কল্পকথার গল্প-'...আমারে চিনলাম না আমি' by আলী হাবিব

আমি কে? আমি এক শক্তিমান। আমার চেয়ে শক্তিশালী আর কেউ নেই। এখানে আমি, ওখানে আমি। আকাশে আমি, পাতালে আমি। আমি সবখানে। সর্বত্র আমি আছি। আমি না থাকলে এটা হবে না_ওটা হবে না। কোথাও গণ্ডগোল_খবর এল। বলে দিলাম, আমি আসছি। আজকাল তো হাতের মুঠোয় ফোন। ফোন থেকে বলে দিলেই হলো।


সর্বশক্তির অধিকারী এই আমি নিয়ে আমাদের বিড়ম্বনায় যে পড়তে হয় না, তা নয়। কিন্তু আমি শক্তিশালী হলে সেই আমাকে আর ঠেকায় কে? 'আমি বিনে গীত নেই।'
কিন্তু আমি কে? মরমি গায়ক গেয়েছেন_'খুঁজলাম তারে আসমান-জমিন/আমারে চিনলাম না আমি।' এ আমি আবার কোন আমি? আমি মানে তো আমি! এই যে আমাকে দেখা যাচ্ছে, এই তো আমি। একেবারেই থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার ভাবার কোনো কারণ তো নেই। আমি, মানে এই আমি স্বমহিমায় সগৌরবে ফার্স্ট পারসন। আমি মানে আমার সন্তান, আমার পুত্র, আমার কন্যা। আমি মানে আমার পরিবার। আমি মানে আমার এলাকা, আমার পাড়া। আমার থানা। আমার জেলা। আমার দল। আমার লোকজন। আমার মামা, আমার ভাগ্নে। আমার ভক্ত, অনুরক্ত। আমার অনুসারী। এই আমি কখনো রেগে কাঁই। কখনো আনন্দে আত্মহারা। বেদনায় বিধুর হই, সেও এই আমি। আদি ও অকৃত্রিম এই আমি কখনো একান্তে হাসি-কাঁদি, গান গাই। আমাকে নিয়ে আমি বেশ আছি। আমাকে ঘিরেই সবাই। আমি কাউকে ঘিরে নেই। আমাকে তুষ্ট করতে পেরে সবাই ধন্য। আমার চেয়ে বড় আর কে আছে! আমি চাইলে রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। আমি চাইলে রাস্তাজুড়ে জ্যাম। আমি চাইলে আকাশের মেঘ কেটে যায়। মেঘের আড়াল থেকে সূর্য বেরিয়ে আসে আলোর মহিমা নিয়ে_এমনই শক্তি আমার। আমি সবাইকে চ্যালেঞ্জ করতে পারি। যে কাউকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করতে পারি। আবার নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারি নিজে। আমি যখন একা, তখন নিজের সঙ্গে নিজের যুদ্ধ চলে আমার। একান্তে হিসাব মেলাতে বসি আমি_কী পেলাম? প্রকাশ্যে সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলি, 'কী পাইনি তারই হিসাব মেলাতে মন মোর নহে রাজি।' কিন্তু ভেতরে ভেতরে হিসাবটা মিলিয়ে চলি সব সময়। আমি যদি হিসাব না মেলাই, তাহলে চলবে কেমন করে? হিসাব তো একটা রাখতেই হবে। বেহিসাবি হলে কি আর চলে_নাকি কারো চলেছে কোনো দিন? হিসাব কষে পা দিতে হবে। প্রতিটি পদক্ষেপ হতে হবে মাপা। আমি তো সেই মানুষ, যার চূড়ান্ত লক্ষ্য স্থির করা আছে। আমাকে আমার সেই লক্ষ্যে পেঁৗছতেই হবে। না পেঁৗছলে চলবে কেমন করে?
