কালান্তরের কড়চা-জীবন সায়াহ্নে পৌঁছেও যদি অভ্যাস পাল্টানো না যায়, তবে আর কবে পাল্টাব? by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
মিথ্যাচারের জবাবে (২) আগেই লিখেছি, সিরাজুর রহমান (বিবিসি রেডিও বাংলা বিভাগের সাবেক স্টাফ) তাঁর 'নয়া দিগন্তের' এক কলামে লিখেছেন, ১৯৫২ সালে আমি ম্যাট্রিক পাস করে বরিশাল থেকে ঢাকায় এসে তাঁর কাছে চাকরিপ্রার্থী হয়েছিলাম। কথাটা ডাহা মিথ্যা না হলে স্বীকার করতাম। কারণ কারো কাছে চাকরিপ্রার্থী হওয়া এমন কিছু লজ্জার ব্যাপার নয়। সিরাজুর রহমানও তাঁর সাংবাদিক জীবনে বহু লোকের কাছে চাকরিপ্রার্থী হয়েছেন।
তাঁদের মধ্যে আছেন প্রখ্যাত সাংবাদিক মোহাম্মদ মোদাব্বের এবং 'ইত্তেফাকের' প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক প্রয়াত তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া। তাঁর সুপারিশেই গ্র্যাজুয়েশন না থাকা সত্ত্বেও সিরাজুর রহমান ঢাকায় পঞ্চাশের দশকে ব্রিটিশ ইনফরমেশন সার্ভিসে চাকরি পেয়েছিলেন।
আমি ম্যাট্রিক পাস করি ১৯৫০ সালে। তখনই আমার ছোটগল্প লেখক হিসেবে এক-আধটু নাম হয়েছে। বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক কাজি আফসারউদ্দীন আহমদ ('চর ভাঙা চর' উপন্যাসসহ বহু উপন্যাসের লেখক) আমাকে খুব স্নেহ করতেন। তিনিই প্রথম ভারত ভাগের পর ঢাকা থেকে 'দৈনিক জিন্দেগী' নামে প্রথম বাংলা দৈনিক প্রকাশ করেন। এটি প্রকাশিত হয়েছিল ঢাকা থেকে দৈনিক আজাদ প্রকাশিত হওয়ারও আগে। ঢাকা তখন বিপিসি আন্দোলনে উত্তাল। পাকিস্তানের লিয়াকত মন্ত্রিসভা দেশের প্রথম সংবিধান প্রণয়নের মূলনীতিগুলো নির্ধারণের জন্য বেসিক প্রিন্সিপালস কমিটি নামে একটি কমিটি গঠন করে। এ কমিটি সংবিধানের যে মূলনীতি নির্ধারণ করে, তাতে পূর্ব পাকিস্তানের ওপর চরম অবিচার ও বৈষম্য করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানে এর বিরুদ্ধে বিরাট আন্দোলন গড়ে ওঠে।
কিন্তু এই আন্দোলনের মুখপত্র কোথায়? জিন্দেগী তখন বন্ধ হয়ে গেছে। দৈনিক আজাদ কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে এসেছে। কিন্তু মুসলিম লীগ সরকারের সমর্থক। এ সময় মুসলিম লীগ সরকারের বিরোধী কাগজ হিসেবে বংশালের বলিয়াদি প্রেস থেকে ক্রাউন সাইজের কাগজে ছয় পৃষ্ঠার 'দৈনিক ইনসাফের' আত্মপ্রকাশ। বিপিসি আন্দোলনের মুখপত্র হিসেবে কাগজটি বিরাট জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
ঢাকার তখনকার প্রগতিশীল সব তরুণ সাংবাদিক দৈনিক ইনসাফের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। যেমন কে জি মুস্তাফা, খোন্দকার আবু তালেব, সৈয়দ রেদওয়ানুর রহমান, দাউদ খান মজলিস, মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, এ বি এম মূসা, বাহাউদ্দীন চৌধুরী, আনিস চৌধুরী এবং আরো অনেকে। কাগজটির সম্পাদক ছিলেন মহিউদ্দীন আহমদ নামে এক স্বাধীনচেতা সাংবাদিক। তিনি এখন অকালপ্রয়াত। সাহিত্যিক কাজি আফসারউদ্দীন আহমদও এই কাগজে বেনামে সম্পাদক হয়েছিলেন। ১৯৫০ সালে ম্যাট্রিক পাস করে (সিরাজ কথিত ১৯৫২ সালে নয়) আমি ঢাকায় আসার পর কাজি আফসারউদ্দীন এই কাগজের নিউজ ডেস্কে আমাকে চাকরি দেন। তখন আমি সিরাজুর রহমানের সঙ্গে পরিচিতও হইনি। তাহলে তাঁর কাছে আমি কী করে চাকরিপ্রার্থী হয়েছিলাম? আর তখন কোনো কাগজে তাঁরই কোনো চাকরি ছিল কি?
