সেবক বনাম ঘাতক বিতর্ক
বদলে দাও বদলে যাও মিছিল-এ দেশের তিনটি জরুরি সমস্যা নিয়ে অব্যাহত আলোচনা হচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনা কি চলতেই থাকবে, গণমাধ্যমে শিশুদের জন্য বাংলায় বিনোদন চাই, ইভটিজিংমুক্ত বাংলাদেশ চাই। সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধ আন্দোলনে অন্যতম সক্রিয় ব্যক্তিত্ব তারানা হালিম-এর লেখাটি ছাপা হলো আজ
আমার মাঝে খুব ছোটবেলা থেকেই দুটি সত্তা ‘শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের’ নীতি মেনে চলছে। একটি সত্তা খুব আবেগপ্রবণ, বিনয়ী। সামান্যতেই খুব বেশি কষ্ট পায়, আর কষ্ট পেলে কেবলই কাঁদে। অন্যটি প্রতিবাদী। অন্যায় দেখলে মুহূর্তেই তার বিনয়ী রূপটি বিদ্রোহী রূপ ধারণ করে। তবে দুটি সত্তার মাঝে সাধারণ যে বিষয়টি লক্ষণীয় তা হলো, ওরা ক্ষতিকর নয়। আর সমস্যার দিকটি হলো, পৃথিবীর সব সমস্যাকে আমার নিজের সমস্যা মনে হয়। আর সব সমস্যা সমাধানের দায়টিও নিজের মনে হয়। আমার খুব শ্রদ্ধেয় একজন রাজনীতিবিদ আমাকে বলেছিলেন, ‘দেশের আর পৃথিবীর যাবতীয় সমস্যার সমাধান তোমার হাতে নেই। সেটি তুমি পারবেও না। তোমার কাজ কচুরিপানায় এক বিন্দু জল রাখা। সেটা তুমি করার চেষ্টা করছ।’ কিন্তু কীভাবে বলি এক বিন্দু নয়, আমার ইচ্ছে করে কচুরিপানার সম্পূর্ণটা জলে ভরে দিই! আর তা করতে না পারায় ক্ষতবিক্ষত অন্তরটি কখনো কষ্ট পেয়ে চোখের জলে ভাসে, কখনো বা প্রতিবাদী হয়ে ওঠে।
ছোটবেলায় আমার বাবা-মা কিছু আদর্শ, অ্যান্টিবায়োটিকের মতো কোর্স কমপ্লিট করিয়েছিলেন, ‘ঘুষ নেবে না, দেবে না’, ‘অহংকারী হবে না,’ ‘হিংসা-বিদ্বেষ থেকে দূরে থাকবে’, ‘পরনিন্দা করবে না’, ‘মানুষকে সম্মান করবে’। শিখিয়েছিলেন—‘সাদা’ আর ‘কালো’। সাদা হলো, সততা, সত্যবাদিতা, পরমতসহিষ্ণুতা, অন্যায়ের প্রতিবাদ করা, দেশ ও মানুষকে ভালোবাসা আর কালো হলো, দুর্নীতি, মিথ্যাচার, দেশ ও মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করা, আদর্শচ্যুত হওয়া। কিন্তু জীবনের কঠিন পথে বারবার এই আদর্শগুলো নিয়ে চলতে গিয়ে হোঁচট খেয়েছি, জেনেছি জীবনে সাদা আর কালো ছাড়াও লাল, নীল, হলুদ, সবুজ, ধূসর নানা রং আছে। তবু আজ এটুকু বলতে পারি, হোঁচট খেয়ে সাদাকে বিসর্জন দিইনি বরং যতবার হোঁচট খেয়েছি, ততবার আরও শক্ত করে সাদাকে আঁকড়ে ধরেছি।
আমাদের দেশে মন্দ কাজে অংশীদারের অভাব হয় না। কারণ তাতে অবৈধ অর্থ বা সম্পদের ভাগবাটোয়ারায় অংশীদারি থাকে। কিন্তু ভালো কাজ করতে যান—প্রতিপদে হোঁচট খাবেন। বিতর্কিত হবেন, আপনার সরল উদ্দেশ্যের পেছনে অনেক উদ্দেশ্য খুঁজে বের করা হবে। এ জন্যই মন্দরা সংগঠিত, ভালোরা অসংগঠিত। আমি ছোট্ট একটি উদাহরণ দিই। আমি যখন ১৮ বছর ধরে চলে আসা পরীক্ষাবিহীনভাবে ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়া বন্ধের জন্য উচ্চকিত হলাম, আমরণ অনশনের ঘোষণা দিলাম, তখন কিন্তু ১৮ বছর ধরে চলে আসা একটি অনিয়ম বন্ধের চেষ্টা করেছি মাত্র। এর পেছনে আন্নাহাজারে হওয়ার কোনো ইচ্ছে ছিল না। শুধু মানুষকে বাঁচানোর ইচ্ছে ছিল। অথচ একজন বড় মাপের নেতা বলে ফেললেন, মিডিয়া আমাকে আন্নাহাজারে বানানোর চেষ্টা করছে। সামাজিক আন্দোলনকে রাজনীতিকরণে ব্যথিত হলাম। কিন্তু জনগণ লাভবান হলো। বিনা পরীক্ষায় লাইসেন্স দেওয়ার ১৮ বছরের অনিয়ম বন্ধ হলো। প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিলেন, পরীক্ষাবিহীন লাইসেন্স দেওয়া হবে না। চালকদের প্রশিক্ষিত হতে হবে। আপাতত বড় একটি লক্ষ্য অর্জিত হলো। কারণ বৈধ লাইসেন্স অদক্ষ চালকের হাতে গেলে তা হতো বৈধ আগ্নেয়াস্ত্র এমন ব্যক্তির হাতে তুলে দেওয়ার মতো।
আমার প্রস্তাবটি মেনে নেওয়ার কারণে আমাকে অনশনে যেতে হয়নি। সড়ক দুর্ঘটনায় স্বজন হারানোদের চোখের জল আর নিথর লাশের বিনিময়ে ‘খ্যাতি’ পাওয়ার ইচ্ছের চেয়ে মৃত্যুও ভালো। আমার চাওয়া—প্রশিক্ষিত চালক ও সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধ। আমার প্রতিষ্ঠিত কোনো ড্রাইভিং ইনস্টিটিউট নেই বা হবেও না। কাজেই এর পেছনে আমার কোনো আর্থিক স্বার্থ নেই, ছিলও না। ছিল শুধু কিছু জীবন রক্ষা করার অদমনীয় চেষ্টা।
কারণটা ব্যাখ্যা করি। আমাদের দুই বোনকে সবাই বলে তোমরা একটু ‘বেশি মা।’ বেশি মা-র অর্থ হলো আমরা একটু বেশিই ‘সন্তান-সন্তান’ করি। কিন্তু স্রষ্টা যখন আমার বড় বোনের ছোট ছেলে ১৯ বছরের সাইফ আহমেদ অর্ণবের ওপর চিরতরে ভাগ বসালেন, তখন তা কীভাবে মানব আমরা? বিশ্বাস করুন, দুই বছর হলো সাইফ সড়ক দুর্ঘটনায় হত হয়েছে—মনে হয় গতকালের ঘটনা। অশ্রু, বেদনা, চাপা কষ্ট সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এক ফোটা কমেনি। মাঝেমধ্যে দুই বোন ভাবি, আমাদের স্ট্রোক হলে ভালো হতো। মস্তিষ্কের অনুভূতির অংশটি অকেজো হয়ে যেত—ওর চলে যাওয়ার কষ্টটা বুঝতে পারতাম না, ওর স্মৃতিগুলো মুছে যেত। আবার পরক্ষণেই মনে হয়, ওর স্মৃতিগুলো তো মুছতে চাই না—শুধু কষ্টটুকু ভুলতে চাই। বলতে পারি না দক্ষিণের জানালা দিয়ে আমাদের বুক ভরা বাতাস ‘সাইফ’ চলে গেছে।
স্বজন হারানোর এই কষ্ট যেন আর কারও হূদয়কে চূর্ণ-বিচূর্ণ না করে, বেঁচে থকার বাতাসটুকু কেড়ে না নেয়, জীবনের আনন্দ-হাসি গান যেন একটি দুর্ঘটনার বলি না হয়, সে জন্যই তো আমরা গড়ে তুলেছি সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধের লক্ষ্যে সাইফের নামে ‘সাইফ ফাউন্ডেশন’। কষ্ট থেকে উৎসারিত যে শুভ চিন্তা, জনকল্যাণ, তা নিয়ে বিবেকবান কেউ কি রাজনীতি করে?
