শিরশ্ছেদ-সৌদি বিচারের অমানবিকতা by মোহীত উল আলম
সৌদি আরব আট বাংলাদেশিকে গত শুক্রবার (৭ অক্টোবর) জনসমক্ষে শিরশ্ছেদ করে তাদের অমানবিকতার নজির রাখল। এই অভিযুক্ত ব্যক্তিরা যদি আমেরিকার নাগরিক হতো, তাহলে সৌদি আরব এ সাহস করত কি না সন্দেহ। বলা বাহুল্য, সৌদি আরবের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্কটা অসমভিত্তিক।
এই মুসলিম দেশটি খ্রিষ্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ আমেরিকার কাছে সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে পদানত। ইরাক-আমেরিকার দ্বিতীয় দফা যুদ্ধ চলাকালে একটি মার্কিন সাময়িকীতে দেখেছিলাম, সৌদি আরবের সবচেয়ে বড় তেলকূপগুলো পাহারা দিচ্ছে কয়েক হাজার মার্কিন সেনা। সমরাস্ত্রসজ্জিত তারা। ইন্টারনেট ঘেঁটে ক্রিস্টোফার প্রেবল নামের একজন সাংবাদিকের এশিয়া টাইমস-এ (এপ্রিল ২৫, ২০০৩) প্রকাশিত ‘ট্রুপস ইন সৌদি অ্যারাবিয়া আর সুপারফ্লুয়াস অ্যান্ড ডেঞ্জারাস’ (সৌদি আরবে মার্কিন সেনা নিয়োগ অপ্রয়োজনীয় ও বিপজ্জনক) প্রবন্ধে দেখলাম, তিনি তর্ক করছেন যে ইরাক-আমেরিকা যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পর সৌদি মুলুকে মার্কিন সেনা নিয়োজিত রাখার দরকার কী? সৌদি আরবে মার্কিন সেনা নিয়োজিত হয় ১৯৯০ সাল থেকে, যখন ইরাকের সাদ্দাম হোসেন মেজাজ চড়া করে এক রাতেই কুয়েত দখল করে ফেলেন। কিন্তু প্রেবলের মতে, সৌদি আরবে মার্কিন সেনা নিয়োজিত থাকার কারণে দুটি ক্ষতি হয়ে গেছে। এক হচ্ছে, মার্কিনদের আয়করের টাকা সৌদি আরবে খরচ করা হচ্ছে; আর দ্বিতীয় হচ্ছে, ওসামা বিন লাদেনের আল-কায়েদা সংগঠনের জন্য সদস্য সংগ্রহের সময় এটাই ছিল মারাত্মক যুক্তি-অস্ত্র যে মুসলমানদের পবিত্র ভূমি সৌদি আরবে মার্কিন সেনা নিয়োগের অর্থ হচ্ছে, আমেরিকার কাছে ইসলামের পদানত হওয়া।
কাজেই সৌদি আরবের এ ড্র্যাকোনিয়ান আইন বা প্রাচীন ইহুদি আইন, ‘অ্যান আই ফর অ্যান আই’, চোখের বদলে চোখ এবং ‘আ টুথ ফর আ টুথ’, দাঁতের বদলে দাঁত যদি সমতার ভিত্তিতে সব দেশের অপরাধীর ওপর কার্যকর হতো, আমাদের আপত্তি ছিল না। কিন্তু রয়টার্সের খবর অনুযায়ী, এ বছর যে ৫৮ জন লোককে শিরশ্ছেদ করা হয়েছে, তার মধ্যে ২০ জন অপরাধী হচ্ছে উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে আসা শ্রমিক। এর ফলে সৌদি আরবের শিরশ্ছেদ-সংস্কৃতি বস্তুত ‘শক্তের ভক্ত নরমের যম’ প্রবণতাকে স্বীকার করে।