আর ১৯৫২ সালে আমি ঢাকা কলেজের ছাত্র। দৈনিক সংবাদ তখন বেরিয়েছে। জন্মলগ্ন থেকেই আমি কাগজটিতে ভালো বেতনে সাংবাদিক। তা ছাড়া ১৯৫২ সালে আমি ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত। একুশে ফেব্রুয়ারিতে পুলিশের গুলিবর্ষণের পর শহীদ রফিক উদ্দীনের মৃতদেহ দেখে 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো' কবিতাটি লিখি। ২২ ফেব্রুয়ারি নিজেও পুলিশের লাঠিতে আহত হই। বেশ কিছুকাল আমাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কাটাতে হয়েছে। এই সময় বন্ধু শফিক রেহমানও আমার দেখাশোনা করেছেন। সুতরাং সিরাজুর রহমানের কাছে চাকরিপ্রার্থী হয়ে যাওয়ার সময় ও সুযোগটা কখন হয়েছিল এবং তার দরকারটাই বা কী ছিল?
সিরাজুর রহমান অবশ্য তখন (১৯৫২) মোহাম্মদ মোদাব্বেরের কৃপায় দৈনিক মিল্লাতের বার্তা সম্পাদক। 'মিল্লাত' তখন ইউসুফ আলী চৌধুরী মোহন মিয়ার কাগজ। আর মোহন মিয়া ছিলেন ক্ষমতাসীন দল প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক। বায়ান্ন সালে মিল্লাত ভাষা আন্দোলনের বিরোধিতা করে। একুশে ফেব্রুয়ারির গুলিবর্ষণের ঘটনাকেও বিকৃত করে প্রকাশ করে। আর সিরাজুর রহমান এখন দাবি করে থাকেন, তিনি মিল্লাতের বার্তা সম্পাদক হিসেবে কাগজটিকে ভাষা আন্দোলনের সমর্থক কাগজ করেছিলেন।
মিল্লাত নীতি পাল্টায় ভাষা আন্দোলন শুরু হওয়ার কিছুকাল পর। মোহন মিয়ার সঙ্গে তখন প্রাদেশিক মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনের প্রচণ্ড বিরোধ দেখা দিয়েছে। মোহন মিয়া মুসলিম লীগের প্রাদেশিক সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে বহিষ্কৃত হন। এটা ১৯৫৩ সালের ঘটনা। মুসলিম লীগ ছাড়তে বাধ্য হয়ে মোহন মিয়া বিরোধী দলে যোগ দেন এবং মিল্লাতও বিরোধী দল ও ভাষা আন্দোলনের সমর্থক পত্রিকা হয়ে দাঁড়ায়। এ ব্যাপারে সিরাজুর রহমানের কোনো ভূমিকাই নেই।
মোহন মিয়া মুসলিম লীগ ছাড়ার কিছুকাল পর মোহাম্মদ মোদাব্বের মিল্লাত সম্পাদনা ছেড়ে দেন। তারপর সিরাজুর রহমানের গতি কী হয়েছিল তা আমার জানা নেই। জানার দরকারও ছিল না।
আমার 'দৈনিক ইনসাফের' চাকরি পাওয়ার কথায় ফিরে যাই। কাজি আফসারউদ্দীনের সুপারিশে এই চাকরিটা আমার হয়েছিল। তাঁকে আমি কৃতজ্ঞচিত্তে এখনো স্মরণ করি। ইনসাফে চাকরি পাওয়ার ফলে তখনকার সব প্রগতিশীল তরুণ সাংবাদিকের সঙ্গে (আমার বয়োজ্যেষ্ঠ এবং সমবয়সী) পরিচিত ও ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ পাই। সিরাজুর রহমান সে দলে ছিলেন না। তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় অত্যন্ত এক দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার মধ্য দিয়ে। সেটাও ইনসাফে চাকরি পাওয়াকালীন ঘটনা।
ইনসাফের বার্তা বিভাগে কাজ করার সময় আমার পজিশন অত্যন্ত জুনিয়র হওয়া সত্ত্বেও টের পেয়েছিলাম, পত্রিকাটি সরকারবিরোধী কাগজ এবং বিপিসি আন্দোলনের মুখপত্র হিসেবে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠায় নুরুল আমিন সরকার বিব্রত এবং যেকোনো প্রকারে কাগজটি হয় বন্ধ করা অথবা বশে নেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন। এ ব্যাপারে মুসলিম লীগপন্থী কয়েকজন প্রবীণ সাংবাদিকের সহায়তা তারা নেয়। প্রথমে পত্রিকাটির মালিককে দেখানো হয় ভয়, তারপর প্রলোভন। মালিক ছিলেন বলিয়াদির একজন জমিদার। তিনি ভয় ও প্রলোভন দুইয়ের কাছেই মাথা নোয়ান।
