বিশেষ সাক্ষাৎকার : মোফাজ্জল করিম-রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আসেনি

তিন বছর পার করল মহাজোট সরকার। এই তিন বছরে কতটুকু এগিয়েছে দেশ? সরকার কি দেশের মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে পেরেছে? বিরোধী দল কি সঠিক ভূমিকা পালন করছে? রাজনীতির মাঠে দুই জোট এখন অনেকটাই মুখোমুখি অবস্থানে।


ওদিকে গঠিত হয়েছে নতুন নির্বাচন কমিশন। সাম্প্রতিক রাজনীতির হালহকিকত আর আগামী দিনের প্রত্যাশার কথা কালের কণ্ঠকে জানিয়েছেন সাবেক সচিব ও লন্ডনে বাংলাদেশের সাবেক হাইকমিশনার মোফাজ্জল করিম। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আলী হাবিব
কালের কণ্ঠ : নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে। এই নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে আপনার অভিমত জানতে চাই।
মোফাজ্জল করিম : নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে। আমি নতুন নির্বাচন কমিশনকে অভিনন্দন জানাই। কমিশন গঠনের আগে একটি সার্চ কমিটি গঠন করা হয়। সার্চ কমিটির সুপারিশক্রমে এই কমিশন গঠন করা হয়েছে। জাতির প্রত্যাশা ছিল সৎ ও যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়েই নির্বাচন কমিশন গঠন করা হবে। আমার মনে হয় সে প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের নতুন সদস্যদর অনেকেই আমার পূর্ব পরিচিত। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিব উদ্দিন আহমেদ সিভিল সার্ভিসের অত্যন্ত সৎ, যোগ্য ও দক্ষ একজন কর্মকর্তা ছিলেন। তাঁর সঙ্গে সিভিল সার্ভিসের আরো দুজন আছেন। তাঁদেরও আমি চিনি। তাঁরা অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য কর্মকর্তা ছিলেন। সঙ্গে বিচার বিভাগ থেকে একজন আছেন। সেনাবাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আছেন। সবাই মিলে একসঙ্গে কাজ করলে নিশ্চয়ই তাঁরা তাঁদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব দক্ষতার সঙ্গে পালন করতে পারবেন। তবে তাঁদের কাছ থেকে জাতি আশা করে সততা, আন্তরিকতা ও নিরপেক্ষতা। এবং আমিও ব্যক্তিগতভাবে সেটাই প্রত্যাশা করি। কোনো পক্ষপাতদোষে দুষ্ট না হয়ে তাঁরা যদি এগিয়ে যান, তাহলে নিশ্চয়ই তাঁরা সফল হবেন।
কালের কণ্ঠ : আগামী নির্বাচন কোন ব্যবস্থায় হওয়া উচিত বলে মনে করেন?
মোফাজ্জল করিম : আমি সব সময় মনে করি, যেকোনো নির্বাচন যদি নিরপেক্ষতা হারায়, জনগণের দৃষ্টিতে যদি সেটা নিরপেক্ষ না হয়, তাহলে তা কিছুতেই জাতীয় বা আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হবে না। আমাদের দেশে যদি এখন জনমত যাচাই করা হয় বা জরিপ চালানো হয়, তাহলে দেখা যাবে দেশের ৯০ শতাংশ মানুষই চায় একটি নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান। তাকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারই বলুন আর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারই বলুন। নিরপেক্ষ কারো অধীনে নির্বাচন হতে হবে। নির্বাচন তো করে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন কমিশনটা যদি নিরপেক্ষ হয়, যে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে, সেই কমিশন যদি নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে পারে, যদি কোনো কারণেই পদস্খলন না হয়, তাহলে আমার ধারণা নির্বাচন নিরপেক্ষ হবে। তবে সব কথার শেষ কথা হচ্ছে সরকার কে পরিচালনা করছে, কারা পরিচালনা করছে তা দেখতে হবে। বর্তমানে বাংলাদেশে কোনো দলীয় সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে পারে না। কারণ অতীতে আমাদের দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করার তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে। আবার অন্তর্বর্তীকালীন বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের অভিজ্ঞতাও রয়েছে। এ সময়ে নির্বাচন সুন্দরভাবে, সুষ্ঠুভাবে, নিরপেক্ষভাবে হয়েছে, তা বিশ্বে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, প্রশংসা কুড়িয়েছে। সেখান থেকে হঠাৎ করে গত পাঁচ বছরে আমরা এমন কোনো যোগ্যতা অর্জন করিনি যে দলীয়ভাবে নির্বাচন করলে সেটা সফল, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হবে। কাজেই আমি মনে করি, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করার সময় এখনো আসেনি। এই বিষয়টি বিবেচনা করেই আদালত থেকে বলা হয়েছে, আগামী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে। এ কথা বলার অর্থই হচ্ছে, আদালত মনে করেন, এখনো সময় আসেনি। আরো দুটি নির্বাচন ওভাবে করে নিজেদের নিরপেক্ষ করে তুলতে হবে। যোগ্য করে তুলতে হবে। আদালতের রায়ের সেই লাইনগুলো না পড়েই একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এটা কিছুতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। দেশের মানুষ এটা মানবে না।
অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, আমাদের রাজনৈতিক ধারায় কোনো গুণগত পরিবর্তন আজ পর্যন্ত হয়নি। স্বাধীনতার পর থেকে একই ধারার রাজনীতি চলে আসছে। সেটা কী? সব কিছু আমি লুটেপুটে খাব। আমি পাব। আর কাউকে কোনো ভাগ দেব না। অংশীদারিত্ব দেব না। আমি যদি ৩০০টির মধ্যে ২০০ বা ২৬০টি আসন পেয়ে যাই, তাহলে 'উইনার্স টেক অল'। বাকি কাউকে কোনো অংশীদারিত্ব দেব না। রাষ্ট্রীয় কোনো বিষয়ে কোনো মতামতও তাদের রাখতে দেব না। সংসদেও তাদের ভূমিকা সঠিকভাবে পালন করতে দেব না। একটা অপসংস্কৃতি রাজনীতির মধ্যে ঢুকেছে। এ কারণেই রাজনীতিতে সহনশীলতার অভাব। আমরা পরমতসহিষ্ণু হতে পারি না। যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা পরমতসহিষ্ণু না হতে পারব ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের মধ্যে কোনো নিরপেক্ষতা আসবে না। নিরপেক্ষতা না এলে কিছুতেই কোনো দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে পারে না।
কালের কণ্ঠ : তিন বছর পার করল মহাজোট সরকার। সরকারের এই সময়টাকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
মোফাজ্জল করিম : নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় আসার আগে বর্তমান সরকার অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। প্রতিশ্রুতি দিয়ে দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিল। সেই প্রতিশ্রুতি পূরণে সরকার কতটুকু সফল হয়েছে, সেই প্রশ্ন সরকার নিজেকেই নিজে করতে পারে। আওয়ামী লীগ ও তাদের সহযোগী দলগুলো নিজেদের এই প্রশ্ন করে দেখতে পারে। দেশের মানুষ ভীষণভাবে হতাশ। তাদের ওপর আস্থা স্থাপন করে, বিশ্বাস স্থাপন করে ভোট দিয়েছিল দেশের মানুষ। কিন্তু তারা যেসব বিষয় সামনে রেখে ভোট দিয়েছিল, যেমন- সুশাসন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, কর্মসংস্থান, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ, গ্যাস-বিদ্যুৎ ব্যবস্থার উন্নয়ন- সব কিছুতেই আমরা দেখতে পাচ্ছি একটা হতাশা। কোনো কিছুতেই উল্লেখযোগ্য কোনো উন্নতি নেই। কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রশ্নবোধক চিহ্ন এমনভাবে এসেছে যে তা আলোচনার বিষয়। দুর্নীতির কথা যেমন বলা হচ্ছে। এখন হয়তো নিম্নপর্যায়ে দুর্নীতি মানুষের গা-সওয়া হয়ে গেছে। কিন্তু