আমরা এখানে যে আটজন বাংলাদেশির শিরশ্ছেদ হয়েছে, তাদের পক্ষে সাফাই গাইছি না, কারণ, যে দেশে তারা অপরাধ করেছে, সে দেশের আইন অনুযায়ী তাদের শাস্তি হয়েছে। কিন্তু আইন কার্যকর করার পদ্ধতি সম্পর্কে প্রশ্নটি উঠবেই। বিশ্বব্যাপী অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন বহু দিন ধরে সৌদি আরবের আইনকানুন ও বিচারকাজ আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন নয় বলে শোর তুলছে।
এই আটজন বাংলাদেশিকে শিরশ্ছেদ করার আইনটি এসেছে, আগেই বলেছি, ওল্ড টেস্টামেন্টের ‘অ্যান আই ফর অ্যান আই’ আইন থেকে। হত্যার বদলে হত্যা। আক্ষরিক অর্থে, চোখের বদলে চোখ, দাঁতের বদলে দাঁত যেমন, হত্যার বদলে হত্যা তেমন। এই আটজন বাংলাদেশির বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তারা কথিত বৈদ্যুতিক তারের দোকান থেকে তার ও বৈদ্যুতিকসামগ্রী ডাকাতি করার সময় সাইদ মোহাম্মদ আবদুল খালেক নামের এক মিসরীয় নিরাপত্তা প্রহরীকে খুন করে। কাজেই হত্যার বদলে হত্যার আইনটি তাদের ওপর জারি হয়। সৌদি রীতি অনুযায়ী, এই আইনের কার্যকারিতা ব্যাহত করতে পারে একমাত্র নিহত ব্যক্তির পরিবারবর্গ, তারা যদি হত্যাকারীকে ক্ষমা করে দেয়। এ প্রসঙ্গে কাজী কাদের নেওয়াজের ‘প্রতিশোধ’ কবিতার কথা বলা যেতে পারে, যেখানে কবি আরব্য আতিথেয়তার ওপর চমৎকার একটি আলেখ্যকে কবিতায় বয়ান করেছেন: ‘পুত্র, তোমার হত্যাকারীরে পাইনিকো আজও ঢুঁড়ে/ আফসোস তাই জ্বলিছে সদায় তামাম কলিজাজুড়ে’ ইত্যাদি। বাবা ছেলের হত্যাকারীকে ঘরে আশ্রয় দিয়েছিলেন না জেনে। জানার পর অতিথিকে রাত পোহালে বললেন, ‘আমি জেনেছি, তুমি আমার পুত্রের হত্যাকারী। কিন্তু তুমি আমার অতিথি ছিলে বলে ছেড়ে দিলাম। সামনে কোনো দিন আবার দেখা হলে ঠিকই প্রতিশোধ নিয়ে নেব।’
সৌদি আরবের শিরশ্ছেদ আইনে এই অতিথিপরায়ণতার কোনো জায়গা নেই। সৌদি আরবের বাংলাদেশ দূতাবাসকে সৌদি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, মিসরের প্রান্তিক অঞ্চলের যে জায়গা থেকে সাইদের আগমন, সেখানকার লোকজন নাকি ব্লাড মানি বা রক্তের বদলে অর্থ গ্রহণ করে না। মিসরের ওই অঞ্চলের লোকদের রক্তনীতি না হয় অটুট থাকতে পারে, কিন্তু সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় আইনে এ ধরনের রক্তনীতি অনুসৃত হবে, এটা কেমন কথা!
