বন্য প্রাণী আইন-কার সুরক্ষা? কার নিরাপত্তা? by পাভেল পার্থ
অরণ্য ও প্রাণবৈচিত্র্যবিষয়ক প্রথম রাষ্ট্রীয় আইন তৈরি হয় ১৯২৭ সালে। বাংলাদেশের বনভূমি ও প্রাণবৈচিত্র্যের সমাহারকে ঔপনিবেশিক ওই আইনের ধাক্কা সামলেই এখনো পর্যন্ত চলতে হচ্ছে। পরবর্তী সময়ে ১৯৭৩ সালে তৈরি হয় বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইন। সম্প্রতি উল্লিখিত আইন দুটি বদলের রাষ্ট্রীয় উন্মাদনা শুরু হয়েছে।
২০১০ সালে জাতীয় সংসদে ‘বাংলাদেশ বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইন, ২০১০’ নামে পূর্বতন বন্য প্রাণী আইনটিকে বদলে একটি নতুন আইন উত্থাপিত হয় এবং সংসদ একে নীতিগতভাবে সমর্থন করে। ৯ জানুয়ারি ২০১২ তারিখে ‘বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির’ সভায় ‘বাংলাদেশ বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইন, ২০১০’ আবারও একটি নতুন নাম পায়। ১৭ জানুয়ারি ২০১২ তারিখে উল্লিখিত আইনটি নিয়ে সংসদে আবারও আলোচনা হয়। বর্তমানে প্রস্তাবিত এই আইনটির নাম হয়েছে ‘বাংলাদেশ বন্য প্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন, ২০১০’। এবং দুঃখজনকভাবে দেশের বনজীবী ও বননির্ভরশীল জনগণের কোনো ধরনের পূর্ব সম্মতি ও অংশগ্রহণ ছাড়াই আইনটি চূড়ান্ত হতে চলেছে।
বাংলা ভাষায় রচিত মোট ৮১ ধারা এবং তিনটি তফসিলের মাধ্যমে ঘোষিত এই আইনে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো পবিত্র উদ্ভিদ, কুঞ্জবন, জনগোষ্ঠীর মাধ্যমে সংরক্ষিত ঐতিহ্যগত বন, বনভূমির ওপর জনগোষ্ঠীর প্রথাগত অধিকার, ইকোপার্ক, আন্তর্জাতিক প্রাণবৈচিত্র্য সনদ (১৯৯২) আগ্রাসী ও এলিয়েন প্রজাতির বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। বারবার নাম পাল্টালেও এখনো পর্যন্ত আইনটি একটি ভুল নামই ধারণ করে আছে। আইনের শিরোনাম ‘বন্য প্রাণী’ রেখে আবার তাতে উদ্ভিদ, বনভূমি ইত্যাদি টেনে এনে এক জমজমাট জগাখিচুড়ি তৈরি করা হয়েছে। আইনটির ২ নম্বর ধারার ৪৯ অনুচ্ছেদে ‘প্রাণী’ অর্থ সব স্তন্যপায়ী, পাখি, সরীসৃপ, উভচর, মৎস্য, অন্যান্য মেরুদণ্ডী ও অমেরুদণ্ডী প্রাণী এবং তাদের বাচ্চা ও ডিমকে উল্লেখ করা হয়েছে। পাশাপাশি একই ধারার ৫৪ অনুচ্ছেদে ‘বন্য প্রাণী’ অর্থ বিভিন্ন প্রকার ও জাতের উদ্ভিদ ও প্রাণী বা তাদের জীবনচক্র বৃদ্ধির বিভিন্ন পর্যায়, যাদের উৎস বন্য হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে এবং শুধু তফসিল ১ ও ২-এর অন্তর্ভুক্ত নয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তার মানে হচ্ছে, এখন থেকে ‘বন্য প্রাণী’ বলতে আমাদের উদ্ভিদ ও প্রাণী উভয়কে বুঝতে হবে