উচ্চপর্যায়ে কিছু দুর্নীতির অভিযোগ সরকারকে যেমন বিব্রত করেছে, তেমনি দেশের মানুষকে হতাশ করেছে। তারপর ধরুন বেকারত্ব। কর্মসংস্থান দেশে নেই বললেই চলে। বিনিয়োগ নেই। গত পাঁচ বছরে দেশে বিনিয়োগের চিত্র কী? এমন হতাশাজনক চিত্র আগের কোনো সরকারের আমলেই ছিল না। ধরুন শেয়ারবাজারের কথা। এত বড় ধাক্কা গেল শেয়ারবাজারে। মানুষ হতাশ হয়ে আত্মহত্যা পর্যন্ত করেছে। খুব আশা করেছিল মানুষ, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হবে। কিন্তু তা কি হয়েছে? চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি-দখলবাজি চরমে পৌঁছেছে। ছাত্রলীগ-যুবলীগের দৌরাত্ম্যে মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত। গুপ্তহত্যা বেড়েছে। বেড়েছে সড়ক দুর্ঘটনা। সরকার কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি। কিন্তু এত কিছুর মধ্যেও আশার আলো কিছুটা নিশ্চয়ই দেখতে পাই। সে জন্য সরকারকে আমি ধন্যবাদ দিতে চাই। যেমন- শিক্ষাব্যবস্থা। এই একটি মন্ত্রণালয় নিশ্চয়ই সাফল্যের দাবিদার। তেমনি কৃষি। এই দুটি ক্ষেত্রে সরকারের সাফল্য অবশ্যই প্রশংসনীয়। পাশাপাশি খাদ্য ব্যবস্থাপনাও খারাপ নয়। এই তিনটি মন্ত্রণালয় সরকারের মান রেখেছে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা, উৎপাদন, বিনিয়োগ, দ্রব্যমূল্য, বৈদেশিক সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয়ে গত তিন বছরে সরকারের কোনো সাফল্য নেই। আগামীতেও কোনো সম্ভাবনা দেখি না।
কালের কণ্ঠ : বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। বেড়েছে জীবনযাত্রার ব্যয়। পাশাপাশি শেয়ারবাজার অস্থিতিশীল। এ অবস্থায় সরকার কী ব্যবস্থা নিতে পারত বলে আপনি মনে করেন?
মোফাজ্জল করিম : আমরা লক্ষ করি, এ সরকার আসার পর থেকে দ্রব্যমূল্য এবং বাজার ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে বক্তব্য রাখা হয়েছে অনেক। কথার ফুলঝুরি ঝরানো হয়েছে। কিন্তু সত্যিকারের ব্যবস্থাপনা বলতে যা বুঝি আমরা, তা হয়নি। এখন হয়তো মন্ত্রিত্বের পরিবর্তনে কথা দিয়ে চিঁড়া ভেজানোর চেষ্টা বন্ধ হয়েছে। ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতা প্রকট। বেসরকারি খাতের ওপর দোষ চাপিয়ে দেওয়ার একটা প্রবণতা- এই করে সর্বনাশ করা হয়েছে। কাজের কাজটা করা হয়নি। কেন দাম বাড়ছে, কেন সরবরাহ বাড়ছে না, সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া হয়নি। মনিটরিং ব্যবস্থাপনা জোরদার করার কোনো চেষ্টাই করা হয়নি। অবহেলা করা হয়েছে। দুঃখের বিষয়, সরকারের কাছে একটা ভালো অস্ত্র আছে, সেটা ব্যবহার করা হয়নি। আমি এককালে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ছিলাম। আমাদের কাছে একটা ভালো অস্ত্র ছিল। সেটা হচ্ছে টিসিবি। টিসিবিকে ব্যবহার করা গেলে জনগণের দুর্ভোগ এতটা চরমে যেত না। হ্যাঁ, জনগণের দুর্ভোগ সব আমলেই ছিল। কিন্তু এতটা চরমে ছিল না। টিসিবি আগে থেকেই বাজার নিয়ে সরকারকে সতর্ক করবে। সেটা কি করেছে? সরকারই টিসিবিকে কাজে লাগায়নি। কেন লাগায়নি, কাকে খুশি করার জন্য লাগায়নি, সেটা একটা চিন্তার বিষয়। মাঝখান থেকে বেসরকারি খাত আর সরকারের মধ্যে একটা বড় ধরনের গ্যাপ সৃষ্টি হয়েছে। হ্যাঁ, সিন্ডিকেটের কথা তো আমরা বরাবর শুনে আসছি। কিন্তু আজ পর্যন্ত সিন্ডিকেটের দেখা মিলল না। কোনো সিন্ডিকেট সদস্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা তো কোনো আমলেই শোনা যায়নি।
কালের কণ্ঠ : মন্ত্রিপরিষদ সদস্যদের নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। আপনার মূল্যায়ন কী?
