খোলা হাওয়া-আমাদের নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম
কলেজে আমাদের বাংলা পড়াতেন সুধীর চন্দ্র পাল স্যার। খুব আবেগ দিয়ে রবীন্দ্রনাথের ‘হৈমন্তী’ গল্পের ওপর আলোচনা করতেন, মাঝেমধ্যে রসিকতাও করতেন। দু-একটি হাসির গল্প বলে ক্লাস-পালানোদ্যত ছোটখাটো দলটিকে ক্লাসে ধরে রাখতেন। তাঁর একটা গল্প ছিল—এক বস্তিবাসী এবং তাঁর বড়লোক ও অট্টালিকাবাসী প্রতিবেশীকে নিয়ে। বড়লোক প্রতিবেশীর ছেলের বিয়ে হচ্ছে, সবাই নিমন্ত্রণ পেয়েছেন। বস্তিবাসী ভাবলেন,
একটা যে উপহার দিতে হয়, তা তো জুতসই হতে হবে, বড়লোকের রুচি আর পছন্দমাফিক হতে হবে। অনেক কষ্টে জমানো সব টাকা খরচ করে তিনি একটা উপহার কিনলেন। বড়লোক উপহার পেয়ে খুশি হলেন এবং বস্তিবাসীকে ভোজে বসালেন। তবে বড়লোকদের টেবিলে নয়, গরিব-গুরবাদের জন্য পাতা চাটাইয়ে। বস্তিবাসী সে আয়োজনকে তথাস্তু মেনে ভোজে বসে পড়লেন।
এর কদিন পর বস্তিবাসীর মেয়ের বিয়ে। তিনি বড়লোককে নিমন্ত্রণ করলেন। বড়লোক নিমন্ত্রণ রক্ষা করলেন এবং বস্তিবাসীর রুচি ও পছন্দমতো একটা উপহার কিনলেন। উপহারটি ছিল একটি মোটা কাপড়ের মিলের শাড়ি। তিনি ভাবলেন, এর চেয়ে দামি কিছু যেহেতু বস্তিবাসীর মেয়েটি জীবনে চোখে দেখেনি, এটিই তার জন্য উপযুক্ত। তিনি বিয়েতে গেলেন, কিন্তু ভোজে বসলেন না, তার সামাজিক অবস্থান অনুযায়ী ভোজের ব্যবস্থা বেচারা বস্তিবাসী করতে পারেননি, সে জন্য।
সুধীর স্যার সর্বদা পান খেতেন এবং কথা বলার সময় পানের পিকের ছোটখাটো একটা ফোয়ারা ছুটত সামনের দু-তিন বেঞ্চের দিকে, যেগুলোতে মেয়েরা বসত। গল্প বলে স্যার হাসছেন দেখে পিক-দুর্গত একটি মেয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘স্যার, এখানে হাসির কী?’ স্যার চোখ বন্ধ করে বলেছিলেন, ‘বোকারাম, সব হাসি আনন্দের নয়, কিছু হাসি আছে কষ্টের। উপহার কিনতে বস্তিবাসীর এক মাসের উপার্জন চলে গেল, অথচ বড়লোকের এক সকালের নাশতার পয়সাও খরচ হলো না সেই মিলের শাড়িটা কিনতে। বুঝতে পারছ না, হাসিটা কোথায়?’
স্যারের ব্যাখ্যার পর মেয়েটি হেসেছিল কি না—কষ্টের হাসি হলেও—তা দেখার জন্য অবশ্য ক্লাস-পালানো দলটি বসে ছিল না। জানালার পাশে গাছের ডালগুলো যদি একটা মইয়ের সুবিধা নিয়ে হাজির হয়, তাহলে ক্যানটিনের পুরি-চা থেকে বঞ্চিত থাকে কোন বোকারাম?
গত মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বাংলাদেশ সফরে এলে সুধীর স্যারের গল্পটা আমার নতুন করে মনে পড়ল। এবং আমি কষ্টের হাসিটা এতকাল পর আরেকবার হাসলাম। কিছুদিন আগে দিল্লি-আগ্রায় একটা সেমিনারে গিয়ে দ্বিতীয়বার হাসলাম। তবে ঈশপের গল্পে যেমন, সুধীর স্যারের গল্পগুলোতেও একটা যে নীতিকথা থাকত, তা মনে করে কিছুটা স্বস্তি পেলাম। ওই বস্তিবাসীর গল্পের নীতিকথাটা আমরা নিজেদের মতো ব্যাখ্যা করে নিয়েছিলাম। আমার কাছে মনে হয়েছিল, এটি হচ্ছে ‘বড়লোক প্রতিবেশীর সঙ্গে আত্মসম্মান নিয়ে চলা উচিত।’ আপনারাও যে যাঁর মতো এই নীতিবাক্যের ব্যাখ্যা করে নিতে পারেন।
২.