বা বুঝতে বাধ্য করানো হবে। প্রাণিবিজ্ঞানের চলমান সংজ্ঞায় যা সার্বিক দিক থেকে সাংঘর্ষিক। এমনকি বাংলা একাডেমীসহ রাষ্ট্রের সব অভিধান ও নথিপত্রে ‘বন্য প্রাণী’ প্রত্যয়টির সংজ্ঞা ও মানেও পাল্টাতে হবে। আইনটির নামকরণ ‘বাংলাদেশ প্রাণবৈচিত্র্য আইন, ২০১০’ করলেও এ ধরনের ভাষা ও ধারণাগত ত্রুটি এড়ানো সম্ভব। তবে পাশাপাশি এ-ও স্মরণে রাখা জরুরি, ১৯৯৮ সালেও ‘বাংলাদেশ প্রাণবৈচিত্র্য ও গোষ্ঠীগত জ্ঞান সুরক্ষা আইন’ নামে একটি খসড়া তৈরি হয়েছিল, যা হয়তো রাষ্ট্রের অসহনীয় আমলাতান্ত্রিকতার চাপেই জলহস্তী, ময়ূর কি গন্ডারের মতো বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
‘বিশেষ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এলাকা, জাতীয় ঐতিহ্যবাহী, স্মারক ও পবিত্র বৃক্ষ’ শীর্ষক শিরোনামে বর্ণিত আইনের পঞ্চম অধ্যায়টি রাষ্ট্রের প্রতিবেশ-রাজনীতির ‘অসাম্প্রদায়িকতাকে’ প্রকাশ করেছে। প্রস্তাবিত আইনে দেশের উদ্ভিদ ও প্রাণীগুলোর তালিকা তিনটি তফসিল আকারে সংযুক্ত করা হলেও দেশের সব পবিত্র উদ্ভিদ ও প্রাণীর নাম এখানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোলের সুড়লা মৌজার সাবেক ৪৬৩ ও হাল ৫০২ দাগের ৮১ শতক জমিতে তেভাগার রক্তাক্ত সাক্ষী এক তেঁতুলবৃক্ষের মতো পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিকাংশ মারমা ও তঞ্চংঙ্গ্যা গ্রামে তেঁতুলগাছ এখনো সামাজিকভাবে ঐতিহাসিক স্মারক হিসেবে টিকে আছে। কিন্তু আইনের ২ নম্বর তফসিলে মাত্র ৫৭টি বৃক্ষের তালিকায় দুঃখজনকভাবে তেঁতুল, পবিত্র বট, মহুয়া, পদ্ম, ফণীমনসা, অশ্বত্থ, পাকুড়, ডুমুর, শেওড়া, কারাম, ধুতরা, শাল, সুন্দরী, বকুল, হিজল, তমাল, করচ, তুলসী, বেলের মতো বহুল চর্চিত পবিত্র বৃক্ষের কোনো হদিস রাখা হয়নি। পাশাপাশি দেশের এনডেমিক ও ভৌগোলিক নির্দেশক প্রজাতিসহ সর্পগন্ধা, মাখনা, বনলেবু, নাগালিঙ্গম, বৃক্ষ ফার্ন, হস্তীকর্ণপলাশ, হরিংআড়ু, নিটাম, ক্রালাহিড, ক্যাক্র নামের শ্যাওলা, দামবং, বৈচিত্র্যময় বনআলু ও কচুর জাতগুলোকে এই তালিকায় যুক্ত করা হয়নি। আইনে Invasive species-কে ‘আগ্রাসী প্রজাতি’ নামে আখ্যায়িত করায় ধন্যবাদ জানাচ্ছি। তবে বাংলাদেশের জন্য কোন কোন উদ্ভিদ ও প্রাণীকে রাষ্ট্র আগ্রাসী মনে করছে, তার একটি তালিকা অবশ্যই আইনটির তফসিল হিসেবে থাকা উচিত ছিল।