মোফাজ্জল করিম : দেখুন, কথায় আছে 'বৃক্ষ তোমার নাম কী, ফলে পরিচয়'। জনগণ মন্ত্রীদের নাম দিয়ে, শিক্ষাগত যোগ্যতা দিয়ে বা দলীয় পরিচয় দিয়ে বিবেচনা করতে চায় না। জনগণের বিচার্য বিষয় হচ্ছে, মন্ত্রীরা যে দায়িত্বে আছেন, সেই দায়িত্ব তিনি কতটা যোগ্যতার সঙ্গে পালন করছেন। আমি বলব, বেশির ভাগ মন্ত্রীই তাঁদের দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতার ছাপ ফেলতে ব্যর্থ হয়েছেন। তাঁরা তাঁদের দক্ষতা বা অভিজ্ঞতা দিয়ে যে মন্ত্রণালয় চালাচ্ছেন, এটা বলা যাবে না। অনেক মন্ত্রণালয়েই এই অনভিজ্ঞতা ও অদক্ষতা প্রকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। মন্ত্রিসভায় যে অতি সম্প্রতি রদবদল হয়েছে, তাতে প্রমাণ হয় ওই সব মন্ত্রী ব্যর্থ হয়েছিলেন। খবরের কাগজেই তো প্রতিদিন বলা হচ্ছে এসব কথা। আমি মনে করি, এখনো সময় আছে অদক্ষদের বাদ দিয়ে দক্ষদের নিয়ে কাজ করার। কোনো কোনো মন্ত্রণালয় আছে, যেসব মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী-উপদেষ্টারা এমন ভাষায় কথা বলেন যে তাঁরা বাংলাদেশের মন্ত্রী না অন্য কোনো দেশের মন্ত্রী বা উপদেষ্টা, তা বুঝে ওঠা মুশকিল।
কালের কণ্ঠ : রাজনৈতিক দলগুলো এখন মুখোমুখি অবস্থানে। বিশেষ করে ১২ মার্চ সামনে রেখে একধরনের উত্তেজনা তৈরি হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে করণীয় কী?
মোফাজ্জল করিম : এই রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিষয়টি আমি খুব গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে বলি। আমরা যা-ই করি না কেন, রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘোষণা করি বা যা কিছুই করি না কেন, সেটা কী লক্ষ্য নিয়ে করছি। আমরা কি আমাদের দলীয় স্বার্থকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছি না জনস্বার্থকে প্রাধান্য দিচ্ছি, সেটা বুঝতে হবে। ১২ তারিখের কর্মসূচি বলুন আর যাই বলুন, কর্মসূচি তো একটা গণতান্ত্রিক অধিকার। একটা রাজনৈতিক দল কর্মসূচি দিতে পারে। কিন্তু সেটা তারা যদি শৃঙ্খলার সঙ্গে করে তাহলে অসুবিধা কোথায়? এটা তাদের রাজনৈতিক অধিকার। কিন্তু সেখানে পাল্টা কর্মসূচি দিয়ে মুখোমুখি অবস্থানে চলে যেতে হবে, এটা তো ঠিক নয়। এটা শক্তি প্রদর্শন। অনেকটা চরদখলের মতো ব্যাপার। আজকাল গ্রামেও এমন দেখা যায় না। মানুষকে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার পালন করতে দিতে হবে। আবার গণতান্ত্রিক অধিকার মানে এই নয়, আমি ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত হব। অন্যের গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করব। আপনি হরতাল করতে চান করুন। আমি যদি না চাই আমাকে বাধ্য করবেন না। আমি যদি বাসে চড়ে যেতে চাই আমার বাসে আগুন দেবেন না। এই সংস্কৃতি কবে আসবে? আমি সেই দিনটির অপেক্ষায় আছি। এখন যে অবস্থা দাঁড়াচ্ছে, এটা সংঘাতের দিকে চলে যাচ্ছে। এই সংঘাতের রাজনীতি রাষ্ট্রের জন্য, জনগণের জন্য, সরকারের জন্য কখনোই মঙ্গল বয়ে আনবে না। আমি বিনীতভাবে আমাদের দেশের সব রাজনৈতিক দলের নেতাদের কাছে অনুরোধ করব, সংঘাতের পথ পরিহার করুন।
কালের কণ্ঠ : বিরোধী দল কি গঠনমূলক ভূমিকা রাখতে পারছে?