ড. মনমোহন সিংয়ের সফরের আগে-পরে আমাদের মিডিয়ায় যে রকম তোলপাড় হয়েছে, প্রতিদিন সংবাদপত্রের প্রথম পৃষ্ঠার অর্ধেকজুড়ে এ নিয়ে খবর-প্রতিবেদন মন্তব্য প্রকাশিত হয়েছে, যে শত শত ঘণ্টা টক শো হয়েছে টিভিতে, সেসব দেখে-শুনে আমার কেন জানি মনে হয়েছে, আমাদের মনোবৃত্তি রয়ে গেছে ওই দরিদ্র বস্তিবাসীর মতো। ভারত আমাদের বন্ধু; আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান আমরা জাতি হিসেবে আজীবন কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণে রাখব—এতে কোনো সন্দেহ নেই এবং এ ব্যাপারে কারও দ্বিমত থাকাও উচিত নয়। কিন্তু গত ৪০ বছরে ভারতের রাজনীতিতে অনেক পরিবর্তন এসেছে। ভারত আঞ্চলিক শক্তি থেকে বৈশ্বিক একটি শক্তিতে পরিণত হতে যাচ্ছে, ভারতে বাম রাজনীতি প্রায় বিদায় নিচ্ছে, হিন্দুত্ববাদীদের উত্থান হয়েছে। পাকিস্তান রাষ্ট্র বদলেছে এই ৪০ বছরে, গণতন্ত্রের দিকে যাত্রা করতে গিয়ে দেশটি দ্রুতই পথচ্যুত হয়েছে। জেনারেল জিয়াউল হক একে এক মৌলবাদী দেশে পরিণত করেছেন। এখন পাকিস্তান একটি প্রায়-ব্যর্থ রাষ্ট্র; এর মানসিকতা নিয়ন্ত্রণ করছে তালেবান মতাদর্শ।
বাংলাদেশও পাল্টেছে। গণতন্ত্র থেকে স্বৈরতন্ত্রের গোলকধাঁধায় পথ হারিয়ে আবার গণতন্ত্রে দেশটি প্রত্যাবর্তন করেছে, যদিও স্বৈরতন্ত্রের মেজাজ বেশ ভালোভাবেই জেঁকে বসেছে এই গণতন্ত্রে। তার পরও বাংলাদেশ কোনো ব্যর্থ রাষ্ট্র নয়। বরং এর বীর কৃষকেরা, এর পরিশ্রমী শ্রমিকেরা, প্রবাসে কর্মরত এর কষ্টসহিষ্ণু অভিবাসী ও শ্রমজীবীরা এর অর্থনীতি সচল রেখেছেন। এ দেশের সামাজিক শক্তি এখনো উগ্র পন্থা ও মৌলবাদ থেকে একে সুরক্ষা দিয়ে চলেছে। এখন এই ২০১১ সালে প্রতিবেশীদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের তাই নতুন সমীকরণ প্রয়োজন এবং তা হতে হবে সমতা, মর্যাদা ও আত্মসম্মানের ভিত্তিতে। কোনো একতরফা সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী হয় না, কোনো এক পক্ষের তাচ্ছিল্যের মনোভাব বন্ধুত্বকে গতিশীল করে না। উল্টোটিই হয় বরং।
ড. মনমোহন সিং আসবেন এবং তিস্তা চুক্তি হবে; চুক্তিতে বাংলাদেশের স্বার্থরক্ষা হবে, একই সঙ্গে ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি ও ট্রানজিট নিয়েও সমঝোতা স্বাক্ষর হবে—এসব কথা শুনে শুনে আমাদের ধারণা হয়েছিল, অন্তত তিস্তা চুক্তিটি বোধহয় প্রায় পনেরো আনা হয়েই গেছে। শেষ মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ক্ষমতা দেখিয়ে চুক্তিকে, কলকাতার পত্রিকার ভাষায়, ‘তিস্তার জলে ডোবালেন।’ মমতার শেষ মুহূর্তের এই উল্টোযাত্রার প্রভাব পড়ল ড. সিংয়ের ভ্রমণে। মমতা সঙ্গে এলেন না—সে না-হয় বোঝা গেল। কিন্তু ভারতের পানিসম্পদমন্ত্রী? তিনি কেন এলেন না এবং এসে বিষয়টা ব্যাখ্যা করলেন না?
