পাখি by আদনান মুকিত

গত রাতে তিথির সঙ্গে পূর্ণদৈর্ঘ্য ঝগড়া হওয়ায় ঘুম হয়নি। আমি আগেও খেয়াল করেছি, কোনো কারণে রাতে ঘুম না হলে পরদিন ভোর থেকেই ঝামেলা শুরু হয়। আজও তা-ই হচ্ছে। যে কাক প্রতিদিন বৈদ্যুতিক খাম্বার ওপর বসে ডাকত, সে একদম আমার জানালার কার্নিশে বসে ডাকছে।


ঘুমানোর আগে বন্ধ করতে ভুলে যাওয়ায় একটু পরপর বাজছে অ্যালার্ম এবং আমি আরামে ঘুমাচ্ছি, এ ব্যাপারটা কিছুতেই মেনে না নিয়ে কাকের চেয়েও কর্কশ গলায় চিৎকার করছে আপু, ‘আম্মা! তোমার পুত্র এখনো ঘুমায় ক্যান? আমি কিন্তু পানি ঢেলে দেব!’ এত সব চিৎকার অগ্রাহ্য করে যখন কম্বলটা ভালো করে টেনে নেব, ঠিক তখনই বাজল ফোন! সাগর ভাই ফোন করেছেন। গত বইমেলা থেকে কেনা বইগুলো পড়তে নেওয়ার পর থেকে যিনি আমার ফোন ধরাই ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি কিনা নিজেই ফোন করেছেন! দ্বিতীয়বার রিং হতেই আমি ফোন ধরলাম—
জি, ভাই, বলেন।
কিরে, কেমন আছিস? তোকে তো ক্যাম্পাসে দেখি না, ঘটনা কী?
আপনি তো শুধু মেয়েদের দেখেন। আমাকে দেখবেন কীভাবে?
আরে! ওয়াই দিস পোলা ভেরি বদ? তুই এত বদ হলি কবে থেকে? আচ্ছা, শোন, বাসায় আয়। জরুরি কাজ আছে।
আমি সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলাম। এমন সুযোগ সহজে আসে না। এত দিন কোনো অজুহাতেই তাঁর বাসায় যেতে পারিনি। এবার ঠেকায় কে! আমার বইগুলো উদ্ধার করে আনবই আনব।
সাগর ভাইয়ের বাসায় গিয়ে প্রথমেই মূল প্রসঙ্গে চলে এলাম—
ভাই, আমার বইগুলা কই?
আসার পথে একটা পাঠাগার দেখেছিস না, তোর বইগুলো ওখানে দান করে দিয়েছি!
এটা কী করলেন? সব কটি নতুন বই!
আরে, বই না দিলে তো চাঁদা দিতে হতো। তা ছাড়া রিয়া মাঝেমধ্যে এই পাঠাগারে আসে। এটাকে ওর সুনজরে পড়ার একটা চেষ্টা বলতে পারিস!
রিয়া আপুর সঙ্গে আপনার প্রেম হয়েছে?
এখনো হয়নি। তবে হবে।
তিন বছর হয়ে গেল। আর এক বছর হলে তো প্রেমের অনার্স হয়ে যাবে। এখনো উনাকে বলতেই পারলেন না।
এবার হবেই ম্যান। দারুণ প্ল্যান করেছি। আমাকে কিছু বলতেই হবে না। শুধু তুই হেল্প করলেই কাজ হয়ে যাবে।
সাগর ভাই আমাকে তাঁর রুমে নিয়ে গেলেন। গিয়ে দেখি খাঁচার ভেতর একটা টিয়াপাখি বেশ ভাব নিয়ে বসে আছে। সাগর ভাই খাঁচার সামনে গিয়ে বললেন, মিঠু, খবর কী?
টিয়া পাখি স্পষ্ট গলায় বলে উঠল, ‘ইউ আর মাই ভ্যালেন্টাইন! ইউ আর মাই ভ্যালেন্টাইন!’
আমি চমকে উঠলাম! আমাদের ইংলিশ স্যারও এত স্পষ্টভাবে কথা বলে না। সাগর ভাই বললেন—
কিরে, কেমন ট্রেনিং দিয়েছি?
ভালোই। তবে আপনি শিখিয়েছেন তো, তাই পাখিটার কথায় বরিশালের সূক্ষ্ম টান আছে।
মশকরা করিস না। দীর্ঘদিন ধরে একে ট্রেনিং দিয়েছি। আমার হয়ে পাখিটাই রিয়াকে বলবে কথাটা। ভেরি ইউনিক আইডিয়া! তবে আসল কাজটা করবি তুই। পাখিটা রিয়ার কাছে পৌঁছে দিয়ে বলবি সাগর ভাই আপনাকে দিয়েছে।
আপনি দিচ্ছেন না কেন?
রোমান্টিকতার একটা ব্যাপার আছে না! আর ও তো তোদের সামনের বাড়িতেই থাকে। তুই দে। তা ছাড়া ওদের বাড়ির দারোয়ানটা ভেরি বদ। আমাকে দেখলেই গেট খুলে দেয়।
এ তো ভালো। বদ বলছেন কেন?
আরে, গেট খুললেই ওদের কুকুরটা বেরিয়ে আসে! আমি ওদিকে যেতেই চাই না। তুই শুধু দিয়ে আয়। বাকিটা আমি রিয়াকে ফোনে বুঝিয়ে দেব।
কিন্তু...
কোনো কিন্তু না। এই নে, তোকে বই কেনার টাকা দিচ্ছি। তুই পাখিটা এখনই দিয়ে আয়।
পকেটে টাকা এলে কি আর না করা যায়? আমি খাঁচা নিয়ে হাঁটা দিলাম।

