ইতিউতিপুলিশের সভ্য আচরণ কি পাওয়া যাবে by আতাউস সামাদ
এক. জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক পুলিশের নৃশংস মারপিটের ফলে গুরুতর আহত হওয়ায় এখন হাসপাতালে নিবিড় পর্যবেক্ষণে (রহঃবহংরাব পধৎব) আছেন। তাঁর ওপর প্রকাশ্যে যে রকম বর্বর অত্যাচার করে কিছু পুলিশ, সে দৃশ্য খানিকটা দেখেছিল দেশবাসী ও সারা বিশ্বের মানুষ বেসরকারি টেলিভিশনগুলোর কল্যাণে।
ওইটুকুতেই তাঁরা শিউরে উঠেছেন। জয়নুল আবদিন ফারুকের সঙ্গে আমার বহুবার দেখা হয়েছে বিভিন্ন আলোচনা সভায়। সেই সময়গুলোতে তাঁকে সবার সঙ্গে ভদ্র ও বিনয়ী ব্যবহার করতে দেখেছি। আলোচনায় তিনি তথ্য ও যুক্তি উপস্থাপন করতেন। বর্তমান সরকারের নানা ভুল বা অন্যায় কাজের সমালোচনা করার সময় মাঝেমধ্যে কড়া রাজনৈতিক ভাষায় কথা বলতে শুনেছি। কিন্তু সেগুলো অশোভন বা তাতে কাউকে ব্যক্তিগতভাবে অপমান করা হচ্ছে বলে মনে হয়নি। বিএনপি নেতা ও বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুকের সঙ্গে গত এক বছরে ঘন ঘন দেখা হয়েছে। কারণ দৈনিক আমার দেশ বন্ধ করার এক সরকারি নির্দেশের প্রতিবাদ করতে এবং পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমান ও প্রতিবেদক অলিউল্লাহ নোমানকে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ আদালত অবমাননার এক মামলায় অভূতপূর্ব একটি রায়ে কারাদণ্ড দিলে ও জরিমানা করলে তাঁদের মুক্তির দাবিতে যেসব সমাবেশ, সভা ও মানববন্ধন করেছি আমরা সাংবাদিকরা, তার প্রায় প্রতিটিতে তিনি এসে সংহতি প্রকাশ করেছেন। এ ছাড়া কোথাও সাংবাদিকরা নির্যাতিত হলে তার প্রতিবাদে ঢাকায় সভা-সমাবেশ হলে তিনি সেগুলোতেও উপস্থিত হয়ে প্রতিবাদে শামিল হয়েছেন এবং কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করেছেন। পরম করুণাময় আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি, জয়নুল আবদিন ফারুক যেন অতিসত্বর সুস্থ হয়ে ওঠেন এবং নিরাপদে থাকেন।
দুই.
জাতীয় সংসদের নির্বাচনের সময় দেশে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখার ব্যবস্থা ফের চালু করার দাবিতে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি গত বুধ ও বৃহস্পতিবার টানা দুই দিনের হরতাল ডেকেছিল। বিএনপির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামী ও অন্য আরো বেশ কয়েকটি ছোট দল একই দিনে হরতাল ডাকে। ঢিলেঢালা হোক আর কঠোরভাবে হোক, দেশজুড়ে এই হরতাল হয়েছে। পুলিশ হরতালের পক্ষে পিকেটারদের রাস্তায় নামতেই দেয়নি বলা চলে। তবু দোকানপাট ও স্কুল-কলেজ বন্ধ ছিল। সড়কপথে দূরপাল্লার বাস-ট্রাক চলেনি। শহরগুলোতে অল্প কিছু যানবাহন চলেছে, কিন্তু লোকজন খুব সামান্য সংখ্যায় ঘর থেকে বেরিয়েছে বলে এগুলোতে যাত্রী কমই ছিল। হরতালের ফলে ঢাকার কাঁচাবাজারে খাদ্যপণ্য সরবরাহ কমে যায়, দামও বেড়ে যায়। হরতালের সময় ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকরা বিভিন্ন জায়গায় হরতালের বিরুদ্ধে মিছিল ও পথসভা করে। তবে ওই সব সমাবেশের আশপাশের দোকানপাট বন্ধ থাকতে দেখা যায়। এদিকে পুলিশ বহু জায়গায় বিক্ষোভ প্রদর্শনকারীদের লাঠিপেটা করেছে। শুক্রবারের পত্রিকাগুলোতেও পুলিশ-পিটুনিতে আহত বিক্ষোভকারীদের রক্তাক্ত মুখ ও শরীরের