মোফাজ্জল করিম : গঠনমূলক ভূমিকা বিরোধী দল সত্যিকার অর্থে রাখতে পারছে না। আবার এটাও ঠিক, দেশে গৃহপালিত বিরোধী দল থাকার চেয়ে না থাকাই ভালো। সুখের বিষয় দেশে এখন একটি বিরোধী দল আছে, গৃহপালিত বিরোধী দল নেই। বিরোধী দল সংসদে হাতে গোনা কয়েকটি আসন পাওয়ার পরও যেসব ইস্যু সামনে নিয়ে আসছে, তা প্রশংসনীয়। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সরকারি দল ও বিরোধী দলের মধ্যে একটা সমঝোতা থাকলে বিরোধী দলকে আরো গঠনমূলক কাজে লাগানো যেত। বড় বড় ইস্যুতে পৃথিবীর সব দেশেই সরকারি দল ও বিরোধী দল একসঙ্গে কাজ করে। জাতীয় ইস্যুতে আমাদের দেশে সরকারি ও বিরোধী দলের ঐকমত্য হয় না। সরকার একা একাই সিদ্ধান্ত নেয়। সরকারের উচিত বিরোধী দলকে সঙ্গে নেওয়া। বিরোধী দলের উচিত দেশ ও জনগণের স্বার্থে বিরোধিতার জন্য বিরোধিতার পথ পরিহার করা।
কালের কণ্ঠ : সরকারের সমান্তরালে বিরোধী দলের ভূমিকা কী হতে পারত? অব্যাহত সংসদ বর্জনকে কি আপনি সমর্থন করেন?
মোফাজ্জল করিম : বিরোধী দল যেসব দেশে সঠিক ভূমিকা পালন করে, সেখানে প্রতিটি বিরোধী দল সংসদে তাদের অবস্থানটা তুলে ধরে। যাতে তাদের ভূমিকার কথা তারা জনগণকে স্পষ্টভাবে বলতে পারে। ধরুন, সরকার একটা বিল নিয়ে এসেছে বা একটা আইন করতে চায়, বিরোধী দল যদি মনে করে এটা জনগণের জন্য ভালো, তাহলে তারা সমর্থন দেবে। যদি তারা মনে করে এটা জনস্বার্থবিরোধী, তাহলে সংসদেই তারা এর প্রতিবাদ করবে। দুঃখের কথা হলো, আমাদের একটা সংসদ আছে, সেটা একদলীয় সংসদ। সেখানে শুধু সরকারি দল আছে, বিরোধী দল নেই। প্রথমে সেখানে গেলেও একটি বা দুটি সেশনের পর আর বিরোধী দলকে খুঁজে পাওয়া যায় না। তারা অনুপস্থিত। এভাবে বিরোধী দল তাদের গঠনমূলক ভূমিকা পালন করতে পারবে না। তাদের যেতে হবে। জনগণ যে কয়টি আসনেই তাদের নির্বাচিত করুক না কেন, একটা প্রত্যাশা নিয়েই তো ভোট দিয়েছিল। সেই প্রত্যাশা পূরণ করতে হবে। প্রশ্ন উঠতে পারে, সেখানে যাওয়ার পথে কি কাঁটা বিছিয়ে রাখা হয়েছে? এমন কোনো পরিস্থিতি কি সৃষ্টি করা হয়েছে যে আত্মসম্মান নিয়ে সেখানে থাকা যাচ্ছে না? তাহলে সেখানে যাওয়া যাবে না। উভয় পক্ষকেই সেই পরিবেশ অনুকূল রাখতে হবে। উভয় দলের সদিচ্ছা থাকলে স্পিকারের মাধ্যমে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির সুযোগ এখনো আছে। সংসদের বাইরে রাজনৈতিক ভূমিকা পালনে তো বাধা নেই।
কালের কণ্ঠ : যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গ নিয়ে কিছু বলুন।
মোফাজ্জল করিম : অনেকে জানেই না যুদ্ধাপরাধ বিষয়টা কী। একাত্তরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে যুদ্ধাপরাধী কারা? এত দিন পর্যন্ত তারা পার পেয়ে গেল কেমন করে? এগুলো দেখতে হবে। বিচারে কেউ বাধা দিচ্ছে বলে মনে হয় না। এমনকি প্রধান বিরোধী দল বিএনপিও বলছে, আমরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই। তাদের কথা হচ্ছে, সেই বিচারটা হতে হবে সম্পূর্ণ আইনসিদ্ধ ও স্বচ্ছ। এমন যেন না হয়, দলীয় পরিচয়ে কেউ পার পেয়ে যাচ্ছে। আমি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই। নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ বিচার। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পদ্ধতির মাধ্যমে বিচার চাই। আত্মীয়তার বন্ধন, সামাজিক মর্যাদা, এসব বিবেচনা করা চলবে না। আমি ন্যায়বিচার ও সুশাসনের পক্ষে।
