ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষের অভিযোগ উপস্থাপন-কাদের মোল্লার নির্দেশে এক পরিবারের ছয়জনকে হত্যা

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালে এক পরিবারের ছয়জনকে পাকিস্তানি সেনারা নৃশংসভাবে হত্যা করে। জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার নির্দেশে ওই হত্যাকাণ্ড ঘটে। এটিসহ আটটি ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে রাষ্ট্রপক্ষ গতকাল বুধবার কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় অভিযোগ গঠনের আবেদন জানিয়েছে।


আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষ এ আবেদন জানায়। আজ বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রপক্ষ অভিযোগ গঠনের পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করবে।
বিচারপতি নিজামুল হকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ উপস্থাপনকালে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি মোহাম্মদ আলী বলেন, একাত্তরের ২৬ মার্চ সন্ধ্যা ছয়টার দিকে মিরপুর ১২ নম্বরে কালাপানির ৫ নম্বর লাইনের ২১ নম্বর বাড়ির বাসিন্দা হজরত আলী লস্কর দৌড়ে নিজ বাড়িতে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেন। স্ত্রীকে তিনি বলেন, কাদের মোল্লা পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে তাঁকে ধাওয়া করেছেন এবং বাড়ির দিকে আসছেন। তিনি ঘরের ট্রাংকের পেছনে ও চৌকির নিচে চার মেয়ের মধ্যে দুজনকে লুকিয়ে রাখেন। কিছুক্ষণ পর কাদের মোল্লা কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা নিয়ে দরজায় ধাক্কা দেন এবং দরজা না খুললে বোমা মারার হুমকি দেন। এর পরও দরজা না খোলায় তারা বোমা ও লাথি মেরে দরজা খোলে। কাদের মোল্লার নির্দেশে পাকিস্তানি সেনারা লস্করকে গুলি করে। পরে সেনারা তাঁর স্ত্রী ও দুই মেয়েকে জবাই করে এবং দুই বছরের ছেলেকে মাটিতে আছড়ে হত্যা করে। এ দৃশ্য দেখে ট্রাংকের পেছনে লুকিয়ে থাকা দ্বিতীয় মেয়ে চিৎকার করলে তাকে বের করে এনে ধর্ষণ ও পরে হত্যা করা হয়। শুধু চৌকির আড়ালে লুকিয়ে থাকা বড় মেয়েকে সেনারা খুঁজে না পাওয়ায় সে বেঁচে যায়। কিন্তু ওই হত্যাকাণ্ড দেখে সে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। তিন বছর চিকিৎসার পর সে সুস্থ হয়।
পরে জানতে চাইলে মোহাম্মদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, এ ঘটনা সাক্ষীদের জবানবন্দিতে আছে, কিন্তু আনুষ্ঠানিক অভিযোগে ভুলবশত উল্লেখ করা হয়নি। অভিযোগটি সংযোজনের জন্য আবেদন করা হয়েছে। ট্রাইব্যুনাল এই আবেদনের শুনানির জন্য আজ বৃহস্পতিবার দিন ধার্য করেছেন।
অভিযোগ উপস্থাপনকালে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি বলেন, একাত্তরের ২৯ মার্চ বিকেলে আরামবাগ থেকে খন্দকার আবু তালেব নামের এক ব্যক্তি মিরপুরে তাঁর পুড়ে যাওয়া বাড়ি দেখতে যান। বাড়ি দেখা শেষে তিনি আরামবাগ ফেরার জন্য মিরপুর ১০ নম্বর সেকশনের বাসস্ট্যান্ডে গেলে কাদের মোল্লা ও তাঁর সহযোগীরা তাঁকে ধরে জল্লাদখানা পাম্প হাউসে নিয়ে যান। সেখানে তাঁকে জবাই করে হত্যা করা হয়। অক্টোবরে মিরপুর ৬ নম্বর সেকশনের বাসিন্দা কবি মেহেরুন্নিসাকে নির্মমভাবে হত্যা করে কাদের মোল্লার সহযোগীরা। সিরাজ নামের এক ব্যক্তি ওই হত্যাকাণ্ড দেখে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন।
কৌঁসুলি আরও বলেন, ২৪ এপ্রিল মিরপুরের আলোকদী গ্রামে গণহত্যার সঙ্গে কাদের মোল্লা জড়িত ছিলেন। গণহত্যার দিন ফজরের নামাজের পর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি হেলিকপ্টার গ্রামের পূর্ব দিকে নামে। কাদের মোল্লা অর্ধশতাধিক অবাঙালি ও রাজাকার নিয়ে গ্রামের পশ্চিম দিক থেকে ঢোকেন ও এলোপাতাড়ি গুলি করতে থাকেন। ওই ঘটনায় ৩৪৪ জনের বেশি মারা যায়, তাদের মধ্যে ২১ জনের নাম-ঠিকানাসহ পরিচিতি পাওয়া গেছে।
মোহাম্মদ আলী বলেন, মুক্তিযুদ্ধকালে কাদের মোল্লা মিরপুর ও মোহাম্মদপুরের ‘জল্লাদ’ বা ‘কসাই’ নামে পরিচিত ছিলেন। একাত্তরের ২৫ মার্চ মধ্যরাত থেকে তিনি স্থানীয় বিহারিদের সঙ্গে নিয়ে বাঙালি নিধন শুরু করেন। ২ এপ্রিল কল্যাণপুর, মিরপুর ও মোহাম্মদপুরে কাদের মোল্লা ও তাঁর সহযোগীরা এলাকার বাঙালিদের ঘরবাড়ি লুট, অগ্নিসংযোগ ও নারী ধর্ষণ করে বীভৎস কাণ্ড ঘটায়। এই ঘটনায় তাঁর নাম হয় ‘কসাই’।
ভুলে ভরা আনুষ্ঠানিক অভিযোগ: গতকাল অভিযোগ উপস্থাপনের সময় ট্রাইব্যুনাল কয়েকবার বিরক্তি প্রকাশ করে বলেন, আনুষ্ঠানিক অভিযোগ ভুলে ভরা। এখানে নাম ভুল, এমনকি ঘটনা ও তারিখ ভুল লেখা হয়েছে। শব্দের বানান ভুল তো বাদই দেওয়া হলো। জেনারেল রাও ফরমান আলীর নামের শেষে ও আসগর আলীর নামের আগে খান যোগ করা হয়েছে। একাত্তরের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় পতাকা উত্তোলন ও ৩ মার্চ পল্টনের সমাবেশের ঘটনা উল্টো লেখা হয়েছে। ট্রাইব্যুনাল এসব ভুল সংশোধন করতে এবং ঐতিহাসিক বিষয় লিখতে রাষ্ট্রপক্ষকে আরও সতর্ক হতে বলেন।

No comments

Powered by Blogger.