শুরু হয় পত্রিকাটির সম্পাদকীয় লেখার ওপর মালিকের হস্তক্ষেপ। সাংবাদিক ও অন্যান্য স্টাফের বেতন দেওয়া নিয়েও শুরু হয় গড়িমসি ও দীর্ঘসূত্রতা। ফলে কে জি মুস্তাফা, মুস্তাফা নূরউল ইসলাম প্রমুখ সিনিয়র সিদ্ধান্ত নেন, পত্রিকাটির নীতি অপরিবর্তিত রাখা এবং বকেয়া বেতন পরিশোধের দাবিতে ধর্মঘট করা হবে। সেই সিদ্ধান্ত অনুসারে ধর্মঘট করা হলো। আমরা সাংবাদিকরা অফিসে একদিন অনুপস্থিত রইলাম।
সেই সুযোগে মালিক কাণ্ডটি ঘটালেন। সম্ভবত এ জন্য তাঁর পূর্বপ্রস্তুতি ছিল এবং তিনি এটাই চাইছিলেন। আমাদের অনুপস্থিতির সুযোগে মুসলিম লীগপন্থী এক প্রবীণ সাংবাদিকের সহায়তায় জনাকয়েক নতুন সাংবাদিক নিয়োগ দেওয়া হলো এবং একজন নতুন বার্তা সম্পাদকও নিযুক্ত হলেন। ধর্মঘটি সব সাংবাদিককে ছাঁটাইয়ের নোটিশ দেওয়া হলো। আমরা ধর্মঘটিরা পরদিন অফিসে এসে অবাক। সেটা সকালের শিফট। সিনিয়ররা তখনো আসেননি। আমি ও আবদুল কুদ্দুস নামে নিউজ ও রিপোর্টিংয়ের দুই জুনিয়র সদস্য অফিসে এসে দেখি, নিউজ এডিটরের রুমে সুটবুটপরিহিত, ক্লিন শেভড, বয়সে আমাদের চেয়ে সামান্য বড় এক যুবক বসে আছেন। আমাদের দেখে তিনি খুব খাতির করে বসালেন। চায়ের অর্ডার দিলেন। পরিচয় দিলেন, তাঁর নাম 'ছেড়াজুর রহমান'। তিনি পত্রিকায় নবনিযুক্ত নিউজ এডিটর। তিনি অফার দিলেন, আমরা যদি ধর্মঘটি সাংবাদিকদের সঙ্গে না থাকি এবং বলি যে, তাঁদের সঙ্গে আমরা ছিলাম না, তাহলে আমাদের চাকরি থাকবে, চাই কি বেতন বৃদ্ধিও হবে।
আমি নিশ্চুপ ছিলাম। কুদ্দুস বলে উঠল, এটা তো সাংবাদিক কমিউনিটি, তাঁদের স্বার্থ ও অধিকারের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা। আপনি যদি একজন সাংবাদিক হয়ে থাকেন, তাহলে কী করে এটা করবেন এবং আমাদের করতে বলবেন? সিরাজুর রহমান বললেন, আপনারা আমার অফারটা ভেবে দেখুন। এখানকার চাকরি গেলে আর কোথাও চাকরি পাবেন না। 'আজাদ' ছাড়া তো ঢাকায় আর কোনো দৈনিক নেই। পাবেন আজাদে চাকরি?
তবু তাঁর অফার আমরা গ্রহণ করিনি। তবে একটা অনুরোধ রক্ষা করেছি। পত্রিকায় স্টাফ শর্টেজ ছিল। আমরা আরো দিনসাতেক কাজ চালিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। আমাদের টাকা-পয়সাও পাওনা ছিল, তা অনাদায়ী অবস্থাতেই আমি ও কুদ্দুস কিছুদিন পর ইনসাফ ছেড়ে দিই। এই-ই হচ্ছে জনাব সিরাজুর রহমানের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়ের অভিজ্ঞতা। তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাতে আমি তাঁর কাছে চাকরিপ্রার্থী হইনি। তাঁর সাংবাদিকদের ঐক্য ভাঙার ও তাঁদের স্বার্থবিরোধী অফার প্রত্যাখ্যান করেছিলাম।
এরপর তিনি আর ঢাকার সাংবাদিক মহলে মুখ দেখাতে পারেননি। তাঁকে ঢাকার সাংবাদিকরা 'সাংবাদিক ঐক্যের শত্রু', 'বিশ্বাসঘাতক', 'মালিকের দালাল' ইত্যাদি আখ্যা দিয়েছিলেন। দৈনিক ইনসাফেও তিনি বেশি দিন থাকতে পারেননি। পত্রিকাটি নীতি বদল করে সরকারকে সমর্থন দিতে থাকায় জনপ্রিয়তা হারায়। সিরাজুর রহমান নতুন চাকরির সন্ধান করতে থাকেন। আজাদ, সংবাদ কোনো কাগজে ঠাঁই হয়নি। তাঁর কপাল ভালো, এ সময় ইউসুফ আলী চৌধুরী মোহন মিয়া পুরনো ঢাকার ওল্ড কোর্ট হাউস স্ট্রিট থেকে দৈনিক মিল্লাত বের করেন। মোহাম্মদ মোদাব্বের তার সম্পাদক হন। তিনিই তাঁর 'প্রোটিজি' সিরাজুর রহমানকে ডেকে নিয়ে ওই কাগজের বার্তা সম্পাদক করেন।