ছবি প্রকাশিত হয়েছে। হরতালের সময় একটি অতীব দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে নাটোরে। সেখানে থেমে থাকা একটি আমবোঝাই ট্রাকে দুষ্কৃতকারীরা আগুন ধরিয়ে দিলে আম ব্যবসায়ী তরুণ মোশাররফ হোসেনের প্রায় সারা শরীর (৯০ শতাংশ) ঝলসে গেছে। ডাক্তাররা তাঁর জীবনাশঙ্কা করছেন। আমরা এ ধরনের হামলার নিন্দা জানাই ও দুর্বৃত্তদের শাস্তি দাবি করি। একই সঙ্গে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি মোশাররফের প্রাণরক্ষা করতে। কে বা কারা ওই ট্রাকে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল, আমরা তা জানি না, তবে বিএনপি নেতাদের আমরা অনুরোধ করব, তাঁদের সমর্থকদের সহিংসতা থেকে দূরে রাখতে। তাঁরা তো নিকট অতীতে কয়েকবার দেখলেন যে তাঁদের আহ্বানে হরতাল সফল হচ্ছে। হরতালের আগে তাঁরা যে বিভিন্ন জায়গায় লিফলেট বিলি করেন ও জনসংযোগ করেন, তাতে তো কাজ হচ্ছে। বাংলাদেশে যদি শান্তিপূর্ণ হরতালের অভ্যাস গড়ে ওঠে তাহলে ভালো হয়।
তিন.
অন্যদিকে আমরা মনে করি, 'নিপীড়ক' বাহিনী এবং 'নির্যাতনের যন্ত্র' হিসেবে পুলিশ যে অন্য মানুষের জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে প্রায়ই, এর একটা আশু সুরাহা দরকার। গত বুধবার জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুকের ওপর পুলিশের বারংবার হামলা এবং অত্যন্ত গুরুতরভাবে জখম করার ঘটনায় গভীর উদ্বেগের বেশ কয়েকটি বিষয় জনগণের সামনে এসেছে। যেমন_জাতীয় সংসদ এলাকায়ই যদি বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্যদের নিরাপত্তা না থাকে এবং তাও আবার সরকারি বেতনে রাখা অর্থাৎ জনগণের দেওয়া করের টাকায় চলা পুলিশের হাত থেকে, সে ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ তাদের গৃহাভ্যন্তরে অথবা দেশের কোনোখানে কি দিনে বা রাতে কখনো নিরাপদ থাকতে পারে এই বাহিনীর লোকদের হাত থেকে? দ্বিতীয়ত, পুলিশ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নামে পরিচিত কিন্তু তারা নিজেরা কি কোনো আইন মানে বা তাদের মধ্যে শৃঙ্খলা আছে কি? সব সভ্য দেশেই পুলিশ ও অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীকে নাগরিকদের জানমালের ক্ষতি না করে তাদের কর্তব্য পালন করতে শেখানো হয়। বাংলাদেশে কী শেখানো হয়? বছরখানেক ধরে আমরা লক্ষ করছি যে পুলিশ সুযোগ পেলেই প্রতিবাদ বা বিক্ষোভ প্রদর্শনকারীদের বুকে-পিঠে লাথি মারে এবং বুট পায়ে মাড়িয়ে দেয়। এটা পাশবিক অত্যাচার। সরকার কেন পুলিশকে এই বর্বর ও নির্মম আচরণ থেকে নিরস্ত করে না? দিনের পর দিন পুলিশের এই উন্মত্ত আচরণ দেখে এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশ অফিসারের উগ্র ও দম্ভপূর্ণ সব মন্তব্য শুনে আমরা ক্রমেই আতঙ্কিত হয়ে পড়ছিলাম যে খুবই বিচ্ছিরি অথবা দুঃখজনক কিছু ঘটবে। তা-ই হলো। এ থেকে রেহাই কোথায়? বিভিন্ন দেশে পুলিশকে বিক্ষোভকারীদের নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য ধৈর্য ধরে বিশেষ কৌশলে কাজ করতে শেখানো হয়, যাতে উত্তেজনা ছড়িয়ে না পড়ে। বাংলাদেশের পুলিশ বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী অথবা সরকারের আরো উচ্চপর্যায়ে এমন সভ্য পন্থা জানার কোনো আগ্রহ আছে কি?