আমি জানি, জীবনকে কেমন করে উপভোগ করতে হয়। নিজে না ঠকে কেমন করে অন্যকে ঠকাতে হয়, সেটাও আমার বিলক্ষণ জানা। আমি আমার জন্য সব কিছু করি, করতে পারি। আমাকে পেছনে ফেলার জন্য যে যতই ষড়যন্ত্র করুক, আমি সবার ষড়যন্ত্রের জাল ভেদ করে বেরিয়ে আসতে পারি। কারণ আমি নিজেও তো একটা স্বপ্নের জাল বুনে চলি। আমাকে তো আমার স্বপ্ন পূরণ করতে হবে। এই যে এত মানুষ আমার পেছনে ঘুুরছে, কেন? তাদেরও স্বপ্ন আছে। আমার পেছনে আসা, পেছনে ঘুরঘুর করে ঘুরে বেড়ানো মানুষগুলোর জন্য কিছু করতে পারা মানে আমার নিজের জন্য কিছু করতে পারা। কবি বলেছেন, 'সকলের তরে সকলে আমরা/ প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।' অমন কথা বলা বেহিসাবি কবিদেরই মানায়। আমি আছি কেবল আমারই জন্য। আমি আর কারো জন্য কিছু করতে পারব না। কারো জন্য কিছু করতে হলে, আগে থেকে হিসাব করে দেখব, তাতে আমার কতটা লাভ হচ্ছে। নিজের লাভটা ষোলোআনা বুঝে নিতে বেশ শিখেছি আমি। কোনো এক কবি বলেছেন, 'নিজে যারে বড় বলে বড় সেই নয়/লোকে যারে বড় বলে বড় সেই হয়।' আজকের দিনে আমি ওই সূত্র পাল্টে দিয়েছি। আমি বলি, 'লোকে যারে বড় বলে বড় সেই নয়/নিজে যারে বড় বলে বড় সেই হয়।' আমি নিজেই নিজেকে বড় বলি, নিজেকে অন্যের চেয়ে উঁচুতে দেখি। আমার কাছাকাছি মাপের কে আর আছে! কেউ নেই। সবাইকে আমার পায়ের নিচে বসিয়ে রেখে আমি আনন্দ পাই। ওই যে এক গায়ক গেয়েছেন, 'সব তোমারই জন্য/ সব তোমারই জন্য'। আমি নিজের জন্য অমন একটা গান লেখাব ভেবেছি_'সব আমারই জন্য/ সব আমারই জন্য!' আমারই জন্য মানে একান্তই আমার জন্য। আমার জন্য মানে আমার পরিবারের জন্য। আমার সন্তানদের জন্য। আমি বলব বটে, 'তোমরা আমার ভাই।' মনে মনে এটাও বলব, কারো জন্য কিছু নাই। আমি থাকতে অন্যরা কেন পাবে! আগে আমার নিজের প্রয়োজন মিটবে, তারপর ছিটেফোঁটা কিছু থাকলে অন্যরা পাবে। সেটা তো আমার জন্যই পাবে। পেয়ে তারা ধন্য হবে। আমার নামেই ধন্য ধন্য করবে।
এই আমি নিয়ে টুকরো টুকরো বেশ কিছু মজার গল্প আছে। এক ভদ্রলোক কথায় কথায় আমি বলেন। নিজেকে সর্বত্র জাহির করেন। তো, একজন কোনো সাহায্যের আশায় গেলেন তাঁর কাছে। ভদ্রলোক সাহায্যপ্রার্থীকে পাঠিয়ে দিলেন উচ্চপদস্থ কোনো কর্মকর্তার কাছে। বলে দিলেন, তাঁর সামনে গিয়ে ফোন করার জন্য। সাহায্যপ্রার্থী গেলেন। কর্মকর্তার সামনে গিয়ে ফোন করলেন। ফোন ধরেই ভদ্রলোক কর্মকর্তাকে বললেন, আমি বলছি। ওর কাজটা করে দিলে খুশি হবো। কর্মকর্তা ধরেই নিলেন এই 'আমি' খুব ক্ষমতাবান। কাজটা করে দিয়ে ধন্য হয়ে গেলেন।