দৈনিক ইনসাফে সিরাজুর রহমানের পেছনের দরজা দিয়ে বার্তা সম্পাদক হওয়া এবং সাংবাদিক ঐক্যের পিঠে ছুরি মারার এই কাহিনী বিশদভাবে বর্ণনা করেছেন বর্তমানের প্রবীণ সাংবাদিক ও কলামিস্ট এ বি এম মূসা তাঁর স্মৃতিচারণমূলক 'সংবাদ কক্ষে দুই দশক' লেখায়। একাত্তরের শহীদ সাংবাদিক খোন্দকার আবু তালেবের স্মৃতিকথা 'কাগজের মানুষেও' এই কাহিনী আছে 'বিভীষণের বিশ্বাসঘাতকতা'_এই উপশিরোনামে।
মোহাম্মদ মোদাব্বেরের মতো বিভাগপূর্ব বাংলার এক প্রখ্যাত সাংবাদিকের প্রোটিজি হওয়ার সৌভাগ্য সিরাজুর রহমান কিভাবে লাভ করেছিলেন তারও একটি নেপথ্য কাহিনী আছে। দৈনিক আজাদ কলকাতা থেকে প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে মোদাব্বের দীর্ঘকাল ছিলেন ওই কাগজের বার্তা সম্পাদক। ছোটদের আসর 'মুকুলের মহফিলের'ও তিনি 'বাগবান' ছিলেন। সিরাজুর রহমানও তখন ছিলেন কলকাতায় তাঁর মাদ্রাসা শিক্ষক বাবার সঙ্গে। 'মুকুলের মহফিলে' লেখার সূত্রে মোহাম্মদ মোদাব্বেরের সঙ্গে পরিচয়। প্রবীণ সাংবাদিক তাঁকে খুব স্নেহ করতেন।
বাংলা ভাগের পর 'আজাদ' ঢাকায় চলে আসে। সিরাজুর রহমানরাও আসেন। মোহাম্মদ মোদাব্বের ঢাকায় এসে আর আজাদে যোগ দেননি। তিনি নিজেই 'অর্ধ সাপ্তাহিক পাকিস্তান' নামে একটি পত্রিকা বের করেন। সিরাজুর রহমান তখন কলেজ থেকে ড্রপ আউট ছাত্র। 'আজাদে' ঢুকতে পারেননি। মোহাম্মদ মোদাব্বের তাঁকে তাঁর মেয়ে শিরিনের গৃহশিক্ষক নিযুক্ত করেন, সেই সঙ্গে অর্ধ সাপ্তাহিক পাকিস্তানে কাজ দেন। কাজটা ছিল দৈনিক কাগজ থেকে বিভিন্ন খবর কেটে অর্ধ সাপ্তাহিকের খবরের পাতাটি সাজানো। এই হলো তাঁর সাংবাদিকতার ট্রেনিং। এরপর মোহাম্মদ মোদাব্বের তাঁকে দৈনিক ইনসাকে পেছনের দরজা দিয়ে ঢোকান। তারপর করেন দৈনিক মিল্লাতের বার্তা সম্পাদক। এই হচ্ছে 'প্রাতঃস্মরণীয়' সিরাজুর রহমানের সাংবাদিকতার 'গৌরবোজ্জ্বল' কাহিনী।
এরপর দৈনিক মিল্লাত ছাড়তে বাধ্য হওয়ার পর সিরাজুর রহমান দৈনিক ইত্তেফাকে আসেন। 'ইত্তেফাক' তত দিনে সাপ্তাহিক থেকে চার পৃষ্ঠার দৈনিক কাগজে রূপান্তরিত হয়েছে। সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া তাঁকে সম্পাদকীয় বিভাগে গ্রহণ করেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর সাংবাদিকতার দক্ষতার দৌড় বুঝে ফেলেন। ফলে তাঁকে দিয়ে সম্পাদকীয় পৃষ্ঠার টুকিটাকি নোট লেখানো ছাড়া কোনো বড় লেখা বা লিড এডিটরিয়াল লেখাতেন না। সিরাজুর রহমানের প্রধান দায়িত্বই ছিল মানিক মিয়ার 'রাজনৈতিক মঞ্চের' ডিকটেশন নেওয়া। এরপর তাঁর সুপারিশেই সিরাজুর রহমান ঢাকায় ব্রিটিশ ইনফরমেশন সার্ভিসে চাকরি পান। তাঁর ভাগ্য খুলতে থাকে।
তিনি দেশপ্রেমের বড়াই করেন। কিন্তু বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন থেকে হরফ রক্ষা, রবীন্দ্রসংগীত রক্ষা, ছয় দফা প্রভৃতি কোনো আন্দোলনে তাঁর কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। ছিল বিপরীতে অবস্থান। করেছেন জীবনের বেশির ভাগ বিদেশি প্রভুদের চাকরি। এ চাকরির কাহিনীও ন্যক্কারজনক। অথচ গর্ব করেন অন্যকে চাকরিদানের ও অনুগ্রহদানের, যা তাঁর জীবনের কুষ্ঠিতে লেখা নেই। জীবন সায়াহ্নে পেঁৗছেও যদি আমরা মিথ্যাচারের অভ্যাস ত্যাগ করতে না পারি, তবে আর কবে পারব? (পরবর্তী অংশ আগামী মঙ্গলবার)
