বিশ্ব বেতার দিবস-জগদীশচন্দ্র বসুর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি by চৌধুরী মুফাদ আহমদ

আজ ১৩ ফেব্রুয়ারি প্রথমবারের মতো বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে World Radio Day বা বিশ্ব বেতার দিবস। গত নভেম্বর মাসে স্পেনের অনুরোধে ইউনেসকোর ৩৬তম সাধারণ অধিবেশনে প্রতি বছর ১৩ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব বেতার দিবস পালনের সিদ্ধান্ত হয়।


বিশ্বে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে রেডিও এখনো সবচেয়ে কার্যকর, নির্ভরযোগ্য ও স্বল্প খরচের একটি মাধ্যম। রেডিও আজ বিশ্বের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। সাম্প্রতিক এক জরিপে জানা যায়, পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে শতকরা ৭৫টিরও বেশি বাড়িতে রেডিও আছে। বাড়ছে রেডিও স্টেশনের সংখ্যা। উগান্ডায় বর্তমানে ১৫০টি রেডিও স্টেশন থেকে ৩৮টি বিভিন্ন ভাষার শ্রোতাদের জন্য অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়। পেরুতে ১৬৯১টি এফএম রেডিও স্টেশন আছে। বাংলাদেশেও বর্তমানে সরকারি, বেসরকারি, কমিউনিটি মিলিয়ে ৪০টি রেডিও স্টেশন আছে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে রেডিও শোনেন এমন শ্রোতার সংখ্যা ২০০০ সাল থেকে প্রতিবছর গড়ে ২৭ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কেবল যুক্তরাষ্ট্রেই আট কোটির বেশি লোক ইন্টারনেটভিত্তিক রেডিও শোনে। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে রেডিও স্রোতার সংখ্যাও বিপুল সংখ্যায় বেড়ে চলেছে।
ইউনেসকোর সাধারণ পরিষদের সিদ্ধান্তে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে রেডিওর ভূমিকা বিশেষত যেকোনো জরুরি পরিস্থিতিতে, গণতান্ত্রিক সুশাসন প্রতিষ্ঠায় জনতার কণ্ঠস্বর সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়া এবং যেকোনো জনবিতর্কে জনসাধারণের অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টিতে রেডিওর ভূমিকার স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। তা ছাড়া দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছানোর প্রধান মাধ্যম হিসেবে রেডিওকে এখনো প্রধান মাধ্যম হিসেবে শনাক্ত করা হয়। ১৯৪৬ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘে United Nation Radio-এর ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই তারিখটির স্মরণে ১৩ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব বেতার দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
আজ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিশ্ব বেতার দিবস পালনের জন্য নানা কর্মসূচি গৃহীত হচ্ছে। বাংলাদেশেও সরকারি বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে সব বেসরকারি বেতার কেন্দ্র ও কমিউনিটি রেডিও যৌথভাবে অনুষ্ঠানটি পালনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। প্রথম বিশ্ব বেতার দিবসে আমরা বেতার তরঙ্গ উদ্ভাবনে বাংলাদেশি বিজ্ঞানী আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর অবিস্মরণীয় কীর্তির কথা স্মরণ করতে চাই। একই সঙ্গে এই বেতার তরঙ্গ উদ্ভাবনে জড়িত বিতর্ক সম্পর্কেও কিছু আলোচনা হয়তো প্রাসঙ্গিক হবে না।
