সন্ত্রাসীর গায়ে যখন পুলিশের পোশাক by পারভেজ খান

'আবে তাজ্জব কারবার। ডাকাইত আরমান আর চোরা রাসেইল্যা আবার পুলিশ অইল কবে? কই পাইলেন এই পিকচার? হ্যারা তো নাটক ফিলিম ভি করে না। তয়, হ্যারা পুলিশ অফিসারের পোশাক পাইছে কই? দুনোজনই তো বড় ছনত্রাসী, কিরমিনাল।


' তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী আরমান ও রাসেলের পুলিশের পোশাক পরা দুটি ছবি এই প্রতিবেদকের হাতে দেখে এভাবেই প্রশ্নের পর প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন পুরান ঢাকার লালবাগে রাজা শ্রীনাথ স্ট্রিটের বাসিন্দা আলী মিয়া। শুধু তিনি নন, এমন প্রশ্নবিদ্ধ অবাক মুখ অনেকেরই। প্রশ্নের সুরে তাঁরাও বললেন, 'তয় কি এই দুই ছনত্রাসী পুলিশের হাত থেইক্যা বাঁচনের লাইগা নিজেরাই পুলিশের পোশাক পইরা ঘুরতাছে?'
কালের কণ্ঠের নিজস্ব অনুসন্ধানে বের হয়ে এসেছে আরমানের বাসা লালবাগের ১২/১ রাজা শ্রীনাথ স্ট্রিটে। আর রাসেলের বাসা ১৬৬/১ লালবাগ রোড, ভাট মসজিদে। তারা দুজনই পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী। দুজনের বিরুদ্ধেই রয়েছে একাধিক হত্যাকাণ্ডসহ কমপক্ষে এক ডজন করে মামলা। গ্রেপ্তারও হয়েছে অনেকবার। এলাকায় তারা মানিক জোড় হিসেবেও পরিচিত।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পুরান ঢাকার লালবাগ, হাজারীবাগ, সূত্রাপুর, কোতোয়ালি আর কামরাঙ্গীরচর থানা এলাকার অতিপরিচিত মুখ এই দুজন। নাম উচ্চারণ মাত্রই স্থানীয় লোকজন তাদের চেনে। এলাকাবাসী আর পুলিশ সূত্রে পাওয়া তথ্য মতে, তারা মূলত মাদক ব্যবসায়ী। টেকনাফ থেকে ইয়াবা আর বিভিন্ন সীমান্ত এলাকা থেকে ড্রাম বা বড় বড় গ্যালনে ভরে ফেনসিডিল এনে ঢাকায় বোতলজাত করে পাইকারি দরে বিক্রি করে। তাদের বাহন হিসেবে থাকে মাইক্রোবাস। মাদক আনার পথে পুলিশের সন্দেহ-দৃষ্টি আর তল্লাশি এড়াতে তারা পুলিশের পোশাক ব্যবহার করে থাকে।
পুলিশের পোশাক ব্যবহার এখানেই সীমাবদ্ধ নয়। তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এই পোশাক পরে পুরান ঢাকার নবাবগঞ্জ বাজার ও আশপাশ এলাকা এবং কামরাঙ্গীরচর এলাকার বিভিন্ন নকল কারখানায় অভিযান চালায়। গ্রেপ্তারের ভয় দেখিয়ে এসব কারখানা থেকে আদায় করে বড় অঙ্কের টাকা। অনেক কারখানা থেকে তারা থানার হয়ে নিয়মিত মাসোয়ারাও আদায় করে। অভিযানের জন্য বেছে নেয় রাতের অন্ধকার আর নির্জনতাকে। মূলত যেসব এলাকার লোকজন ব্যক্তিগতভাবে তাদের চেনে না, সেই এলাকাগুলোতেই তারা এভাবে অপরাধ কর্মকাণ্ড চালায়। এই চক্রে জয়নাল (রাসেলের বোনজামাই ও পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী), সাজু, আজমল, ওয়াসিম ও নাদিম নামে আরো পাঁচ সদস্য রয়েছে বলে জানা গেছে।
