উচ্চশিক্ষা-একটি বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যাশায় by আবদুল মান্নান
যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইংল্যান্ড অ্যাসোসিয়েশন অব স্কুলস অ্যান্ড কলেজেসের কমিশন অন ইনস্টিটিউশনস অব হায়ার এডুকেশনের (এনইএএসসি) আমন্ত্রণে গত মাসে বোস্টনের নিকটবর্তী শহর বেডফোর্ডে গিয়েছিলাম তাদের বার্ষিক সভায় অংশগ্রহণ করতে।
১৮৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত এই সংস্থার প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইংল্যান্ড এলাকার (কানেকটিকাট, মেইন, ম্যাসাচুসেটস, নিউ হ্যাম্পশায়ার, রোড আইল্যান্ড ও ভেরমন্ট অঙ্গরাজ্য) উচ্চশিক্ষা প্রদানের কাজে নিয়োজিত প্রায় দুই হাজার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় মানসম্মত শিক্ষা কার্যক্রম চালু রাখতে পারছে কি না, তা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা, তাদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেওয়া এবং সময়মতো তাদের মানের নিশ্চয়তার সনদ দেওয়া। এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যেমন জড়িত আছে বিশ্বখ্যাত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় বা এমআইটি, তেমনি আছে অনেকগুলো কমিউনিটি কলেজ। কমিশনের সঙ্গে জড়িত আছেন নিউ ইংল্যান্ড এলাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষাবিদ। প্রয়োজনে তাঁরা অবসরপ্রাপ্তদেরও সহায়তা নিতে পারেন। সাধারণ কথায়, এটি একটি অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল। সম্প্রতি বাংলাদেশে এডুকেশন কোয়ালিটি অ্যাসিউরেন্স ফাউন্ডেশন নামে এমন একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক কাজ সম্পন্ন হয়েছে। সেই সংস্থার হয়ে অংশগ্রহণ করার জন্য আমাকে এই সভায় আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। এটি ছিল অনেকটা শিক্ষামূলক অংশগ্রহণ।
এনইএএসসি এই সভার সপ্তাহ তিনেক পর গত ৬ অক্টোবর যুক্তরাজ্যভিত্তিক সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য টাইমস হায়ার এডুকেশন বিশ্বব্যাপী মানসম্মত ৪০০ উচ্চশিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের র্যাঙ্কিং প্রকাশ করে। সব মহাদেশ থেকে ১৫টি দেশ বাছাই করে তার ৫০ জন শিক্ষা বিশেষজ্ঞের মতামতের ভিত্তিতে এই র্যাঙ্কিং করা হয়। ব্যবহার করা হয় ১৩টি সূচক, যা পরে পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয়। এগুলো হচ্ছে (১) শিক্ষাদান ও শিক্ষার পরিবেশ (২) গবেষণা ও তার মান (৩) সেই গবেষণার ব্যবহার (৪) সৃজনশীলতায় শিক্ষার অবদান (৫) শিক্ষক নিয়োগ, ছাত্রভর্তি ও গবেষণায় আন্তর্জাতিকতা। তালিকার শীর্ষে স্থান পায় যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালটেক, তারপর হার্ভার্ড। ব্রিটেনের অক্সফোর্ড চতুর্থ আর কেমব্রিজ ষষ্ঠ। এশিয়ার শীর্ষে আছে টোকিও বিশ্ববিদ্যালয় (৩০তম)। উপমহাদেশের একমাত্র প্রতিনিধি মুম্বাইয়ের আইআইটি। বলা বহুল্য, সারা বিশ্বের ৪০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের এই তালিকায় বাংলাদেশের কোনো অবস্থান নেই । অঞ্চলভিত্তিক এমন একটা তালিকা করলে তাতেও বাংলাদেশের স্থান পাওয়া সহজ হতো না, যদিও আমাদের বুয়েট বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দু-একবার অন্য কয়েকটি র্যাঙ্কিংয়ে স্থান পেয়েছে।
