সাদাকালো-জাতিসংঘে ব্যবহারিক ভাষা বাংলার দাবি নিয়ে কথা by আহমদ রফিক
চেষ্টা
শুরু আজ থেকে প্রায় এক যুগ আগে। 'বিশ্ব বাংলাভাষা পরিষদ' নামের একটি
সংগঠনের উদ্যোগে। এ উদ্যোগের প্রেরণা ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবসকে
'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি ও ঘোষণা। স্বভাবতই
কথাটা আমাদের মনে হয়, জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে বাংলাকে কেন গ্রহণ
করা হবে না।
জাতিসংঘে
প্রাথমিক পর্যায়ে চীনা, ইংরেজি, ফরাসি, রুশ ও স্পেনীয় ভাষাগুলোকে
কাজকর্মের ভাষা হিসেবে গ্রহণ করা হয়। পরে একপর্যায়ে আরবি ভাষাকেও
অন্তর্ভুক্ত করা হয়। জাতিসংঘ সনদের একটি ধারায় বলা হয়েছে যে ইংরেজি, ফরাসি,
স্পেনীয়, চীনা ও রুশ ভাষায় লিখিত সনদের ভাষ্যগুলো প্রামাণ্য হিসেবে গণ্য
হবে। এর অর্থ এই ভাষাগুলোকে জাতিসংঘের ব্যবহারিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি
দেওয়া।
জাতিসংঘের সব অঙ্গ সংগঠনের একটি ভাষা ব্যবহৃত হয়ে থাকে; যদিও আন্তর্জাতিক আদালতের ভাষা ইংরেজি ও ফরাসি। আরবিসহ ওই ভাষাগুলো জাতিসংঘের ব্যবহারিক ভাষা হলেও এ সংগঠনের দাপ্তরিক ভাষা অর্থাৎ তাদের হিসাবে 'ওয়ার্কিং ল্যাংগুয়েজ' হিসেবে ইংরেজি ও ফরাসি ভাষারই প্রাধান্য। অর্থাৎ জাতিসংঘের বিভিন্ন দফতরের দলিলপত্র এ দুই ভাষায় প্রকাশ করা হয়। এ সিদ্ধান্তের মধ্যে কি সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতা ও ঐতিহ্যের প্রকাশ ঘটেছে? ঘটুক না ঘটুক এটাই বাস্তবতা।
জনসংখ্যার হিসেবে বিশ্বের প্রধান ১০টি ভাষার মধ্যে বাংলা ভাষার অবস্থান ছিল পঞ্চম। বাংলা তৃতীয় বিশ্বের একটি অন্যতম সমৃদ্ধ ভাষা। সমৃদ্ধি সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চায়। বাঙালি কবি রবীন্দ্রনাথ ১৯১৩ সালে মূলত 'গীতাঞ্জলি' কাব্যপুস্তিকার জন্য সাহিত্য শাখায় নোবেল পুরস্কার পান। সেই থেকে উন্নত বিশ্বে বাংলা ভাষার চর্চা শুরু। রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও রচনাবলির সুবাদে ইউরোপের একাধিক দেশে রবীন্দ্রচর্চা তথা বাংলাভাষা চর্চা শুরু এবং তা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাদ পড়েনি যুক্তরাষ্ট্রও।
ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, স্পেন, রাশিয়াসহ পূর্ব ইউরোপের একাধিক দেশে রবীন্দ্রসাহিত্যের পাঠ ও বাংলা চর্চা চলছে। চলছে দীর্ঘদিন থেকে চীন ও জাপানে। সেসব দেশে মূল ভাষা থেকেও অনূদিত হচ্ছে রবীন্দ্র রচনাবলি। এখন কোনো কোনো পশ্চিমা দেশে অনুদতি হতে শুরু করেছে নজরুলের কবিতা। সব কিছু মিলে বলা যায়, পশ্চিমা দেশে বাংলা চর্চার বিষয়টি লক্ষ করার মতো। সম্প্রতি একটি সূত্রে দেখা গেছে, বহির্বিশ্বে বাংলাভাষী মানুষের সংখ্যা এক কোটিরও ওপরে।
দুই দশক আগের হিসাবে দেখা গিয়েছিল বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপরা, আসামসহ বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী বাংলা ভাষী তথা বাঙালির সংখ্যা ২৫ কোটি। এখন তা বেড়ে ৩০ কোটিতে এসে দাঁড়িয়েছে। এবং বিদেশি পরিসংখ্যান মতে বিশ্বে বাংলা ভাষাভাষী মানুষের অবস্থান জনসংখ্যা বিচারে এখন চতুর্থ স্থানে। তৃতীয় বিশ্বের আর্থ-সামাজিক গুরুত্ব বিচারে জাতিসংঘের মতো বিশ্বসভায় ব্যবহারিক ভাষার সংখ্যা বাড়ানোর দাবি যুক্তিসঙ্গত বলা চলে।'
