চারদিক-৯০ বছরে পা দিল বাংলা বিভাগ

বেলা ১১টা। টিএসসির মূল ফটক পেরিয়ে ভেতরে পা দিতেই চোখে পড়ল হুলস্থুল কাণ্ড। একজন অন্যজনকে দেখেই জড়িয়ে ধরছেন। আবার কেউ হয়তো ইতিউতি খুঁজেই মরছেন তাঁর ব্যাচের বন্ধুদের। কেউ আবার অনেক দিন পরে বন্ধুকে দেখে একজন অন্যজনের থেকে মুঠোফোনের নম্বর বিনিময় করছেন। কুশল বিনিময়ের পালা যেন শেষই হচ্ছে না।


কর্মক্ষেত্রের খোঁজ, পারিবারিক খোঁজখবর, সন্তানাদি আরও কত্ত খবর। কোনটা রেখে কোনটা দেবেন সবাই। তবে সবকিছুর পরে এত দিন বাদে যে দেখা হলো, এই বা কম কী! টিএসসি অডিটরিয়াম ততক্ষণে একেবারে লোকে লোকারণ্য। আয়োজনটি হয় ৮ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ৯০ বছর পূর্তি উপলক্ষকে কেন্দ্র করে। বিভাগের বয়স ৯০ বছর হলেও সেদিন যেন পুরোনো শিক্ষার্থীদের পদচারণে চিরনবীন ঠেকছিল।
দিনটিতে বাংলা বিভাগ কেবল ৯০ বছরেই পা দিল না, বরং এই দিন বিভাগের পুরোনো শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান আর তাঁদের উপস্থিতিতে বাংলা বিভাগ অ্যালামনাই গঠন করা হলো।
‘মিলন মেলায় মিলি’ কথাটা যেন একেবারে খেটে যাচ্ছিল দিনটার ক্ষেত্রে।
জাফরিন আক্তার নিয়ে এসেছেন তাঁর তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ুয়া মেয়ে সৈয়দা সোহাকে। সোহা বলে, ‘খুব ভালো লাগছে। মা-মণি তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করছে দেখেই অনেক ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে, আমি যেমন ফ্রেন্ডদের সঙ্গে গল্প করি, মা-মণি তেমনই করছে।’
সকাল ১০টায় মঞ্চে উঠে আসেন আলোচনার প্রথম পর্বের সঞ্চালক, বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ। তিনি বলেন, বিভাগের ৮০ বছর পূর্তিতে এক বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। তবে এবারের আয়োজনের পরিসর যেমন ব্যাপক, তেমনি অ্যালামনাই গঠনের মাধ্যমে বাংলা বিভাগের উন্নয়নের জন্য কাজ করা হবে। মোট কথা, ভাষা ও সাহিত্য বিকাশের জন্য এ বিভাগ কাজ করবে।
অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। মুক্তিযুদ্ধসহ দেশের ক্রান্তিকালে দেশমাতৃকার সেবায় এ বিভাগের অগ্রগণ্য ভূমিকার কথা তুলে ধরেন তিনি। প্রথম পর্যায়ের সভাপতি ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান বলেন, বাংলা বিভাগের এই আয়োজন গৌরবময় অতীতের কথা মনে করিয়ে দেয়। শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে মানবিক মূল্যবোধ ও গণতান্ত্রিক চেতনায় এই বিভাগের অবদান কখনোই বিস্মৃত হওয়ার নয়। এই আয়োজনের মাধ্যমে প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা সম্পৃক্ত হবেন এবং সেই গৌরব পুনরুজ্জীবিত হবে।
অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্যায়ে হয় ইতিহাস-কথন। বিভাগের ৯০ বছরের সময়কালকে মোট চারটি পর্যায়ে ভাগ করে শিক্ষকেরা আলোচনা করেন। বক্তা হিসেবে ছিলেন ড. আনিসুজ্জামান, ড. রফিকুল ইসলাম, বিশ্বজিৎ ঘোষ ও বায়তুল্লাহ কাদেরী। এ পর্যায়ে সভাপতিত্ব করেন বিভাগের চেয়ারপারসন অধ্যাপক সিদ্দিকা মাহমুদা।
আটজন শিক্ষার্থীকে বিভাগ থেকে প্রদান করা হয় সম্মাননা। আর তাঁরা সবাই অর্ধ-শতাব্দী আগে বিভাগ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেছিলেন এবং বাংলা ভাষা এবং সাহিত্য সেবায় তাঁদের অবদান কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করা হয়। তবে সম্মাননা গ্রহণ করতে আসেন অধ্যাপক ড. আশরাফ হোসেন সিদ্দিকী (১৯৫০), অধ্যাপক রওশন আরা রহমান (১৯৫৩), অধ্যাপক মোহাম্মাদ আব্দুল কাইউম (১৯৫৪) ও অধ্যাপক মনোয়ারা ইসলাম (১৯৫৪)। তাঁরা উপাচার্যের কাছ থেকে সম্মাননা গ্রহণ করেন।
মধ্যাহ্নের বিরতি যেন বিশ্ববিদ্যালয়ে দুপুরের খাবার খাওয়ার কথা মনে করিয়ে দেয়, এমনটাই জানা যায় ব্যাংক কর্মকর্তা রাশেদ আহম্মেদের কথা থেকে। তিনি এবং তাঁর স্ত্রী এই বিভাগেরই প্রাক্তন শিক্ষার্থী। তবে আজ তাঁরা আলাদা বসেছেন। রাশেদ আহম্মেদ আরও বলেন, ‘আজ আমরা দুজনে বিভাগের শিক্ষার্থী হিসেবে এসেছি। আর তাই যে যার বন্ধুদের সঙ্গে বসে খাচ্ছি আর গল্পে মশগুল হচ্ছি।’
এর পরে বিভাগকে নিয়ে কেবলই স্মৃতিচারণা। বিভাগের অধ্যাপক ড. আহম্মেদ কবির বলেন, বাংলা বিভাগ কেবল রূপের পূজারি নয়, গুণেরও পূজারি।
এত আড্ডার মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনে নিজের হাসি, আনন্দ, হলের জীবন আর রাজনৈতিক আগ্রাসন/নির্যাতনের কথা মনে করছিলেন লায়ন অধ্যাপক মোয়াররফ হোসেন। ১৯৭০ সালে এমএ পাস করেছেন তিনি। এত দিন পরে বন্ধুদের পেয়ে বাঁধভাঙা আবেগ আর ধরে রাখতে পারছেন না। বয়সে অনুজপ্রতিম হলেও আড্ডায় শামিল না হয়ে পারি না। মোয়াররফ হোসেন বলেন, ১৯৬৯-এর ১৮ জানুয়ারি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে। আর এর ফলে যে কত নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছিল, তা বলে দেয় আমার হাতের কনুই আর মাথার কাটা দাগ। কথাটা বুঝতে কিছুটা সময় লাগে। হেসে উত্তর দেন এই প্রবীণ, ‘আরে বুঝলা না, সেন্ট্রাল জেলে ছিলাম, মাইরের দাগ এইগুলা।’ এর পরে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে যাই, দেশ স্বাধীন হয়। আর লোভ সামলাতে পারছিলাম না। এরই মধ্যে তাঁর সহপাঠী সাজেদা বেগম হেসেই খুন। ‘হইছে আর ইতিহাস বলতে হবে না।’ এমনই হাসি-আনন্দে কাটে পুরোটা দিন। সর্বশেষ আয়োজন করা হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বর্তমান ও প্রবীণ শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে পরিবেশিত হয় গান, অভিনয়সহ কবিতা আবৃত্তি।
অনুষ্ঠান শেষ। চোখের পলকেই যেন আনন্দের সময়টা কেটে যায়। সবাই ফেরেন ঘরে, তবে বাংলা বিভাগকে আরেকটু বেশি ভালোবেসে।
শারমিন নাহার

No comments

Powered by Blogger.