বাংলাদেশে কলেজ পর্যায়ে উচ্চশিক্ষার শুরু ইংরেজ আমলে। পূর্ববঙ্গের সবচেয়ে পুরোনো কলেজ ঢাকা কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৮৪১ সালে। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার কয়েক বছরের মধ্যে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের যশখ্যাতি ভারতবর্ষ তো বটেই, তার বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে। প্রধান কারণ, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে উপমহাদেশের অনেক খ্যাতিমান পণ্ডিত শিক্ষক এবং শিক্ষাবিদ যোগ দিয়েছিলেন। বিলেত থেকেও এসেছিলেন কেউ কেউ। একসময় এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ছিলেন শ্রীষচন্দ্র চক্রবর্তী, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, নলিনীকান্ত ভট্টশালী, বৈদ্যনাথ আয়ার, ডব্লিউ এ জেনকিনস, সত্যেন বোস, কাজী মোতাহার হোসেন, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, আর সি মজুমদার প্রমুখ। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো শিক্ষকের নিযুক্তির এই ধারা মোটামুটি আশির দশক পর্যন্ত বজায় থেকেছে। তারপর ধীরে ধীরে শুরু হয় অবক্ষয় এবং শিক্ষক নিয়োগে স্বজনপ্রীতি, দলীয় বিবেচনা—এবং অভিযোগ আছে—কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রবেশ করে আর্থিক দুর্নীতি। এমনকি এসবের সঙ্গে ইদানীং যোগ হয়েছে শিক্ষক নিয়োগে ছাত্রসংগঠনগুলোর অযাচিত হস্তক্ষেপ। এটি শুধু যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সীমাবদ্ধ থেকেছে তা নয়, তা সংক্রমিত হয়েছে বস্তুত দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে। ফলে একদিকে যেমন অযোগ্য আর মধ্য মেধার শিক্ষক দ্বারা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভরে গেছে, অন্যদিকে মেধাবী শিক্ষার্থীরা পাস করার পর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাকে পেশা হিসেবে নেওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। কালক্রমে এসব স্বল্প মেধার শিক্ষকের মধ্য থেকেই কেউ হবেন বিভাগীয় প্রধান, ডিন এবং এমনকি উপাচার্য। ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়, তবে এই ব্যতিক্রমী শিক্ষকদের সংখ্যা দিন দিন কমতির দিকে এবং তাঁরা সব সময় কোণঠাসা অবস্থায় নিজের সম্মান বাঁচাতে ব্যস্ত থাকেন।
স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু সরকারের সময় যে কটি ভালো কাজ হয়েছিল তার অন্যতম হচ্ছে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচালনার জন্য ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় আইন প্রণয়ন। সেই আইন প্রণয়নের সময় ধরে নেওয়া হয়েছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা তাঁদের দায়িত্ব পালনে সর্বদা সচেষ্ট থাকবেন আর জবাবদিহি থাকবে নিজের বিবেকের কাছে এবং সরকার বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ক্ষেত্রে অযাচিত হস্তক্ষেপ করবে না। কিন্তু পরে এই প্রত্যাশার কোনোটিই ঠিক থাকেনি। আমরা শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হয়েছি (ব্যতিক্রম আছে)। আর সরকার কারণে-অকারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত কর্মকাণ্ডে হস্তক্ষেপ করছে। ২০ বছর আগেও শিক্ষকদের মধ্যে ক্লাস ফাঁকি দেওয়ার সংস্কৃতি তেমন একটা পরিচিত ছিল না। বর্তমানে তা কোনো কোনো ক্ষেত্রে মহামারি আকার ধারণ করেছে। ছাত্রী নির্যাতনের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক চাকরিচ্যুত হচ্ছেন—এসব সংবাদ পত্রিকার পাতা খুললেই দেখা যায়। দুজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক—একজন শিশুকে পাশবিক নির্যাতনের কারণে অধ্যয়নরত অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে গ্রেপ্তারের পর সে দেশ থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন; অন্যজন গবেষক—শিক্ষকের থিসিস নকল করে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন। দুজনই দেখি এখন একটি টিভি চ্যানেলে জনগণকে ইসলামের বাণী শোনান। এটি ভণ্ডামি ছাড়া আর কী? শিক্ষকতার কাছ থেকে নৈতিকতার সম্পর্কটা কেমন জানি ছিন্ন হয়ে গেছে।
