জহুর আহমদ চৌধুরী : একজন আজীবন সংগ্রামী by মুহম্মদ সবুর

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পাঠানো স্বাধীনতার সেই পবিত্র ঘোষণাটি টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়াসহ বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে দিয়েছিলেন জহুর আহমদ চৌধুরী। বাঙালির মুক্তির পতাকাটি ঊধর্ে্ব তুলে ধরে বাঙালির প্রাণের আকুতিটুকু তিনি ছড়িয়ে দিয়েছিলেন অসীম সাহসে।


জনগণের সংগ্রামের পাশে দাঁড়ানো অবিচল মুক্তিকামী মানুষটি মহান নেতার বিশ্বস্ত সহকর্মীর শুধু দায়িত্বটুকু নয়, জাতির মুক্তির বার্তাটি বহন করেছিলেন দীর্ঘ স্বপ্ন বাস্তবায়নের তাড়নায়। সংগ্রামী মানুষের প্রাণপ্রিয় স্বাধীনতার সেই বাণীটি ছিল মুক্তিকামী মানুষের প্রাণের দাবি, যার সফল বাস্তবায়ন স্বাধীন বাংলাদেশ। তিনি যে শুধু বাঙালির প্রাণের স্পর্শটুকু অনুভব করেছিলেন তা-ই নয়, জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে তা লালনও করেছেন। সংগ্রামে-আন্দোলনে ছিলেন প্রথম সারিতে। সংগঠক থেকে নেতৃত্বের আসনে নিজেকে এগিয়ে নিয়েছেন, অগি্নপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। কোথাও থেমে থাকেননি। আপসহীন লড়াকু মনোভাব নিয়ে বাঙালি জাতির বিকাশের পথপরিক্রমায় অন্যতম সংগঠক, পরিকল্পনাবিশারদ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন। ত্যাগ-তিতিক্ষা, সততা, একনিষ্ঠতা, অধ্যবসায়, শ্রম, কর্মনিষ্ঠা ও দূরদর্শিতা তাঁকে সাধারণ থেকে অসাধারণে পরিণত করেছিল। তিনি কর্মী থেকে জননেতায় পরিণত হয়েছেন, জনতার হৃদয় উৎসারিত ভালোবাসার সমন্বয়ে জনতাকে সংগঠিত করেছেন আদর্শের পতাকাতলে। কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠ তাঁকে নিবৃত্ত করতে পারেনি জনগণের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম থেকে।
১৯৩২ সালে কলকাতার খিদিরপুর খ্রিস্টান মিশনারি হাই স্কুল থেকে এনট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। রাজনীতির প্রতি আগ্রহ তাঁকে স্কুলবিমুখ করে তোলে। সেই সময় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের সানি্নধ্যে আসেন। সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল প্রবল, ১৯৪৩ সালে কলকাতায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে প্রথম পরিচয় ঘটে। এরপর শুরু হয় তাঁর সক্রিয় রাজনৈতিক জীবন। ১৯৪৪ সালে খিদিরপুর ডকে জাহাজ শ্রমিকদের সংগঠন গড়ে তোলেন। সেই সময় চট্টগ্রামের অনেক জাহাজ শ্রমিক খিদিরপুর ডকে কর্মরত ছিল।
ঢাকায় ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের ধর্মঘটে অংশ নেন বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে। ১৯৪৯ সালে মুসলিম লীগের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন এবং আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হন। ১৯৫০ সালে চট্টগ্রামে ফিরে আসেন এবং মরহুম এম এ আজিজের সঙ্গে যৌথ প্রচেষ্টায় আওয়ামী লীগের সংগঠন গড়ে তোলেন বৃহত্তর চট্টগ্রামে। ১৯৫১ সালে চট্টগ্রামে খাদ্য আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে কারাবরণ করেন। ১৯৫২ সালে যখন রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে উত্তাল দেশ, তখন জহুর আহমদ চৌধুরী সক্রিয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হন এবং কারাবরণ করেন পুনর্বার। জেল থেকে বেরিয়ে পৌর নির্বাচনে অংশ নিয়ে পৌরসভার কাউন্সিলর হন। ১৯৫৩ সালে আবার কারাবরণ করেন বাঙালি পুলিশের বেতন বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলন চালাতে গিয়ে। ১৯৫৪ সালে যখন মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠে যুক্তফ্রন্ট, তখন তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিয়ে মুসলিম লীগের প্রার্থীকে বিপুল ভোটে পরাজিত করেন। যুক্তফ্রন্ট সরকারের অপসারণের পর তাঁকে ৯২(গ) ধারা জারি করে পাকিস্তান সরকার গ্রেপ্তার করে। দীর্ঘদিন কারাগারে ছিলেন। ১৯৬২ সালে হামদুর রহমান শিক্ষা কমিশন রিপোর্টবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন এবং ছাত্রদের নেপথ্যে থেকে সংগঠিত করেছেন। ১৯৬৩ সালে চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। বাঙালি জাতির ইতিহাসে ১৯৬৬ সাল একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্ব। এ বছর বাঙালির মুক্তির সনদ ঘোষিত হয়েছিল, যা স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে পূর্ণতা পায়। ২৫ ফেব্রুয়ারি লালদীঘি ময়দানে জনসভার আয়োজন করা হয়েছে। দেশবাসী উৎকণ্ঠিত আওয়ামী লীগপ্রধান শেখ মুজিব কী ঘোষণা দেন, আগে থেকেই প্রচার হয়ে গেছে, গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা আসবে। জহুর আহমদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জনসভায় প্রধান অতিথির ভাষণে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছিলেন বাঙালির মুক্তিসনদ ছয় দফা।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে যখন ঢাকায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গণহত্যা শুরু করে, তখন ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর বাসভবন থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যাঁর কথা প্রথমে ভেবেছিলেন, তিনি জহুর আহমদ চৌধুরী। পরম বিশ্বাসে অত্যন্ত বিশ্বস্ত জহুর আহমদ চৌধুরীর কাছেই পাঠান ডিক্লারেশন অব ওয়ার অব ইনডিপেনডেন্স, অর্থাৎ স্বাধীনতার ঘোষণাবাণীটি। ওয়্যারলেসে পাঠানো সেই বাণীটি রাতেই চট্টগ্রাম বন্দরের জাহাজের মাধ্যমে বেতারযোগে বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্বটিও পালন করেন তিনি।
মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরী সম্মুখসমরে নিহত হন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটি পুনর্গঠনে এবং সোনার বাংলা গড়ে তোলার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন আমৃত্যু। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের দ্বিতীয় মন্ত্রিসভায় শ্রম ও সমাজকল্যাণমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৪ সালের ১ জুলাই সকাল পৌনে ৭টায় বাঙালির প্রাণপ্রিয় পুরুষটি পৃথিবীর সব ভালোবাসা, মায়া-মমতা কাটিয়ে চলে যান পরপারে। বাঙালির মুক্তি ও স্বাধীনতার সংগ্রামে অনন্য ভূমিকা পালনকারী জহুর আহমদ চৌধুরী সাধারণের মতো জীবন যাপন করেও অসাধারণ হয়ে উঠেছিলেন শ্রম-কর্ম, মেধা-মননের বিশালত্বে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নয়, জীবন থেকে পাঠ নিয়েছিলেন তিনি। মানুষকে দেখেছেন মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে। সাহিত্য, রাজনীতি বিচারে পড়াশোনাও কম ছিল না। ইংরেজিও চমৎকার লিখতেন এবং বলতেন। বাঙালির ইতিহাস যখন সঠিকভাবে লেখা হবে, বাঙালির অগ্রনায়কদের জীবনচরিত রচনা হবে, তখন জহুর আহমদ চৌধুরী উদ্ভাসিত হবেন স্বমহিমায়, দুর্জয় সাহসী মানব হিসেবে। কারণ যে শ্রম-কর্ম ও আদর্শ রেখে গেছেন তিনি, তাঁর মৃত্যু নেই। মানবজাতির বিকাশে তাঁর আত্মত্যাগ ও জীবনচর্চা উদাহরণ হয়ে থাকবে।

লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক

No comments

Powered by Blogger.