লন্ডন, ১৮ জুলাই, সোমবার ২০১১
আমি ম্যাট্রিক পাস করি ১৯৫০ সালে। তখনই আমার ছোটগল্প লেখক হিসেবে এক-আধটু নাম হয়েছে। বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক কাজি আফসারউদ্দীন আহমদ ('চর ভাঙা চর' উপন্যাসসহ বহু উপন্যাসের লেখক) আমাকে খুব স্নেহ করতেন। তিনিই প্রথম ভারত ভাগের পর ঢাকা থেকে 'দৈনিক জিন্দেগী' নামে প্রথম বাংলা দৈনিক প্রকাশ করেন। এটি প্রকাশিত হয়েছিল ঢাকা থেকে দৈনিক আজাদ প্রকাশিত হওয়ারও আগে। ঢাকা তখন বিপিসি আন্দোলনে উত্তাল। পাকিস্তানের লিয়াকত মন্ত্রিসভা দেশের প্রথম সংবিধান প্রণয়নের মূলনীতিগুলো নির্ধারণের জন্য বেসিক প্রিন্সিপালস কমিটি নামে একটি কমিটি গঠন করে। এ কমিটি সংবিধানের যে মূলনীতি নির্ধারণ করে, তাতে পূর্ব পাকিস্তানের ওপর চরম অবিচার ও বৈষম্য করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানে এর বিরুদ্ধে বিরাট আন্দোলন গড়ে ওঠে।
কিন্তু এই আন্দোলনের মুখপত্র কোথায়? জিন্দেগী তখন বন্ধ হয়ে গেছে। দৈনিক আজাদ কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে এসেছে। কিন্তু মুসলিম লীগ সরকারের সমর্থক। এ সময় মুসলিম লীগ সরকারের বিরোধী কাগজ হিসেবে বংশালের বলিয়াদি প্রেস থেকে ক্রাউন সাইজের কাগজে ছয় পৃষ্ঠার 'দৈনিক ইনসাফের' আত্মপ্রকাশ। বিপিসি আন্দোলনের মুখপত্র হিসেবে কাগজটি বিরাট জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
ঢাকার তখনকার প্রগতিশীল সব তরুণ সাংবাদিক দৈনিক ইনসাফের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। যেমন কে জি মুস্তাফা, খোন্দকার আবু তালেব, সৈয়দ রেদওয়ানুর রহমান, দাউদ খান মজলিস, মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, এ বি এম মূসা, বাহাউদ্দীন চৌধুরী, আনিস চৌধুরী এবং আরো অনেকে। কাগজটির সম্পাদক ছিলেন মহিউদ্দীন আহমদ নামে এক স্বাধীনচেতা সাংবাদিক। তিনি এখন অকালপ্রয়াত। সাহিত্যিক কাজি আফসারউদ্দীন আহমদও এই কাগজে বেনামে সম্পাদক হয়েছিলেন। ১৯৫০ সালে ম্যাট্রিক পাস করে (সিরাজ কথিত ১৯৫২ সালে নয়) আমি ঢাকায় আসার পর কাজি আফসারউদ্দীন এই কাগজের নিউজ ডেস্কে আমাকে চাকরি দেন। তখন আমি সিরাজুর রহমানের সঙ্গে পরিচিতও হইনি। তাহলে তাঁর কাছে আমি কী করে চাকরিপ্রার্থী হয়েছিলাম? আর তখন কোনো কাগজে তাঁরই কোনো চাকরি ছিল কি?
আর ১৯৫২ সালে আমি ঢাকা কলেজের ছাত্র। দৈনিক সংবাদ তখন বেরিয়েছে। জন্মলগ্ন থেকেই আমি কাগজটিতে ভালো বেতনে সাংবাদিক। তা ছাড়া ১৯৫২ সালে আমি ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত। একুশে ফেব্রুয়ারিতে পুলিশের গুলিবর্ষণের পর শহীদ রফিক উদ্দীনের মৃতদেহ দেখে 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো' কবিতাটি লিখি। ২২ ফেব্রুয়ারি নিজেও পুলিশের লাঠিতে আহত হই। বেশ কিছুকাল আমাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কাটাতে হয়েছে। এই সময় বন্ধু শফিক রেহমানও আমার দেখাশোনা করেছেন। সুতরাং সিরাজুর রহমানের কাছে চাকরিপ্রার্থী হয়ে যাওয়ার সময় ও সুযোগটা কখন হয়েছিল এবং তার দরকারটাই বা কী ছিল?