হাস্যকরভাবে প্রস্তাবিত বন্য প্রাণী আইনের ২ নম্বর ধারায় আদিবাসী সমাজে ব্যবহূত বাটুল বা তীর-ধনুক এবং করপোরেট কোম্পানির আগ্নেয়াস্ত্রকে একইভাবে একই কাতারে ‘অস্ত্র’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। ১৯২৭ সালের ঔপনিবেশিক বন আইনের মতোই প্রস্তাবিত আইনেও সব ধরনের শিকারকে রাষ্ট্রীয় বনে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আমরা যদি শিকারকে অরণ্যচারী আদিবাসী জীবনের এক প্রতিবেশীয় চর্চা এবং অরণ্য জীবনধারা হিসেবে পাঠ করি, তাহলে কিন্তু বলতেই হয় শিকারপ্রথাকে জোরপূর্বক কোনো ধরনের সম্মতি ও অনুমতি ছাড়া বন্ধ করাও অধিকার লঙ্ঘন। সাঁওতাল আদিবাসীদের সোহরাই ও সারহুল উৎসবের এক অন্যতম পর্ব হচ্ছে শিকার, লালেং আদিবাসীদের নাফাং উৎসব কাছিম শিকার ছাড়া হয় না। আদিবাসীসহ অরণ্যনির্ভর জনগণের শিকার সংশ্লিষ্ট ধর্মীয় ও সামাজিক কৃত্যগুলোকে আইনের আওতায় ‘বন অপরাধ’ হিসেবে গণ্য করা যাবে না।
আইনের দ্বিতীয় অধ্যায়ে বন্য প্রাণী উপদেষ্টা বোর্ড গঠনের ক্ষেত্রে পানি সম্পদ, ভূমি, শিল্প মন্ত্রণালয়সহ হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন বোর্ডকেও সদস্য রাখা হয়নি। অথচ বাংলাদেশের দুটি রামসার এলাকা সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর এবং সুন্দরবন সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সরাসরি পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও হাওর উন্নয়ন বোর্ডের অনেক পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত জড়িত। দুঃখজনকভাবে বন্য প্রাণী উপদেষ্টা বোর্ডে রাখা হয়নি দেশের বন্য প্রাণী রক্ষায় নিঃস্বার্থভাবে শ্রম ঘাম ঢেলে যাওয়া সত্যিকারের সংরক্ষণবিদ অরণ্যনির্ভর জনগণকেও। বাংলাদেশে এই প্রথম কোনো রাষ্ট্রীয় আইনে সুস্পষ্টভাবে ‘বননির্ভর জনগোষ্ঠীর’ অস্তিত্ব স্বীকার করা হয়েছে এবং ‘বনের ওপর প্রথাগত অধিকারকে’ কার্যত স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। ১৮ নম্বর ধারায় স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে প্রাকৃতিক সংরক্ষিত বনভূমিতে শিল্প কারখানা স্থাপন ও বাণিজ্যিক খনন নিষিদ্ধ। যদি আইনটির এই ছোট দুটি ধারা পালন করা যায় তবে ভাওয়াল শালবনকে শিল্পায়নের আগ্রাসন এবং লাউয়াছড়া বনকে করপোরেট গ্যাস কোম্পানির খনন থেকে রক্ষা করা সম্ভব।
খুবই সুনির্দিষ্টভাবে আইনটিতে এক ধরনের মার্কিন মাতব্বরি লক্ষ করা যাচ্ছে। আইনের চতুর্থ অধ্যায়ের ২১ নম্বর ধারায় ‘সহ-ব্যবস্থাপনার’ প্রসঙ্গ উত্থাপন করা হয়েছে। প্রাকৃতিক বনভূমি ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণে এই ‘সহ-ব্যবস্থাপনা’ ধারণাটি সম্ভবত মার্কিন ইউএসএআইডির সহায়তায় প্রশ্নহীন কায়দায় চালু হওয়া বিতর্কিত ‘আইপ্যাক কর্মসূচিকে’ বৈধ করতেই রাখা হয়েছে। কারণ, এর আগে বাংলাদেশ সামাজিক বনায়ন বিধিমালা তৈরি হয়েছিল এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের সরাসরি খবরদারিতে। কোনো ধরনের পারস্পরিক কারণ ছাড়াই ‘সহ-ব্যবস্থাপনা’, ‘প্রথাগত অধিকার’ ও ‘কমিউনিটি কনজারভেশন এরিয়া’ বিষয়গুলোকে একই আইনে রাখা হয়েছে। আইপ্যাক কর্মসূচি বাংলাদেশের বননির্ভর জনগোষ্ঠীকে বনের ওপর তাদের সব সম্পর্ক ছিন্ন করে তথাকথিত ‘বিকল্প পেশায়’ স্থানান্তরের জন্য জানপ্রাণ দিয়ে কাজ করছে। অথচ বন্য প্রাণী আইনে এই তথাকথিত ‘সহ-ব্যবস্থাপনাকেই’ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, আবার পাশাপাশি বনভূমির ওপর বননির্ভর জনগোষ্ঠীর প্রথাগত অধিকার ও কমিউনিটি কনজারভেশন এরিয়া সংরক্ষণের কথাও বলা হয়েছে। আইনের নবম অধ্যায়ে দণ্ড এবং কার্যপ্রণালি বিধি-সম্পর্কিত অংশে অবিবেচনাপ্রসূত ধারাগুলো আগের সেই ১৯৭৩ সালের আইন অনুযায়ীই উল্লেখ করা হয়েছে। বন অপরাধ চিহ্নিতকরণ ও শাস্তির বিধান বননির্ভর জনগোষ্ঠী ও অবননির্ভর জনগোষ্ঠী, শিশু-কিশোর-প্রাপ্তবয়স্ক এবং নারী ও পুরুষের জন্য একই হলে তা ওই আইন ও রাষ্ট্রের বিদ্যমান অন্যান্য আইনগত বিচারব্যবস্থার সঙ্গে দ্বন্দ্ব তৈরি করবে। বন অপরাধ নিরসনে বন অপরাধীদের জন্য প্রতিবেশীয় শিক্ষা ও পরিবেশবান্ধব সংশোধনী কার্যক্রমের কোনো উল্লেখ ওই আইনে নেই। অথচ বন অপরাধ কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে জনগোষ্ঠীর ভেতর প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং প্রাণবৈচিত্র্যের ওপর জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই। আশা করি, ‘বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটি’ উল্লিখিত বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে দেশের বন্য প্রাণী ও উদ্ভিদ সবার সুরক্ষায় চূড়ান্ত করবে এক অবিস্মরণীয় প্রাণবৈচিত্র্য আইন। দেশের জনগণের সায় ও স্বার্থে যে আইন নিশ্চিত করবে প্রাণবৈচিত্র্যের ন্যায়বিচার।
পাভেল পার্থ: গবেষক, প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ।
animistbangla@yahoo.com
বাংলা ভাষায় রচিত মোট ৮১ ধারা এবং তিনটি তফসিলের মাধ্যমে ঘোষিত এই আইনে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো পবিত্র উদ্ভিদ, কুঞ্জবন, জনগোষ্ঠীর মাধ্যমে সংরক্ষিত ঐতিহ্যগত বন, বনভূমির ওপর জনগোষ্ঠীর প্রথাগত অধিকার, ইকোপার্ক, আন্তর্জাতিক প্রাণবৈচিত্র্য সনদ (১৯৯২) আগ্রাসী ও এলিয়েন প্রজাতির বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। বারবার নাম পাল্টালেও এখনো পর্যন্ত আইনটি একটি ভুল নামই ধারণ করে আছে। আইনের শিরোনাম ‘বন্য প্রাণী’ রেখে আবার তাতে উদ্ভিদ, বনভূমি ইত্যাদি টেনে এনে এক জমজমাট জগাখিচুড়ি তৈরি করা হয়েছে। আইনটির ২ নম্বর