মহানগর-সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন ঢাকা শহরের প্রত্যাশায়... by শেখ হাফিজুর রহমান
৭ অক্টোবর প্রথম আলোর খোলা কলামে নজরুলের জীবনযুদ্ধের কথা পড়ছিলাম। সিরাজগঞ্জের চৌহালী থেকে আসা নজরুল ভ্যানগাড়িতে করে আখ বিক্রি করেন। জীবনযুদ্ধে জেরবার নজরুল বলছেন, ‘ঢাকায় কি আর সাধে থাকি?’ শিরোনামটি দেখেই লেখাটি পড়ি। লেখাটি ভালো লাগে আর শিরোনামটি মনে গেঁথে যায়। ‘ঢাকায় কি আর সাধে থাকি?’
নজরুলের মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে হাজার হাজার মানুষের মনের কথা। ঢাকায় এখন কত মানুষ থাকে? পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী, নারায়ণগঞ্জ-সাভার মিলিয়ে বৃহত্তর ঢাকায় এখন দেড় কোটি মানুষের বাস। এর মধ্যে ৩৬ লাখ মানুষ বস্তিতে থাকে। ঢাকা এখন মানুষ ভারাক্রান্ত। বিপণিবিতান, রাস্তাঘাট আর বাসে শুধু মানুষ আর মানুষ। ফুটপাতের মালিকানা নিয়েছে হকাররা। গায়ে গা ঘেঁষে, একজনের পা আরেকজন মাড়িয়ে তবু হেঁটে যায় হাজার হাজার মানুষ। সুস্থ, সামর্থ্যবান মানুষকেই রাস্তা পার হতে হয় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। শিশু ও প্রৌঢ়দের তো ভোগান্তির কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। আর প্রতিবন্ধীদের কথা যদি ওঠে, তাহলে আমাদের সবাইকে লজ্জায় মুখ লুকাতে হবে।
এই আমাদের প্রিয় ঢাকা শহর! বায়ুদূষণ, পানিদূষণ ও শব্দদূষণে কলুষিত, ময়লা-আবর্জনায় নোংরা, যানজটে স্থবির এই আমাদের ঢাকা শহর। খাবারে বিষ নিয়ে, ওষুধে ভেজাল নিয়ে, নিঃশ্বাসে সিসা নিয়ে আমরা বহন করে চলি আমাদের নাগরিক জীবন, জীবনকে আর আমাদের যাপন করা হয় না। এমন অসম্ভবের শহর পৃথিবীর আর কোথাও নেই। এ শহরের নাগরিকেরা ‘ট্যাক্স’ দেন, কিন্তু কেন ‘ট্যাক্স’ দেন তা জানেন না। কোনো ঐশ্বরিক শক্তির অলৌকিক ক্ষমতায় এ শহরের মানুষেরা বেঁচে থাকে। তাদের বেঁচে থাকাটাই পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্য ঘটনা! নইলে খাবারে বিষ নিয়ে, নিঃশ্বাসে সিসা নিয়ে, প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর আশঙ্কা নিয়ে কী করে তারা বেঁচে আছে? সরকার আসে, সরকার যায়। কিন্তু ঢাকার বাতাসে সিসার পরিমাণ বেড়েই চলে, যানজটে জনজীবনকে স্থবির করে দিয়ে ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্রে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে সামরিক স্থাপনা, ঢাকার খাল-বিল ভরাট করে একের পর এক নির্মিত হতে থাকে আকাশচুম্বী সব ভবন।
নজরুলরা কেন ঢাকা আসে? সহজ উত্তর, পেটের দায়ে। যোগাযোগব্যবস্থা ভালো হয়েছে। বাংলাদেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে এখন বাসে, ট্রেনে বা লঞ্চে করে যে কেউ ঢাকায় আসতে পারে। নদীভাঙা মানুষ নিরুপায় হয়ে ঢাকায় চলে আসে। গ্রামে বা মফস্বলে কাজ না থাকলে মানুষ ঢাকায় চলে আসে। ১৫-২০ দিন বা এক মাস কাজ করে, তারপর ফিরে যায় গ্রাম বা মফস্বলে স্ত্রী-সন্তানের কাছে। উপার্জনের টাকা শেষ হয়ে গেলে আশপাশে কাজ খোঁজে। কাজ না পেলে ছুটে আসে ঢাকায়। কেউ রিকশা চালায়, কেউ চা বিক্রি করে, কেউ সবজির দোকান দেয়। মুহূর্তেই বিষ, ভেজাল ও নোংরায় পরিপূর্ণ ঢাকা শহর হয়ে ওঠে পয়মন্ত এক দেবী। দেবী হাজার হাজার মানুষের কর্মের ব্যবস্থা করে দেন, কর্মশেষে উপার্জন নিয়ে মানুষেরা ফিরে যায় তাদের স্বজনদের কাছে। নীতিনির্ধারকদের সঠিক নীতি অনুসরণ না করার কারণে ঢাকা শহরকে করুণার দেবী হতে হয়। করুণার দেবী হাজার হাজার লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে তাদের হাতে উপার্জন তুলে দেন ঠিকই, কিন্তু ঢাকা শহর হয়ে ওঠে বসবাসের অযোগ্য এক স্থান, পৃথিবীতে বাস করেই এর বাসিন্দারা পেয়ে যান দোজখের আঁচ। নজরুলদের বলতে হয়, ‘ঢাকায় কি আর সাধে ভালো লাগে? মনে করেন, ঢাকায় থাকলে যেটুকু কামাই করি, সেটা দিয়েই বউ-বাচ্চা চলে। এখানে থাকলে তাই ভালো লাগে আবার গ্রামে গেলে মা, বউ রেন্দে-বেড়ে খাওয়ালে খুব ভালো লাগে।’
ঢাকা শহরে আমরা কেমন আছি? প্রতিদিন হাজারীবাগের ট্যানারি থেকে ১৬ হাজার টন বিষাক্ত বর্জ্য বুড়িগঙ্গায় গিয়ে পড়ছে। তেজগাঁও শিল্প এলাকা থেকে যে বিষাক্ত বর্জ্য বুড়িগঙ্গায় গিয়ে প্রতিদিন পড়ছে, তার পরিমাণ তিন হাজার টন। ঢাকার অধিবাসীরা প্রতিদিন ৬০ লাখ পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করছে। পরিত্যক্ত পলিথিন ব্যাগে জলাবদ্ধতা হচ্ছে, পরিবেশ দূষিত হচ্ছে, পরিবেশের জন্য তৈরি হচ্ছে মারাত্মক হুমকি। ঢাকা শহরের বাসাবাড়ির পাকঘর ও হোটেল-রেস্তোরাঁ থেকে প্রতিদিন যে পরিমাণ বর্জ্য নিঃসৃত হয়, তার পরিমাণ তিন হাজার ৫০০ টন। সিটি করপোরেশনের গাড়ি, কর্মী ও ব্যক্তিগত ব্যবস্থাপনায় এক হাজার ৮০০ থেকে দুই হাজার টন বর্জ্য সংগ্রহ করে তা বর্জ্য ফেলার নির্ধারিত স্থানে ফেলা হয়। বাকি এক হাজার ৫০০ টন বর্জ্য পড়ে থাকে রাস্তাঘাটে, ড্রেনে অথবা নিচু এলাকায়। ঢাকা শহরে বাতাসের প্রতি কিউবিক মিটারে সিসার পরিমাণ ৪৬৩ ন্যানোগ্রাম, যা সহনীয় সীমার চেয়ে ১০ গুণ বেশি। প্রতিবছর বায়ুদূষণের কারণে এ শহরের ১৫ হাজার লোক মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে, কয়েক লাখ লোক আক্রান্ত হয় ফুসফুসের ব্যাধিতে। পানিদূষণ, বায়ুদূষণ, শব্দদূষণের ওপর ঢাকাবাসীর জন্য রয়েছে অসহনীয় যানজট। ঢাকা শহরের যানজটের কারণে প্রতিবছর অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ ১ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার।
অনেক সমস্যার কথা বললাম। এবার সমাধানের কথা বলি। প্রথম সমস্যা যানজট। সমস্যা সমাধানের জন্য মাটির ওপর ‘ফ্লাইওভার’ ও মাটির নিচে পাতালরেল দরকার। যানবাহনের অতিরিক্ত চাপ মাটির ওপরের ‘ফ্লাইওভার’ ও মাটির নিচের পাতালরেলে ছড়িয়ে দেওয়া গেলে মাটিসংলগ্ন রাস্তাঘাটের ওপর চাপ অনেক কমবে। এর সঙ্গে পর্যাপ্তসংখ্যক শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বাস, ট্যাক্সি ও পাতালরেলের সমন্বয়ে অবিলম্বে ঢাকা শহরের গণপরিবহনব্যবস্থাকে গড়ে তুলতে হবে। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) এক তথ্য অনুযায়ী, রাজধানী ঢাকার দেড় কোটি মানুষ পরিবহনের জন্য বৈধ ও অবৈধ মিলিয়ে পাবলিক গাড়ি আছে প্রায় সাড়ে সাত হাজার। এই অবস্থায় অবকাঠামো নির্মাণ করে পর্যাপ্তসংখ্যক গণপরিবহনব্যবস্থা করা না গেলে ‘প্রাইভেট কারে’র যন্ত্রণায় জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠবে।
ঢাকা শহরকে সহনীয় ও বাসযোগ্য করার জন্য ঢাকা থেকে ট্যানারি আর তেজগাঁও শিল্প এলাকাকে সরিয়ে ফেলতে হবে। সরিয়ে ফেলতে হবে সেনানিবাস, তেজগাঁও পুরাতন বিমানবন্দর ও বিডিআর সদর দপ্তর। তবে সেনানিবাস ও বিমানবন্দর সরিয়ে ফেলার পর এ জায়গাটি যেন রিয়েল এস্টেটের ব্যবসায়ীরা দখল করে না নেয়, সেদিকেও লক্ষ রাখতে হবে। বিকল্প আরেকটি প্রস্তাব নীতিনির্ধারকেরা বিবেচনা করতে পারেন। ঢাকাকে মূল রাজধানী রেখে, বেশ খানিকটা দূরে গিয়ে পদ্মা বা যমুনার তীর ঘেঁষে প্রশাসনিক ও বিচারিক রাজধানী করা যেতে পারে। প্রশাসনিক ও বিচারিক রাজধানী নির্মিত হলে সচিবালয়, উচ্চ ও নিম্ন আদালত এবং দূতাবাসগুলোকে ওই জায়গায় সরিয়ে নেওয়া হলে রাজধানী ঢাকার ওপর চাপ অনেক কমে যাবে। মালয়েশিয়ার উদাহরণটি প্রাসঙ্গিক হবে। মালয়েশিয়ার অফিশিয়াল রাজধানী হচ্ছে কুয়ালালামপুর কিন্তু প্রশাসনিক রাজধানী হচ্ছে পুত্রজায়া।
আকাশচুম্বী একটি ভবনকে ভেঙে ফেলা যায়, দাবদাহের দাউদাউ আগুনকে নিভিয়ে ফেলা যায়, একটি তেজস্ক্রিয় পারমাণবিক চুল্লিকে কংক্রিটে ঢেকে স্তব্ধ করে দেওয়া যায়, কিন্তু একটি শহরের অরাজকতাকে সুসংহত পরিকল্পনা ছাড়া নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। একটি পরিকল্পিত শহর যেমন তার অধিবাসীদের জন্য অপার সম্ভাবনা তৈরি করে, তেমনি শহরের অপরিকল্পিত বিন্যাস ও সীমাহীন অরাজকতা এর অধিবাসীদের জীবন করে তুলতে পারে দুর্বিষহ। আমরা চাইব, ঢাকা শহর তার সামাজিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতাকে বিবেচনায় নিয়ে নিজস্ব সংস্কৃতি ও কৃষ্টিকে আত্মস্থ করেই গড়ে উঠবে। যে ঢাকা শহর সব সেবা নিশ্চিত করে আমাদের স্বাস্থ্য দেবে, বিকশিত হওয়ার পুষ্টি দেবে, সম্মিলিত প্রয়াসে সেই প্রত্যাশার ঢাকা শহর কি আমরা নির্মাণ করতে পারব না?
শেখ হাফিজুর রহমান: সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
hrkarzon@yahoo.com
এই আমাদের প্রিয় ঢাকা শহর! বায়ুদূষণ, পানিদূষণ ও শব্দদূষণে কলুষিত, ময়লা-আবর্জনায় নোংরা, যানজটে স্থবির এই আমাদের ঢাকা শহর। খাবারে বিষ নিয়ে, ওষুধে ভেজাল নিয়ে, নিঃশ্বাসে সিসা নিয়ে আমরা বহন করে চলি আমাদের নাগরিক জীবন, জীবনকে আর আমাদের যাপন করা হয় না। এমন অসম্ভবের শহর পৃথিবীর আর কোথাও নেই। এ শহরের নাগরিকেরা ‘ট্যাক্স’ দেন, কিন্তু কেন ‘ট্যাক্স’ দেন তা জানেন না। কোনো ঐশ্বরিক শক্তির অলৌকিক ক্ষমতায় এ শহরের মানুষেরা বেঁচে থাকে। তাদের বেঁচে থাকাটাই পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্য ঘটনা! নইলে খাবারে বিষ নিয়ে, নিঃশ্বাসে সিসা নিয়ে, প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর আশঙ্কা নিয়ে কী করে তারা বেঁচে আছে? সরকার আসে, সরকার যায়। কিন্তু ঢাকার বাতাসে সিসার পরিমাণ বেড়েই চলে, যানজটে জনজীবনকে স্থবির করে দিয়ে ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্রে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে সামরিক স্থাপনা, ঢাকার খাল-বিল ভরাট করে একের পর এক নির্মিত হতে থাকে আকাশচুম্বী সব ভবন।
নজরুলরা কেন ঢাকা আসে? সহজ উত্তর, পেটের দায়ে। যোগাযোগব্যবস্থা ভালো হয়েছে। বাংলাদেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে এখন বাসে, ট্রেনে বা লঞ্চে করে যে কেউ ঢাকায় আসতে পারে। নদীভাঙা মানুষ নিরুপায় হয়ে ঢাকায় চলে আসে। গ্রামে বা মফস্বলে কাজ না থাকলে মানুষ ঢাকায় চলে আসে। ১৫-২০ দিন বা এক মাস কাজ করে, তারপর ফিরে যায় গ্রাম বা মফস্বলে স্ত্রী-সন্তানের কাছে। উপার্জনের টাকা শেষ হয়ে গেলে আশপাশে কাজ খোঁজে। কাজ না পেলে ছুটে আসে ঢাকায়। কেউ রিকশা চালায়, কেউ চা বিক্রি করে, কেউ সবজির দোকান দেয়। মুহূর্তেই বিষ, ভেজাল ও নোংরায় পরিপূর্ণ ঢাকা শহর হয়ে ওঠে পয়মন্ত এক দেবী। দেবী হাজার হাজার মানুষের কর্মের ব্যবস্থা করে দেন, কর্মশেষে উপার্জন নিয়ে মানুষেরা ফিরে যায় তাদের স্বজনদের কাছে। নীতিনির্ধারকদের সঠিক নীতি অনুসরণ না করার কারণে ঢাকা শহরকে করুণার দেবী হতে হয়। করুণার দেবী হাজার হাজার লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে তাদের হাতে উপার্জন তুলে দেন ঠিকই, কিন্তু ঢাকা শহর হয়ে ওঠে বসবাসের অযোগ্য এক স্থান, পৃথিবীতে বাস করেই এর বাসিন্দারা পেয়ে যান দোজখের আঁচ। নজরুলদের বলতে হয়, ‘ঢাকায় কি আর সাধে ভালো লাগে? মনে করেন, ঢাকায় থাকলে যেটুকু কামাই করি, সেটা দিয়েই বউ-বাচ্চা চলে। এখানে থাকলে তাই ভালো লাগে আবার গ্রামে গেলে মা, বউ রেন্দে-বেড়ে খাওয়ালে খুব ভালো লাগে।’
ঢাকা শহরে আমরা কেমন আছি? প্রতিদিন হাজারীবাগের ট্যানারি থেকে ১৬ হাজার টন বিষাক্ত বর্জ্য বুড়িগঙ্গায় গিয়ে পড়ছে। তেজগাঁও শিল্প এলাকা থেকে যে বিষাক্ত বর্জ্য বুড়িগঙ্গায় গিয়ে প্রতিদিন পড়ছে, তার পরিমাণ তিন হাজার টন। ঢাকার অধিবাসীরা প্রতিদিন ৬০ লাখ পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করছে। পরিত্যক্ত পলিথিন ব্যাগে জলাবদ্ধতা হচ্ছে, পরিবেশ দূষিত হচ্ছে, পরিবেশের জন্য তৈরি হচ্ছে মারাত্মক হুমকি। ঢাকা শহরের বাসাবাড়ির পাকঘর ও হোটেল-রেস্তোরাঁ থেকে প্রতিদিন যে পরিমাণ বর্জ্য নিঃসৃত হয়, তার পরিমাণ তিন হাজার ৫০০ টন। সিটি করপোরেশনের গাড়ি, কর্মী ও ব্যক্তিগত ব্যবস্থাপনায় এক হাজার ৮০০ থেকে দুই হাজার টন বর্জ্য সংগ্রহ করে তা বর্জ্য ফেলার নির্ধারিত স্থানে ফেলা হয়। বাকি এক হাজার ৫০০ টন বর্জ্য পড়ে থাকে রাস্তাঘাটে, ড্রেনে অথবা নিচু এলাকায়। ঢাকা শহরে বাতাসের প্রতি কিউবিক মিটারে সিসার পরিমাণ ৪৬৩ ন্যানোগ্রাম, যা সহনীয় সীমার চেয়ে ১০ গুণ বেশি। প্রতিবছর বায়ুদূষণের কারণে এ শহরের ১৫ হাজার লোক মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে, কয়েক লাখ লোক আক্রান্ত হয় ফুসফুসের ব্যাধিতে। পানিদূষণ, বায়ুদূষণ, শব্দদূষণের ওপর ঢাকাবাসীর জন্য রয়েছে অসহনীয় যানজট। ঢাকা শহরের যানজটের কারণে প্রতিবছর অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ ১ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার।
অনেক সমস্যার কথা বললাম। এবার সমাধানের কথা বলি। প্রথম সমস্যা যানজট। সমস্যা সমাধানের জন্য মাটির ওপর ‘ফ্লাইওভার’ ও মাটির নিচে পাতালরেল দরকার। যানবাহনের অতিরিক্ত চাপ মাটির ওপরের ‘ফ্লাইওভার’ ও মাটির নিচের পাতালরেলে ছড়িয়ে দেওয়া গেলে মাটিসংলগ্ন রাস্তাঘাটের ওপর চাপ অনেক কমবে। এর সঙ্গে পর্যাপ্তসংখ্যক শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বাস, ট্যাক্সি ও পাতালরেলের সমন্বয়ে অবিলম্বে ঢাকা শহরের গণপরিবহনব্যবস্থাকে গড়ে তুলতে হবে। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) এক তথ্য অনুযায়ী, রাজধানী ঢাকার দেড় কোটি মানুষ পরিবহনের জন্য বৈধ ও অবৈধ মিলিয়ে পাবলিক গাড়ি আছে প্রায় সাড়ে সাত হাজার। এই অবস্থায় অবকাঠামো নির্মাণ করে পর্যাপ্তসংখ্যক গণপরিবহনব্যবস্থা করা না গেলে ‘প্রাইভেট কারে’র যন্ত্রণায় জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠবে।
ঢাকা শহরকে সহনীয় ও বাসযোগ্য করার জন্য ঢাকা থেকে ট্যানারি আর তেজগাঁও শিল্প এলাকাকে সরিয়ে ফেলতে হবে। সরিয়ে ফেলতে হবে সেনানিবাস, তেজগাঁও পুরাতন বিমানবন্দর ও বিডিআর সদর দপ্তর। তবে সেনানিবাস ও বিমানবন্দর সরিয়ে ফেলার পর এ জায়গাটি যেন রিয়েল এস্টেটের ব্যবসায়ীরা দখল করে না নেয়, সেদিকেও লক্ষ রাখতে হবে। বিকল্প আরেকটি প্রস্তাব নীতিনির্ধারকেরা বিবেচনা করতে পারেন। ঢাকাকে মূল রাজধানী রেখে, বেশ খানিকটা দূরে গিয়ে পদ্মা বা যমুনার তীর ঘেঁষে প্রশাসনিক ও বিচারিক রাজধানী করা যেতে পারে। প্রশাসনিক ও বিচারিক রাজধানী নির্মিত হলে সচিবালয়, উচ্চ ও নিম্ন আদালত এবং দূতাবাসগুলোকে ওই জায়গায় সরিয়ে নেওয়া হলে রাজধানী ঢাকার ওপর চাপ অনেক কমে যাবে। মালয়েশিয়ার উদাহরণটি প্রাসঙ্গিক হবে। মালয়েশিয়ার অফিশিয়াল রাজধানী হচ্ছে কুয়ালালামপুর কিন্তু প্রশাসনিক রাজধানী হচ্ছে পুত্রজায়া।
আকাশচুম্বী একটি ভবনকে ভেঙে ফেলা যায়, দাবদাহের দাউদাউ আগুনকে নিভিয়ে ফেলা যায়, একটি তেজস্ক্রিয় পারমাণবিক চুল্লিকে কংক্রিটে ঢেকে স্তব্ধ করে দেওয়া যায়, কিন্তু একটি শহরের অরাজকতাকে সুসংহত পরিকল্পনা ছাড়া নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। একটি পরিকল্পিত শহর যেমন তার অধিবাসীদের জন্য অপার সম্ভাবনা তৈরি করে, তেমনি শহরের অপরিকল্পিত বিন্যাস ও সীমাহীন অরাজকতা এর অধিবাসীদের জীবন করে তুলতে পারে দুর্বিষহ। আমরা চাইব, ঢাকা শহর তার সামাজিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতাকে বিবেচনায় নিয়ে নিজস্ব সংস্কৃতি ও কৃষ্টিকে আত্মস্থ করেই গড়ে উঠবে। যে ঢাকা শহর সব সেবা নিশ্চিত করে আমাদের স্বাস্থ্য দেবে, বিকশিত হওয়ার পুষ্টি দেবে, সম্মিলিত প্রয়াসে সেই প্রত্যাশার ঢাকা শহর কি আমরা নির্মাণ করতে পারব না?
শেখ হাফিজুর রহমান: সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
hrkarzon@yahoo.com
No comments