কিন্তু যখন দাবি করা হয় সব চালকই সেবক, তখন চালকদের নিয়ে এই সেবক বনাম ঘাতক বিতর্কে না জড়িয়ে নিজেকে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে রাখতে পারি না। চালকেরা সেবক তখনই, যখন তাঁরা সততা ও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে গাড়ি চালান, যাত্রীসেবা নিশ্চিত করেন, ট্রাফিক আইন মেনে চলেন, গতির প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হন না, গতির চেয়ে জীবনের অধিক মূল্য দেন। কিন্তু যে চালকের বেপরোয়া গতি, ট্রাফিক আইন অমান্য করা, হেলপার দিয়ে গাড়ি চালানোর কারণে সড়কে কেউ হত হয়, তখনো কি সেই চালককে সেবক বলতে হবে? তদন্ত শেষে বিচারে দুর্ঘটনার জন্য তাকে দায়ী করে রায় দেওয়া হলেও কি তাকে সেবক বলতে হবে? বিচারে দোষী সাব্যস্ত চালককে অবশ্যই ‘ঘাতক’ বা পরিমার্জিতভাবে বললে ‘দোষী চালক’ বলতে হবে। সব মানুষ যেমন খুনি নন, তেমনি সব চালক ঘাতক—এ কথা নির্বোধও বলবে না। তবে ‘খুনি’ অবশ্যই ‘খুনি’ , ‘ঘাতক’ অবশ্যই ঘাতক এবং সেবক ও ঘাতক বিতর্কের যে চালক অন্যকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের দুর্ঘটনার শিকার হন, তাঁকে আমরা ‘সেবক’ই বলতে চাই। কিন্তু যে চালকের বেপরোয়া মনোভাব, বেপরোয়া গতি জীবন কেড়ে নেয় তাকে ‘সেবক’ বলতে রাজি নই। ঘাতকই বলতে চাই।
কেউ কি সিলভী বা সাইফের মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে বলতে পারবেন, যে চালক হাত দেখানোর পরও গাড়ি না থামিয়ে বা দ্রুত ও বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালিয়ে আপনার সন্তানকে কেড়ে নিয়েছে সে আপনাদের সেবা করেছে। কারণ এখন আর সন্তানের পেছনে আপনার সময় দিতে হয় না। কাজেই সে আপনার মূল্যবান সময়ের অপচয় রোধ করেছে, তাই সে একজন সেবক কিংবা এই সন্তানদের মানুষ করতে আপনার যে অর্থব্যয় হতো তা থেকে আপনাকে সে মুক্তি দিয়েছে তাই সে একজন সেবক কিংবা সন্তানকে নিয়ে আপনার সমস্ত আবেগ বা উৎকণ্ঠার অবসান ঘটিয়েছে তাই সে একজন সেবক—তাহলে আমি নিশ্চিত ওদের মা’রা সেই সেবকদের তদবিরকারীর চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করবেন—‘আমার স্থানে আসুন। তারপর বলতে পারবেন আপনার সন্তানের ঘাতক একজন সেবক?’ আমি নিশ্চিত তদবিরকারী, মনুষ্য প্রজাতির হলে চোখে চোখ রেখে তখন আর তাদের সেবক হিসেবে দাবি করতে পারবেন না। রাস্তায় চলতে ট্রাকের শরীরে মাঝেমধ্যে লেখা দেখি, ‘সমগ্র বাংলাদেশ ৫ টন’। গুটি কয়েক স্বার্থান্বেষী মানুষের কাছে দেশটাই ৫ টন, তাদের কাছে মানুষের জীবনের ওজন আর কত হবে?
তারানা হালিম: সমাজকর্মী ও আইনজীবী। (সামাজিক আন্দোলন রাজনৈতিক হতে পারে না দেখে সমাজ কর্মী পরিচয়েই লিখলাম)
জনমত জরিপের ফলাফল
বদলে যাও বদলে দাও মিছিলের ওয়েবসাইটে নতুন তিনটি জনমত শুরু হয়েছে চলতি সপ্তাহে। আপনিও অংশ নিন জরিপে।
আপনি কি মনে করেন রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন ইভ টিজিং বন্ধে বড় ভূমিকা রাখতে পারে?
