতে নারীদের খানিকটা সময় তো লাগবেই।
গতকালের সম্মেলনে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক, মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী শিরীন শারমিন চৌধুরী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব সি কিউ কে মোশতাক আহমেদ, বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক (ইন্সপেক্টর জেনারেল) হাসান মাহমুদ খন্দকার, ইউএনডিপির আবাসিক প্রতিনিধি নীল ওয়াকার, সিআইডির অ্যাডিশনাল ইন্সপেক্টর জেনারেল মো. মোখলেছুর রহমান, গোয়েন্দা প্রশিক্ষণ স্কুলের (ডিটিএস) কমান্ড্যান্ট এবং নারী পুলিশ নেটওয়ার্কের প্রেসিডেন্ট রওশন আরা বেগম আলোচনায় অংশ নেন। সমাজে নারী পুলিশের সদস্যরা বর্তমানে ‘ইতিবাচক পরিবর্তনের এজেন্ট’ হিসেবে ভূমিকা রাখছেন বলে উল্লেখ করা হয়।

No comments

Powered by Blogger.