তিনি তো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নন, ড. সিংয়ের মন্ত্রিসভার সদস্য। তাহলে যদি ভারতের পানিসম্পদমন্ত্রী না-ই এলেন, আমাদের পানিসম্পদমন্ত্রী কেন, দু-এক পত্রিকার ভাষায় ‘উৎফুল্ল মেজাজে’ ড. সিংয়ের অভ্যর্থনায় শামিল হলেন? কোন আশায়? তিনি যদি না যেতেন, তাহলে ভারতকে একটা ক্ষুদ্র বার্তা আমরা হয়তো পাঠাতে পারতাম এবং তা হতো আত্মসম্মানের। মমতা যা করলেন, তাঁকে কূটনৈতিক ভাষায় অনেকভাবে বর্ণনা করা যায়, কিন্তু সোজা কথায়, উনি বাংলাদেশকে তাচ্ছিল্য করলেন। ড. সিং চলে যাওয়ার পর যেভাবে গোটা বিষয় ব্যাখ্যা করলেন সরকারের উপদেষ্টা ও মন্ত্রীরা, তাতে ওই বস্তিবাসীর দৈন্য ও অসহায়তাই ফুটে উঠল। এমনটাও বলা হলো—মমতার সঙ্গে কথা হবে, তাঁকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে রাজি করানো হবে।
এ কথাটা যাঁরা বলেন, তাঁরা গত কয়েক বছরের পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির খবর রাখেন কি না সন্দেহ। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের ঘটনাগুলো পুঁজি করে, অন্য অনেক পুঁজির সঙ্গে বামদের সিংহাসন যেভাবে নিজের করে নিলেন মমতা, তাতে বাংলাদেশকে তাঁর ন্যায্য পানি দিয়ে তিনি উত্তরবঙ্গের ভোট যে কিছুতেই হারাবেন না, এ কথাটা শিলিগুড়ির এক কলেজছাত্রও জানে। উত্তরবঙ্গে তৃণমূলের অবস্থান কিছুটা দুর্বল। মমতার তিস্তা চুক্তি বিরোধিতায় ওই দুর্বলতা অনেকটাই কেটেছে। এখন কাগজে দেখছি, বাম দলগুলোও চুক্তির বিরোধী। যেখানে সরকার ও বিরোধী দল একটি বৃহত্তর (প্রদেশভিত্তিক) ইস্যুতে এক হয়ে যায়, যে অভিজ্ঞতা বাংলাদেশে আমাদের একবারই হয়েছে এবং আরও ১০-২০ বছরে যে আরেকবার হবে, সে আশা দুরাশা—তখন কেন্দ্রের সরকারের হাত গুটিয়ে বসে থাকা ছাড়া করার বেশি কিছু থাকে না।
আমার সংক্ষিপ্ত আগ্রা-দিল্লি সফরে আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে যতগুলো ইংরেজি-বাংলা কাগজ পাওয়া যায়, পড়েছি। কিন্তু বাংলাদেশের কোনো প্রসঙ্গ কোথাও তেমন চোখে পড়েনি। পাকিস্তান আছে, শ্রীলঙ্কা আছে—বাংলাদেশ নেই। ভারতের আকাশে বাংলাদেশের কোনো চ্যানেল নেই, যদিও নেপালের আছে। বাংলাদেশ সম্পর্কে ভারতের সাম্প্রতিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিমাপ করাটা নিশ্চয় কঠিন—তার নিশ্চয় অনেক সূচক রয়েছে, কিন্তু মিডিয়া যদি একটি নির্ভরযোগ্য সূচক হয়, তাহলে তা এককথায় হচ্ছে: উদাসীনতা। তবে বাংলাদেশ যে কলকাতার কাগজে ১০০ ভাগ অনুপস্থিত, তা নয়। সেগুলোতে মাঝেমধ্যে ছিটেফোঁটা খবর ছাপা হয়। যেমন—কলকাতার স্টেটসম্যান ৪ অক্টোবর লিখল, পূজা উপলক্ষে বাংলাদেশ থেকে ৩৫০ টন ইলিশ যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে। সংবাদটা