হ্যাঁ ৬৬% না ৩১%
মন্তব্য নেই ৩%
৭ মার্চ, ২০১২ পর্যন্ত
স্যাটেলাইট চ্যানেলে হিন্দি ভাষায় প্রচারিত কার্টুন বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশে ক্ষতিকর বলে কি আপনি করেন?
হ্যাঁ ৮৪% না ১৪%
মন্তব্য নেই ২%
৭ মার্চ, ২০১২ পর্যন্ত
মহাসড়কে সোয়া লাখ ফিটনেসবিহীন লক্কড়ঝক্কড় গাড়ি চলছে। আপনি কি মনে করেন এগুলো তুলে নিলে সড়ক দুর্ঘটনা কমে আসবে?
হ্যাঁ ৭৮% না ২১% মন্তব্য নেই ১%
৭ মার্চ, ২০১২ পর্যন্ত
ছোটবেলায় আমার বাবা-মা কিছু আদর্শ, অ্যান্টিবায়োটিকের মতো কোর্স কমপ্লিট করিয়েছিলেন, ‘ঘুষ নেবে না, দেবে না’, ‘অহংকারী হবে না,’ ‘হিংসা-বিদ্বেষ থেকে দূরে থাকবে’, ‘পরনিন্দা করবে না’, ‘মানুষকে সম্মান করবে’। শিখিয়েছিলেন—‘সাদা’ আর ‘কালো’। সাদা হলো, সততা, সত্যবাদিতা, পরমতসহিষ্ণুতা, অন্যায়ের প্রতিবাদ করা, দেশ ও মানুষকে ভালোবাসা আর কালো হলো, দুর্নীতি, মিথ্যাচার, দেশ ও মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করা, আদর্শচ্যুত হওয়া। কিন্তু জীবনের কঠিন পথে বারবার এই আদর্শগুলো নিয়ে চলতে গিয়ে হোঁচট খেয়েছি, জেনেছি জীবনে সাদা আর কালো ছাড়াও লাল, নীল, হলুদ, সবুজ, ধূসর নানা রং আছে। তবু আজ এটুকু বলতে পারি, হোঁচট খেয়ে সাদাকে বিসর্জন দিইনি বরং যতবার হোঁচট খেয়েছি, ততবার আরও শক্ত করে সাদাকে আঁকড়ে ধরেছি।
আমাদের দেশে মন্দ কাজে অংশীদারের অভাব হয় না। কারণ তাতে অবৈধ অর্থ বা সম্পদের ভাগবাটোয়ারায় অংশীদারি থাকে। কিন্তু ভালো কাজ করতে যান—প্রতিপদে হোঁচট খাবেন। বিতর্কিত হবেন, আপনার সরল উদ্দেশ্যের পেছনে অনেক উদ্দেশ্য খুঁজে বের করা হবে। এ জন্যই মন্দরা সংগঠিত, ভালোরা অসংগঠিত। আমি ছোট্ট একটি উদাহরণ দিই। আমি যখন ১৮ বছর ধরে চলে আসা পরীক্ষাবিহীনভাবে ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়া বন্ধের জন্য উচ্চকিত হলাম, আমরণ অনশনের ঘোষণা দিলাম, তখন কিন্তু ১৮ বছর ধরে চলে আসা একটি অনিয়ম বন্ধের চেষ্টা করেছি মাত্র। এর পেছনে আন্নাহাজারে হওয়ার কোনো ইচ্ছে ছিল না। শুধু মানুষকে বাঁচানোর ইচ্ছে ছিল। অথচ একজন বড় মাপের নেতা বলে ফেললেন, মিডিয়া আমাকে আন্নাহাজারে বানানোর চেষ্টা করছে। সামাজিক আন্দোলনকে রাজনীতিকরণে ব্যথিত