রেনেসাঁ যুগে ইউরোপে প্রতিহিংসানির্ভর আইন ইংল্যান্ডসহ কোনো কোনো দেশে রদ হলেও আদালতের বাইরে ব্যক্তিগত পর্যায়ে প্রতিহিংসাজনিত হত্যা বংশপরম্পরায় চলতে থাকে। এমনকি ইংল্যান্ডের এলিজাবেথীয় নাট্যসাহিত্যের সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে জিঘাংসা বা প্রতিহিংসার ওপর রচিত থিম। সাহিত্যে এ বিষয়ের ওপর জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকলেও সমাজে এর আইনগত স্বীকৃতি ছিল না। তাঁর ‘প্রতিহিংসা’ নামের রচনায়, ইংল্যান্ডের তৎকালীন প্রথম সারির চিন্তাবিদ স্যার ফ্রান্সিস বেকন লিখেলেন, ‘রিভেঞ্জ ইজ আ ওয়াইল্ড জাস্টিস’। বেকনের সমসাময়িক শেক্সপিয়ার তাঁর নাটক মেজার ফর মেজার-এ খানিকটা চটুলভাবে দেখালেন, কেন চোখের বদলা চোখ আধুনিক মানবসমাজে গৃহীত হতে পারে না।
চোখের বদলা চোখ যদি সভ্য সমাজে গৃহীত হতে না পারে, তাহলে হত্যার বদলা হত্যাও তো গৃহীত হতে পারে না। কিন্তু সংকটটা সেখানেই হচ্ছে, যখন দেখছি যে একটি অমানবিক আইন পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃত একটি দেশের শাসনতন্ত্রে সিদ্ধ আইন হিসেবে সন্নিবেশিত হয়ে আছে। যেমন, আমাদের দেশে ‘ক্রসফায়ার’ বা ‘এনকাউন্টার’-এ বিনা বিচারে মানুষ মারার একটা রেওয়াজ তৈরি হয়েছে। আমরা জানি, এটা একটা অসাংবিধানিক পন্থা। যদিও এটা কমবেশি চলছে, কিন্তু এটার সমালোচনায় আমরা কখনো থেমে থাকি না। কিন্তু এখন যদি আমাদের শাসনতন্ত্রে ক্রসফায়ার বা এনকাউন্টারকে সিদ্ধ আইন হিসেবে সন্নিবেশ করা হয়, তাহলে আমরা বর্বর ও অসভ্য রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচিত হব।
আরেকটি প্রাসঙ্গিক কথা এসে যায়। এই যে আটজন বাংলাদেশি ডাকাতি করতে গেল, কিন্তু কেন গেল? নিজের দেশে বাংলাদেশিরা ডাকাতি করতে পারে, কারণ তাদের এ দেশের শিথিল আইন সম্পর্কে জানা আছে। কিন্তু তারা তো ২০০৭ সালে ঘটনাটি ঘটার আগে থেকেই কাজের জন্য সৌদি আরবে ছিল। কেউ কেউ ২০০৩ থেকে, আর কেউ কেউ ২০০৪ থেকে সৌদি আরবে অবস্থান করছিল। তারা তো সৌদি আরবের আইনের কড়াকড়ি সম্পর্কে অবহিত ছিল যে চুরি করে ধরা পড়লে হাত কাটা যায়, আর খুন করলে মাথা কাটা যায়। এটা জেনেও তারা এই দুঃসাহসিক কাজটি করতে গেল কেন? নিশ্চয় পেটের দায়ে। পত্রপত্রিকায় প্রায় বিভিন্ন দেশে প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিকদের সমস্যা নিয়ে পড়ি। বিশেষ করে সৌদি আরবে চাকরির মালিকদের হঠাৎ করে বাংলাদেশি শ্রমিকদের চাকরি থেকে খসিয়ে দেওয়ার অনেক কাহিনি শুনেছি এবং পড়েছি। সৌদি আরবে চাকরিচ্যুত বা কর্মচ্যুত শ্রমিকদের নিদারুণ খাদ্যকষ্টে পড়তে হয়। সে ক্ষুধা নিবারণের জন্য তারা বৈধ পথ বন্ধ হয়ে গেলে অবৈধ পথে অর্থ উপার্জনের উপায় খোঁজে। এ জন্যই কি এই আটজন বাংলাদেশি ওই ভয়ংকর ডাকাতির পথে গিয়েছিল?