এখানে উল্লেখ করি, গত ডিসেম্বর অথবা জানুয়ারিতে ব্রিটেনে সরকার যেদিন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের বেতন বাড়ানোর জন্য পার্লামেন্টে বিল আনে সেদিন সে দেশের হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী লন্ডনে বিক্ষোভ করছিল। সেই বিকেলে প্রিন্স চার্লস ও তাঁর স্ত্রী ক্যামিলা গাড়ি করে একটা কনসার্টে যাচ্ছিলেন। ঘটনাচক্রে কিছু বিক্ষোভকারী তাঁদের দেখে ফেলে এবং তাঁদের গাড়ির কাচ ভেঙে দেয়, এমনকি ভাঙা জানালা দিয়ে একটা লাঠি ঢুকিয়ে তাঁদের খোঁচা দেওয়ার চেষ্টা করে। প্রিন্স চার্লসের গাড়ির চালক কৌশলে গাড়িটি সেখান থেকে সরিয়ে নেন। ওই সময়ে গাড়ির আশপাশে প্রিন্স চার্লসের দেহরক্ষী কমান্ডোরাও ছিল। তারা কিন্তু কাউকে গুলি করেনি বা লাঠির বাড়িও দেয়নি। লন্ডন পুলিশ ধীরে-সুস্থে তদন্ত করে পরে হামলাকারীদের শনাক্ত করে। প্রিন্স চার্লস বা প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনও হুঙ্কার দিয়ে বলেননি, 'এক্ষুনি ওদের শির এনে দাও আমাকে।' বরঞ্চ ব্রিটেনের শিক্ষামন্ত্রী সেদিন সেই বিতর্কিত বিল পাস হওয়ার পরও পার্লামেন্টে বলেছিলেন, এ কথা স্পষ্ট যে এই বিলের ভালো দিকগুলো আমরা শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের বোঝাতে পারিনি। এখন আমাদের সারা দেশ সফর করে সে কাজটাই করতে হবে।' আমাদের সরকার ও পুলিশ এ ধরনের মনোভাব নিতে সামান্যতম আগ্রহী আছে কি?
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী, ক্ষমতাসীন জোটের কিছু সংসদ সদস্য ও পুলিশ অফিসার বুধবারের ঘটনার জন্য ক্রমাগত বিরোধী দলের নেতৃস্থানীয় সংসদ সদস্য জয়নুল আবদিন ফারুককে দায়ী করে গেছেন। পুলিশকে দিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করানো হয়েছে; কিন্তু তাঁর হয়ে মামলা করতে গেলে থানা তাৎক্ষণিকভাবে সেই মামলা নেয়নি। এ ক্ষেত্রে আইনের প্রয়োগ নিয়ে কথা উঠতে বাধ্য এবং অনুমান করি, সরকার তাতে সুবিধা করতে পারবে না। তবুও যদি সরকারের হুঁশ না হয়, তাহলে এ দেশে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার অনুপস্থিত থাকার সমস্যাটি আরো প্রকট হবে। এতে অবশেষে জনগণ ফুঁসে উঠলে সরকার কী করবে, হাজার হাজার দলীয় ক্যাডারকে পুলিশ বানিয়ে দেশের মানুষের বিরুদ্ধে নামাবে? সে রকম আয়োজন নাকি হচ্ছে!