সিরাজুর রহমান অবশ্য তখন (১৯৫২) মোহাম্মদ মোদাব্বেরের কৃপায় দৈনিক মিল্লাতের বার্তা সম্পাদক। 'মিল্লাত' তখন ইউসুফ আলী চৌধুরী মোহন মিয়ার কাগজ। আর মোহন মিয়া ছিলেন ক্ষমতাসীন দল প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক। বায়ান্ন সালে মিল্লাত ভাষা আন্দোলনের বিরোধিতা করে। একুশে ফেব্রুয়ারির গুলিবর্ষণের ঘটনাকেও বিকৃত করে প্রকাশ করে। আর সিরাজুর রহমান এখন দাবি করে থাকেন, তিনি মিল্লাতের বার্তা সম্পাদক হিসেবে কাগজটিকে ভাষা আন্দোলনের সমর্থক কাগজ করেছিলেন।
মিল্লাত নীতি পাল্টায় ভাষা আন্দোলন শুরু হওয়ার কিছুকাল পর। মোহন মিয়ার সঙ্গে তখন প্রাদেশিক মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনের প্রচণ্ড বিরোধ দেখা দিয়েছে। মোহন মিয়া মুসলিম লীগের প্রাদেশিক সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে বহিষ্কৃত হন। এটা ১৯৫৩ সালের ঘটনা। মুসলিম লীগ ছাড়তে বাধ্য হয়ে মোহন মিয়া বিরোধী দলে যোগ দেন এবং মিল্লাতও বিরোধী দল ও ভাষা আন্দোলনের সমর্থক পত্রিকা হয়ে দাঁড়ায়। এ ব্যাপারে সিরাজুর রহমানের কোনো ভূমিকাই নেই।
মোহন মিয়া মুসলিম লীগ ছাড়ার কিছুকাল পর মোহাম্মদ মোদাব্বের মিল্লাত সম্পাদনা ছেড়ে দেন। তারপর সিরাজুর রহমানের গতি কী হয়েছিল তা আমার জানা নেই। জানার দরকারও ছিল না।
আমার 'দৈনিক ইনসাফের' চাকরি পাওয়ার কথায় ফিরে যাই। কাজি আফসারউদ্দীনের সুপারিশে এই চাকরিটা আমার হয়েছিল। তাঁকে আমি কৃতজ্ঞচিত্তে এখনো স্মরণ করি। ইনসাফে চাকরি পাওয়ার ফলে তখনকার সব প্রগতিশীল তরুণ সাংবাদিকের সঙ্গে (আমার বয়োজ্যেষ্ঠ এবং সমবয়সী) পরিচিত ও ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ পাই। সিরাজুর রহমান সে দলে ছিলেন না। তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় অত্যন্ত এক দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার মধ্য দিয়ে। সেটাও ইনসাফে চাকরি পাওয়াকালীন ঘটনা।
ইনসাফের বার্তা বিভাগে কাজ করার সময় আমার পজিশন অত্যন্ত জুনিয়র হওয়া সত্ত্বেও টের পেয়েছিলাম, পত্রিকাটি সরকারবিরোধী কাগজ এবং বিপিসি আন্দোলনের মুখপত্র হিসেবে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠায় নুরুল আমিন সরকার বিব্রত এবং যেকোনো প্রকারে কাগজটি হয় বন্ধ করা অথবা বশে নেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন। এ ব্যাপারে মুসলিম লীগপন্থী কয়েকজন প্রবীণ সাংবাদিকের সহায়তা তারা নেয়। প্রথমে পত্রিকাটির মালিককে দেখানো হয় ভয়, তারপর প্রলোভন। মালিক ছিলেন বলিয়াদির একজন জমিদার। তিনি ভয় ও প্রলোভন দুইয়ের কাছেই মাথা নোয়ান।
শুরু হয় পত্রিকাটির সম্পাদকীয় লেখার ওপর মালিকের হস্তক্ষেপ। সাংবাদিক ও অন্যান্য স্টাফের বেতন দেওয়া নিয়েও শুরু হয় গড়িমসি ও দীর্ঘসূত্রতা। ফলে কে জি মুস্তাফা, মুস্তাফা নূরউল ইসলাম প্রমুখ সিনিয়র সিদ্ধান্ত নেন, পত্রিকাটির নীতি অপরিবর্তিত রাখা এবং বকেয়া বেতন পরিশোধের দাবিতে ধর্মঘট করা হবে। সেই সিদ্ধান্ত অনুসারে ধর্মঘট করা হলো। আমরা সাংবাদিকরা অফিসে একদিন অনুপস্থিত রইলাম।