আমরা জানি না, সৌদি আদালতের বিচারে কী ধরনের যুক্তির আদান-প্রদান হয়েছিল, কিন্তু এ প্রশ্ন যদি সৌদি রাষ্ট্রের তরফ থেকে ওঠানো না হয়ে থাকে যে এদের চাকরিদাতা সৌদি মালিকেরা যখন এদের চাকরি থেকে বরখাস্ত করল, তখন খোঁজ করা হলো না কেন যে চাকরি থেকে বিতাড়নের কারণ কী ছিল। আর এরা যখন বুভুক্ষু অবস্থায় দিন কাটাচ্ছিল, তখন রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব বা নৈতিক দায়িত্ব কি ছিল না এদের বেঁচে থাকার ব্যবস্থা করার? বিদেশি গরিব দেশের মানুষ চাকরি করতে এসে পেটের ক্ষিধায় মারা যাবে, কিন্তু যারা এর জন্য দায়ী, তাদের কোনো শাস্তি হবে না, অথচ এরা চুরি করলেই চরম শাস্তি পাবে—এ ধরনের ব্যবস্থা আর যা-ই হোক, কোনো সভ্য সমাজের পরিচায়ক নয়।
অধ্যাপক ড. মোহীত উল আলম, ইংরেজি বিভাগ, ইউল্যাব, ঢাকা।
Mohit_13_1952@yahoo.com
কাজেই সৌদি আরবের এ ড্র্যাকোনিয়ান আইন বা প্রাচীন ইহুদি আইন, ‘অ্যান আই ফর অ্যান আই’, চোখের বদলে চোখ এবং ‘আ টুথ ফর আ টুথ’, দাঁতের বদলে দাঁত যদি সমতার ভিত্তিতে সব দেশের অপরাধীর ওপর কার্যকর হতো, আমাদের আপত্তি ছিল না। কিন্তু রয়টার্সের খবর অনুযায়ী, এ বছর যে ৫৮ জন লোককে শিরশ্ছেদ করা হয়েছে, তার মধ্যে ২০ জন অপরাধী হচ্ছে উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে আসা শ্রমিক। এর ফলে সৌদি আরবের শিরশ্ছেদ-সংস্কৃতি বস্তুত ‘শক্তের ভক্ত নরমের যম’ প্রবণতাকে স্বীকার করে।
আমরা এখানে যে আটজন বাংলাদেশির শিরশ্ছেদ হয়েছে, তাদের পক্ষে সাফাই গাইছি না, কারণ, যে দেশে তারা অপরাধ করেছে, সে দেশের আইন অনুযায়ী তাদের শাস্তি হয়েছে। কিন্তু আইন কার্যকর করার পদ্ধতি সম্পর্কে প্রশ্নটি উঠবেই। বিশ্বব্যাপী অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন বহু দিন ধরে সৌদি আরবের আইনকানুন ও বিচারকাজ আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন নয় বলে শোর তুলছে।
এই আটজন বাংলাদেশিকে শিরশ্ছেদ করার আইনটি এসেছে, আগেই বলেছি, ওল্ড টেস্টামেন্টের ‘অ্যান আই ফর অ্যান আই’ আইন থেকে। হত্যার বদলে হত্যা। আক্ষরিক অর্থে, চোখের বদলে চোখ, দাঁতের বদলে দাঁত যেমন, হত্যার বদলে হত্যা তেমন। এই আটজন বাংলাদেশির বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তারা কথিত বৈদ্যুতিক তারের দোকান থেকে তার ও বৈদ্যুতিকসামগ্রী ডাকাতি করার সময় সাইদ মোহাম্মদ আবদুল খালেক নামের এক মিসরীয় নিরাপত্তা প্রহরীকে খুন করে। কাজেই হত্যার বদলে হত্যার আইনটি