পড়ে আমার মন খারাপ হয়ে গেল। এ যদি মমতার মন গলানোর জন্য ইলিশ-কূটনীতির একটি চাল হয়, তাহলে বলব, এটি ব্যর্থ হবে। মমতা দায়বদ্ধতা তাঁর রাজ্যের মানুষের কাছে, তাঁর মন গলানোও সহজ নয়। এই কূটনীতি মোটেও আত্মসম্মানের নয়। আমার বরং সুধীর স্যারের গল্প থেকে একটা তুলনা মনে আসে—সেই বস্তিবাসীটি বড়লোক দালানবাসীর কাছ থেকে কিছু আদায়ের জন্য তাঁর এক-আঙুলের সমান জমিতে ফলানো লালশাক নিয়ে গেছেন বড়লোকের কাছে, আর বড়লোক বাড়ির দারোয়ানকে বলছেন, ‘দুটো টাকা ওকে দিয়ে শাকটা রেখে দাও। আর লোকটাকে বললেন, সে যা চায়, আমি দেখব।’
কাগজে আরও দেখলাম, ছয়টি ভারতীয় জাহাজ আশুগঞ্জ নদীবন্দরে নোঙর করে আগরতলার জন্য ইস্পাত ও অন্যান্য জিনিস খালাস করছে। এর একটির নাম ‘হোমি ভাবা’! জাহাজটির নামকরণ নিশ্চয় পণ্ডিত হোমি ভাবার নামে হয়নি, যিনি nation-এর dissemination নিয়ে অনেক তত্ত্বকথা লিখেছেন। তবে ব্যাপারটাতে যে একটা আয়রনি আছে, তা ভাবার পাঠকদের নিশ্চয় চক্ষু এড়ায়নি। প্রশ্ন হচ্ছে, জাহাজগুলো কি একবারই এল, নাকি এই আগমন নিয়মিত ট্রানজিটের অংশ? এ জন্য তারা কি প্রয়োজনীয় ফি দিয়েছে, নাকি আমরা ভদ্রতা দেখিয়ে তা মাফ করে দিয়েছি? তবে এসব জাহাজকে আমাদের নদীপথ ব্যবহার করতে দিয়ে যদি আমরা ভাবি, তিস্তা চুক্তির পথে এক ধাপ এগোনো গেল, তাহলে তা খুব সুচিন্তিত ভাবনা হবে না। হোমি ভাবাই আমাদের জানান, আধুনিক ন্যাশন স্টেটের ক্ষমতা-চিন্তার কাছে এসব উদ্যোগের খুব একটা মূল্য নেই।
৩.
আমি দেখেছি, আত্মসম্মান নিয়ে কেউ উঠে দাঁড়ালে মানুষ তাকে সমীহ করে। ভারত যে আজ বিশ্বের কাছে সমীহ পাচ্ছে, তা তার অর্থনীতি, শিক্ষা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে নানা অর্জন ও তার আত্মসম্মানের জন্য। আমরা হয়তো অনেক ক্ষেত্রে ভারত থেকে পিছিয়ে আছি, কিন্তু আমাদের দেশটা তো সম্ভাবনাময়। আশপাশে তাকান—দক্ষিণ কোরিয়া অথবা মালয়েশিয়া, কী ছিল ষাটের দশকে? অথবা আশির দশকে ভিয়েতনাম? এখন তারা কোথায় গেছে? যেখানে গেছে, সেখানে আবার রাস্তাটা আমাদের জনগণ তৈরি করতে প্রস্তুত, কিন্তু তাতে নানা সময়ে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন আমাদের দলবাজ রাজনীতিবিদ, স্বৈরশাসক, এক-এগারোর পর দেশের ‘হাল ধরা’ সামরিক-বেসামরিক নেতা ও পার্টটাইম পারফরমাররা। যদি সবাই মিলে একজোট হতে পারতাম আমরা, যেমন মমতা ও তাঁর বিরোধীরা হয়েছেন তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে, তাহলে আমরা কবেই চাঁদে পৌঁছে যেতাম। তবে যদি এ বছরই এ প্রত্যয়টি আমরা নিজেদের ভেতর তৈরি করতে পারি, তাহলে ১০-২০ বছরে আমরা অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারি।