চার.
তবুও ফিরে আসি পুলিশের দক্ষতা ও সদাচরণের প্রশ্নে। গত বুধবার জাতীয় সংসদ এলাকায় বিক্ষোভ প্রদর্শন করছিলেন জনা পনেরো বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্য। সেখানে উপস্থিত ভারী পুলিশ বাহিনী তো ইচ্ছা করলেই তাঁদের সরিয়ে দিতে পারত। এমনকি তাঁদের সাময়িকভাবে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে যেতে পারত। জয়নুল আবদিন ফারুক একবার একটা ঢিল হাতে তুলে নিয়েছিলেন (তিনি সেটা ছুড়েছিলেন কি না বা ছুড়তে পেরেছিলেন কি না প্রথম আলোর ছবি দেখে তা বোঝা যায় না)। তাঁকে ওই এলাকা থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য তাই তো যথেষ্ট অজুহাত ছিল পুলিশের হাতে। কিন্তু তা না করে পুলিশ তাঁকে একদফা লাঠিপেটা করে জখম করে। এরপর তিনি যখন ন্যাম ভবনের দিকে চলে যাচ্ছিলেন তখন তাঁকে আবার ধাওয়া করে। তিনি দৌড়ে ন্যাম ভবনে ঢুকে পড়লে সেখান থেকে পুলিশ তাঁকে টেনে এনে মাটিতে ফেলে পেটায় ও মাড়ায়। তারপর তাঁকে গাড়িতে তুলে আবার ফেলে দেয়। এ সময় জয়নুল আবদিন ফারুক জ্ঞান হারান। শেষ পর্যন্ত তাঁর মাথা, পা ও পিঠে প্রায় পঁচিশটি সেলাই দিতে হয়েছে। তাঁর সারা গায়ে পিটুনির দাগ আছে। বোঝাই যায়, তাঁর সুস্থ হতে সময় লাগবে। ফলে সরকার যে এ ঘটনার প্রথম দিন বলছিল, এসব নাটক, হতে পারে ধস্তাধস্তিতে তিনি মৃদু আঘাত পেয়েছেন সেই গলা খানিকটা পাল্টে বলছে, যা হয়েছে সে জন্য তারা মৃদু দুঃখিত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বৃহস্পতিবার অর্থাৎ ওই বর্বরোচিত ঘটনার পরদিন বলেছেন, এখন তিনি নিজে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপের চিকিৎসার খোঁজখবর রাখছেন।
পাঁচ.
জয়নাল আবদিন ফারুককে যখন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে এবং চিকিৎসকরা তাঁর অবস্থা নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তিত সেই সময়ে জাতীয় সংসদে ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন সদস্য তাঁর সম্পর্কে কটু ও তির্যক মন্তব্য করেছেন। ওই সব উক্তিকে খুব কম করে বললেও 'দায়িত্বজ্ঞানহীন' হিসেবে আখ্যায়িত করতে হয়। কারণ সবাই জানেন যে দেশে এখন একটা রাজনৈতিক সংকট ঘনীভূত হচ্ছে। আর সে জন্য মূলত দায়ী ক্ষমতাসীনদের আদালতের রায়ের নিজ ব্যাখ্যা অনুযায়ী সংবিধান থেকে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা তুলে দেওয়াসহ সংবিধানের অনেক কিছু একতরফাভাবে তড়িঘড়ি করে বদলে ফেলা। সংসদের ভেতরে-বাইরে বিভিন্ন দলের নেতা, অভিজ্ঞ পর্যবেক্ষক এবং বিভিন্ন পত্রিকায় মতামতদানকারী পাঠকদের বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ আওয়ামী লীগ সরকারের ওই পদক্ষেপের বিরোধিতা করছেন। আর কারো কারো ভাষায়, 'আন্দোলনে অপারদর্শী' প্রধান বিরোধী দল বিএনপি দেশজুড়ে একটানা ৪৮ ঘণ্টার হরতাল করে ফেলল এই প্রশ্নে। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী সম্পর্কে যে একটা গণভোটের মাধ্যমে জনসাধারণের রায় নেওয়া যেত সে পথও এখন বন্ধ। কারণ ক্ষমতাসীন দল সংবিধান থেকে গণভোটের বিধান তুলে দিয়েছে। তার ফলে বর্তমানে সমস্যা সমাধানের একটা পথ অবলুপ্ত হয়েছে। এ অবস্থায় সর্বোত্তম হচ্ছে হয় আগের ব্যবস্থা পুনর্বহাল করে অশান্তির কারণ দূর করা। অন্য পথ হচ্ছে, সরকারপক্ষ বিরোধী দলকে বর্তমান বিরোধ মেটাতে অর্থপূর্ণ কোনো প্রস্তাব দিক। 'এখানে বসি, সেখানে বসি' এ রকম অর্থহীন বা হেঁয়ালিপূর্ণ কথা বর্তমান পরিস্থিতিতে না বলাই ভালো।