গতকাল বুধবার সকালে ১২/১ রাজা শ্রীনাথ স্ট্রিটে আরমানের বাড়িতে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। আরমানের খোঁজ করতেই ওই বাড়ি থেকে সুলতানা পরিচয়ে এক মহিলা জানান, এটা আরমানদের বাড়ি নয়। তিনি পাশের আরেকটি বাড়ি দেখিয়ে দেন। ওই বাড়িতে গেলে সেখানকার একজন জানান, সুলতানা মিথ্যা বলেছেন। আগে খোঁজ করা বাড়িটিই আরমানদের। ওই বাড়িতে ফের গিয়ে খোঁজ করতেই বেরিয়ে আসেন আরমানের বড় ভাই শাহাবুদ্দিনের মেয়ে শামিমা। তিনি জানান, তাঁর চাচা আরমান এখানে থাকে না। সে কোথায় থাকে, কী করে, সে ব্যাপারে তাঁরা কিছুই জানেন না। শুধু এটুকু জানা যায়, তিন ভাই ও চার বোনের মধ্যে আরমান দ্বিতীয়।
পুলিশের পোশাক পরা আরমানের ছবি দেখে তার বোন জোবেদা জানান, এটি তাঁর ভাইয়েরই ছবি। সে কেন পুলিশের পোশাক পরেছে তাও তিনি জানেন না। এই কাজটা আপত্তিকর উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটা করা আরমানের উচিত হয়নি। তবে এর পেছনে কোনো চক্রান্ত থাকতে পারে বলে তিনি দাবি করেন।
এরপর ১৬৬/১ লালবাগ রোড, ভাট মসজিদ ঠিকানায় রাসেলের বাড়িতে গিয়ে তাকেও পাওয়া যায়নি। রাসেল সম্পর্কে কথা হয় তার বোন সাবিনা বেগমের সঙ্গে। তিনি এই প্রতিবেদককে জানান, পাঁচ ভাই ও চার বোনের মধ্যে রাসেল পঞ্চম। তার স্ত্রী ডালিয়া গার্মেন্টে চাকরি করেন। রাসেলের বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ডের অভিযোগসহ বেশ কয়েকটি মামলা রয়েছে। অনেকবার হাজতও খেটেছে। সাবিনা বলেন, রাসেল আগে খারাপ ছিল না। আসলে ওর বন্ধুদের মধ্যে অনেকেই অসৎ। তাদের সঙ্গে ওঠাবসা করে সেও খারাপ হয়ে গেছে। সে এলাকায় অনেকের কাছে বাড়ি বিক্রির কথা বলে বায়নার টাকা নিয়ে সেগুলোও নষ্ট করেছে। রাসেলের মা ফুলবানুর দাবি, তাঁর সন্তানের বিরুদ্ধে সব মামলাই মিথ্যা। শত্রুতা করে এসব মামলা করা হয়েছে।
মিন্টু নামে প্রতিবেশী কনফেকশনারি মালিক জানান, রাসেলের কাছে আগে এলাকার অনেকেই টাকা পেত। তবে তার হাতে এখন বেশ টাকা আছে বলে মনে হয়। ইতিমধ্যে সে অনেকের টাকা শোধ করে দিয়েছে।
লালবাগের ডুরি আঙ্গুল লেন পার হয়ে নবাবগঞ্জ বাজারের উদ্দেশে কিছুদূর এগোতেই আচার ও চকলেট তৈরির একটি কারখানা। চার তলা এই ভবনে ছোট আটটি কারখানা রয়েছে। পুলিশের পোশাক পরা আরমান আর রাসেলের ছবি দেখে একটি কারখানার ম্যানেজার রশিদ উদ্দিন বিস্মিত হন। তিনি জানান, দুই বছর ধরে এই দুজন (মাঝেমধ্যে পুলিশের পোশাক পরে) প্রতি সপ্তাহেই তাদের কারখানায় এসে টাকা নিয়ে যায়। পুলিশ কর্মকর্তা মনে করে তাঁরা তাদের যথেষ্ট খাতির-যত্নও করেন। নবাবগঞ্জের তাজ বিরিয়ানির দোকান থেকে মোরগ পোলাও এনে খাওয়ান। অথচ তারা যে পুলিশ নয় এবং তাদেরই পাশের এলাকার সন্ত্রাসী, সেটা তাঁরা জানতেন না।