এ পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘে ব্যবহারিক ভাষা হিসেবে ৩০ কোটি মানুষের ভাষা বাংলাকে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি যুক্তিসঙ্গত বলে মনে হয়। প্রায় এক যুগ আগে অর্থাৎ ২০০১ সালের এপ্রিল মাসে বিশ্ব বাংলা ভাষা পরিষদের উদ্যোগে বাংলাকে জাতিসংঘের অন্যতম ব্যবহারিক ভাষা হিসেবে গণ্য করার জন্য তৎকালীন জাতিসংঘ মহাসচিব কফি আনানের কাছে একটি স্মারকলিপি প্রেরণ করা হয় (১১ এপ্রিল) এবং জাতিসংঘের ঢাকাস্থ আবাসিক সমন্বয়ক তা গ্রহণ করেন ৩০ এপ্রিল (২০০১)।
ওই স্মারকলিপিতে প্রসঙ্গক্রমে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে বাঙালির আত্মদান, একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভাষিক জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য বাঙালির ব্যাপক আত্মত্যাগ, বিশ্বে বাঙালি তথা বাংলাভাষী হিসেবে দুই নোবেল-তারকা রবীন্দ্রনাথ ও অমর্ত্য সেন চলচ্চিত্রে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সত্যজিত রায়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। এখন এই সঙ্গে যোগ করা যায় আরেক বাঙালি নোবেল পুরস্কারের সম্মানে ভূষিত ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নাম।
সত্যি বলতে কি ওই স্মারকলিপিতে উলি্লখিত দাবি নিয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরে যোগাযোগ ও তদারকি করার মতো সঙ্গতি বিশ্ববাংলা পরিষদের ছিল না। তবে তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার (আওয়ামী লীগ) বিষয়টির গুরুত্ব অনুভব করে এ বিষয়ে জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট দফতরে যোগাযোগের চেষ্টা নিয়েছিল। কিন্তু তাদের মেয়াদকাল শেষ হয়ে যাওয়ায় এ বিষয়ে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে বর্তমান বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে বাংলাকে জাতিসংঘে ব্যবহারিক ভাষা হিসেবে গ্রহণ করার পক্ষে জোরাল যুক্তি রয়েছে। উল্লেখ্য, ওই ২০০১ সালে প্রদত্ত স্মারকলিপির সঙ্গে 'বাংলাকে জাতিসংঘের সরকারি ভাষা করতে হবে' শিরোনামে পৃথক আবেদন জানানো হয় বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর কাছে।
আমাদের বিশ্বাস, তৃতীয় বিশ্বের বন্ধুদেশ এবং বন্ধুপ্রতিম দেশগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ এবং এ বিষয়ে তাদের সমর্থন আদায় পূর্বোক্ত দাবি আদায়ের পক্ষে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে। বিষয়টিকে জাতিসংঘের এজেন্ডাভুক্ত করার ক্ষেত্রে তাদের সমর্থন গুরুত্বপূর্ণ। এটা ব্যক্তি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের তদবিরে হবে না। এ জন্য প্রয়োজন সরকারের কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ এবং জাতিসংঘের সদর দফতর ও সংশ্লিষ্ট দফতরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ও প্রভাব বিস্তার।
এটা গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় বিষয়। 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে ইউনেস্কো-ঘোষিত শহীদ দিবস ২১ ফেব্রুয়ারির আনুষঙ্গিকতা এ বিষয়ে আমাদের সাহায্যে আসতে পারে। সম্প্রতি 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' অনুষ্ঠানে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ বিষয়ে সদর্থক বক্তব্য আমাদের আশান্বিত করেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, 'বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের চেষ্টার সঙ্গে জনমতও গড়ে তুলতে হবে। ... আমরা বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা করার চেষ্টা চালাচ্ছি। এ লক্ষ্যে আমি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেছি। এ ব্যাপারে বিশ্বজনমত গড়ে তোলার জন্য আমি বিশ্বের প্রতিটি বাঙালির প্রতি আহ্বান জানাই।'
আমরা প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের সঙ্গে একমত যে ব্যাপক প্রচেষ্টার প্রভাব ব্যতিরেকে বাংলা ভাষার উলি্লখিত আন্তর্জাতিক দাবি পূরণ সহজ নয়, সম্ভব নয়। আমার বিশ্ব্বাস এ বিষয়ে প্রবাসী বাঙালিদের সক্রিয় সমর্থন ও প্রচেষ্টা সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। যেমনটা আমরা দেখেছি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের ক্ষেত্রে দুই প্রবাসী বাঙালি সন্তান রফিক উদ্দিন ও আবদুস সালামের তৎপরতা। তারা ওই দিবসটি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
এবারও জাতিসংঘে বাংলাকে ব্যবহারিক ভাষা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্যে আমাদের মেধাবী বাঙালি সদস্য যারা বিদেশে বিশেষ অবস্থানে আছেন তারা গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারেন। কিন্তু বিষয়টি যেহেতু কার্যকর করার ক্ষেত্রে ব্যক্তিক বা বেসরকারি পর্যায়ের নয়, তাই বাংলাদেশ সরকারকেই এ ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করতে হবে।
আর সরকারি কাজকর্মে বিলম্বিত ধারা একটি বহুকথিত বিষয় বলে আমরা বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র দফতরের প্রতি অনুরোধ জানাব, তারা যেন বিষয়টিকে অগ্রাধিকার বিবেচনায় তৎপর হন এবং প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে প্রতিফলিত ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন ঘটাতে সর্বশক্ত নিয়োগ করেন। এ কাজটি সম্পন্ন হলে বাঙালি জাতির একটি বিশেষ আশা-আকাঙ্ক্ষাই শুধু পূরণ হবে তা-ই নয়, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের তাত্তি্ব্বক গুরুত্বের চেয়ে এর ব্যবহারিক গুরুত্ব হবে অনেক বেশি।
লেখক : ভাষাসংগ্রামী, কবি, প্রাবন্ধিক, রবীন্দ্র গবেষক
জাতিসংঘের সব অঙ্গ সংগঠনের একটি ভাষা ব্যবহৃত হয়ে থাকে; যদিও আন্তর্জাতিক আদালতের ভাষা ইংরেজি ও ফরাসি। আরবিসহ ওই ভাষাগুলো জাতিসংঘের ব্যবহারিক ভাষা হলেও এ সংগঠনের দাপ্তরিক ভাষা অর্থাৎ তাদের হিসাবে 'ওয়ার্কিং ল্যাংগুয়েজ' হিসেবে ইংরেজি ও ফরাসি ভাষারই প্রাধান্য। অর্থাৎ জাতিসংঘের বিভিন্ন দফতরের দলিলপত্র এ দুই ভাষায় প্রকাশ করা হয়। এ সিদ্ধান্তের মধ্যে কি সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতা ও ঐতিহ্যের প্রকাশ ঘটেছে? ঘটুক না ঘটুক এটাই বাস্তবতা।
জনসংখ্যার হিসেবে বিশ্বের প্রধান ১০টি ভাষার মধ্যে বাংলা ভাষার অবস্থান ছিল পঞ্চম। বাংলা তৃতীয় বিশ্বের একটি অন্যতম সমৃদ্ধ ভাষা। সমৃদ্ধি সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চায়। বাঙালি কবি রবীন্দ্রনাথ ১৯১৩ সালে মূলত 'গীতাঞ্জলি' কাব্যপুস্তিকার জন্য সাহিত্য শাখায় নোবেল পুরস্কার পান। সেই থেকে উন্নত বিশ্বে বাংলা ভাষার চর্চা শুরু। রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও রচনাবলির সুবাদে ইউরোপের একাধিক দেশে রবীন্দ্রচর্চা তথা বাংলাভাষা চর্চা শুরু এবং তা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাদ পড়েনি যুক্তরাষ্ট্রও।
ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, স্পেন, রাশিয়াসহ পূর্ব ইউরোপের একাধিক দেশে রবীন্দ্রসাহিত্যের পাঠ ও বাংলা চর্চা চলছে। চলছে দীর্ঘদিন থেকে চীন ও জাপানে। সেসব দেশে মূল ভাষা থেকেও অনূদিত হচ্ছে রবীন্দ্র রচনাবলি। এখন কোনো কোনো পশ্চিমা দেশে অনুদতি হতে শুরু করেছে নজরুলের কবিতা। সব কিছু মিলে বলা যায়, পশ্চিমা দেশে বাংলা চর্চার বিষয়টি লক্ষ করার মতো। সম্প্রতি একটি সূত্রে দেখা গেছে, বহির্বিশ্বে বাংলাভাষী মানুষের সংখ্যা এক কোটিরও ওপরে।
দুই দশক আগের হিসাবে দেখা গিয়েছিল বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপরা, আসামসহ বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী বাংলা ভাষী তথা বাঙালির সংখ্যা ২৫ কোটি। এখন তা বেড়ে ৩০ কোটিতে এসে দাঁড়িয়েছে। এবং বিদেশি পরিসংখ্যান মতে বিশ্বে বাংলা ভাষাভাষী মানুষের অবস্থান জনসংখ্যা বিচারে এখন চতুর্থ স্থানে। তৃতীয় বিশ্বের আর্থ-সামাজিক গুরুত্ব বিচারে জাতিসংঘের মতো বিশ্বসভায় ব্যবহারিক ভাষার সংখ্যা বাড়ানোর দাবি যুক্তিসঙ্গত বলা চলে।'
এ পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘে ব্যবহারিক ভাষা হিসেবে ৩০ কোটি মানুষের ভাষা বাংলাকে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি যুক্তিসঙ্গত বলে মনে হয়। প্রায় এক যুগ আগে অর্থাৎ ২০০১ সালের এপ্রিল মাসে বিশ্ব বাংলা ভাষা পরিষদের উদ্যোগে বাংলাকে জাতিসংঘের অন্যতম ব্যবহারিক ভাষা হিসেবে গণ্য করার জন্য তৎকালীন জাতিসংঘ মহাসচিব কফি আনানের কাছে একটি স্মারকলিপি প্রেরণ করা হয় (১১ এপ্রিল) এবং জাতিসংঘের ঢাকাস্থ আবাসিক সমন্বয়ক তা গ্রহণ করেন ৩০ এপ্রিল (২০০১)।
ওই স্মারকলিপিতে প্রসঙ্গক্রমে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে বাঙালির আত্মদান, একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভাষিক জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য বাঙালির ব্যাপক আত্মত্যাগ, বিশ্বে বাঙালি তথা বাংলাভাষী হিসেবে দুই নোবেল-তারকা রবীন্দ্রনাথ ও অমর্ত্য সেন চলচ্চিত্রে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সত্যজিত রায়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। এখন এই সঙ্গে যোগ করা যায় আরেক বাঙালি নোবেল পুরস্কারের সম্মানে ভূষিত ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নাম।
সত্যি বলতে কি ওই স্মারকলিপিতে উলি্লখিত দাবি নিয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরে যোগাযোগ ও তদারকি করার মতো সঙ্গতি বিশ্ববাংলা পরিষদের ছিল না। তবে তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার (আওয়ামী লীগ) বিষয়টির গুরুত্ব অনুভব করে এ বিষয়ে জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট দফতরে যোগাযোগের চেষ্টা নিয়েছিল। কিন্তু তাদের মেয়াদকাল শেষ হয়ে যাওয়ায় এ বিষয়ে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে বর্তমান বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে বাংলাকে জাতিসংঘে ব্যবহারিক ভাষা হিসেবে গ্রহণ করার পক্ষে জোরাল যুক্তি রয়েছে। উল্লেখ্য, ওই ২০০১ সালে প্রদত্ত স্মারকলিপির সঙ্গে 'বাংলাকে জাতিসংঘের সরকারি ভাষা করতে হবে' শিরোনামে পৃথক আবেদন জানানো হয় বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর কাছে।
আমাদের বিশ্বাস, তৃতীয় বিশ্বের বন্ধুদেশ এবং বন্ধুপ্রতিম দেশগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ এবং এ বিষয়ে তাদের সমর্থন আদায় পূর্বোক্ত দাবি আদায়ের পক্ষে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে। বিষয়টিকে জাতিসংঘের এজেন্ডাভুক্ত করার ক্ষেত্রে তাদের সমর্থন গুরুত্বপূর্ণ। এটা ব্যক্তি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের তদবিরে হবে না। এ জন্য প্রয়োজন সরকারের কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ এবং জাতিসংঘের সদর দফতর ও সংশ্লিষ্ট দফতরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ও প্রভাব বিস্তার।
এটা গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় বিষয়। 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে ইউনেস্কো-ঘোষিত শহীদ দিবস ২১ ফেব্রুয়ারির আনুষঙ্গিকতা এ বিষয়ে আমাদের সাহায্যে আসতে পারে। সম্প্রতি 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' অনুষ্ঠানে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ বিষয়ে সদর্থক বক্তব্য আমাদের আশান্বিত করেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, 'বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের চেষ্টার সঙ্গে জনমতও গড়ে তুলতে হবে। ... আমরা বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা করার চেষ্টা চালাচ্ছি। এ লক্ষ্যে আমি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেছি। এ ব্যাপারে বিশ্বজনমত গড়ে তোলার জন্য আমি বিশ্বের প্রতিটি বাঙালির প্রতি আহ্বান জানাই।'
আমরা প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের সঙ্গে একমত যে ব্যাপক প্রচেষ্টার প্রভাব ব্যতিরেকে বাংলা ভাষার উলি্লখিত আন্তর্জাতিক দাবি পূরণ সহজ নয়, সম্ভব নয়। আমার বিশ্ব্বাস এ বিষয়ে প্রবাসী বাঙালিদের সক্রিয় সমর্থন ও প্রচেষ্টা সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। যেমনটা আমরা দেখেছি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের ক্ষেত্রে দুই প্রবাসী বাঙালি সন্তান রফিক উদ্দিন ও আবদুস সালামের তৎপরতা। তারা ওই দিবসটি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
এবারও জাতিসংঘে বাংলাকে ব্যবহারিক ভাষা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্যে আমাদের মেধাবী বাঙালি সদস্য যারা বিদেশে বিশেষ অবস্থানে আছেন তারা গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারেন। কিন্তু বিষয়টি যেহেতু কার্যকর করার ক্ষেত্রে ব্যক্তিক বা বেসরকারি পর্যায়ের নয়, তাই বাংলাদেশ সরকারকেই এ ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করতে হবে।
আর সরকারি কাজকর্মে বিলম্বিত ধারা একটি বহুকথিত বিষয় বলে আমরা বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র দফতরের প্রতি অনুরোধ জানাব, তারা যেন বিষয়টিকে অগ্রাধিকার বিবেচনায় তৎপর হন এবং প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে প্রতিফলিত ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন ঘটাতে সর্বশক্ত নিয়োগ করেন। এ কাজটি সম্পন্ন হলে বাঙালি জাতির একটি বিশেষ আশা-আকাঙ্ক্ষাই শুধু পূরণ হবে তা-ই নয়, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের তাত্তি্ব্বক গুরুত্বের চেয়ে এর ব্যবহারিক গুরুত্ব হবে অনেক বেশি।
লেখক : ভাষাসংগ্রামী, কবি, প্রাবন্ধিক, রবীন্দ্র গবেষক
No comments