শ্রদ্ধাঞ্জলি : সৈয়দ জাহাঙ্গীর-বিদায় বন্ধু আমিনুল ইসলাম, বিদায়
আমিনুল ইসলাম এ দেশের প্রথম প্রজন্মের প্রথম স্থান অধিকারী প্রথম চিত্রশিল্পী। শিল্পের প্রতি অনুরাগ তাঁর কেবল নিজস্ব শিল্প সৃষ্টিতেই সীমাবদ্ধ ছিল না, তিনি সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের শিল্পকলার অগ্রগতিতে নিরলস ও সক্রিয় ভূমিকা রেখে গেছেন। উল্লেখ করা যায়, তিনি দ্বিবার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনী বাংলাদেশে অনুষ্ঠানের প্রচেষ্টায় অনুপ্রেরণা ও সক্রিয় সহযোগিতা প্রদানে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন।
আমিনুল ইসলাম ছিলেন 'সত্যের সন্ধানে শিল্প রচনা'র একজন অনন্য পথপ্রদর্শক, স্পষ্টভাষী, নিরহংকারী ব্যক্তিত্ব। এ দেশে আধুনিক চিত্রচর্চার পথিকৃৎ হিসেবে তিনি ছিলেন সর্বজনস্বীকৃত। বিষয়বস্তু নির্বাচন ও নির্মাণ কৌশলে তাঁর চিত্রকর্ম প্রশংসিত ও পুরস্কৃত হয়েছে ১৯৫১ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় চারুকলা (ঢাকা আর্ট গ্রুপ) প্রদর্শনীতে।
ঢাকায় চারুকলা কলেজ (গভর্নমেন্ট ইনস্টিটিউট অব আর্ট) স্থাপিত হয় ১৯৪৮ সালে। আমিনুল ইসলাম ছিলেন ওই কলেজের প্রথম ছাত্র। ১৯৫৩ সালে সমাপনী পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করে শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে তিনি ইতালির ফ্লোরেন্সে যান। সেখানে আন্তর্জাতিক শিল্পকলার গতি-প্রকৃতির সঙ্গে পরিচিত হয়ে এবং শিল্পে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করে ১৯৫৬ সালে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। ওই বছরই তিনি আর্ট কলেজে শিক্ষকতা শুরু করেন। এর পর থেকেই চারুকলার শিক্ষার্থীরা আধুনিক চিত্রকলার ধারা অনুসরণ করতে শুরু করে। রেখা ও রঙের ব্যবহারের পরিমার্জন আর ভিন্ন ধরনের আঙ্গিকের উপস্থাপনায় তৎকালীন প্রচলিত চিত্র নির্মাণ পদ্ধতিতে আমূল পরিবর্তন এনেছিলেন আমিনুল ইসলাম। এর কিছু নিদর্শন পাওয়া যায় আমিনুলের ইতালিতে আঁকা ছবিতে (চেয়ারে উপবিষ্ট বিদেশি রমণী)। আমিনুলের কাজের প্রশংসা করতেন প্রায় সবাই, বিশেষ করে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, যিনি তাঁর শিক্ষকও ছিলেন। এ সময়ই এ দেশের চিত্রকলায় একটা উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসে।
ইতালি ফেরত আমিনুলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কৃতিত্ব ছিল, তাঁর মোজাইক ম্যুরাল নির্মাণ। আমিনুলের এই ম্যুরালের (দেয়ালচিত্র) মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ওসমানী মেমোরিয়াল ভবনের পূর্ব পাশে প্রবেশপথের সামনে নির্মিত ম্যুরাল_সম্ভবত নাম দিয়েছিলেন 'উজ্জীবন', যা নিশ্চয়ই সব পথচারীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকে। দ্বিতীয় বৃহৎ ম্যুরাল, যা প্রায় ৫০ ফুট উঁচু এবং ১৫০ ফুট প্রস্থে নির্মাণ করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় ভবনের বহির্দেয়ালে ১৯৯৫ সালে। এরপর আশি ও নব্বইয়ের দশক ছিল আমিনুলের শিল্পকর্মের স্বর্ণযুগ। সম্পূর্ণ বিমূর্তরীতিতে চিত্রকর্ম নির্মাণের যুগ। এসব ছবির বেশির ভাগই ছিল তেল রঙে আঁকা। এসব শিল্পকর্মের নির্মাণশৈলী এ দেশের বহু নবীন শিল্পীকে অনুপ্রাণিত করেছে।
আমিনুল ইসলামের সঙ্গে আমার পরিচয় এবং হৃদ্যতা গড়ে ওঠে সেই পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে, আর্ট কলেজে ছাত্রাবস্থায়। আমিনুল আমার দুই বছরের সিনিয়র ছিলেন, কিন্তু ওই সময় আর্ট কলেজের পরিবেশ ছিল কিছুটা অন্য রকম, তাই ঘনিষ্ঠ হতে সময় লাগেনি আমাদের। বন্ধুতাও হয়ে যায় অনায়াসে এবং আজীবন এই বন্ধুতা ছিল অটুট। অনেক দিনের অনেক দীর্ঘ স্মৃতিকথা সময় এবং সুযোগ হলে অন্য কোনো সময় তা লিখব। আমিনুলের জীবনের শেষ কয় বছর ছিল খুবই নিরানন্দের। প্রথমত, মালিবাগে নিজ হাতে নির্মিত নিজস্ব স্টুডিও ছেড়ে গুলশানে স্ত্রীর বাড়িতে চলে আসা; দ্বিতীয়ত, একমাত্র কিশোর সন্তানের অকাল মৃত্যুতে আমিনুল খুবই ভেঙে পড়েছিলেন। নিঃসঙ্গতা আর অব্যক্ত বেদনার ছাপ ছিল তাঁর শরীর আর কর্মেও। ছবি আঁকা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন তিনি। বাহ্যত তিনি কোনো কিছুকেই তেমন আমল দিতেন না, এমনকি দীর্ঘ এক বছর ধরে দুরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েও তার প্রকাশে কোনো অভিযোগ ছিল না। কী নিদারুণ কষ্ট সহ্য করে নীরবে চিরদিনের জন্য চলে গেলেন আমিনুল ইসলাম। আমিনুলের এই দীর্ঘ অসুস্থতার মধ্যে তাঁর স্ত্রী রুবী ইসলাম যে অপরিসীম সাহস আর মনোবল নিয়ে আমিনুলের সেবা করেছেন, তা নিঃসন্দেহে অতুলনীয়। আমিনুল ইসলাম সম্পর্কে আরো দীর্ঘ স্মৃতিচারণের ইচ্ছা রইল। তাঁর বিদেহী আত্মার প্রতি জানাই আমার গভীর শ্রদ্ধা।
লেখক : চিত্রশিল্পী
ঢাকায় চারুকলা কলেজ (গভর্নমেন্ট ইনস্টিটিউট অব আর্ট) স্থাপিত হয় ১৯৪৮ সালে। আমিনুল ইসলাম ছিলেন ওই কলেজের প্রথম ছাত্র। ১৯৫৩ সালে সমাপনী পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করে শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে তিনি ইতালির ফ্লোরেন্সে যান। সেখানে আন্তর্জাতিক শিল্পকলার গতি-প্রকৃতির সঙ্গে পরিচিত হয়ে এবং শিল্পে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করে ১৯৫৬ সালে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। ওই বছরই তিনি আর্ট কলেজে শিক্ষকতা শুরু করেন। এর পর থেকেই চারুকলার শিক্ষার্থীরা আধুনিক চিত্রকলার ধারা অনুসরণ করতে শুরু করে। রেখা ও রঙের ব্যবহারের পরিমার্জন আর ভিন্ন ধরনের আঙ্গিকের উপস্থাপনায় তৎকালীন প্রচলিত চিত্র নির্মাণ পদ্ধতিতে আমূল পরিবর্তন এনেছিলেন আমিনুল ইসলাম। এর কিছু নিদর্শন পাওয়া যায় আমিনুলের ইতালিতে আঁকা ছবিতে (চেয়ারে উপবিষ্ট বিদেশি রমণী)। আমিনুলের কাজের প্রশংসা করতেন প্রায় সবাই, বিশেষ করে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, যিনি তাঁর শিক্ষকও ছিলেন। এ সময়ই এ দেশের চিত্রকলায় একটা উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসে।