লালবাগ কেল্লার মোড় এলাকার এক পরিবহন ব্যবসায়ী কালের কণ্ঠকে জানান, আরমান ও রাসেল তাঁর মাইক্রোবাস ভাড়া করে প্রায়ই কুমিল্লা ও আখাউড়ায় যেত। সেখান থেকে লোহার ট্রাংকে ভরে এবং পানির গ্যালনে করে তারা জিনিসপত্র আনত। জিজ্ঞেস করলে বলত, এগুলো মামলার আলামত। পুলিশের পোশাক পরে থাকায় তাঁদেরও কোনো সন্দেহ হয়নি। তা ছাড়া মাইক্রোবাসের ভাড়াও মিলত সাধারণের তুলনায় বেশি। তিনি জানান, আরমান ও রাসেল পুলিশের পোশাক পরে থাকায় পথে পথে পুলিশও গাড়িতে কোনো তল্লাশি করত না। অনেক সময় পথে নেমে সেখানকার কর্তব্যরত পুলিশের সঙ্গে তারা আলাপ করত। একসঙ্গে চা-সিগারেট খেত।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আরমান-রাসেল গ্রুপের একটি আড্ডাখানা রয়েছে লালবাগ কেল্লার মোড় এলাকায়। অনেকে এটাকে মাদকের ডেরা হিসেবেও জানে। এ আড্ডাখানাতেই সীমান্ত এলাকা থেকে মাদক এনে জড়ো করা হয়। গ্যালন থেকে ফেনসিডিল ঢেলে বোতলজাত করা হয়। এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের নিয়ে এখানে নিয়মিত ফেনসিডিলের আসর বসে। আর এ আসরের মধ্যমণি হয়ে থাকে আরমান, রাসেল আর পুলিশের সোর্স আজমল। আড্ডাখানার পাশেই রয়েছে একটি বিনোদন কক্ষ। এখানেই রাসেল ও আরমান তাদের ব্যক্তিগত মালামাল ও পুলিশের পোশাক রাখে। বাড়িতে না ফিরে এখানেই তারা রাত কাটায়। আর যেদিন অভিযান থাকে, সেদিন রাতের আঁধারে এখান থেকেই তারা পুলিশ সেজে মাইক্রোবাস নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। পুলিশের পোশাক পরা ছবি তাদের অভিযানের প্রস্তুতির সময় এখান থেকেই গোপন ক্যামেরায় ধারণ করা।
এলাকার অনেকেই অভিযোগ করে, লালবাগ থানার এসআই রবিউল ও এএসআই মাজেদুল হকের সঙ্গে এই দুই সন্ত্রাসীর যথেষ্ট ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। আরমান ও রাসেলকে তাঁরা নিজস্ব সোর্স হিসেবেও ব্যবহার করেন।
আরমান ও রাসেলের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই গত ২৬ ফেব্রুয়ারি এসআই মজিবর আজিমপুর এলাকা থেকে প্রবাসী মোজাম্মেল ওরফে রনী ও রাজীব নামে তাঁর এক বন্ধুকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে আসেন। এরপর থানায় দায়িত্বরত কর্মকর্তা (ডিউটি অফিসার) রবিউল আলম ও মাজেদুল হক তাঁদের হাজতে আটকে রেখে নানা ভয়ভীতি দেখান। একপর্যায়ে তাঁরা রনী আর রাজীবের স্বজনদের কাছে দুই লাখ টাকা দাবি করেন। টাকা না দিলে আটককৃতদের ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে চালান করার হুমকি দেন এসআই রবিউল। শেষ পর্যন্ত নগদ ২৫ হাজার টাকা ও ১০০ ইউরোর বিনিময়ে রনী ও রাজীব ছাড়া পান।