কালের কণ্ঠ : বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির গতি-প্রকৃতি কী হওয়া উচিত? বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করেন।
মোফাজ্জল করিম : বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে যখনই কথা বলা হয়, তখন কেন জানি না, আমরা প্রাধান্য দিয়ে থাকি ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে। কারণ ভারত আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী। ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক অনেক পুরনো এবং ঐতিহাসিক। অন্য যেকোনো দেশের সম্পর্কের চেয়ে ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ, এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু সেই সঙ্গে এটাও ভুললে চলবে না যে বিশ্বে যেকোনো একটি রাষ্ট্র- তা ভারতই হোক বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য যেকোনো দেশই হোক, তার ওপর নির্ভর করে কোনো দেশের পররাষ্ট্রনীতি চলতে পারে না। এখন বৈশ্বিক যে পরিস্থিতি বিরাজমান তাতে সবার সঙ্গে সদ্ভাব রেখে, সবার সাহায্য ও সহযোগিতা নিয়ে একটি উন্নয়নশীল দেশকে চলতে হয়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, এ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে পররাষ্ট্রনীতি বলতেই যেন আমরা মনে করি তিস্তার পানি। পররাষ্ট্রনীতি মানেই যেন ট্রানজিট সুবিধা দেওয়া হবে কি হবে না। পররাষ্ট্রনীতি মানেই সীমান্তে মানুষ মারছে ভারত। অর্থাৎ যা-ই হচ্ছে না কেন, যা কিছু আমরা আলোচনা করছি, এর ৭৫ শতাংশই ভারতসংক্রান্ত এবং ভারতমুখী। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে আমরা বিশ্বের সমর্থনটা এখন অনেকখানিই হারাতে বসেছি আমাদের মনোযোগের অভাবে। বিশ্বের অনেক দেশ, যাদের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্ব খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তাদের প্রতি আমাদের মনোযোগ কমে আসছে কি না আমি জানি না। একটা উদাহরণ দিতে পারি। যেমন- মধ্যপ্রাচ্য। মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের অবস্থান খুবই ভালো ছিল। কিন্তু গত কিছুদিন এখানে যেন কেমন একটা স্থবিরতা লক্ষ করা যাচ্ছে।
আরেকটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে পদ্মা সেতু নিয়ে। আমি তো মনে করি, বিশ্বব্যাংককে খামোখাই চটিয়ে দেওয়া হয়েছে বা চটিয়ে দেওয়ার উপক্রম হয়েছে। আমরা যতই বলি না কেন, বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক খারাপ হচ্ছে না, ঠিকই আছে, সাহায্য-সহযোগিতা আগের মতোই পাওয়া যাবে- এটা তো মুখে শুধু বললেই হবে না। যেকোনো একটা ইস্যুতে সরকার স্পষ্ট করে অবস্থান নেয় না কেন, তা বুঝতে পারি না। পররাষ্ট্রনীতি হওয়া উচিত ছিল সম্মুখমুখী ও গঠনমূলক। সেটা হয়নি। এ জন্য বর্তমান পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে আরো গভীরভাবে ভেবে দেখা দরকার। এখানে আরো উন্নতির অবকাশ রয়েছে বলে আমি মনে করি।
কালের কণ্ঠ : দেশের সাধারণ মানুষ কেমন আছে বলে মনে হয় আপনার?