হলাম। কিন্তু জনগণ লাভবান হলো। বিনা পরীক্ষায় লাইসেন্স দেওয়ার ১৮ বছরের অনিয়ম বন্ধ হলো। প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিলেন, পরীক্ষাবিহীন লাইসেন্স দেওয়া হবে না। চালকদের প্রশিক্ষিত হতে হবে। আপাতত বড় একটি লক্ষ্য অর্জিত হলো। কারণ বৈধ লাইসেন্স অদক্ষ চালকের হাতে গেলে তা হতো বৈধ আগ্নেয়াস্ত্র এমন ব্যক্তির হাতে তুলে দেওয়ার মতো।
আমার প্রস্তাবটি মেনে নেওয়ার কারণে আমাকে অনশনে যেতে হয়নি। সড়ক দুর্ঘটনায় স্বজন হারানোদের চোখের জল আর নিথর লাশের বিনিময়ে ‘খ্যাতি’ পাওয়ার ইচ্ছের চেয়ে মৃত্যুও ভালো। আমার চাওয়া—প্রশিক্ষিত চালক ও সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধ। আমার প্রতিষ্ঠিত কোনো ড্রাইভিং ইনস্টিটিউট নেই বা হবেও না। কাজেই এর পেছনে আমার কোনো আর্থিক স্বার্থ নেই, ছিলও না। ছিল শুধু কিছু জীবন রক্ষা করার অদমনীয় চেষ্টা।
কারণটা ব্যাখ্যা করি। আমাদের দুই বোনকে সবাই বলে তোমরা একটু ‘বেশি মা।’ বেশি মা-র অর্থ হলো আমরা একটু বেশিই ‘সন্তান-সন্তান’ করি। কিন্তু স্রষ্টা যখন আমার বড় বোনের ছোট ছেলে ১৯ বছরের সাইফ আহমেদ অর্ণবের ওপর চিরতরে ভাগ বসালেন, তখন তা কীভাবে মানব আমরা? বিশ্বাস করুন, দুই বছর হলো সাইফ সড়ক দুর্ঘটনায় হত হয়েছে—মনে হয় গতকালের ঘটনা। অশ্রু, বেদনা, চাপা কষ্ট সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এক ফোটা কমেনি। মাঝেমধ্যে দুই বোন ভাবি, আমাদের স্ট্রোক হলে ভালো হতো। মস্তিষ্কের অনুভূতির অংশটি অকেজো হয়ে যেত—ওর চলে যাওয়ার কষ্টটা বুঝতে পারতাম না, ওর স্মৃতিগুলো মুছে যেত। আবার পরক্ষণেই মনে হয়, ওর স্মৃতিগুলো তো মুছতে চাই না—শুধু কষ্টটুকু ভুলতে চাই। বলতে পারি না দক্ষিণের জানালা দিয়ে আমাদের বুক ভরা বাতাস ‘সাইফ’ চলে গেছে।
স্বজন হারানোর এই কষ্ট যেন আর কারও হূদয়কে চূর্ণ-বিচূর্ণ না করে, বেঁচে থকার বাতাসটুকু কেড়ে না নেয়, জীবনের আনন্দ-হাসি গান যেন একটি দুর্ঘটনার বলি না হয়, সে জন্যই তো আমরা গড়ে তুলেছি সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধের লক্ষ্যে সাইফের নামে ‘সাইফ ফাউন্ডেশন’। কষ্ট থেকে উৎসারিত যে শুভ চিন্তা, জনকল্যাণ, তা নিয়ে বিবেকবান কেউ কি রাজনীতি করে?