ইতালি ফেরত আমিনুলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কৃতিত্ব ছিল, তাঁর মোজাইক ম্যুরাল নির্মাণ। আমিনুলের এই ম্যুরালের (দেয়ালচিত্র) মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ওসমানী মেমোরিয়াল ভবনের পূর্ব পাশে প্রবেশপথের সামনে নির্মিত ম্যুরাল_সম্ভবত নাম দিয়েছিলেন 'উজ্জীবন', যা নিশ্চয়ই সব পথচারীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকে। দ্বিতীয় বৃহৎ ম্যুরাল, যা প্রায় ৫০ ফুট উঁচু এবং ১৫০ ফুট প্রস্থে নির্মাণ করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় ভবনের বহির্দেয়ালে ১৯৯৫ সালে। এরপর আশি ও নব্বইয়ের দশক ছিল আমিনুলের শিল্পকর্মের স্বর্ণযুগ। সম্পূর্ণ বিমূর্তরীতিতে চিত্রকর্ম নির্মাণের যুগ। এসব ছবির বেশির ভাগই ছিল তেল রঙে আঁকা। এসব শিল্পকর্মের নির্মাণশৈলী এ দেশের বহু নবীন শিল্পীকে অনুপ্রাণিত করেছে।
আমিনুল ইসলামের সঙ্গে আমার পরিচয় এবং হৃদ্যতা গড়ে ওঠে সেই পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে, আর্ট কলেজে ছাত্রাবস্থায়। আমিনুল আমার দুই বছরের সিনিয়র ছিলেন, কিন্তু ওই সময় আর্ট কলেজের পরিবেশ ছিল কিছুটা অন্য রকম, তাই ঘনিষ্ঠ হতে সময় লাগেনি আমাদের। বন্ধুতাও হয়ে যায় অনায়াসে এবং আজীবন এই বন্ধুতা ছিল অটুট। অনেক দিনের অনেক দীর্ঘ স্মৃতিকথা সময় এবং সুযোগ হলে অন্য কোনো সময় তা লিখব। আমিনুলের জীবনের শেষ কয় বছর ছিল খুবই নিরানন্দের। প্রথমত, মালিবাগে নিজ হাতে নির্মিত নিজস্ব স্টুডিও ছেড়ে গুলশানে স্ত্রীর বাড়িতে চলে আসা; দ্বিতীয়ত, একমাত্র কিশোর সন্তানের অকাল মৃত্যুতে আমিনুল খুবই ভেঙে পড়েছিলেন। নিঃসঙ্গতা আর অব্যক্ত বেদনার ছাপ ছিল তাঁর শরীর আর কর্মেও। ছবি আঁকা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন তিনি। বাহ্যত তিনি কোনো কিছুকেই তেমন আমল দিতেন না, এমনকি দীর্ঘ এক বছর ধরে দুরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েও তার প্রকাশে কোনো অভিযোগ ছিল না। কী নিদারুণ কষ্ট সহ্য করে নীরবে চিরদিনের জন্য চলে গেলেন আমিনুল ইসলাম। আমিনুলের এই দীর্ঘ অসুস্থতার মধ্যে তাঁর স্ত্রী রুবী ইসলাম যে অপরিসীম সাহস আর মনোবল নিয়ে আমিনুলের সেবা করেছেন, তা নিঃসন্দেহে অতুলনীয়। আমিনুল ইসলাম সম্পর্কে আরো দীর্ঘ স্মৃতিচারণের ইচ্ছা রইল। তাঁর বিদেহী আত্মার প্রতি জানাই আমার গভীর শ্রদ্ধা।
লেখক : চিত্রশিল্পী
No comments