যৌথ নদী-তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে জটিলতা বাড়ছে by ম. ইনামুল হক

গত ১১ জানুয়ারি কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় ‘মমতার শর্ত মেনে তিস্তা-জট খুলতে উদ্যোগী মনমোহন’ শীর্ষক একটি খবর প্রকাশিত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তীব্র আপত্তির কারণে মুখ থুবড়ে পড়েছিল তিস্তা চুক্তি। পশ্চিমবঙ্গ জল থেকে বঞ্চিত হবে—এই অভিযোগ তোলায় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ঢাকা সফরে গিয়েও সেই চুক্তি বাস্তবায়ন করতে পারেননি।


মমতা ইতিমধ্যে নদীবিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্রকে তিস্তার পরিস্থিতি সরেজমিনে খতিয়ে দেখে রিপোর্ট জমা দিতে বলেছেন। এ মাসের শেষে কল্যাণবাবু তাঁর রিপোর্ট জমা দিতে পারেন। মমতার কথা, বাংলাদেশকে ২৫ শতাংশের বেশি জল দেওয়া যাবে না। কিন্তু খসড়া চুক্তিতে সে কথা ছিল না। এবার মনমোহন সিং আগেভাগেই চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন, বাংলাদেশকে গজলডোবা থেকে ২৫ শতাংশ জলই দেওয়া হবে। তা ছাড়া গঙ্গার জল বণ্টনের ক্ষেত্রে যেমন কে কত কিউসেক জল পাবে তা বলা আছে, তিস্তার ক্ষেত্রে তা করা হচ্ছে না। সেখানে প্রবাহিত জলের শতাংশের ভিত্তিতে ভাগাভাগির কথা বলা থাকবে।
বাংলাদেশকে ২৫ শতাংশ তিস্তার জল দেওয়ার স্বপক্ষে আনন্দবাজার পত্রিকায় বলা হয়েছে, গজলডোবায় যে ব্যারাজ আছে, সেখান থেকে ২৫ শতাংশ জল দেওয়া হলেও নদীর ভাটিতে দোমোহনির কাছে এসে তা অন্যান্য উপনদী ও বৃষ্টির প্রবাহে ‘রিচার্জ’ হয়ে আরও ২৫ শতাংশ বেড়ে যাবে। এভাবে বাংলাদেশকে সন্তুষ্ট করা হবে এবং এ কথা নতুন খসড়া চুক্তিতে বলা থাকবে। সিকিম যে তিস্তা নদীর উপনদীগুলোতে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য জলাধার নির্মাণ করে তিস্তার তলানিপ্রবাহ আটকে ফেলছে, সে ব্যাপারে সিকিমের মুখ্যমন্ত্রীকে জানানো হয়েছে। ‘তিস্তায় এখন জল নেই’ বলেই চুক্তির প্রয়োজন হচ্ছে। তবে এই চুক্তি অন্তর্বর্তীকালীন। ১০ বছরের প্রবাহ দেখে স্থায়ী চুক্তি করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। বাংলাদেশ এখনো এ ধরনের ব্যবস্থাপনায় রাজি হচ্ছে না, কিন্তু রাজি করানোর চেষ্টা চলছে। উল্লেখ্য, ২০১১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং দুদিনের সফরে বাংলাদেশে এলে তাঁর সঙ্গে আসেন ভারতীয় চার রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা—আসামের তরুণ গগৈই, ত্রিপুরার মাণিক সরকার, মিজোরামের লালথান হাওলা এবং মেঘালয়ের মুকুল সংমা। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি আসেননি বলে তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি হয়নি। গত ৮ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব মিজারুল কায়েস বলেন, তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি চূড়ান্ত হয়েই আছে। বাংলাদেশ তার অবস্থান থেকে এক বিন্দুও ছাড় দেবে না। তবে কথাগুলো যত সহজে তিনি বলেছিলেন, বিষয়টি তত সহজ আর থাকছে না।