ধারার ৪৯ অনুচ্ছেদে ‘প্রাণী’ অর্থ সব স্তন্যপায়ী, পাখি, সরীসৃপ, উভচর, মৎস্য, অন্যান্য মেরুদণ্ডী ও অমেরুদণ্ডী প্রাণী এবং তাদের বাচ্চা ও ডিমকে উল্লেখ করা হয়েছে। পাশাপাশি একই ধারার ৫৪ অনুচ্ছেদে ‘বন্য প্রাণী’ অর্থ বিভিন্ন প্রকার ও জাতের উদ্ভিদ ও প্রাণী বা তাদের জীবনচক্র বৃদ্ধির বিভিন্ন পর্যায়, যাদের উৎস বন্য হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে এবং শুধু তফসিল ১ ও ২-এর অন্তর্ভুক্ত নয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তার মানে হচ্ছে, এখন থেকে ‘বন্য প্রাণী’ বলতে আমাদের উদ্ভিদ ও প্রাণী উভয়কে বুঝতে হবে বা বুঝতে বাধ্য করানো হবে। প্রাণিবিজ্ঞানের চলমান সংজ্ঞায় যা সার্বিক দিক থেকে সাংঘর্ষিক। এমনকি বাংলা একাডেমীসহ রাষ্ট্রের সব অভিধান ও নথিপত্রে ‘বন্য প্রাণী’ প্রত্যয়টির সংজ্ঞা ও মানেও পাল্টাতে হবে। আইনটির নামকরণ ‘বাংলাদেশ প্রাণবৈচিত্র্য আইন, ২০১০’ করলেও এ ধরনের ভাষা ও ধারণাগত ত্রুটি এড়ানো সম্ভব। তবে পাশাপাশি এ-ও স্মরণে রাখা জরুরি, ১৯৯৮ সালেও ‘বাংলাদেশ প্রাণবৈচিত্র্য ও গোষ্ঠীগত জ্ঞান সুরক্ষা আইন’ নামে একটি খসড়া তৈরি হয়েছিল, যা হয়তো রাষ্ট্রের অসহনীয় আমলাতান্ত্রিকতার চাপেই জলহস্তী, ময়ূর কি গন্ডারের মতো বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
‘বিশেষ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এলাকা, জাতীয় ঐতিহ্যবাহী, স্মারক ও পবিত্র বৃক্ষ’ শীর্ষক শিরোনামে বর্ণিত আইনের পঞ্চম অধ্যায়টি রাষ্ট্রের প্রতিবেশ-রাজনীতির ‘অসাম্প্রদায়িকতাকে’ প্রকাশ করেছে। প্রস্তাবিত আইনে দেশের উদ্ভিদ ও প্রাণীগুলোর তালিকা তিনটি তফসিল আকারে সংযুক্ত করা হলেও দেশের সব পবিত্র উদ্ভিদ ও প্রাণীর নাম এখানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোলের সুড়লা মৌজার সাবেক ৪৬৩ ও হাল ৫০২ দাগের ৮১ শতক জমিতে তেভাগার রক্তাক্ত সাক্ষী এক তেঁতুলবৃক্ষের মতো পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিকাংশ মারমা ও তঞ্চংঙ্গ্যা গ্রামে তেঁতুলগাছ এখনো সামাজিকভাবে ঐতিহাসিক স্মারক হিসেবে টিকে আছে। কিন্তু আইনের ২ নম্বর তফসিলে মাত্র ৫৭টি বৃক্ষের তালিকায় দুঃখজনকভাবে তেঁতুল, পবিত্র বট, মহুয়া, পদ্ম, ফণীমনসা, অশ্বত্থ, পাকুড়, ডুমুর, শেওড়া, কারাম, ধুতরা, শাল, সুন্দরী, বকুল, হিজল, তমাল, করচ, তুলসী, বেলের মতো বহুল চর্চিত পবিত্র বৃক্ষের কোনো হদিস রাখা হয়নি। পাশাপাশি দেশের এনডেমিক ও ভৌগোলিক নির্দেশক প্রজাতিসহ সর্পগন্ধা, মাখনা, বনলেবু, নাগালিঙ্গম, বৃক্ষ ফার্ন, হস্তীকর্ণপলাশ, হরিংআড়ু, নিটাম, ক্রালাহিড, ক্যাক্র নামের শ্যাওলা, দামবং, বৈচিত্র্যময় বনআলু ও কচুর জাতগুলোকে এই তালিকায় যুক্ত করা হয়নি। আইনে Invasive species-কে ‘আগ্রাসী প্রজাতি’ নামে আখ্যায়িত করায় ধন্যবাদ জানাচ্ছি। তবে বাংলাদেশের জন্য কোন কোন উদ্ভিদ ও প্রাণীকে রাষ্ট্র আগ্রাসী মনে করছে, তার একটি তালিকা অবশ্যই আইনটির তফসিল হিসেবে থাকা উচিত ছিল।
হাস্যকরভাবে প্রস্তাবিত বন্য প্রাণী আইনের ২ নম্বর ধারায় আদিবাসী সমাজে ব্যবহূত বাটুল বা তীর-ধনুক এবং করপোরেট কোম্পানির আগ্নেয়াস্ত্রকে একইভাবে একই কাতারে ‘অস্ত্র’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। ১৯২৭ সালের ঔপনিবেশিক বন আইনের মতোই প্রস্তাবিত আইনেও সব ধরনের শিকারকে রাষ্ট্রীয় বনে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আমরা যদি শিকারকে অরণ্যচারী আদিবাসী জীবনের এক প্রতিবেশীয় চর্চা এবং অরণ্য জীবনধারা হিসেবে পাঠ করি, তাহলে কিন্তু বলতেই হয় শিকারপ্রথাকে জোরপূর্বক কোনো ধরনের সম্মতি ও অনুমতি ছাড়া বন্ধ করাও অধিকার লঙ্ঘন। সাঁওতাল আদিবাসীদের সোহরাই ও সারহুল উৎসবের এক অন্যতম পর্ব হচ্ছে শিকার, লালেং আদিবাসীদের নাফাং উৎসব কাছিম শিকার ছাড়া হয় না। আদিবাসীসহ অরণ্যনির্ভর জনগণের শিকার সংশ্লিষ্ট ধর্মীয় ও সামাজিক কৃত্যগুলোকে আইনের আওতায় ‘বন অপরাধ’ হিসেবে গণ্য করা যাবে না।
আইনের দ্বিতীয় অধ্যায়ে বন্য প্রাণী উপদেষ্টা বোর্ড গঠনের ক্ষেত্রে পানি সম্পদ, ভূমি, শিল্প মন্ত্রণালয়সহ হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন বোর্ডকেও সদস্য রাখা হয়নি। অথচ বাংলাদেশের দুটি রামসার এলাকা সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর এবং সুন্দরবন সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সরাসরি পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও হাওর উন্নয়ন বোর্ডের অনেক পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত জড়িত। দুঃখজনকভাবে বন্য প্রাণী উপদেষ্টা বোর্ডে রাখা হয়নি দেশের বন্য প্রাণী রক্ষায় নিঃস্বার্থভাবে শ্রম ঘাম ঢেলে যাওয়া সত্যিকারের সংরক্ষণবিদ অরণ্যনির্ভর জনগণকেও। বাংলাদেশে এই প্রথম কোনো রাষ্ট্রীয় আইনে সুস্পষ্টভাবে ‘বননির্ভর জনগোষ্ঠীর’ অস্তিত্ব স্বীকার করা হয়েছে এবং ‘বনের ওপর প্রথাগত অধিকারকে’ কার্যত স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। ১৮ নম্বর ধারায় স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে প্রাকৃতিক সংরক্ষিত বনভূমিতে শিল্প কারখানা স্থাপন ও বাণিজ্যিক খনন নিষিদ্ধ। যদি আইনটির এই ছোট দুটি ধারা পালন করা যায় তবে ভাওয়াল শালবনকে শিল্পায়নের আগ্রাসন এবং লাউয়াছড়া বনকে করপোরেট গ্যাস কোম্পানির খনন থেকে রক্ষা করা সম্ভব।