তবে সরকারকে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথাই ভাবতে হবে। কারণ সদ্যসমাপ্ত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ব্যাপক হাঙ্গামায় ৬৫ জন নিহত, আট হাজার জন আহত এবং পুলিশের এক হাজার রাউন্ড গুলি চালানোর পর এ কথা আদৌ বিশ্বাসযোগ্য নয় যে বাংলাদেশে এখন দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে পারে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
০৮.৭.২০১১
দুই.
জাতীয় সংসদের নির্বাচনের সময় দেশে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখার ব্যবস্থা ফের চালু করার দাবিতে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি গত বুধ ও বৃহস্পতিবার টানা দুই দিনের হরতাল ডেকেছিল। বিএনপির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামী ও অন্য আরো বেশ কয়েকটি ছোট দল একই দিনে হরতাল ডাকে। ঢিলেঢালা হোক আর কঠোরভাবে হোক, দেশজুড়ে এই হরতাল হয়েছে। পুলিশ হরতালের পক্ষে পিকেটারদের রাস্তায় নামতেই দেয়নি বলা চলে। তবু দোকানপাট ও স্কুল-কলেজ বন্ধ ছিল। সড়কপথে দূরপাল্লার বাস-ট্রাক চলেনি। শহরগুলোতে অল্প কিছু যানবাহন চলেছে, কিন্তু লোকজন খুব সামান্য সংখ্যায় ঘর থেকে বেরিয়েছে বলে এগুলোতে যাত্রী কমই ছিল। হরতালের ফলে ঢাকার কাঁচাবাজারে খাদ্যপণ্য সরবরাহ কমে যায়, দামও বেড়ে যায়। হরতালের সময় ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকরা বিভিন্ন জায়গায় হরতালের বিরুদ্ধে মিছিল ও পথসভা করে। তবে ওই সব সমাবেশের আশপাশের দোকানপাট বন্ধ থাকতে দেখা যায়। এদিকে পুলিশ বহু জায়গায় বিক্ষোভ প্রদর্শনকারীদের লাঠিপেটা করেছে। শুক্রবারের পত্রিকাগুলোতেও পুলিশ-পিটুনিতে আহত বিক্ষোভকারীদের রক্তাক্ত মুখ ও শরীরের ছবি প্রকাশিত হয়েছে। হরতালের সময় একটি অতীব দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে নাটোরে। সেখানে থেমে থাকা একটি আমবোঝাই ট্রাকে দুষ্কৃতকারীরা আগুন ধরিয়ে দিলে আম ব্যবসায়ী তরুণ মোশাররফ হোসেনের প্রায় সারা শরীর (৯০ শতাংশ) ঝলসে গেছে। ডাক্তাররা তাঁর জীবনাশঙ্কা করছেন। আমরা এ ধরনের হামলার নিন্দা জানাই ও দুর্বৃত্তদের শাস্তি দাবি করি। একই সঙ্গে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি মোশাররফের প্রাণরক্ষা করতে। কে বা কারা ওই ট্রাকে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল, আমরা তা জানি না, তবে বিএনপি নেতাদের আমরা অনুরোধ করব, তাঁদের সমর্থকদের সহিংসতা থেকে দূরে রাখতে। তাঁরা তো নিকট অতীতে কয়েকবার দেখলেন যে তাঁদের আহ্বানে হরতাল সফল হচ্ছে। হরতালের আগে তাঁরা যে বিভিন্ন জায়গায় লিফলেট বিলি করেন ও জনসংযোগ করেন, তাতে তো কাজ হচ্ছে। বাংলাদেশে যদি শান্তিপূর্ণ হরতালের অভ্যাস গড়ে ওঠে তাহলে ভালো হয়।
তিন.