তখন বাংলাদেশের সংবাদ আগ্রহ নিয়ে ছাপবে ভারতীয় পত্রিকা, পুনে অথবা পণ্ডিচেরিতে বসেও বাংলাদেশের টিভি চ্যানেল আপনারা দেখতে পারবেন এবং তিস্তার ন্যায়ভিত্তিক চুক্তির জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই দূত পাঠাবেন আমাদের কাছে।
পানি নিচ থেকে ওপরে যায় না। আমরা সীমান্তের বাইরে উজানে যেতে পারব না, কিন্তু অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদিতে উচ্চাসনে বসলে আলোচনা হবে সমানে সমানে।
কিন্তু আত্মসম্মান না থাকলে ওই উচ্চাসন কেন, তার পায়াটার কাছেও তো পৌঁছাতে পারব না।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
এর কদিন পর বস্তিবাসীর মেয়ের বিয়ে। তিনি বড়লোককে নিমন্ত্রণ করলেন। বড়লোক নিমন্ত্রণ রক্ষা করলেন এবং বস্তিবাসীর রুচি ও পছন্দমতো একটা উপহার কিনলেন। উপহারটি ছিল একটি মোটা কাপড়ের মিলের শাড়ি। তিনি ভাবলেন, এর চেয়ে দামি কিছু যেহেতু বস্তিবাসীর মেয়েটি জীবনে চোখে দেখেনি, এটিই তার জন্য উপযুক্ত। তিনি বিয়েতে গেলেন, কিন্তু ভোজে বসলেন না, তার সামাজিক অবস্থান অনুযায়ী ভোজের ব্যবস্থা বেচারা বস্তিবাসী করতে পারেননি, সে জন্য।
সুধীর স্যার সর্বদা পান খেতেন এবং কথা বলার সময় পানের পিকের ছোটখাটো একটা ফোয়ারা ছুটত সামনের দু-তিন বেঞ্চের দিকে, যেগুলোতে মেয়েরা বসত। গল্প বলে স্যার হাসছেন দেখে পিক-দুর্গত একটি মেয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘স্যার, এখানে হাসির কী?’ স্যার চোখ বন্ধ করে বলেছিলেন, ‘বোকারাম, সব হাসি আনন্দের নয়, কিছু হাসি আছে কষ্টের। উপহার কিনতে বস্তিবাসীর এক মাসের উপার্জন চলে গেল, অথচ বড়লোকের এক সকালের নাশতার পয়সাও খরচ হলো না সেই মিলের শাড়িটা কিনতে। বুঝতে পারছ না, হাসিটা কোথায়?’
স্যারের ব্যাখ্যার পর মেয়েটি হেসেছিল কি না—কষ্টের হাসি হলেও—তা দেখার জন্য অবশ্য ক্লাস-পালানো দলটি বসে ছিল না। জানালার পাশে গাছের ডালগুলো যদি একটা মইয়ের সুবিধা নিয়ে হাজির হয়, তাহলে ক্যানটিনের পুরি-চা থেকে বঞ্চিত থাকে কোন বোকারাম?
গত মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বাংলাদেশ সফরে এলে সুধীর স্যারের গল্পটা আমার নতুন করে মনে পড়ল। এবং আমি কষ্টের হাসিটা এতকাল পর আরেকবার হাসলাম। কিছুদিন আগে দিল্লি-আগ্রায় একটা সেমিনারে গিয়ে দ্বিতীয়বার হাসলাম। তবে ঈশপের গল্পে যেমন, সুধীর স্যারের গল্পগুলোতেও একটা যে নীতিকথা থাকত, তা মনে করে কিছুটা স্বস্তি পেলাম। ওই বস্তিবাসীর গল্পের নীতিকথাটা আমরা নিজেদের মতো ব্যাখ্যা করে নিয়েছিলাম। আমার কাছে মনে হয়েছিল, এটি হচ্ছে ‘বড়লোক প্রতিবেশীর সঙ্গে আত্মসম্মান নিয়ে চলা উচিত।’ আপনারাও যে যাঁর মতো এই নীতিবাক্যের ব্যাখ্যা করে নিতে পারেন।
২.