পাখিটা দিয়ে আবার সাগর ভাইয়ের বাসায় এলাম। সাগর ভাই আমাকে পিৎজা খেতে দিয়ে রিয়া আপুকে ফোন দিলেন। আমি মনোযোগ দিলাম পিৎজার দিকে। প্রেমিক-প্রেমিকার ব্যক্তিগত কথার চেয়ে পিৎজা উত্তম! এমনিতে পিৎজা তেমন ভালো লাগে না, তবে আজকে খুব ভালো লাগছে। একটু পর গম্ভীরমুখে রুমে ঢুকলেন সাগর ভাই।
একটা ঝামেলা হয়েছে রে। পাখিটা কথা বন্ধ করে দিয়েছে।
রিয়া আপুকে দেখলে আপনারই কথা বন্ধ হয়ে যায়, আর এটা তো সামান্য টিয়া পাখি! উনি ‘মিঠু, খবর কী’ বলেন নাই?
বলেছে। কিন্তু পাখি কিছু না বলে টয়লেট করে দিয়েছে। রিয়া খুব খেপে গেছে। ওর আবার শুচিবাই রোগ আছে তো!
আমার মনে হয়, পাখিটা নতুন কন্ডিশনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেনি। কয়েকটা দিন সময় দেন। ঠিকই বলবে।
দূর। কদিন পরে বললে লাভ কিরে ব্যাটা? ভ্যালেন্টাইনস ডে তো কালকে।
এমন সময় ফোন বেজে উঠল। দ্রুত রিসিভ করলেন সাগর ভাই।
হ্যাঁ, রিয়া, পাখিটা কিছু বলেছে? বলো কী! আবার! অ্যা? আচ্ছা, ঠিক আছে।
আপডেট কী ভাই?
আবার নাকি টয়লেট করেছে! আর বেশি চিৎকার করছে দেখে রিয়ার মা বারান্দায় নিয়ে পাখিটা ছেড়ে দিয়েছে। রিয়া বলেছে, ওকে যেন আর ফোন না করি।
ভেরি স্যাড! আমি তাইলে যাইগা ভাই। আপনার এখন একা থাকা দরকার।
সাগর ভাইয়ের মন খারাপ হলেও আমি খুব খুশিমনে বাসায় ফিরলাম। আসতে না আসতেই তিথির ফোন। আশপাশে কেউ নেই দেখে রিসিভ করলাম।
হ্যালো!
ও গড। তুমি আমাকে এত ভালোবাসো?
আমি তোমাকে আরও অনেক বেশি ভালোবাসি। এ তো সামান্য নমুনামাত্র।
আমার জন্য তুমি কত কষ্ট করেছ। জানো, আমার না ডান চোখে পানি এসে গেছে। একটু পর মনে হয় বাম চোখেও পানি আসবে। আমি আর তোমার সঙ্গে ঝগড়া করব না। আই লাভ ইউ।
আহ্! কী যে ভালো লাগল। আমি তো আসলে কোনো কষ্টই করিনি। শুধু সাগর ভাইয়ের টিয়া পাখিটা তিথিকে দিয়েছি। আর কাঁটাবন থেকে একটা টিয়া কিনে দিয়েছি রিয়া আপুকে। আমার হয়ে যা করার তা তো ওই পাখিটাই করেছে। একেই বলে কম খরচে বেশি লাভ!

No comments

Powered by Blogger.