ব্রিটিশ তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানী জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল তড়িৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গের অস্তিত্ব সম্পর্কে সর্বপ্রথম আভাস দেন। কিন্তু তিনি তাঁর তত্ত্ব প্রদানের আগেই ১৮৭৯ সালে মারা যান। পরবর্তীকালে আরেকজন ব্রিটিশ পদার্থবিজ্ঞানী অলিভার লজ্ তারের মাধ্যমে সংকেত প্রেরণ করে ম্যাক্সওয়েল বর্ণিত তরঙ্গের অস্তিত্ব প্রদান করেন। জার্মান বিজ্ঞানী হাইনরিশ হার্টস ১৮৮৮ সালে শূন্যে বা হাওয়ায় তড়িৎ-চৌম্বকীয় তরঙ্গের অস্তিত্ব প্রমাণ করেন। এ সময় মার্কিন বিজ্ঞানী নিকোলা টেসলা, রুশ বিজ্ঞানী পপভ এবং বাঙালি বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুও পৃথক পৃথকভাবে একই বিষয়ের ওপর কাজ করেছিলেন।
জগদীশচন্দ্র বসু অতি ক্ষুদ্র (মিলিমিটার) তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের বেতার তরঙ্গ উদ্ভাবনে সক্ষম হন। তিনি তাঁর নাম দেন ‘অদৃশ্য আলোক’ - যাতে দৃশ্য আলোকের সব ধর্ম বিদ্যমান। ১৮৯৫ সালে তিনি ১ মাইল দূর থেকে বেতার তরঙ্গ ব্যবহার করে কলকাতা টাউন হলে জনসমক্ষে রক্ষিত বারুদে অগ্নিসংযোগ করেন এবং একটি ঘণ্টা বাজিয়ে তাঁর উদ্ভাবনের প্রমাণ প্রদর্শন করেন। এই ঘটনার প্রায় দুই বছর পর ১৮৯৭ সালে মার্কনি ইংল্যান্ডে তাঁর বেতার তরঙ্গের মাধ্যমে সংকেত প্রেরণ পদ্ধতি জনসমক্ষে প্রথম প্রদর্শন করেন। বেতার তরঙ্গবিষয়ক গবেষণায় জগদীশচন্দ্র বসুর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য ছিল বেতার তরঙ্গ গ্রহণের একটি নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন। পরবর্তী সময়ে প্রমাণিত হয়েছে যে মার্কনি আটলান্টিক মহাসাগরের এপার থেকে ওপারে বেতার বার্তা প্রেরণের সময় বেতার তরঙ্গ গ্রহণের জন্য জগদীশচন্দ্র বসুর উদ্ভাবিত প্রযুক্তি ব্যবহার করেছিলেন।
রেডিওর উদ্ভাবক হিসেবে মার্কনির নাম সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ার কারণ তিনি তাঁর পূর্ববর্তী ও সমসাময়িক বিজ্ঞানীদের অবদান সম্পর্কে নীরব থেকে নিজের নামে নানা উদ্ভাবন পেটেন্ট করেছিলেন।
মার্কনির এই চতুরতা বিজ্ঞানী মহলে যথেষ্ট নিন্দিত হয়েছিল। এমনকি এ নিয়ে যুক্তরাজ্যের সুপ্রিম কোর্টে মামলা হয়।
নিজ উদ্ভাবন পেটেন্ট করে তা থেকে পয়সা কামানোতে জগদীশচন্দ্র বসুর কোনো আগ্রহ ছিল না। তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় তিনি ছিলেন ‘হতদরিদ্র হতভাগ্য’ দেশের ‘প্রলোভনহীন পণ্ডিত’। তিনি তাঁর উদ্ভাবন অন্যদের ব্যবহার করার অনুমতি দিয়ে রেখেছিলেন। মার্কনি ১৯০৯ সালে বেতার তরঙ্গ নিয়ে তাঁর কাজের জন্য নোবেল পুরস্কার পান। অনেকেই মনে করেন, তাঁর আগে জগদীশচন্দ্র বসুর এই পুরস্কার প্রাপ্য ছিল।
ময়মনসিংহে ১৮৫৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর জন্ম নেওয়া বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর আদি নিবাস ছিল বিক্রমপুরের রাড়িখালে। পিতার চাকরির সুবাদে ফরিদপুরের প্রাইমারি স্কুলে তাঁর হাতে খড়ি হয়। পরবর্তীকালে তিনি কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুল ও কলেজে পড়েন। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞানে অনার্সসহ বিএ এবং লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি করার পর ভারতে ফিরে তিনি ১৮৮৫ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজে পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক হন। কিন্তু ইংরেজ অধ্যাপকদের সঙ্গে বেতন বৈষম্যের প্রতিবাদে তিনি তিন বৎসর কলেজ থেকে কোনো বেতন নেননি। পদার্থবিজ্ঞানে তাঁর উল্লিখিত অবদান ছাড়াও উদ্ভিদবিদ্যায় যুগান্তকারী অবদানের জন্য তিনি বিশ্ববিশ্রুত। পরাধীন ভারতে আধুনিক বিজ্ঞান চর্চা সূচনা করে তিনি তা বিশ্বমানে উন্নীত করেন। আজ প্রথম বিশ্ব বেতার দিবসে এই বিশ্ববিশ্রুত বাংলাদেশি বিজ্ঞানীর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা জানাই।
চৌধুরী মুফাদ আহমদ: সচিব, বাংলাদেশ ইউনেসকোর জাতীয় কমিশন।

No comments

Powered by Blogger.