ড. মনমোহন সিংয়ের সফরের আগে-পরে আমাদের মিডিয়ায় যে রকম তোলপাড় হয়েছে, প্রতিদিন সংবাদপত্রের প্রথম পৃষ্ঠার অর্ধেকজুড়ে এ নিয়ে খবর-প্রতিবেদন মন্তব্য প্রকাশিত হয়েছে, যে শত শত ঘণ্টা টক শো হয়েছে টিভিতে, সেসব দেখে-শুনে আমার কেন জানি মনে হয়েছে, আমাদের মনোবৃত্তি রয়ে গেছে ওই দরিদ্র বস্তিবাসীর মতো। ভারত আমাদের বন্ধু; আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান আমরা জাতি হিসেবে আজীবন কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণে রাখব—এতে কোনো সন্দেহ নেই এবং এ ব্যাপারে কারও দ্বিমত থাকাও উচিত নয়। কিন্তু গত ৪০ বছরে ভারতের রাজনীতিতে অনেক পরিবর্তন এসেছে। ভারত আঞ্চলিক শক্তি থেকে বৈশ্বিক একটি শক্তিতে পরিণত হতে যাচ্ছে, ভারতে বাম রাজনীতি প্রায় বিদায় নিচ্ছে, হিন্দুত্ববাদীদের উত্থান হয়েছে। পাকিস্তান রাষ্ট্র বদলেছে এই ৪০ বছরে, গণতন্ত্রের দিকে যাত্রা করতে গিয়ে দেশটি দ্রুতই পথচ্যুত হয়েছে। জেনারেল জিয়াউল হক একে এক মৌলবাদী দেশে পরিণত করেছেন। এখন পাকিস্তান একটি প্রায়-ব্যর্থ রাষ্ট্র; এর মানসিকতা নিয়ন্ত্রণ করছে তালেবান মতাদর্শ।
বাংলাদেশও পাল্টেছে। গণতন্ত্র থেকে স্বৈরতন্ত্রের গোলকধাঁধায় পথ হারিয়ে আবার গণতন্ত্রে দেশটি প্রত্যাবর্তন করেছে, যদিও স্বৈরতন্ত্রের মেজাজ বেশ ভালোভাবেই জেঁকে বসেছে এই গণতন্ত্রে। তার পরও বাংলাদেশ কোনো ব্যর্থ রাষ্ট্র নয়। বরং এর বীর কৃষকেরা, এর পরিশ্রমী শ্রমিকেরা, প্রবাসে কর্মরত এর কষ্টসহিষ্ণু অভিবাসী ও শ্রমজীবীরা এর অর্থনীতি সচল রেখেছেন। এ দেশের সামাজিক শক্তি এখনো উগ্র পন্থা ও মৌলবাদ থেকে একে সুরক্ষা দিয়ে চলেছে। এখন এই ২০১১ সালে প্রতিবেশীদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের তাই নতুন সমীকরণ প্রয়োজন এবং তা হতে হবে সমতা, মর্যাদা ও আত্মসম্মানের ভিত্তিতে। কোনো একতরফা সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী হয় না, কোনো এক পক্ষের তাচ্ছিল্যের মনোভাব বন্ধুত্বকে গতিশীল করে না। উল্টোটিই হয় বরং।
ড. মনমোহন সিং আসবেন এবং তিস্তা চুক্তি হবে; চুক্তিতে বাংলাদেশের স্বার্থরক্ষা হবে, একই সঙ্গে ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি ও ট্রানজিট নিয়েও সমঝোতা স্বাক্ষর হবে—এসব কথা শুনে শুনে আমাদের ধারণা হয়েছিল, অন্তত তিস্তা চুক্তিটি বোধহয় প্রায় পনেরো আনা হয়েই গেছে। শেষ মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ক্ষমতা দেখিয়ে চুক্তিকে, কলকাতার পত্রিকার ভাষায়, ‘তিস্তার জলে ডোবালেন।’ মমতার শেষ মুহূর্তের এই উল্টোযাত্রার প্রভাব পড়ল ড. সিংয়ের ভ্রমণে। মমতা সঙ্গে এলেন না—সে না-হয় বোঝা গেল। কিন্তু ভারতের পানিসম্পদমন্ত্রী? তিনি কেন এলেন না এবং এসে বিষয়টা ব্যাখ্যা করলেন না?