খুবই সুনির্দিষ্টভাবে আইনটিতে এক ধরনের মার্কিন মাতব্বরি লক্ষ করা যাচ্ছে। আইনের চতুর্থ অধ্যায়ের ২১ নম্বর ধারায় ‘সহ-ব্যবস্থাপনার’ প্রসঙ্গ উত্থাপন করা হয়েছে। প্রাকৃতিক বনভূমি ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণে এই ‘সহ-ব্যবস্থাপনা’ ধারণাটি সম্ভবত মার্কিন ইউএসএআইডির সহায়তায় প্রশ্নহীন কায়দায় চালু হওয়া বিতর্কিত ‘আইপ্যাক কর্মসূচিকে’ বৈধ করতেই রাখা হয়েছে। কারণ, এর আগে বাংলাদেশ সামাজিক বনায়ন বিধিমালা তৈরি হয়েছিল এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের সরাসরি খবরদারিতে। কোনো ধরনের পারস্পরিক কারণ ছাড়াই ‘সহ-ব্যবস্থাপনা’, ‘প্রথাগত অধিকার’ ও ‘কমিউনিটি কনজারভেশন এরিয়া’ বিষয়গুলোকে একই আইনে রাখা হয়েছে। আইপ্যাক কর্মসূচি বাংলাদেশের বননির্ভর জনগোষ্ঠীকে বনের ওপর তাদের সব সম্পর্ক ছিন্ন করে তথাকথিত ‘বিকল্প পেশায়’ স্থানান্তরের জন্য জানপ্রাণ দিয়ে কাজ করছে। অথচ বন্য প্রাণী আইনে এই তথাকথিত ‘সহ-ব্যবস্থাপনাকেই’ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, আবার পাশাপাশি বনভূমির ওপর বননির্ভর জনগোষ্ঠীর প্রথাগত অধিকার ও কমিউনিটি কনজারভেশন এরিয়া সংরক্ষণের কথাও বলা হয়েছে। আইনের নবম অধ্যায়ে দণ্ড এবং কার্যপ্রণালি বিধি-সম্পর্কিত অংশে অবিবেচনাপ্রসূত ধারাগুলো আগের সেই ১৯৭৩ সালের আইন অনুযায়ীই উল্লেখ করা হয়েছে। বন অপরাধ চিহ্নিতকরণ ও শাস্তির বিধান বননির্ভর জনগোষ্ঠী ও অবননির্ভর জনগোষ্ঠী, শিশু-কিশোর-প্রাপ্তবয়স্ক এবং নারী ও পুরুষের জন্য একই হলে তা ওই আইন ও রাষ্ট্রের বিদ্যমান অন্যান্য আইনগত বিচারব্যবস্থার সঙ্গে দ্বন্দ্ব তৈরি করবে। বন অপরাধ নিরসনে বন অপরাধীদের জন্য প্রতিবেশীয় শিক্ষা ও পরিবেশবান্ধব সংশোধনী কার্যক্রমের কোনো উল্লেখ ওই আইনে নেই। অথচ বন অপরাধ কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে জনগোষ্ঠীর ভেতর প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং প্রাণবৈচিত্র্যের ওপর জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই। আশা করি, ‘বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটি’ উল্লিখিত বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে দেশের বন্য প্রাণী ও উদ্ভিদ সবার সুরক্ষায় চূড়ান্ত করবে এক অবিস্মরণীয় প্রাণবৈচিত্র্য আইন। দেশের জনগণের সায় ও স্বার্থে যে আইন নিশ্চিত করবে প্রাণবৈচিত্র্যের ন্যায়বিচার।
পাভেল পার্থ: গবেষক, প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ।
animistbangla@yahoo.com
No comments