তাদের ওপর জারি হয়। সৌদি রীতি অনুযায়ী, এই আইনের কার্যকারিতা ব্যাহত করতে পারে একমাত্র নিহত ব্যক্তির পরিবারবর্গ, তারা যদি হত্যাকারীকে ক্ষমা করে দেয়। এ প্রসঙ্গে কাজী কাদের নেওয়াজের ‘প্রতিশোধ’ কবিতার কথা বলা যেতে পারে, যেখানে কবি আরব্য আতিথেয়তার ওপর চমৎকার একটি আলেখ্যকে কবিতায় বয়ান করেছেন: ‘পুত্র, তোমার হত্যাকারীরে পাইনিকো আজও ঢুঁড়ে/ আফসোস তাই জ্বলিছে সদায় তামাম কলিজাজুড়ে’ ইত্যাদি। বাবা ছেলের হত্যাকারীকে ঘরে আশ্রয় দিয়েছিলেন না জেনে। জানার পর অতিথিকে রাত পোহালে বললেন, ‘আমি জেনেছি, তুমি আমার পুত্রের হত্যাকারী। কিন্তু তুমি আমার অতিথি ছিলে বলে ছেড়ে দিলাম। সামনে কোনো দিন আবার দেখা হলে ঠিকই প্রতিশোধ নিয়ে নেব।’
সৌদি আরবের শিরশ্ছেদ আইনে এই অতিথিপরায়ণতার কোনো জায়গা নেই। সৌদি আরবের বাংলাদেশ দূতাবাসকে সৌদি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, মিসরের প্রান্তিক অঞ্চলের যে জায়গা থেকে সাইদের আগমন, সেখানকার লোকজন নাকি ব্লাড মানি বা রক্তের বদলে অর্থ গ্রহণ করে না। মিসরের ওই অঞ্চলের লোকদের রক্তনীতি না হয় অটুট থাকতে পারে, কিন্তু সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় আইনে এ ধরনের রক্তনীতি অনুসৃত হবে, এটা কেমন কথা!
রেনেসাঁ যুগে ইউরোপে প্রতিহিংসানির্ভর আইন ইংল্যান্ডসহ কোনো কোনো দেশে রদ হলেও আদালতের বাইরে ব্যক্তিগত পর্যায়ে প্রতিহিংসাজনিত হত্যা বংশপরম্পরায় চলতে থাকে। এমনকি ইংল্যান্ডের এলিজাবেথীয় নাট্যসাহিত্যের সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে জিঘাংসা বা প্রতিহিংসার ওপর রচিত থিম। সাহিত্যে এ বিষয়ের ওপর জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকলেও সমাজে এর আইনগত স্বীকৃতি ছিল না। তাঁর ‘প্রতিহিংসা’ নামের রচনায়, ইংল্যান্ডের তৎকালীন প্রথম সারির চিন্তাবিদ স্যার ফ্রান্সিস বেকন লিখেলেন, ‘রিভেঞ্জ ইজ আ ওয়াইল্ড জাস্টিস’। বেকনের সমসাময়িক শেক্সপিয়ার তাঁর নাটক মেজার ফর মেজার-এ খানিকটা চটুলভাবে দেখালেন, কেন চোখের বদলা চোখ আধুনিক মানবসমাজে গৃহীত হতে পারে না।
