এই দিনে-ক্ষমতা ও নারীর ভাষা by গুলশান আরা

আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। ক্ষমতা ও নারীর ভাষা নিয়েই এখানে কিছু কথা বলা হলো। বিশ্বজুড়ে নারীর সামগ্রিক অবস্থা যে পুরুষের চেয়ে দুর্বল ও নাজুক, তা নিচে তুলে দেওয়া বিষয় থেকেই বুঝে নেওয়া যায়:উন্নত দেশে নারীরা পুরুষের চেয়ে ২৩ শতাংশ কম আয় করে, আর উন্নয়নশীল দেশে তা ২৭ শতাংশ কম।


পৃথিবীর সর্বমোট কর্মঘণ্টার তিন ভাগের দুই ভাগ সময় নারীরা কাজ করে। অর্ধেক খাদ্য উৎপাদন করে, কিন্তু আয় করে মোট আয়ের মাত্র ১০ শতাংশ। পৃথিবীর মোট সম্পদের ১ শতাংশেরও কম ভোগ করে নারী। পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার চার ভাগের এক ভাগ অতিদরিদ্র (দৈনিক আয় এক ডলারের কম) জনগোষ্ঠীর ৭০ শতাংশ নারী।
বিশ্বজুড়ে ১৫-৪৪ বছর বয়সের নারীর প্রতি সহিংসতার ফলে যে মৃত্যু ও পঙ্গুত্ব ঘটে, তা ক্যানসার, ম্যালেরিয়া, সড়ক দুর্ঘটনা বা যুদ্ধের কারণে মৃতের সংখ্যার চেয়ে বেশি।
খোদ ব্রিটেনে পুরুষ বন্ধু বা স্বামী দ্বারা নিগৃহীত হয়ে স্বাস্থ্য খাতে নারীরা ব্যয় করে বছরে এক বিলিয়ন পাউন্ড।
সুইজারল্যান্ড, জাপান ও বেলজিয়ামে উচ্চশিক্ষার জন্য প্রতি ১০০ জন পুরুষের বিপরীতে নারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা যথাক্রমে ৫৩, ৬৩ এবং ৭৮ জন।
বিশ্বে নির্বাহী কর্মকর্তার পদে মাত্র ১ শতাংশ নারী এবং মাত্র ৬ দশমিক ২ শতাংশ নারী বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে কর্মরত।
বিশ্বের ১৯০ জন রাষ্ট্রপ্রধানের মধ্যে নারীর সংখ্যা মাত্র নয়জন। সারা পৃথিবীর সংসদগুলোয় নারীর সংখ্যা ১৩ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রের করপোরেট জগতে ১৫ শতাংশ এবং অধ্যাপকদের মধ্যে ২৪ শতাংশ নারী। ক্ষমতার এই অসম বণ্টন ভাষাকেও করেছে পীড়িত। নারীর প্রতি ব্যবহূত ভাষা এবং নারী কর্তৃক ব্যবহূত ভাষা—উভয়ই সমাজে পুরুষের চেয়ে নারীর ভিন্নতর এবং অনেক ক্ষেত্রে নিম্নতর সামাজিক অবস্থানকে প্রকট করে তোলে।
সমাজভাষা-বিজ্ঞানীদের মতে, নারীর ভাষা সাধারণত বিনয়পূর্ণ, তারা প্রচুর পরিমাণে ট্যাগ প্রশ্ন করে থাকে। কিছু কিছু শব্দ, বাক্যাংশ প্রচুর ব্যবহার করে থাকে (লক্ষ্মী সোনা, আহা রে, হায় আল্লাহ, ইশ্, কী সুন্দর ইত্যাদি)। বিশুদ্ধ উচ্চারণ প্রবণতা থাকে, তবে কখনো কখনো তা ‘অতিবিশুদ্ধি’ প্রবণতায় পরিণত হয়। যেমন: বর্তমানে বাংলাদেশের অনেক নারী সংবাদ পাঠক ‘র’-কে ‘ড়’ উচ্চারণ করেন এবং প্রায়ই ‘স’-এর দীর্ঘ শিসজাত উচ্চারণ পরিলক্ষিত হয়। মেয়েরা পুরুষদের চেয়ে বেশি কথা বলে, বেশি প্রশ্ন করে, ন্যাকামো করে, অভিযোগও বেশি করে। পুরুষের ভাষায় আবেগ প্রবণতা কম, তারা খেলাধুলা সম্পর্কে বেশি কথা বলতে পছন্দ করে, কর্তৃত্বশীল, আদেশ করতে পছন্দ করে এবং অন্যের বক্তব্য প্রকাশকে বাধাগ্রস্ত করে বেশি। নারী-পুরুষের ভাষা প্রভেদবিষয়ক উল্লেখযোগ্য একটি তত্ত্ব হচ্ছে ‘আধিপত্য তত্ত্ব’। এ তত্ত্ব অনুযায়ী, পুরুষ ভাষার মাধ্যমে অন্যের ওপর আধিপত্য বিস্তার করে। এ ছাড়া রয়েছে ‘পার্থক্য তত্ত্ব’। এতে পুরুষ ও নারীর ভাষার ছয়টি পার্থক্যের কথা বলা হয়েছে, যথা—১. পুরুষ সব সময় নিজেকে মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে রাখতে চায়, কিন্তু নারীর চোখে বিশ্ব হচ্ছে পারস্পরিক সমর্থন দ্বারা বন্ধন সুরক্ষা করা; ২. পুরুষ স্বাধীনতাকামী, কিন্তু নারীরা পরস্পরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা রক্ষার চেষ্টা করে; ৩. পুরুষেরা উপদেশপ্রবণ, কিন্তু নারীরা সমঝোতায় বিশ্বাসী; ৪. ছেলেদের ভাষা অনেক তথ্যসমৃদ্ধ হয়ে থাকে, অন্যদিকে মেয়েরা আবেগময় কথা বেশি বলে; ৫. পুরুষের কথায় আদেশ বেশি থাকতে পারে, কিন্তু মেয়েরা সরাসরি না বলে ঘুরিয়ে কথা বলে; ৬. বিরোধ পরিহারের জন্য মেয়েরা অন্যের মতামতকে প্রকাশ্যে নাকচ করে দেয় না।
ভাষায় নারী-পুরুষবাচক অনেক জোড়া শব্দের মধ্যে অর্থের পার্থক্য থাকে। যেমন: রাজা-রানি, রাজার রাজ্য আছে, কিন্তু রানি কেবলই রাজার স্ত্রী মাত্র। বাংলা ভাষায় পেশাবাচক শব্দগুলোর নারীবাচক রূপ ক্রমে ব্যবহারের যোগ্যতা হারাচ্ছে, যেমন: শিক্ষক, অধ্যাপক, কবি, ডাক্তার, প্রকৌশলী, লেখক—নারী-পুরুষ সবার ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা হচ্ছে। বর্তমানে মেয়েরা যেকোনো পেশা গ্রহণ করছে, এমনকি অফিসের বড়কর্তা হলেও আশ্চর্যের কিছু নেই, এভাবেই পাল্টে যাচ্ছে ভাষার লিঙ্গভেদ।
কোনো ভাষার লোকসাহিত্য ওই ভাষাসংশ্লিষ্ট সমাজের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরতে সক্ষম। বাংলা ভাষায় লোকসাহিত্য, প্রবাদ-প্রবচন, ছড়া আমাদের সমাজের রীতিনীতি, ধ্যানধারণা মূল্যবোধকেই ধারণ করে। এসব লোকসাহিত্য থেকে নারীর প্রতি সমাজের সদস্যদের মনোভঙ্গি পরিষ্কার বোঝা যায়, যেমন: ‘অনেক বড় ঘরনি ঘর পায় না, অনেক বড় সুন্দরীও বর পায় না’, ‘কুড়িতে বুড়ি’, ‘আগুনের কাছে ঘি পুরুষের কাছে স্ত্রী’, ‘গরু চিনি বলনে নারী চিনি চলনে’, ‘মাটি আর বেটি যার দখলে রয় তার কথা কয়’, ‘মেয়ে মানুষের বাড় কলাগাছের ঝাড়’, ‘নারীর বল চোখের জল মিথ্যা কথা চোরের বল’, ‘নারীর জন্য পুরুষ বাতির জন্য তেল’ ইত্যাদি। এসব প্রবচন থেকে একজন নারীকে ‘মানুষ’ বলে চেনা মুশকিল।
ছেলেবেলা, ছেলে ভোলানো ছড়া, ছেলের হাতের মোয়া, ছেলে ধরা ইত্যাদি বাক্যাংশে ‘ছেলে’ শব্দটি প্রকৃতপক্ষে ‘শিশু’ অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। আমাদের সমাজে ছেলেসন্তানই অধিক কাম্য, এ দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ এ শব্দগুচ্ছে।
শিক্ষার বিস্তার ও অধিকার সচেতনতা আমাদের সার্বিক মানসজগতে ইতিবাচক ও গুণগত পরিবর্তন আনতে সক্ষম। সমাজে নারী ও পুরুষের বৈষম্য যত হ্রাস পাবে, ততই কমে আসবে নারী-পুরুষের ভাষাপার্থক্য।
গুলশান আরা
সহযোগী অধ্যাপক ও চেয়ারপারসন, ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.