সেই সুযোগে মালিক কাণ্ডটি ঘটালেন। সম্ভবত এ জন্য তাঁর পূর্বপ্রস্তুতি ছিল এবং তিনি এটাই চাইছিলেন। আমাদের অনুপস্থিতির সুযোগে মুসলিম লীগপন্থী এক প্রবীণ সাংবাদিকের সহায়তায় জনাকয়েক নতুন সাংবাদিক নিয়োগ দেওয়া হলো এবং একজন নতুন বার্তা সম্পাদকও নিযুক্ত হলেন। ধর্মঘটি সব সাংবাদিককে ছাঁটাইয়ের নোটিশ দেওয়া হলো। আমরা ধর্মঘটিরা পরদিন অফিসে এসে অবাক। সেটা সকালের শিফট। সিনিয়ররা তখনো আসেননি। আমি ও আবদুল কুদ্দুস নামে নিউজ ও রিপোর্টিংয়ের দুই জুনিয়র সদস্য অফিসে এসে দেখি, নিউজ এডিটরের রুমে সুটবুটপরিহিত, ক্লিন শেভড, বয়সে আমাদের চেয়ে সামান্য বড় এক যুবক বসে আছেন। আমাদের দেখে তিনি খুব খাতির করে বসালেন। চায়ের অর্ডার দিলেন। পরিচয় দিলেন, তাঁর নাম 'ছেড়াজুর রহমান'। তিনি পত্রিকায় নবনিযুক্ত নিউজ এডিটর। তিনি অফার দিলেন, আমরা যদি ধর্মঘটি সাংবাদিকদের সঙ্গে না থাকি এবং বলি যে, তাঁদের সঙ্গে আমরা ছিলাম না, তাহলে আমাদের চাকরি থাকবে, চাই কি বেতন বৃদ্ধিও হবে।
আমি নিশ্চুপ ছিলাম। কুদ্দুস বলে উঠল, এটা তো সাংবাদিক কমিউনিটি, তাঁদের স্বার্থ ও অধিকারের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা। আপনি যদি একজন সাংবাদিক হয়ে থাকেন, তাহলে কী করে এটা করবেন এবং আমাদের করতে বলবেন? সিরাজুর রহমান বললেন, আপনারা আমার অফারটা ভেবে দেখুন। এখানকার চাকরি গেলে আর কোথাও চাকরি পাবেন না। 'আজাদ' ছাড়া তো ঢাকায় আর কোনো দৈনিক নেই। পাবেন আজাদে চাকরি?
তবু তাঁর অফার আমরা গ্রহণ করিনি। তবে একটা অনুরোধ রক্ষা করেছি। পত্রিকায় স্টাফ শর্টেজ ছিল। আমরা আরো দিনসাতেক কাজ চালিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। আমাদের টাকা-পয়সাও পাওনা ছিল, তা অনাদায়ী অবস্থাতেই আমি ও কুদ্দুস কিছুদিন পর ইনসাফ ছেড়ে দিই। এই-ই হচ্ছে জনাব সিরাজুর রহমানের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়ের অভিজ্ঞতা। তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাতে আমি তাঁর কাছে চাকরিপ্রার্থী হইনি। তাঁর সাংবাদিকদের ঐক্য ভাঙার ও তাঁদের স্বার্থবিরোধী অফার প্রত্যাখ্যান করেছিলাম।
এরপর তিনি আর ঢাকার সাংবাদিক মহলে মুখ দেখাতে পারেননি। তাঁকে ঢাকার সাংবাদিকরা 'সাংবাদিক ঐক্যের শত্রু', 'বিশ্বাসঘাতক', 'মালিকের দালাল' ইত্যাদি আখ্যা দিয়েছিলেন। দৈনিক ইনসাফেও তিনি বেশি দিন থাকতে পারেননি। পত্রিকাটি নীতি বদল করে সরকারকে সমর্থন দিতে থাকায় জনপ্রিয়তা হারায়। সিরাজুর রহমান নতুন চাকরির সন্ধান করতে থাকেন। আজাদ, সংবাদ কোনো কাগজে ঠাঁই হয়নি। তাঁর কপাল ভালো, এ সময় ইউসুফ আলী চৌধুরী মোহন মিয়া পুরনো ঢাকার ওল্ড কোর্ট হাউস স্ট্রিট থেকে দৈনিক মিল্লাত বের করেন। মোহাম্মদ মোদাব্বের তার সম্পাদক হন। তিনিই তাঁর 'প্রোটিজি' সিরাজুর রহমানকে ডেকে নিয়ে ওই কাগজের বার্তা সম্পাদক করেন।