চোখের বদলা চোখ যদি সভ্য সমাজে গৃহীত হতে না পারে, তাহলে হত্যার বদলা হত্যাও তো গৃহীত হতে পারে না। কিন্তু সংকটটা সেখানেই হচ্ছে, যখন দেখছি যে একটি অমানবিক আইন পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃত একটি দেশের শাসনতন্ত্রে সিদ্ধ আইন হিসেবে সন্নিবেশিত হয়ে আছে। যেমন, আমাদের দেশে ‘ক্রসফায়ার’ বা ‘এনকাউন্টার’-এ বিনা বিচারে মানুষ মারার একটা রেওয়াজ তৈরি হয়েছে। আমরা জানি, এটা একটা অসাংবিধানিক পন্থা। যদিও এটা কমবেশি চলছে, কিন্তু এটার সমালোচনায় আমরা কখনো থেমে থাকি না। কিন্তু এখন যদি আমাদের শাসনতন্ত্রে ক্রসফায়ার বা এনকাউন্টারকে সিদ্ধ আইন হিসেবে সন্নিবেশ করা হয়, তাহলে আমরা বর্বর ও অসভ্য রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচিত হব।
আরেকটি প্রাসঙ্গিক কথা এসে যায়। এই যে আটজন বাংলাদেশি ডাকাতি করতে গেল, কিন্তু কেন গেল? নিজের দেশে বাংলাদেশিরা ডাকাতি করতে পারে, কারণ তাদের এ দেশের শিথিল আইন সম্পর্কে জানা আছে। কিন্তু তারা তো ২০০৭ সালে ঘটনাটি ঘটার আগে থেকেই কাজের জন্য সৌদি আরবে ছিল। কেউ কেউ ২০০৩ থেকে, আর কেউ কেউ ২০০৪ থেকে সৌদি আরবে অবস্থান করছিল। তারা তো সৌদি আরবের আইনের কড়াকড়ি সম্পর্কে অবহিত ছিল যে চুরি করে ধরা পড়লে হাত কাটা যায়, আর খুন করলে মাথা কাটা যায়। এটা জেনেও তারা এই দুঃসাহসিক কাজটি করতে গেল কেন? নিশ্চয় পেটের দায়ে। পত্রপত্রিকায় প্রায় বিভিন্ন দেশে প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিকদের সমস্যা নিয়ে পড়ি। বিশেষ করে সৌদি আরবে চাকরির মালিকদের হঠাৎ করে বাংলাদেশি শ্রমিকদের চাকরি থেকে খসিয়ে দেওয়ার অনেক কাহিনি শুনেছি এবং পড়েছি। সৌদি আরবে চাকরিচ্যুত বা কর্মচ্যুত শ্রমিকদের নিদারুণ খাদ্যকষ্টে পড়তে হয়। সে ক্ষুধা নিবারণের জন্য তারা বৈধ পথ বন্ধ হয়ে গেলে অবৈধ পথে অর্থ উপার্জনের উপায় খোঁজে। এ জন্যই কি এই আটজন বাংলাদেশি ওই ভয়ংকর ডাকাতির পথে গিয়েছিল?
আমরা জানি না, সৌদি আদালতের বিচারে কী ধরনের যুক্তির আদান-প্রদান হয়েছিল, কিন্তু এ প্রশ্ন যদি সৌদি রাষ্ট্রের তরফ থেকে ওঠানো না হয়ে থাকে যে এদের চাকরিদাতা সৌদি মালিকেরা যখন এদের চাকরি থেকে বরখাস্ত করল, তখন খোঁজ করা হলো না কেন যে চাকরি থেকে বিতাড়নের কারণ কী ছিল। আর এরা যখন বুভুক্ষু অবস্থায় দিন কাটাচ্ছিল, তখন রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব বা নৈতিক দায়িত্ব কি ছিল না এদের বেঁচে থাকার ব্যবস্থা করার? বিদেশি গরিব দেশের মানুষ চাকরি করতে এসে পেটের ক্ষিধায় মারা যাবে, কিন্তু যারা এর জন্য দায়ী, তাদের কোনো শাস্তি হবে না, অথচ এরা চুরি করলেই চরম শাস্তি পাবে—এ ধরনের ব্যবস্থা আর যা-ই হোক, কোনো সভ্য সমাজের পরিচায়ক নয়।
অধ্যাপক ড. মোহীত উল আলম, ইংরেজি বিভাগ, ইউল্যাব, ঢাকা।
Mohit_13_1952@yahoo.com
No comments