অন্যদিকে আমরা মনে করি, 'নিপীড়ক' বাহিনী এবং 'নির্যাতনের যন্ত্র' হিসেবে পুলিশ যে অন্য মানুষের জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে প্রায়ই, এর একটা আশু সুরাহা দরকার। গত বুধবার জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুকের ওপর পুলিশের বারংবার হামলা এবং অত্যন্ত গুরুতরভাবে জখম করার ঘটনায় গভীর উদ্বেগের বেশ কয়েকটি বিষয় জনগণের সামনে এসেছে। যেমন_জাতীয় সংসদ এলাকায়ই যদি বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্যদের নিরাপত্তা না থাকে এবং তাও আবার সরকারি বেতনে রাখা অর্থাৎ জনগণের দেওয়া করের টাকায় চলা পুলিশের হাত থেকে, সে ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ তাদের গৃহাভ্যন্তরে অথবা দেশের কোনোখানে কি দিনে বা রাতে কখনো নিরাপদ থাকতে পারে এই বাহিনীর লোকদের হাত থেকে? দ্বিতীয়ত, পুলিশ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নামে পরিচিত কিন্তু তারা নিজেরা কি কোনো আইন মানে বা তাদের মধ্যে শৃঙ্খলা আছে কি? সব সভ্য দেশেই পুলিশ ও অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীকে নাগরিকদের জানমালের ক্ষতি না করে তাদের কর্তব্য পালন করতে শেখানো হয়। বাংলাদেশে কী শেখানো হয়? বছরখানেক ধরে আমরা লক্ষ করছি যে পুলিশ সুযোগ পেলেই প্রতিবাদ বা বিক্ষোভ প্রদর্শনকারীদের বুকে-পিঠে লাথি মারে এবং বুট পায়ে মাড়িয়ে দেয়। এটা পাশবিক অত্যাচার। সরকার কেন পুলিশকে এই বর্বর ও নির্মম আচরণ থেকে নিরস্ত করে না? দিনের পর দিন পুলিশের এই উন্মত্ত আচরণ দেখে এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশ অফিসারের উগ্র ও দম্ভপূর্ণ সব মন্তব্য শুনে আমরা ক্রমেই আতঙ্কিত হয়ে পড়ছিলাম যে খুবই বিচ্ছিরি অথবা দুঃখজনক কিছু ঘটবে। তা-ই হলো। এ থেকে রেহাই কোথায়? বিভিন্ন দেশে পুলিশকে বিক্ষোভকারীদের নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য ধৈর্য ধরে বিশেষ কৌশলে কাজ করতে শেখানো হয়, যাতে উত্তেজনা ছড়িয়ে না পড়ে। বাংলাদেশের পুলিশ বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী অথবা সরকারের আরো উচ্চপর্যায়ে এমন সভ্য পন্থা জানার কোনো আগ্রহ আছে কি?