দৈনিক ইনসাফে সিরাজুর রহমানের পেছনের দরজা দিয়ে বার্তা সম্পাদক হওয়া এবং সাংবাদিক ঐক্যের পিঠে ছুরি মারার এই কাহিনী বিশদভাবে বর্ণনা করেছেন বর্তমানের প্রবীণ সাংবাদিক ও কলামিস্ট এ বি এম মূসা তাঁর স্মৃতিচারণমূলক 'সংবাদ কক্ষে দুই দশক' লেখায়। একাত্তরের শহীদ সাংবাদিক খোন্দকার আবু তালেবের স্মৃতিকথা 'কাগজের মানুষেও' এই কাহিনী আছে 'বিভীষণের বিশ্বাসঘাতকতা'_এই উপশিরোনামে।
মোহাম্মদ মোদাব্বেরের মতো বিভাগপূর্ব বাংলার এক প্রখ্যাত সাংবাদিকের প্রোটিজি হওয়ার সৌভাগ্য সিরাজুর রহমান কিভাবে লাভ করেছিলেন তারও একটি নেপথ্য কাহিনী আছে। দৈনিক আজাদ কলকাতা থেকে প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে মোদাব্বের দীর্ঘকাল ছিলেন ওই কাগজের বার্তা সম্পাদক। ছোটদের আসর 'মুকুলের মহফিলের'ও তিনি 'বাগবান' ছিলেন। সিরাজুর রহমানও তখন ছিলেন কলকাতায় তাঁর মাদ্রাসা শিক্ষক বাবার সঙ্গে। 'মুকুলের মহফিলে' লেখার সূত্রে মোহাম্মদ মোদাব্বেরের সঙ্গে পরিচয়। প্রবীণ সাংবাদিক তাঁকে খুব স্নেহ করতেন।
বাংলা ভাগের পর 'আজাদ' ঢাকায় চলে আসে। সিরাজুর রহমানরাও আসেন। মোহাম্মদ মোদাব্বের ঢাকায় এসে আর আজাদে যোগ দেননি। তিনি নিজেই 'অর্ধ সাপ্তাহিক পাকিস্তান' নামে একটি পত্রিকা বের করেন। সিরাজুর রহমান তখন কলেজ থেকে ড্রপ আউট ছাত্র। 'আজাদে' ঢুকতে পারেননি। মোহাম্মদ মোদাব্বের তাঁকে তাঁর মেয়ে শিরিনের গৃহশিক্ষক নিযুক্ত করেন, সেই সঙ্গে অর্ধ সাপ্তাহিক পাকিস্তানে কাজ দেন। কাজটা ছিল দৈনিক কাগজ থেকে বিভিন্ন খবর কেটে অর্ধ সাপ্তাহিকের খবরের পাতাটি সাজানো। এই হলো তাঁর সাংবাদিকতার ট্রেনিং। এরপর মোহাম্মদ মোদাব্বের তাঁকে দৈনিক ইনসাকে পেছনের দরজা দিয়ে ঢোকান। তারপর করেন দৈনিক মিল্লাতের বার্তা সম্পাদক। এই হচ্ছে 'প্রাতঃস্মরণীয়' সিরাজুর রহমানের সাংবাদিকতার 'গৌরবোজ্জ্বল' কাহিনী।
এরপর দৈনিক মিল্লাত ছাড়তে বাধ্য হওয়ার পর সিরাজুর রহমান দৈনিক ইত্তেফাকে আসেন। 'ইত্তেফাক' তত দিনে সাপ্তাহিক থেকে চার পৃষ্ঠার দৈনিক কাগজে রূপান্তরিত হয়েছে। সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া তাঁকে সম্পাদকীয় বিভাগে গ্রহণ করেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর সাংবাদিকতার দক্ষতার দৌড় বুঝে ফেলেন। ফলে তাঁকে দিয়ে সম্পাদকীয় পৃষ্ঠার টুকিটাকি নোট লেখানো ছাড়া কোনো বড় লেখা বা লিড এডিটরিয়াল লেখাতেন না। সিরাজুর রহমানের প্রধান দায়িত্বই ছিল মানিক মিয়ার 'রাজনৈতিক মঞ্চের' ডিকটেশন নেওয়া। এরপর তাঁর সুপারিশেই সিরাজুর রহমান ঢাকায় ব্রিটিশ ইনফরমেশন সার্ভিসে চাকরি পান। তাঁর ভাগ্য খুলতে থাকে।
তিনি দেশপ্রেমের বড়াই করেন। কিন্তু বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন থেকে হরফ রক্ষা, রবীন্দ্রসংগীত রক্ষা, ছয় দফা প্রভৃতি কোনো আন্দোলনে তাঁর কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। ছিল বিপরীতে অবস্থান। করেছেন জীবনের বেশির ভাগ বিদেশি প্রভুদের চাকরি। এ চাকরির কাহিনীও ন্যক্কারজনক। অথচ গর্ব করেন অন্যকে চাকরিদানের ও অনুগ্রহদানের, যা তাঁর জীবনের কুষ্ঠিতে লেখা নেই। জীবন সায়াহ্নে পেঁৗছেও যদি আমরা মিথ্যাচারের অভ্যাস ত্যাগ করতে না পারি, তবে আর কবে পারব? (পরবর্তী অংশ আগামী মঙ্গলবার)
লন্ডন, ১৮ জুলাই, সোমবার ২০১১
No comments