কোথাও আটকে গেলে এই লোকটি বলেন, জানেন আমি কে? এই 'আমি আমি' করতে করতেই অনেকে অনেক কিছু করে ফেলেন। আমি যখন পরাস্ত হই, তখন আমার, আমরা বা আমাদের। আমার ভাই, আমার মামা, আমার ভাগ্নে, আমার লোক, আমার দল ইত্যাদি। আমি ছেড়ে এখন আমার নিয়ে পড়া যাক (এখানেও তো নেপথ্যে আমি!)। পুরাণের গল্প।
রাম-রাবণের গল্প তো সবারই জানা আছে। বনবাসে গিয়েছিলেন রাম। সেখানে রাবণ সীতাকে হরণ করেছিলেন। বানর সেনাদের সহায়তায় সেখান থেকে তাঁকে উদ্ধার করতে যান রাম-লক্ষ্মণ। সে এক ভীষণ লড়াই বটে। সে লড়াইয়ে সোনার লঙ্কা পুড়ে ছারখার। রাবণ বধ হলো। হলো সীতা উদ্ধার। পতিপ্রাণা সীতা ফিরলেন রামের কাছে। কেমন করে ফিরলেন? পুরাণ লিখছে, সীতা রামের কাছে ফিরে আসেন 'রাক্ষস-বাহিত শিবিকায়' বিভীষণের সঙ্গে। ওদিকে বনবাস শেষ হওয়ার পর নিজের রাজ্যে ফিরলেন রাম। তত দিনে রাজা দশরথ পরলোকে। ভরত 'দাদার খড়ম' সিংহাসনে রেখে রাজত্ব চালিয়ে নিচ্ছিলেন। এবার রামের পালা। সিংহাসনে বসতে হবে তাঁকে। কিন্তু...। এই এক কিন্তু সব হিসাব ওলটপালট করে দিল। কী হবে? অগি্নপরীক্ষা দিতে হবে সীতাকে। কেন? দীর্ঘদিন তিনি রাবণপুরীতে অবস্থান করেছেন। ফিরেছেন বিভীষণের সঙ্গে। প্রজাদের পুরুষ মনে তো সীতার সতীত্ব নিয়ে সন্দেহ দেখা দিতেই পারে! রামচন্দ্র নিজেও যে একজন পুরুষ, সে কথা এখানে স্মরণ করিয়ে দেওয়া বাহুল্য। ব্যাপারটা মোটেও ভালোভাবে নেননি সীতা। ব্যাপারটা তাঁর জন্য অপমানজনক মনে হলো। আগুনে আত্মাহুতি দেবেন ভেবেছিলেন। সে আমলে নাকি এমনটিই চল ছিল। সতীত্বের পরীক্ষা নাকি দিতে হতো অগি্নপরীক্ষার মাধ্যমে। যাহোক প্রজাদের সামনে আগুনে প্রবেশ করলেন সীতা। সেখানে আগে থেকেই ছিলেন অগি্নদেব। তিনি তাঁকে আগুন থেকে তুলে এনে রামের হাতে অর্পণ করলেন। অগি্নপরীক্ষায় সীতার সতীত্ব প্রমাণিত হলো। সবার মনের সন্দেহ দূর হলো। সীতা তখন রাগে রীতিমতো কাঁপছেন। রাম তাঁকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে আস্তে করে নাকি বলেছিলেন, 'আমি এটা চাইনি। কিন্তু আমার প্রজাদের মুখের দিকে তাকিয়ে আমাকে এটা করতে হয়েছে। কেবল প্রজাদের বিশ্বাস ফিরে পেতেই এটা করেছি আমি। আমার পরিবারের জন্যই এটা করেছি আমি।'
না, শুধু নিজের কাছেই পরিষ্কার হলো না, আমি কে। কী করছি, কেন করছি, কার স্বার্থে করছি? শুধু এটুকুই জানি, আমি নিজেকে খুব শক্তিমান মনে করছি। আসলেই কী আমি বিপুল শক্তির অধিকারী?

লেখক : সাংবাদিক
habib.alihabib@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.