তিস্তা পানি চুক্তির বিপরীতে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে যাতায়াত ও মালামাল পরিবহনের জন্য বাংলাদেশের কাছে ট্রানজিট চাইছিল। বাংলাদেশসংলগ্ন অন্য চারটি রাজ্যের যে মুখ্যমন্ত্রীরা এসেছিলেন, তাঁদের স্বার্থে বিষয়টি জরুরি ছিল। আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী, দেশীয় বাধ্যবাধকতা পালন করে কাস্টম ছাড় ও শুল্ক প্রদান সাপেক্ষে বাংলাদেশ বন্ধুপ্রতিম দেশের মালামাল গমনাগমনের সুযোগ দিতেই পারে। তবে ভারতীয় মালামালের নিরাপত্তার দায় কোনো আন্তর্জাতিক ইনস্যুরেন্স কোম্পানিকে দেওয়ার কথা আমরা বলেছিলাম, যাতে কোনো দুর্ঘটনার দায় বাংলাদেশের ঘাড়ে এসে না পড়ে। প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশ কি তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে যথেষ্ট প্রস্তুত ছিল, নাকি একটি লোকদেখানো চুক্তি সই করার ব্যাপারে ভারতের চাপের মুখে ছিল? তিস্তা পানি চুক্তি না হলেও পরবর্তীকালে ভারত তার ট্রানজিট-সুবিধাগুলো ক্রমাগত পেয়েই যাচ্ছে।
ভারত ১৯৮২ সালে গজলডোবার কাছে তিস্তা নদীর ওপর ব্যারাজ নির্মাণ করে এবং ডাইভারশন খাল কেটে মহানন্দা নদীতে পানি সরিয়ে নিচ্ছে। তা ছাড়া উত্তর বঙ্গের কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং, উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিণ দিনাজপুর এবং মালদহ জেলার ৯ দশমিক ২২ লাখ হেক্টর জমিতে তিস্তার পানি দিয়ে সেচ দেওয়ার জন্য ভারতের বিশাল পরিকল্পনা আছে। বাংলাদেশ ১৯৯০ সালে দোয়ানীর কাছে তিস্তা ব্যারাজ নির্মাণ করেছে, যার আওতায় বৃহত্তর রংপুর, দিনাজপুর ও বগুড়া জেলার ৬ দশমিক ৩২ লাখ হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়ার পরিকল্পনা আছে। বাংলাদেশে নির্মিত তিস্তা ব্যারাজের কাছে ঐতিহাসিকভাবে তিস্তা নদীর সর্বাধিক গড় প্রবাহ ছিল দুই লাখ ৮০ হাজার কিউসেক এবং সর্বনিম্ন গড় প্রবাহ ছিল ১০ হাজার কিউসেক। এর উজানে ক্রমবৃদ্ধি হারে পানি সরিয়ে নেওয়ার কারণে বাংলাদেশে এর প্রবাহ এখন এক হাজার কিউসেকে এসে দাঁড়িয়েছে। এমনকি খরার সময় তা ৫০০ কিউসেক হয়ে যায়।
২০১০ সালের মার্চ মাসে দিল্লিতে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ নদী কমিশনের ৩৭তম বৈঠকের সময় বাংলাদেশের পানিসম্পদমন্ত্রী রমেশ চন্দ্র রায় তিস্তার পানি গজলডোবা পয়েন্টে ৫০-৫০ হারে ভাগাভাগির দাবি তুলেছিলেন। ওই সময় তিনি সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, আমরা না চাইতেই তিন হাজার ৫০০ কিউসেক পানি পাচ্ছি—আলাপের মাধ্যমে আরও বেশি পাব। (দি ডেইলি স্টার, ১৮.০৩.২০১০)। ২০১১ সালের জানুয়ারি মাসে ঢাকায় সচিব পর্যায়ের বৈঠকে বাংলাদেশ আট হাজার কিউসেক ও ভারত ২১ হাজার কিউসেক পানি পাওয়ার দাবি তোলে। এই দুই মিলে ২৯ হাজার কিউসেক হয়, কিন্তু তিস্তার গড় ন্যূনতম প্রবাহ ছিল ১০ হাজার কিউসেক! ঐতিহাসিকভাবে, তিস্তার পানি আসে হিমালয়ের হিমবাহগুলো থেকে, যার সঙ্গে যোগ দেয় এর গতিপথের ঝরনা ও উপনদীগুলোর প্রবাহ। এই প্রবাহ বসন্ত আসার সঙ্গে বাড়তে থাকে, যখন তাপ বৃদ্ধির কারণে তুষার ও হিমবাহগুলো গলতে শুরু করে। বর্ষার অতিবৃষ্টি (সারা সিকিমে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত ২৭৪০ মিলিমিটার) অনেক সময় ভাটির ডুয়ার্স সমতলে বন্যা সৃষ্টি করে। ভারতের পানিবিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্র তিস্তার পানি প্রসঙ্গে লিখেছেন, এন্ডারসন সেতুর তলায় এই প্রবাহ অনেক সময় ৯০ কিউমেকে (৩১৭৭ কিউসেক) নেমে আসে। [১ কিউমেক (কিউবিক মিটার প্রতি সেকেন্ডে) = ৩৫.৩ কিউসেক (কিউবিক ফিট প্রতি সেকেন্ড)]। এই সেতুটি দার্জিলিং কালিমপং সড়কে অবস্থিত, যার ২৫ কিলোমিটার ভাটিতে সিভক শহরের কাছে তিস্তা নদী ডুয়ার্সের সমতলে প্রবেশ করেছে। এরও ১৫ কিলোমিটার ভাটিতে গজলডোবা ব্যারাজ নির্মিত। গজলডোবার ২৫ কিলোমিটার ভাটিতে দোমোহনি রেল বা সড়কসেতু, যার উজানে ডুয়ার্স অঞ্চলের ধরলা নদী এসে মিশেছে। শীতে তিস্তা নদীতে এই নদীর জোগান ১০ কিউমেকের বেশি হবে না। গজলডোবার ৬৫ কিলোমিটার ভাটিতে তিস্তা নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। বাংলাদেশের কাউনিয়া রেল সেতুর কাছে আমরা গড়ে ২০০ কিউমেক ন্যূনতম প্রবাহ পেয়েছি।