মোফাজ্জল করিম : কে সরকার গঠন করল আর কে বিরোধী দলে গেল, এটা নিয়ে সাধারণ মানুষ চিন্তিত নয়। তাদের চিন্তা নিত্যদিনের জীবনযাপন নিয়ে। দেশের মানুষ ভাবে পাঁচ কি সাত বছর আগে আমি কত টাকা দিয়ে চাল কিনেছি, এখন কত দিয়ে কিনছি। দেশের মানুষ বিবেচনা করে আগে রাতে ঠিকমতো ঘুমানো গেছে কি না। সন্ত্রাস তাকে ঘিরে ধরছে কি না, এটাই দেশের মানুষের চিন্তা। ঘুষ-দুর্নীতি, বাসভাড়া, রাস্তাঘাট- এসব নিয়ে দেশের মানুষ ভাবে। কোন দল দেশ চালাচ্ছে, তা নিয়ে দেশের মানুষ চিন্তিত নয়। দেশের মানুষ চিন্তিত তার জীবন-জগৎজনিত সমস্যা নিয়ে। শিক্ষাঙ্গনে এখনো রক্ত ঝরে কেন? বিশ্ববিদ্যালয়ে এত খুন-খারাবি কেন? প্রতিটি দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে কেন? সব মিলিয়ে দেশের মানুষ এখন শান্তিতে নেই। খুবই খারাপ অবস্থায় আছে।
কালের কণ্ঠ : আগামী দুই বছরে দেশ ও দেশের মানুষের ব্যাপারে সরকারের কাছে আপনার প্রত্যাশা কী?
মোফাজ্জল করিম : সরকারের কাছে আমার বড় প্রত্যাশা হলো- আসুন, নেতার মতো ব্যবহার করুন। আপনি এই দেশটার নেতা। আপনি দলপতি। ১৬ কোটি মানুষের ভাগ্যবিধাতা আপনি। অতএব আপনি সেই ভাগ্যবিধাতার মতো, দলপতির মতো আচরণ করুন। সহনশীলতার পরিচয় দিন। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে দেশটিকে সামনের দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করুন। যত সমস্যা আছে, তা সে তিস্তার পানি নিয়েই হোক, সীমান্তে মানুষ হত্যা হোক তার সমাধান করা হোক। দ্রব্যমূল্য, সন্ত্রাস, রাহাজানি- সব সমস্যা সমাধানে একসঙ্গে বসুন। একসঙ্গে বসে আলোচনা করে সব সমস্যার সমাধান করুন। সরকারের আহ্বানে যারা এগিয়ে যাবে তাদেরও খোলা মন নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। বিরোধী দলকেও দেশের স্বার্থে কথা বলতে হবে। সবাইকে বলব, অনুগ্রহ করে দেশের কথাটি ভাবুন।
কালের কণ্ঠ : বাংলাদেশকে আগামীতে কী অবস্থায় দেখতে চান? আপনার স্বপ্নের বাংলাদেশের কথা বলুন।
মোফাজ্জল করিম : আমার স্বপ্নের বাংলাদেশ হচ্ছে সেই বাংলাদেশ, মুক্তিযোদ্ধারা একাত্তরে যে স্বপ্নের দেশের কথা ভেবে জীবন দিয়েছিলেন, সেই দেশ। যুদ্ধে যাঁরা গিয়েছিলেন, তাঁরা যে স্বপ্ন দেখতেন, আমিও সেই একই স্বপ্ন দেখি। এই বাংলাদেশ সব মানুষের দেশ। এক ব্যক্তি, এক গোষ্ঠী বা এক পরিবারের দেশ নয়। আমি দেখতে চাই- এই দেশে সাম্য, সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য, সৌভ্রাতৃত্ব বিরাজ করবে। দেশটি ন্যায়নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে। আমি চাই সুশাসনের বাংলাদেশ। এখানে সুশাসন নেই, ন্যায়বিচার নেই। আইন আছে, আইনের প্রয়োগ নেই। আসুন, সবাই মিলে আমরা এমন একটি দেশ গড়ে তুলি, যেখানে সব শ্রেণীর মানুষ ন্যায়বিচার পাবে। আইন হবে সবার জন্য সমান। মানুষের ভাগ্যের যেন উন্নতি হয়। আমরা যেন তরুণদের জন্য কালো টাকা ও পেশিশক্তির বাইরে সুদৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারি।
কালের কণ্ঠ : আপনাকে ধন্যবাদ।
মোফাজ্জল করিম : আপনাকেও ধন্যবাদ।

No comments

Powered by Blogger.