মঙ্গলবার লালবাগ থানায় গিয়ে হাজত রেজিস্টার ঘেঁটে মোজাম্মেল ও রাজীবের নাম পাওয়া গেছে এবং লেখার পর সেটা কলম দিয়ে কেটেও ফেলা হয়েছে।
থানার ওসি আজিজুল হক এ ব্যাপারে জানান, কোনো গোপন সংবাদের ভিত্তিতে একজন এসআই তাঁদের ধরে আনেন। ঘটনাটি তিনি জানার পর তদন্ত করে তাঁদের ব্যাপারে কোনো কিছু না পেয়ে ওই দিনই ছেড়ে দেন। আর ২৫ হাজার টাকা বা বৈদেশিক মুদ্রা নেওয়ার ব্যাপারে তিনি কিছু জানেন না বলে দাবি করেন।
থানার একাধিক সূত্রে জানা গেছে, এসআই রবিউল আলম সন্ত্রাসী আরমান ও রাসেলকে নিয়ে এলাকায় সাধারণ মানুষকে নানাভাবে হয়রানি করে বেড়াচ্ছেন। রবিউলের বাড়ি গোপালগঞ্জ। আর এ প্রভাবের কারণে তিনি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের তোয়াক্কা করেন না। একই কারণে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেন না।
এ ব্যাপারে ওসি আজিজুল হক জানান, আরমান ও রাসেল পেশাদার সন্ত্রাসী। লালবাগে সংঘটিত চাঞ্চল্যকর রিয়াজ হত্যাসহ তাদের বিরুদ্ধে একাধিক হত্যা, মাদকদ্রব্যসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের মামলা রয়েছে। তাদের একাধিকবার গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। পুলিশের পোশাক কোথা থেকে তারা পেল, বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। এ সন্ত্রাসীদের খোঁজে ইতিমধ্যে তিনি মাঠে নেমেছেন বলে জানান।
এসআই রবিউলের সঙ্গে এ দুই সন্ত্রাসীর সম্পৃক্ততার ব্যাপারে ওসি জানান, বিষয়টি তাঁর জানা নেই। এটা হওয়ারও কথা নয়। এ ধরনের দুজন শীর্ষ সন্ত্রাসীর সঙ্গে পুলিশের ব্যক্তিগত সখ্য থাকতে পারে না। এ রকম কোনো সম্পৃক্ততা পাওয়া গেলে তাঁর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এসআই মজিবর রহমান গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, আরমান ও রাসেল পেশাদার সন্ত্রাসী, হত্যা মামলার আসামি এবং মাদক বিক্রেতা। তিনি নিজেই এ দুই সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালাচ্ছেন বলে দাবি করেন।
একাধিক সূত্র থেকে নিশ্চিত হওয়া গেছে, লালবাগ থানার এসআই রবিউল আলমের সঙ্গে সখ্য রয়েছে আরমান ও রাসেলের। রাতের টহলে বের হলে তারা প্রায়ই মাইক্রোবাস বা পুলিশের গাড়িতে করে একসঙ্গে ঘুরে বেড়ায়। তবে এ ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ অস্বীকার করেন এসআই রবিউল আলম। তিনি দাবি করেন, আরমান ও রাসেলকে তিনি চিনেনই না। আর ২৬ ফেব্রুয়ারি তিনি ডিউটি অফিসার ছিলেন সত্য, তবে মোজাম্মেল রনী বা রাজীব নামে কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল কি না সে ব্যাপারে কিছু জানেন না। তাঁর বাড়ি গোপালগঞ্জে ঠিক, তবে এ 'বিশেষ এলাকার' লোক হওয়ার কারণে তিনি কোনো বাড়তি সুবিধা নেন না।

No comments

Powered by Blogger.