কিন্তু যখন দাবি করা হয় সব চালকই সেবক, তখন চালকদের নিয়ে এই সেবক বনাম ঘাতক বিতর্কে না জড়িয়ে নিজেকে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে রাখতে পারি না। চালকেরা সেবক তখনই, যখন তাঁরা সততা ও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে গাড়ি চালান, যাত্রীসেবা নিশ্চিত করেন, ট্রাফিক আইন মেনে চলেন, গতির প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হন না, গতির চেয়ে জীবনের অধিক মূল্য দেন। কিন্তু যে চালকের বেপরোয়া গতি, ট্রাফিক আইন অমান্য করা, হেলপার দিয়ে গাড়ি চালানোর কারণে সড়কে কেউ হত হয়, তখনো কি সেই চালককে সেবক বলতে হবে? তদন্ত শেষে বিচারে দুর্ঘটনার জন্য তাকে দায়ী করে রায় দেওয়া হলেও কি তাকে সেবক বলতে হবে? বিচারে দোষী সাব্যস্ত চালককে অবশ্যই ‘ঘাতক’ বা পরিমার্জিতভাবে বললে ‘দোষী চালক’ বলতে হবে। সব মানুষ যেমন খুনি নন, তেমনি সব চালক ঘাতক—এ কথা নির্বোধও বলবে না। তবে ‘খুনি’ অবশ্যই ‘খুনি’ , ‘ঘাতক’ অবশ্যই ঘাতক এবং সেবক ও ঘাতক বিতর্কের যে চালক অন্যকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের দুর্ঘটনার শিকার হন, তাঁকে আমরা ‘সেবক’ই বলতে চাই। কিন্তু যে চালকের বেপরোয়া মনোভাব, বেপরোয়া গতি জীবন কেড়ে নেয় তাকে ‘সেবক’ বলতে রাজি নই। ঘাতকই বলতে চাই।
কেউ কি সিলভী বা সাইফের মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে বলতে পারবেন, যে চালক হাত দেখানোর পরও গাড়ি না থামিয়ে বা দ্রুত ও বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালিয়ে আপনার সন্তানকে কেড়ে নিয়েছে সে আপনাদের সেবা করেছে। কারণ এখন আর সন্তানের পেছনে আপনার সময় দিতে হয় না। কাজেই সে আপনার মূল্যবান সময়ের অপচয় রোধ করেছে, তাই সে একজন সেবক কিংবা এই সন্তানদের মানুষ করতে আপনার যে অর্থব্যয় হতো তা থেকে আপনাকে সে মুক্তি দিয়েছে তাই সে একজন সেবক কিংবা সন্তানকে নিয়ে আপনার সমস্ত আবেগ বা উৎকণ্ঠার অবসান ঘটিয়েছে তাই সে একজন সেবক—তাহলে আমি নিশ্চিত ওদের মা’রা সেই সেবকদের তদবিরকারীর চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করবেন—‘আমার স্থানে আসুন। তারপর বলতে পারবেন আপনার সন্তানের ঘাতক একজন সেবক?’ আমি নিশ্চিত তদবিরকারী, মনুষ্য প্রজাতির হলে চোখে চোখ রেখে তখন আর তাদের সেবক হিসেবে দাবি করতে পারবেন না। রাস্তায় চলতে ট্রাকের শরীরে মাঝেমধ্যে লেখা দেখি, ‘সমগ্র বাংলাদেশ ৫ টন’। গুটি কয়েক স্বার্থান্বেষী মানুষের কাছে দেশটাই ৫ টন, তাদের কাছে মানুষের জীবনের ওজন আর কত হবে?
তারানা হালিম: সমাজকর্মী ও আইনজীবী। (সামাজিক আন্দোলন রাজনৈতিক হতে পারে না দেখে সমাজ কর্মী পরিচয়েই লিখলাম)
জনমত জরিপের ফলাফল
বদলে যাও বদলে দাও মিছিলের ওয়েবসাইটে নতুন তিনটি জনমত শুরু হয়েছে চলতি সপ্তাহে। আপনিও অংশ নিন জরিপে।
আপনি কি মনে করেন রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন ইভ টিজিং বন্ধে বড় ভূমিকা রাখতে পারে?
হ্যাঁ ৬৬% না ৩১%
মন্তব্য নেই ৩%
৭ মার্চ, ২০১২ পর্যন্ত
স্যাটেলাইট চ্যানেলে হিন্দি ভাষায় প্রচারিত কার্টুন বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশে ক্ষতিকর বলে কি আপনি করেন?
হ্যাঁ ৮৪% না ১৪%
মন্তব্য নেই ২%
৭ মার্চ, ২০১২ পর্যন্ত
মহাসড়কে সোয়া লাখ ফিটনেসবিহীন লক্কড়ঝক্কড় গাড়ি চলছে। আপনি কি মনে করেন এগুলো তুলে নিলে সড়ক দুর্ঘটনা কমে আসবে?
হ্যাঁ ৭৮% না ২১% মন্তব্য নেই ১%
৭ মার্চ, ২০১২ পর্যন্ত
No comments