এখানে উল্লেখ করি, গত ডিসেম্বর অথবা জানুয়ারিতে ব্রিটেনে সরকার যেদিন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের বেতন বাড়ানোর জন্য পার্লামেন্টে বিল আনে সেদিন সে দেশের হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী লন্ডনে বিক্ষোভ করছিল। সেই বিকেলে প্রিন্স চার্লস ও তাঁর স্ত্রী ক্যামিলা গাড়ি করে একটা কনসার্টে যাচ্ছিলেন। ঘটনাচক্রে কিছু বিক্ষোভকারী তাঁদের দেখে ফেলে এবং তাঁদের গাড়ির কাচ ভেঙে দেয়, এমনকি ভাঙা জানালা দিয়ে একটা লাঠি ঢুকিয়ে তাঁদের খোঁচা দেওয়ার চেষ্টা করে। প্রিন্স চার্লসের গাড়ির চালক কৌশলে গাড়িটি সেখান থেকে সরিয়ে নেন। ওই সময়ে গাড়ির আশপাশে প্রিন্স চার্লসের দেহরক্ষী কমান্ডোরাও ছিল। তারা কিন্তু কাউকে গুলি করেনি বা লাঠির বাড়িও দেয়নি। লন্ডন পুলিশ ধীরে-সুস্থে তদন্ত করে পরে হামলাকারীদের শনাক্ত করে। প্রিন্স চার্লস বা প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনও হুঙ্কার দিয়ে বলেননি, 'এক্ষুনি ওদের শির এনে দাও আমাকে।' বরঞ্চ ব্রিটেনের শিক্ষামন্ত্রী সেদিন সেই বিতর্কিত বিল পাস হওয়ার পরও পার্লামেন্টে বলেছিলেন, এ কথা স্পষ্ট যে এই বিলের ভালো দিকগুলো আমরা শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের বোঝাতে পারিনি। এখন আমাদের সারা দেশ সফর করে সে কাজটাই করতে হবে।' আমাদের সরকার ও পুলিশ এ ধরনের মনোভাব নিতে সামান্যতম আগ্রহী আছে কি?
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী, ক্ষমতাসীন জোটের কিছু সংসদ সদস্য ও পুলিশ অফিসার বুধবারের ঘটনার জন্য ক্রমাগত বিরোধী দলের নেতৃস্থানীয় সংসদ সদস্য জয়নুল আবদিন ফারুককে দায়ী করে গেছেন। পুলিশকে দিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করানো হয়েছে; কিন্তু তাঁর হয়ে মামলা করতে গেলে থানা তাৎক্ষণিকভাবে সেই মামলা নেয়নি। এ ক্ষেত্রে আইনের প্রয়োগ নিয়ে কথা উঠতে বাধ্য এবং অনুমান করি, সরকার তাতে সুবিধা করতে পারবে না। তবুও যদি সরকারের হুঁশ না হয়, তাহলে এ দেশে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার অনুপস্থিত থাকার সমস্যাটি আরো প্রকট হবে। এতে অবশেষে জনগণ ফুঁসে উঠলে সরকার কী করবে, হাজার হাজার দলীয় ক্যাডারকে পুলিশ বানিয়ে দেশের মানুষের বিরুদ্ধে নামাবে? সে রকম আয়োজন নাকি হচ্ছে!
চার.
তবুও ফিরে আসি পুলিশের দক্ষতা ও সদাচরণের প্রশ্নে। গত বুধবার জাতীয় সংসদ এলাকায় বিক্ষোভ প্রদর্শন করছিলেন জনা পনেরো বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্য। সেখানে উপস্থিত ভারী পুলিশ বাহিনী তো ইচ্ছা করলেই তাঁদের সরিয়ে দিতে পারত। এমনকি তাঁদের সাময়িকভাবে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে যেতে পারত। জয়নুল আবদিন ফারুক একবার একটা ঢিল হাতে তুলে নিয়েছিলেন (তিনি সেটা ছুড়েছিলেন কি না বা ছুড়তে পেরেছিলেন কি না প্রথম আলোর ছবি দেখে তা বোঝা যায় না)। তাঁকে ওই এলাকা থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য তাই তো যথেষ্ট অজুহাত ছিল পুলিশের হাতে। কিন্তু তা না করে পুলিশ তাঁকে একদফা লাঠিপেটা করে জখম করে। এরপর তিনি যখন ন্যাম ভবনের দিকে চলে যাচ্ছিলেন তখন তাঁকে আবার ধাওয়া করে। তিনি দৌড়ে ন্যাম ভবনে ঢুকে পড়লে সেখান থেকে পুলিশ তাঁকে টেনে এনে মাটিতে ফেলে পেটায় ও মাড়ায়। তারপর তাঁকে গাড়িতে তুলে আবার ফেলে দেয়। এ সময় জয়নুল আবদিন ফারুক জ্ঞান হারান। শেষ পর্যন্ত তাঁর মাথা, পা ও পিঠে প্রায় পঁচিশটি সেলাই দিতে হয়েছে। তাঁর সারা গায়ে পিটুনির দাগ আছে। বোঝাই যায়, তাঁর সুস্থ হতে সময় লাগবে। ফলে সরকার যে এ ঘটনার প্রথম দিন বলছিল, এসব নাটক, হতে পারে ধস্তাধস্তিতে তিনি মৃদু আঘাত পেয়েছেন সেই গলা খানিকটা পাল্টে বলছে, যা হয়েছে সে জন্য তারা মৃদু দুঃখিত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বৃহস্পতিবার অর্থাৎ ওই বর্বরোচিত ঘটনার পরদিন বলেছেন, এখন তিনি নিজে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপের চিকিৎসার খোঁজখবর রাখছেন।
পাঁচ.