কল্যাণ রুদ্র গত ৬ সেপ্টেম্বর কলকাতায় বলেন, গজলডোবা ব্যারাজের কাছে তিস্তার ন্যূনতম প্রবাহ হলো তিন হাজার ৫০০ থেকে চার হাজার কিউসেক। কল্যাণ রুদ্র আরও বলেন, সিকিমে প্রস্তাবিত ২৩টি ‘লো ফ্লো’ ড্যামস নির্মিত হলে পানি আরও কম পাওয়া যাবে। বাস্তবে ১৯৮২ সালে গজলডোবা ব্যারাজ চালু করার আগে থেকেই সেচের জন্য তিস্তা নদী থেকে পানি উত্তোলন করায় এবং সিকিমে নির্মিত পর্যটন ও জলবিদ্যুৎ জলাধারগুলোতে পানি আটকে রাখায় প্রবাহ কমতে থাকে। তিস্তা অববাহিকায় পাঁচটি নির্মিত, চারটি নির্মীয়মাণ এবং ৩১টি প্রস্তাবিত ড্যাম প্রকল্প আছে । কিন্তু প্রশ্ন হলো, গজলডোবা ব্যারাজের কাছে আসা তিন হাজার ৫০০ থেকে চার হাজার কিউসেক পানি কোথায় যাচ্ছে? কারণ, ভাটিতে দোয়ানীর কাছে আমরা মাত্র ১০০০ থেকে ৪০০ কিউসেক পানি পাচ্ছি। এর উত্তর পেতে আমাদেরকে তেঁতুলিয়া থেকে বাংলাবান্ধা সড়কে যেতে হবে, যার পাশ দিয়ে মহানন্দা নদী প্রবাহিত। আমরা দেখব, তিস্তার পানি এই নদী দিয়ে সরিয়ে ভারত নিয়ে যাচ্ছে বিহারের মেচী নদীতে, সেখান থেকে ফুলহার নদের মাধ্যমে ফারাক্কার উজানে। ভারত মেচী নদীতে একটি ব্যারাজ নির্মাণ করছে, যে কারণে উত্তরবঙ্গ ও বিহারে তার আন্তনদী সংযোগ পরিকল্পনা সম্পূর্ণ হয়ে যাবে। আমরা মমতা ব্যানার্জিকে বলব, তিস্তার পানি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ আর বাংলাদেশের কলহের সুযোগে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার যে তিস্তার পানির সিংহভাগ উত্তর ভারতে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, সেটা কি তিনি দেখতে পাচ্ছেন? ভারত এখন জটিলতা সৃষ্টির লক্ষ্যে বাংলাদেশের দোয়ানীতে পানির প্রবাহের ১৫ বছরের রেকর্ড চেয়েছে এবং দোমোহনির কাছে কী পরিমাণ পানি রিচার্জ হলো, সে প্রসঙ্গ আনছে। আমরা কি ভারতের কাছে তিস্তার পানি প্রত্যাহারের সব রেকর্ড চাইতে পারি না?
সুসম্পর্কসম্পন্ন প্রতিবেশী দুটি দেশের মধ্যে কোনো আন্তর্জাতিক চুক্তি হলে কী দেব আর কী পাব বা কে কত বেশি লাভবান হবে, তা মোটেই বিবেচ্য হতে পারে না, বরং বিবেচ্য হবে উভয় দেশের জনগণের স্বার্থ। তিস্তার পানি চুক্তি, ফেনী নদীর চুক্তি, ছিটমহল বিনিময় কিংবা ট্রানজিট দেওয়ার ব্যাপারে শুধু ভারত বা পশ্চিমবঙ্গের জনগণের স্বার্থই নয়, বাংলাদেশের স্বার্থকেও প্রাধান্য দিতে হবে। ভারত ও বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলোর ঋতুভিত্তিক ঐতিহাসিক গড়প্রবাহের ওপর নির্ভর করেই এই অববাহিকার জীবজীবন, কৃষি ও অর্থনীতি গড়ে উঠেছে। তাই তিস্তা নদীর পানি বণ্টনের সময় আমাদের ঐতিহাসিক প্রবাহ অক্ষুণ্ন রাখার দাবি তুলতে হবে এবং আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী তিস্তার অববাহিকার পানি অন্য অববাহিকায় চালান বন্ধ করার কথা বলতে হবে।
ম. ইনামুল হক: চেয়ারম্যান, জল পরিবেশ ইনস্টিটিউট।
minamul@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.