তলব না পালে আকাল লাইগবেক’-নন্দরানী চা-বাগানে শ্রমিকদের আকুতি by উজ্জ্বল মেহেদী ও মুজিবুর রহমান

মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার নন্দরানী চা-বাগানের শ্রমিক সমীরণ গড়। স্ত্রীসহ শ্রমিকের কাজ করেন ওই বাগানে। তাঁদের রোজগারে চলে দুই সন্তানের পরিবার। চা-বাগানে সপ্তাহে এক দিন মজুরি দেওয়ার ‘তলব’ প্রথায় অভ্যস্ত এই দম্পতি তিন দিন ধরে কর্মহীন।


কাজ না করলে মজুরি মিলবে না, এই আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন সমীরণ। বললেন, ‘তিন দিন তো কাম না কইরেই গেল। এই বুধবার তলব না পালে আকাল লাইগবেক!’
শুধু সমীরণ নয়, গতকাল দুপুরে নন্দরানী চা-বাগানে গেলে নারী-পুরুষ সব শ্রমিকের মুখে অনেকটা আহাজারির মতো ‘আকাল’ শব্দ শোনা গেছে।
গত শুক্রবার ওই বাগানের দখলদারি নিয়ে দুই পক্ষের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে দুজন নিহত হওয়ার পর জারি করা ১৪৪ ধারা বহাল আছে। বাগানের সব কার্যক্রম বন্ধ। কর্মরত চা-শ্রমিকেরা জীবনে প্রথমবারের মতো কাটাচ্ছেন বেকার সময়।
বাগানের পঞ্চায়েতপ্রধান উত্তম হাজরা জানালেন, সংঘর্ষের পর থেকে পুলিশ ও প্রশাসন তাঁদের নিরাপত্তা দিচ্ছে। তবু শ্রমিকেরা আতঙ্কে আছেন।
এ নিরাপত্তায় তাঁদের পেট চলবে না জানিয়ে উত্তম বলেন, ‘চা-বাগানে দৈনিক মজুরিভিত্তিক কাজ চললেও সপ্তাহে এক দিন বুধবার মজুরি দেওয়া হয়। ওই দিন তাঁদের তলব করে বাগান কর্তৃপক্ষ মজুরি দেয় বলে চা-পল্লিতে দিনটি ‘তলব’ বলে পরিচিত।
নন্দরানী চা-বাগানের শ্রমিকেরা জানান, বাগানে বংশপরম্পরায় সাত শতাধিক চা-শ্রমিক কাজ করছেন। এর মধ্যে স্থায়ী শ্রমিক ৩৫০ জন। অন্যরা অস্থায়ী। এই শ্রমিকেরা পরিবার নিয়ে চা-বাগান এলাকায় থাকেন। সংঘর্ষের কারণে গত শুক্রবার কাজ হয়নি। পরদিন শনিবার সকালে শ্রমিকেরা কাজে গেলে পুলিশ ফিরিয়ে দেয়।
চা-পল্লিতে মোট দুই শতাধিক পরিবার রয়েছে জানিয়ে উত্তম বলেন, ‘আমরা কামলা লাগি (মজুর)। কাম ছাড়া নাই চলে। কোম্পানি (মালিক) কে হবেক, ওইটা আমদের বিষয় নাই লাগে। আমরা কাম মাইনগছি (কাজ চাই)!’
পুলিশের অস্থায়ী দপ্তর: নন্দরানী চা-বাগানের ব্যবস্থাপকের কার্যালয়টি পুলিশের অস্থায়ী দপ্তর হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে। সেখানে ১৪ জন পুলিশ পালাক্রমে বাগান পাহারা দিচ্ছে। কর্তব্যরত উপপরিদর্শক (এসআই) মো. মানিক মিয়া বলেন, ‘মালিক দাবিদার কোনো পক্ষই বাগানে নেই। তবে দুই পক্ষই সংগঠিত হয়ে বাগানে ঢোকার চেষ্টা করছে। এ অবস্থায় চা-শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিয়ে আমাদের বেশি সতর্ক থাকতে হচ্ছে।’
যোগাযোগ করলে কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) প্রকাশ কান্তি চৌধুরী বলেন, পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত নন্দরানী চা-বাগানে ১৪৪ ধারা বলবৎ থাকবে।
বেকার শ্রমিকদের মজুরি প্রসঙ্গে ইউএনও প্রথম আলোকে বলেন, কাজ না হওয়া সত্ত্বেও মালিক দাবিদার দুই পক্ষই চা-শ্রমিকদের মজুরি দিতে চেয়েছে। তবে মালিকানার বিষয়টি সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত তা গ্রহণ করা হবে না বলে প্রশাসন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই অবস্থায় শ্রমিকদের অসহায়ত্ব বিবেচনা করে জেলা প্রশাসনের ত্রাণ তহবিল থেকে খাদ্যসহায়তা দেওয়ার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে।
ছাত্রলীগের সাবেক এক নেতা ডেকেছিলেন: নন্দরানী চা-বাগান দখল করতে গিয়ে নিহত কমলগঞ্জের ধলাইরপার গ্রামের জাহিদ মিয়ার (২৫) পরিবারে চলছে শোক। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম জাহিদকে হারিয়ে ১৬ দিনের শিশুকন্যা তাসনিমকে নিয়ে কাঁদছেন স্ত্রী রেজিয়া বেগম।
জাহিদের বোন নাসিমা বেগম ও ভাই খলিলুর রহমান বলেন, গ্রামের মোশাররফ (জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি কামাল আহমদের ব্যক্তিগত কর্মচারী) তাঁর বাড়িতে গরু শিরনির কথা বলে জাহিদকে নন্দরানী চা-বাগানসংলগ্ন মাঠে নিয়ে যান।
মামলা হয়নি: এদিকে শুক্রবারের ঘটনায় গতকাল পর্যন্ত কমলগঞ্জ থানায় কোনো মামলা হয়নি। এ ব্যাপারে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. নূরুল ইসলাম বলেন, ‘কোনো পক্ষ কোনো মামলা বা অভিযোগ দেয়নি। নিহতের পক্ষ থেকেও কেউ যোগাযোগ করেনি।’
এ ব্যাপারে নন্দরানী চা-বাগানের মালিক দাবিদার পক্ষে সাউথ এশিয়ান ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক জহির আহমদ চৌধুরী বলেন, বাগান কর্তৃপক্ষ আজ সোমবার আলোচনা করে মামলার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে।
পরিদর্শনে আ.লীগের কেন্দ্রীয় দল: চা-বাগান দখলে আওয়ামী লীগের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি তদন্ত করতে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের তিন সদস্যের একটি দল গতকাল মৌলভীবাজার যায়। তারা নন্দরানী চা-বাগান ও আশপাশের এলাকার লোকজন, আওয়ামী লীগ ও পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে।
তদন্ত দলের প্রধান কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মিসবাহউদ্দিন সিরাজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘চা-বাগানে প্রাণহানির ঘটনায় আমরা দুঃখিত ও মর্মাহত। কেন এমন ঘটনা ঘটল, বিষয়টি খোঁজ নিতেই আমরা সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে কথা বলেছি।’

No comments

Powered by Blogger.