তিনি তো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নন, ড. সিংয়ের মন্ত্রিসভার সদস্য। তাহলে যদি ভারতের পানিসম্পদমন্ত্রী না-ই এলেন, আমাদের পানিসম্পদমন্ত্রী কেন, দু-এক পত্রিকার ভাষায় ‘উৎফুল্ল মেজাজে’ ড. সিংয়ের অভ্যর্থনায় শামিল হলেন? কোন আশায়? তিনি যদি না যেতেন, তাহলে ভারতকে একটা ক্ষুদ্র বার্তা আমরা হয়তো পাঠাতে পারতাম এবং তা হতো আত্মসম্মানের। মমতা যা করলেন, তাঁকে কূটনৈতিক ভাষায় অনেকভাবে বর্ণনা করা যায়, কিন্তু সোজা কথায়, উনি বাংলাদেশকে তাচ্ছিল্য করলেন। ড. সিং চলে যাওয়ার পর যেভাবে গোটা বিষয় ব্যাখ্যা করলেন সরকারের উপদেষ্টা ও মন্ত্রীরা, তাতে ওই বস্তিবাসীর দৈন্য ও অসহায়তাই ফুটে উঠল। এমনটাও বলা হলো—মমতার সঙ্গে কথা হবে, তাঁকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে রাজি করানো হবে।
এ কথাটা যাঁরা বলেন, তাঁরা গত কয়েক বছরের পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির খবর রাখেন কি না সন্দেহ। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের ঘটনাগুলো পুঁজি করে, অন্য অনেক পুঁজির সঙ্গে বামদের সিংহাসন যেভাবে নিজের করে নিলেন মমতা, তাতে বাংলাদেশকে তাঁর ন্যায্য পানি দিয়ে তিনি উত্তরবঙ্গের ভোট যে কিছুতেই হারাবেন না, এ কথাটা শিলিগুড়ির এক কলেজছাত্রও জানে। উত্তরবঙ্গে তৃণমূলের অবস্থান কিছুটা দুর্বল। মমতার তিস্তা চুক্তি বিরোধিতায় ওই দুর্বলতা অনেকটাই কেটেছে। এখন কাগজে দেখছি, বাম দলগুলোও চুক্তির বিরোধী। যেখানে সরকার ও বিরোধী দল একটি বৃহত্তর (প্রদেশভিত্তিক) ইস্যুতে এক হয়ে যায়, যে অভিজ্ঞতা বাংলাদেশে আমাদের একবারই হয়েছে এবং আরও ১০-২০ বছরে যে আরেকবার হবে, সে আশা দুরাশা—তখন কেন্দ্রের সরকারের হাত গুটিয়ে বসে থাকা ছাড়া করার বেশি কিছু থাকে না।
আমার সংক্ষিপ্ত আগ্রা-দিল্লি সফরে আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে যতগুলো ইংরেজি-বাংলা কাগজ পাওয়া যায়, পড়েছি। কিন্তু বাংলাদেশের কোনো প্রসঙ্গ কোথাও তেমন চোখে পড়েনি। পাকিস্তান আছে, শ্রীলঙ্কা আছে—বাংলাদেশ নেই। ভারতের আকাশে বাংলাদেশের কোনো চ্যানেল নেই, যদিও নেপালের আছে। বাংলাদেশ সম্পর্কে ভারতের সাম্প্রতিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিমাপ করাটা নিশ্চয় কঠিন—তার নিশ্চয় অনেক সূচক রয়েছে, কিন্তু মিডিয়া যদি একটি নির্ভরযোগ্য সূচক হয়, তাহলে তা এককথায় হচ্ছে: উদাসীনতা। তবে বাংলাদেশ যে কলকাতার কাগজে ১০০ ভাগ অনুপস্থিত, তা নয়। সেগুলোতে মাঝেমধ্যে ছিটেফোঁটা খবর ছাপা হয়। যেমন—কলকাতার স্টেটসম্যান ৪ অক্টোবর লিখল, পূজা উপলক্ষে বাংলাদেশ থেকে ৩৫০ টন ইলিশ যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে। সংবাদটা পড়ে আমার মন খারাপ হয়ে গেল। এ যদি মমতার মন গলানোর জন্য ইলিশ-কূটনীতির একটি চাল হয়, তাহলে বলব, এটি ব্যর্থ হবে। মমতা দায়বদ্ধতা তাঁর রাজ্যের মানুষের কাছে, তাঁর মন গলানোও সহজ নয়। এই কূটনীতি মোটেও আত্মসম্মানের নয়। আমার বরং সুধীর স্যারের গল্প থেকে একটা তুলনা মনে আসে—সেই বস্তিবাসীটি বড়লোক দালানবাসীর কাছ থেকে কিছু আদায়ের জন্য তাঁর এক-আঙুলের সমান জমিতে ফলানো লালশাক নিয়ে গেছেন বড়লোকের কাছে, আর বড়লোক বাড়ির দারোয়ানকে বলছেন, ‘দুটো টাকা ওকে দিয়ে শাকটা রেখে দাও। আর লোকটাকে বললেন, সে যা চায়, আমি দেখব।’