বর্তমানে সব ক্ষেত্রে শিক্ষা হয়ে পড়েছে সার্টিফিকেট, গ্রেড, শ্রেণী বা ক্লাসকেন্দ্রিক। জ্ঞান অর্জন এখন মুখ্য বিষয় নয়। কলেজ পাস করে আসা ৪০ জন ছাত্রের একটি ক্লাসের যদি ৩০ জনই বাংলাদেশের সুন্দরবন কোন জেলায় অবস্থিত তা বলতে না পারে তাহলে বুঝতে হবে, আমাদের পড়ালেখায় মারাত্মক গলদ আছে। সেদিন এক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আমাকে জানালেন, তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি কোর্সে ৫৫ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে ৫০ জন ফেল করেছে। সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের কাছে এর কারণ জানতে চাইলে তিনি অকপটে জানালেন, তাঁর ক্লাসে শিক্ষার্থীরা অমনোযোগী থাকে। ক্লাসে শিক্ষার্থীদের মনোযোগী করে তোলার দায়িত্ব একান্তভাবেই শিক্ষকের।
বর্তমানে দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে ভর্তি কার্যক্রম শুরু হয়েছে। সামর্থ্য থাকলে দেশের এইচএসসি পাস করা সব শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চায়। যেহেতু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা কিছুটা ব্যয়বহুল, সেহেতু ভর্তির জন্য সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর চাপ ক্রমাগত বাড়ছে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্পদ আর সুযোগের অপ্রতুলতার কারণে যত শিক্ষার্থী ভর্তি হতে চায় তার অধিকাংশই ভর্তি হতে পারে না। আবার একটি বিরাট অংশ তার প্রত্যাশিত বিভাগে ভর্তি হতে পারে না। আর বাস্তব কথাটি হচ্ছে, যারা ভর্তি হতে আসছে তাদের বেশির ভাগেরই বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পড়ার প্রকৃত জ্ঞানের যথেষ্ট অভাব আছে। এটি তাদের কোনো দোষ নয়। দোষ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার। স্কুল-কলেজ পর্যায়ে শিক্ষার ব্যাপ্তি বেড়েছে বহুগুণ, কিন্তু পাল্লা দিয়ে কমেছে শিক্ষার মান এবং গভীরতা। শিক্ষা হয়ে পড়েছে সার্টিফিকেট আর গ্রেডসর্বস্ব।
সরকার ঘোষণা করেছে, দেশের জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে এটি হবে আত্মঘাতী। শুধু জায়গাজমি আর দালানকোঠা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় হয় না—যা সরকার, শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা বিশ্ববিদ্যারয় মঞ্জুরি কমিশন কিছুটা ভ্রান্তভাবে মনে করে। ভালো বিশ্ববিদ্যালয় গড়তে চাইলে প্রথম পূর্বশর্ত হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করার উপযোগী শিক্ষার্থী তৈরি করা, যা একান্তভাবে কলেজগুলোর দায়িত্ব। তার জন্য চাই কলেজগুলোর আমূল সংস্কার। পাঠ্যসূচিকে নিয়মিত আধুনিক করা এবং শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং অবশ্যই আইন করে সকল পর্যায়ে প্রাইভেট পড়ানো বন্ধ করা এবং পড়ালেখাকে শ্রেণীকক্ষে ফিরিয়ে আনা। বর্তমানে শিক্ষার মানের যে করুণ হাল, তার একটি প্রধান কারণ প্রাইভেট টিউশন ব্যবস্থা। সরকার শিক্ষকদের জন্য পৃথক বেতনকাঠামোর কথা বলেছে। এটি অচিরেই বাস্তবায়ন করতে হবে। উপযোগী শিক্ষার্থীর পাশাপাশি চাই যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক, গ্রন্থাগার আর গবেষণাগার। বিগত কয়েক বছরে যে কটি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে তার কোনোটিতেই পর্যাপ্তসংখ্যক ভালো মানের শিক্ষক নেই। একটি উপায় হতে পারে, ইতিমধ্যে যেসব বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক অবসরে আছেন সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা দিয়ে তাঁদের পুনরায় নিয়োগদানের ব্যবস্থা করা। অর্থাৎ বর্তমানে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা না করে যেগুলো চালু আছে সেগুলোর মান কীভাবে ফিরিয়ে আনা বা উন্নত করা যায় তা চিন্তা করা। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে আর্থিক বরাদ্দ মোট শিক্ষা খাতের বরাদ্দের ১ শতাংশেরও কম। এত কম বরাদ্দ দিয়ে উচ্চশিক্ষার মান বজায় রাখা অসম্ভব। অবশ্যই এই বরাদ্দ কয়েক গুণ বাড়াতে হবে। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে বরাদ্দকৃত অর্থের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে কোনো অবস্থাতেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অপ্রয়োজনীয় কর্মসংস্থানের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে দেওয়া যাবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞান সৃষ্টি হবে—এটি একটি পূর্বশর্ত। তার জন্য চাই গবেষণার সুষ্ঠু পরিবেশ এবং পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এর অভাব প্রকট। তার পরও কিছু শিক্ষক আছেন, অনেক পরিশ্রম করে তাঁদের গবেষণাকাজ পরিচালনা করেন। তাঁদের কারও কারও কাজের কারণে বিশ্ববিদ্যালয় বহির্বিশ্বে পরিচিত হয়। তাঁদের সংখ্যা বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই।
স্বল্প পরিসরে হলেও বাংলাদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সম্পর্কে দু-একটি কথা বলতে চাই। ১৯৯২ সালে যাত্রা করা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এখন এ দেশে একটি বাস্তব সত্য। সব বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়ার মধ্যে আনুমানিক ৫৫ শতাংশ শিক্ষার্থী বর্তমানে ৫১টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। আরও গোটা দশেক নতুন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আসার অপেক্ষায় আছে। মাঝেমধ্যে আইনের দোহাই দিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বেশ কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে বন্ধ করার হুমকি দেয়। তা না করে বরং যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে সমস্যা আছে তা সমাধানে তাদের সহায়তা করা উচিত। শিক্ষাক্ষেত্রই হতে পারে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিরও সর্বোৎকৃষ্ট ক্ষেত্র। অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশের দু-একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে হলেও অন্তত আঞ্চলিক র্যাঙ্কিংয়ের ওপরের দিকে দেখতে চাই। এটি অসম্ভব কিছু ব্যাপার নয়। তবে তা হতে হলে প্রস্তুতি এখনই শুরু করতে হবে। ১৬ কোটি মানুষের দেশে দু-চারটি বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় থাকবে না, তা তো হতে পারে না।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; বর্তমান শিক্ষক, ইউল্যাব, ঢাকা।
এনইএএসসি এই সভার সপ্তাহ তিনেক পর গত ৬ অক্টোবর যুক্তরাজ্যভিত্তিক সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য টাইমস হায়ার এডুকেশন বিশ্বব্যাপী মানসম্মত ৪০০ উচ্চশিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের র্যাঙ্কিং প্রকাশ করে। সব মহাদেশ থেকে ১৫টি দেশ বাছাই করে তার ৫০ জন শিক্ষা বিশেষজ্ঞের মতামতের ভিত্তিতে এই র্যাঙ্কিং করা হয়। ব্যবহার করা হয় ১৩টি সূচক, যা পরে পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয়। এগুলো হচ্ছে (১) শিক্ষাদান ও শিক্ষার পরিবেশ (২) গবেষণা ও তার মান (৩) সেই গবেষণার ব্যবহার (৪) সৃজনশীলতায় শিক্ষার অবদান (৫) শিক্ষক নিয়োগ, ছাত্রভর্তি ও গবেষণায় আন্তর্জাতিকতা। তালিকার শীর্ষে স্থান পায় যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালটেক, তারপর হার্ভার্ড। ব্রিটেনের অক্সফোর্ড চতুর্থ আর কেমব্রিজ ষষ্ঠ। এশিয়ার শীর্ষে আছে টোকিও বিশ্ববিদ্যালয় (৩০তম)। উপমহাদেশের একমাত্র প্রতিনিধি মুম্বাইয়ের আইআইটি। বলা বহুল্য, সারা বিশ্বের ৪০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের এই তালিকায় বাংলাদেশের কোনো অবস্থান নেই । অঞ্চলভিত্তিক এমন একটা তালিকা করলে তাতেও বাংলাদেশের স্থান পাওয়া সহজ হতো না, যদিও আমাদের বুয়েট বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দু-একবার অন্য কয়েকটি র্যাঙ্কিংয়ে স্থান পেয়েছে।
বাংলাদেশে কলেজ পর্যায়ে উচ্চশিক্ষার শুরু ইংরেজ আমলে। পূর্ববঙ্গের সবচেয়ে পুরোনো কলেজ ঢাকা কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৮৪১ সালে। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার কয়েক বছরের মধ্যে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের যশখ্যাতি ভারতবর্ষ তো বটেই, তার বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে। প্রধান কারণ, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে উপমহাদেশের অনেক খ্যাতিমান পণ্ডিত শিক্ষক এবং শিক্ষাবিদ যোগ দিয়েছিলেন। বিলেত থেকেও এসেছিলেন কেউ কেউ। একসময় এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ছিলেন শ্রীষচন্দ্র চক্রবর্তী, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, নলিনীকান্ত ভট্টশালী, বৈদ্যনাথ আয়ার, ডব্লিউ এ জেনকিনস, সত্যেন বোস, কাজী মোতাহার হোসেন, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, আর সি মজুমদার প্রমুখ। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো শিক্ষকের নিযুক্তির এই ধারা মোটামুটি আশির দশক পর্যন্ত বজায় থেকেছে। তারপর ধীরে ধীরে শুরু হয় অবক্ষয় এবং শিক্ষক নিয়োগে স্বজনপ্রীতি, দলীয় বিবেচনা—এবং অভিযোগ আছে—কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রবেশ করে আর্থিক দুর্নীতি। এমনকি এসবের সঙ্গে ইদানীং যোগ হয়েছে শিক্ষক নিয়োগে ছাত্রসংগঠনগুলোর অযাচিত হস্তক্ষেপ। এটি শুধু যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সীমাবদ্ধ থেকেছে তা নয়, তা সংক্রমিত হয়েছে বস্তুত দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে। ফলে একদিকে যেমন অযোগ্য আর মধ্য মেধার শিক্ষক দ্বারা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভরে গেছে, অন্যদিকে মেধাবী শিক্ষার্থীরা পাস করার পর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাকে পেশা হিসেবে নেওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। কালক্রমে এসব স্বল্প মেধার শিক্ষকের মধ্য থেকেই কেউ হবেন বিভাগীয় প্রধান, ডিন এবং এমনকি উপাচার্য। ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়, তবে এই ব্যতিক্রমী শিক্ষকদের সংখ্যা দিন দিন কমতির দিকে এবং তাঁরা সব সময় কোণঠাসা অবস্থায় নিজের সম্মান বাঁচাতে ব্যস্ত থাকেন।
স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু সরকারের সময় যে কটি ভালো কাজ হয়েছিল তার অন্যতম হচ্ছে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচালনার জন্য ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় আইন প্রণয়ন। সেই আইন প্রণয়নের সময় ধরে নেওয়া হয়েছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা তাঁদের দায়িত্ব পালনে সর্বদা সচেষ্ট থাকবেন আর জবাবদিহি থাকবে নিজের বিবেকের কাছে এবং সরকার বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ক্ষেত্রে অযাচিত হস্তক্ষেপ করবে না। কিন্তু পরে এই প্রত্যাশার কোনোটিই ঠিক থাকেনি। আমরা শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হয়েছি (ব্যতিক্রম আছে)। আর সরকার কারণে-অকারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত কর্মকাণ্ডে হস্তক্ষেপ করছে। ২০ বছর আগেও শিক্ষকদের মধ্যে ক্লাস ফাঁকি দেওয়ার সংস্কৃতি তেমন একটা পরিচিত ছিল না। বর্তমানে তা কোনো কোনো ক্ষেত্রে মহামারি আকার ধারণ করেছে। ছাত্রী নির্যাতনের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক চাকরিচ্যুত হচ্ছেন—এসব সংবাদ পত্রিকার পাতা খুললেই দেখা যায়। দুজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক—একজন শিশুকে পাশবিক নির্যাতনের কারণে অধ্যয়নরত অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে গ্রেপ্তারের পর সে দেশ থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন; অন্যজন গবেষক—শিক্ষকের থিসিস নকল করে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন। দুজনই দেখি এখন একটি টিভি চ্যানেলে জনগণকে ইসলামের বাণী শোনান। এটি ভণ্ডামি ছাড়া আর কী? শিক্ষকতার কাছ থেকে নৈতিকতার সম্পর্কটা কেমন জানি ছিন্ন হয়ে গেছে।
বর্তমানে সব ক্ষেত্রে শিক্ষা হয়ে পড়েছে সার্টিফিকেট, গ্রেড, শ্রেণী বা ক্লাসকেন্দ্রিক। জ্ঞান অর্জন এখন মুখ্য বিষয় নয়। কলেজ পাস করে আসা ৪০ জন ছাত্রের একটি ক্লাসের যদি ৩০ জনই বাংলাদেশের সুন্দরবন কোন জেলায় অবস্থিত তা বলতে না পারে তাহলে বুঝতে হবে, আমাদের পড়ালেখায় মারাত্মক গলদ আছে। সেদিন এক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আমাকে জানালেন, তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি কোর্সে ৫৫ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে ৫০ জন ফেল করেছে। সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের কাছে এর কারণ জানতে চাইলে তিনি অকপটে জানালেন, তাঁর ক্লাসে শিক্ষার্থীরা অমনোযোগী থাকে। ক্লাসে শিক্ষার্থীদের মনোযোগী করে তোলার দায়িত্ব একান্তভাবেই শিক্ষকের।
বর্তমানে দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে ভর্তি কার্যক্রম শুরু হয়েছে। সামর্থ্য থাকলে দেশের এইচএসসি পাস করা সব শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চায়। যেহেতু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা কিছুটা ব্যয়বহুল, সেহেতু ভর্তির জন্য সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর চাপ ক্রমাগত বাড়ছে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্পদ আর সুযোগের অপ্রতুলতার কারণে যত শিক্ষার্থী ভর্তি হতে চায় তার অধিকাংশই ভর্তি হতে পারে না। আবার একটি বিরাট অংশ তার প্রত্যাশিত বিভাগে ভর্তি হতে পারে না। আর বাস্তব কথাটি হচ্ছে, যারা ভর্তি হতে আসছে তাদের বেশির ভাগেরই বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পড়ার প্রকৃত জ্ঞানের যথেষ্ট অভাব আছে। এটি তাদের কোনো দোষ নয়। দোষ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার। স্কুল-কলেজ পর্যায়ে শিক্ষার ব্যাপ্তি বেড়েছে বহুগুণ, কিন্তু পাল্লা দিয়ে কমেছে শিক্ষার মান এবং গভীরতা। শিক্ষা হয়ে পড়েছে সার্টিফিকেট আর গ্রেডসর্বস্ব।
সরকার ঘোষণা করেছে, দেশের জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে এটি হবে আত্মঘাতী। শুধু জায়গাজমি আর দালানকোঠা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় হয় না—যা সরকার, শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা বিশ্ববিদ্যারয় মঞ্জুরি কমিশন কিছুটা ভ্রান্তভাবে মনে করে। ভালো বিশ্ববিদ্যালয় গড়তে চাইলে প্রথম পূর্বশর্ত হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করার উপযোগী শিক্ষার্থী তৈরি করা, যা একান্তভাবে কলেজগুলোর দায়িত্ব। তার জন্য চাই কলেজগুলোর আমূল সংস্কার। পাঠ্যসূচিকে নিয়মিত আধুনিক করা এবং শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং অবশ্যই আইন করে সকল পর্যায়ে প্রাইভেট পড়ানো বন্ধ করা এবং পড়ালেখাকে শ্রেণীকক্ষে ফিরিয়ে আনা। বর্তমানে শিক্ষার মানের যে করুণ হাল, তার একটি প্রধান কারণ প্রাইভেট টিউশন ব্যবস্থা। সরকার শিক্ষকদের জন্য পৃথক বেতনকাঠামোর কথা বলেছে। এটি অচিরেই বাস্তবায়ন করতে হবে। উপযোগী শিক্ষার্থীর পাশাপাশি চাই যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক, গ্রন্থাগার আর গবেষণাগার। বিগত কয়েক বছরে যে কটি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে তার কোনোটিতেই পর্যাপ্তসংখ্যক ভালো মানের শিক্ষক নেই। একটি উপায় হতে পারে, ইতিমধ্যে যেসব বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক অবসরে আছেন সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা দিয়ে তাঁদের পুনরায় নিয়োগদানের ব্যবস্থা করা। অর্থাৎ বর্তমানে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা না করে যেগুলো চালু আছে সেগুলোর মান কীভাবে ফিরিয়ে আনা বা উন্নত করা যায় তা চিন্তা করা। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে আর্থিক বরাদ্দ মোট শিক্ষা খাতের বরাদ্দের ১ শতাংশেরও কম। এত কম বরাদ্দ দিয়ে উচ্চশিক্ষার মান বজায় রাখা অসম্ভব। অবশ্যই এই বরাদ্দ কয়েক গুণ বাড়াতে হবে। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে বরাদ্দকৃত অর্থের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে কোনো অবস্থাতেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অপ্রয়োজনীয় কর্মসংস্থানের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে দেওয়া যাবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞান সৃষ্টি হবে—এটি একটি পূর্বশর্ত। তার জন্য চাই গবেষণার সুষ্ঠু পরিবেশ এবং পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এর অভাব প্রকট। তার পরও কিছু শিক্ষক আছেন, অনেক পরিশ্রম করে তাঁদের গবেষণাকাজ পরিচালনা করেন। তাঁদের কারও কারও কাজের কারণে বিশ্ববিদ্যালয় বহির্বিশ্বে পরিচিত হয়। তাঁদের সংখ্যা বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই।
স্বল্প পরিসরে হলেও বাংলাদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সম্পর্কে দু-একটি কথা বলতে চাই। ১৯৯২ সালে যাত্রা করা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এখন এ দেশে একটি বাস্তব সত্য। সব বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়ার মধ্যে আনুমানিক ৫৫ শতাংশ শিক্ষার্থী বর্তমানে ৫১টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। আরও গোটা দশেক নতুন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আসার অপেক্ষায় আছে। মাঝেমধ্যে আইনের দোহাই দিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বেশ কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে বন্ধ করার হুমকি দেয়। তা না করে বরং যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে সমস্যা আছে তা সমাধানে তাদের সহায়তা করা উচিত। শিক্ষাক্ষেত্রই হতে পারে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিরও সর্বোৎকৃষ্ট ক্ষেত্র। অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশের দু-একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে হলেও অন্তত আঞ্চলিক র্যাঙ্কিংয়ের ওপরের দিকে দেখতে চাই। এটি অসম্ভব কিছু ব্যাপার নয়। তবে তা হতে হলে প্রস্তুতি এখনই শুরু করতে হবে। ১৬ কোটি মানুষের দেশে দু-চারটি বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় থাকবে না, তা তো হতে পারে না।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; বর্তমান শিক্ষক, ইউল্যাব, ঢাকা।
No comments