জয়নাল আবদিন ফারুককে যখন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে এবং চিকিৎসকরা তাঁর অবস্থা নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তিত সেই সময়ে জাতীয় সংসদে ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন সদস্য তাঁর সম্পর্কে কটু ও তির্যক মন্তব্য করেছেন। ওই সব উক্তিকে খুব কম করে বললেও 'দায়িত্বজ্ঞানহীন' হিসেবে আখ্যায়িত করতে হয়। কারণ সবাই জানেন যে দেশে এখন একটা রাজনৈতিক সংকট ঘনীভূত হচ্ছে। আর সে জন্য মূলত দায়ী ক্ষমতাসীনদের আদালতের রায়ের নিজ ব্যাখ্যা অনুযায়ী সংবিধান থেকে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা তুলে দেওয়াসহ সংবিধানের অনেক কিছু একতরফাভাবে তড়িঘড়ি করে বদলে ফেলা। সংসদের ভেতরে-বাইরে বিভিন্ন দলের নেতা, অভিজ্ঞ পর্যবেক্ষক এবং বিভিন্ন পত্রিকায় মতামতদানকারী পাঠকদের বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ আওয়ামী লীগ সরকারের ওই পদক্ষেপের বিরোধিতা করছেন। আর কারো কারো ভাষায়, 'আন্দোলনে অপারদর্শী' প্রধান বিরোধী দল বিএনপি দেশজুড়ে একটানা ৪৮ ঘণ্টার হরতাল করে ফেলল এই প্রশ্নে। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী সম্পর্কে যে একটা গণভোটের মাধ্যমে জনসাধারণের রায় নেওয়া যেত সে পথও এখন বন্ধ। কারণ ক্ষমতাসীন দল সংবিধান থেকে গণভোটের বিধান তুলে দিয়েছে। তার ফলে বর্তমানে সমস্যা সমাধানের একটা পথ অবলুপ্ত হয়েছে। এ অবস্থায় সর্বোত্তম হচ্ছে হয় আগের ব্যবস্থা পুনর্বহাল করে অশান্তির কারণ দূর করা। অন্য পথ হচ্ছে, সরকারপক্ষ বিরোধী দলকে বর্তমান বিরোধ মেটাতে অর্থপূর্ণ কোনো প্রস্তাব দিক। 'এখানে বসি, সেখানে বসি' এ রকম অর্থহীন বা হেঁয়ালিপূর্ণ কথা বর্তমান পরিস্থিতিতে না বলাই ভালো।
তবে সরকারকে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথাই ভাবতে হবে। কারণ সদ্যসমাপ্ত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ব্যাপক হাঙ্গামায় ৬৫ জন নিহত, আট হাজার জন আহত এবং পুলিশের এক হাজার রাউন্ড গুলি চালানোর পর এ কথা আদৌ বিশ্বাসযোগ্য নয় যে বাংলাদেশে এখন দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে পারে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
০৮.৭.২০১১
No comments