কাগজে আরও দেখলাম, ছয়টি ভারতীয় জাহাজ আশুগঞ্জ নদীবন্দরে নোঙর করে আগরতলার জন্য ইস্পাত ও অন্যান্য জিনিস খালাস করছে। এর একটির নাম ‘হোমি ভাবা’! জাহাজটির নামকরণ নিশ্চয় পণ্ডিত হোমি ভাবার নামে হয়নি, যিনি nation-এর dissemination নিয়ে অনেক তত্ত্বকথা লিখেছেন। তবে ব্যাপারটাতে যে একটা আয়রনি আছে, তা ভাবার পাঠকদের নিশ্চয় চক্ষু এড়ায়নি। প্রশ্ন হচ্ছে, জাহাজগুলো কি একবারই এল, নাকি এই আগমন নিয়মিত ট্রানজিটের অংশ? এ জন্য তারা কি প্রয়োজনীয় ফি দিয়েছে, নাকি আমরা ভদ্রতা দেখিয়ে তা মাফ করে দিয়েছি? তবে এসব জাহাজকে আমাদের নদীপথ ব্যবহার করতে দিয়ে যদি আমরা ভাবি, তিস্তা চুক্তির পথে এক ধাপ এগোনো গেল, তাহলে তা খুব সুচিন্তিত ভাবনা হবে না। হোমি ভাবাই আমাদের জানান, আধুনিক ন্যাশন স্টেটের ক্ষমতা-চিন্তার কাছে এসব উদ্যোগের খুব একটা মূল্য নেই।
৩.
আমি দেখেছি, আত্মসম্মান নিয়ে কেউ উঠে দাঁড়ালে মানুষ তাকে সমীহ করে। ভারত যে আজ বিশ্বের কাছে সমীহ পাচ্ছে, তা তার অর্থনীতি, শিক্ষা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে নানা অর্জন ও তার আত্মসম্মানের জন্য। আমরা হয়তো অনেক ক্ষেত্রে ভারত থেকে পিছিয়ে আছি, কিন্তু আমাদের দেশটা তো সম্ভাবনাময়। আশপাশে তাকান—দক্ষিণ কোরিয়া অথবা মালয়েশিয়া, কী ছিল ষাটের দশকে? অথবা আশির দশকে ভিয়েতনাম? এখন তারা কোথায় গেছে? যেখানে গেছে, সেখানে আবার রাস্তাটা আমাদের জনগণ তৈরি করতে প্রস্তুত, কিন্তু তাতে নানা সময়ে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন আমাদের দলবাজ রাজনীতিবিদ, স্বৈরশাসক, এক-এগারোর পর দেশের ‘হাল ধরা’ সামরিক-বেসামরিক নেতা ও পার্টটাইম পারফরমাররা। যদি সবাই মিলে একজোট হতে পারতাম আমরা, যেমন মমতা ও তাঁর বিরোধীরা হয়েছেন তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে, তাহলে আমরা কবেই চাঁদে পৌঁছে যেতাম। তবে যদি এ বছরই এ প্রত্যয়টি আমরা নিজেদের ভেতর তৈরি করতে পারি, তাহলে ১০-২০ বছরে আমরা অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারি।
তখন বাংলাদেশের সংবাদ আগ্রহ নিয়ে ছাপবে ভারতীয় পত্রিকা, পুনে অথবা পণ্ডিচেরিতে বসেও বাংলাদেশের টিভি চ্যানেল আপনারা দেখতে পারবেন এবং তিস্তার ন্যায়ভিত্তিক চুক্তির জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই দূত পাঠাবেন আমাদের কাছে।
পানি নিচ থেকে ওপরে যায় না। আমরা সীমান্তের বাইরে উজানে যেতে পারব না, কিন্তু অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদিতে উচ্চাসনে বসলে আলোচনা হবে সমানে সমানে।
কিন্তু আত্মসম্মান না থাকলে ওই উচ্চাসন কেন, তার পায়াটার কাছেও তো পৌঁছাতে পারব না।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments