শ্রদ্ধাঞ্জলি-নানকার বিদ্রোহের বীর

‘নান’ শব্দের অর্থ রুটি তথা খাদ্য এবং ‘কার’ হচ্ছে কাজ। খাদ্যের বিনিময়ে যাঁদের দিয়ে কাজ করানো হতো, তাঁরাই সামন্ত সমাজে নানকার নামে পরিচিত ছিলেন। নানকার একটি বর্বর শ্রম শোষণের প্রথা, অনেকটা মধ্যযুগীয় দাস প্রথার সঙ্গে তুলনীয়। প্রধানত সিলেটের বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ অঞ্চলে এই সামন্ত প্রথাটি প্রচলিত ছিল।


সামন্ত ভূ-মালিকদের সিলেট অঞ্চলে মিরাশদার এবং বড় মিরাশদারকে জমিদার বলা হতো। জমিদার বা মিরাশদারবাড়ির নিকটবর্তী স্থানে কিছু প্রজার বসবাসের ব্যবস্থা করা হতো, তাঁরাই ছিলেন নানকার প্রজা। জমিদারবাড়ির সার্বক্ষণিক গৃহস্থালি কাজে নিয়োজিত থাকতে হতো তাঁদের। এমনকি গভীর রাতেও নারী-পুরুষনির্বিশেষে জমিদারবাড়ির ডাকে ত্বরিত সাড়া না দিলে নেমে আসত অসহনীয় নির্যাতন। এমনই এক মানবতাবিরোধী নানকার প্রথার সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে যাঁর নাম, সেই অজয় ভট্টাচার্য কিন্তু ১৯১৪ সালের ১০ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেছিলেন এক মিরাশদার কুলীন পরিবারে। নানকার প্রথার কেন্দ্রভূমি বিয়ানীবাজারের লাউতা গ্রাম হচ্ছে কমরেড অজয় ভট্টাচার্যের জন্মভূমি। ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সমর্থক পিতা উপেন্দ্র কুমার ভট্টাচার্যের পরিবারে চার ভাই ও পাঁচ বোনের দ্বিতীয় হিসেবে বেড়ে উঠতে থাকেন অজয় ভট্টাচার্য। ১৯৩৭ সালে আসামের করিমগঞ্জ পাবলিক হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক এবং ১৯৩৯ সালে কাছাড় জেলার শিলচর গুরুচরণ কলেজ থেকে আইএ পাস করে ১৯৪১ সালে তিনি বিএ ভর্তি হন সিলেটের এমসি কলেজে। অজয় ভট্টাচার্যের প্রাতিষ্ঠানিক জীবন এগিয়ে চলার সমান্তরালে মনের গভীরে বাসা বাঁধে বাম রাজনীতির আদর্শ, ঘৃণা করতে থাকেন নানকার প্রথাকে। স্কুলে থাকাবস্থায় ১৯৩৬ সালে সিলেটে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির গোড়াপত্তন হলে তিনি যোগ দেন সাম্যবাদী আন্দোলনে। পার্টি পরিচালিত সর্বভারতীয় স্টুডেন্টস ফেডারেশনের সুরমা উপত্যকা প্রাদেশিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক এবং একই সঙ্গে কাছাড় জেলা কৃষক সভার সহসাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি। ১৯৩৯-৪০ সালে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার দায়ে সিলেট কারাগারে বন্দী হন তিনি। ১৯৪০ সাল থেকে শুরু হয় তাঁর গোপন জীবন, যা অব্যাহত ছিল আমৃত্যু। ১৯৪৭-এর আগেই অজয় ভট্টাচার্য আত্মনিয়োগ করেন নানকার প্রজাদের সংগঠিত করতে এবং একাধিকবার গ্রেপ্তার হন ব্রিটিশ ভারতের নিরাপত্তা আইনে। দেশ বিভক্তির আগে ও পরে দুই ভাগে সংঘটিত হয় রক্তক্ষয়ী ঐতিহাসিক নানকার বিদ্রোহ, যার অন্যতম রূপকার হলেন কমরেড অজয় ভট্টাচার্য। পাকিস্তান সৃষ্টির পর কিছুটা বিরতিসহ ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৭ পর্যন্ত প্রায় ২০ বছর কারাগারে অন্তরীণ রাখা হয় এই বিপ্লবীকে। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার, রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগার, সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারসহ বিভিন্ন কারাগারে জীবনের মোট ২১ বছর অতিক্রম করেন তিনি। ১৯৬৭ সালে কমিউনিস্ট আন্দোলনের আন্তর্জাতিক বিতর্কে অংশ নিয়ে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির (এমএল) কেন্দ্রীয় সদস্য এবং পরে বাংলাদেশের বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির (এমএল) পলিটব্যুরো সদস্য নির্বাচিত হন। নানকার আন্দোলনের অভিজ্ঞতায় তিনি নানকার বিদ্রোহ নামে একটি ইতিহাসগ্রন্থ রচনা করেন, যার ভিত্তিতে মঞ্চস্থ হয় নানকার পালা নাটক। রাজনীতির পাশাপাশি সাহিত্য সৃষ্টিতেও অবদান রাখেন এই প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তি। তাঁর সাহিত্যকর্মে গল্পগ্রন্থ: নীড়, ইতিহাসের ছেঁড়া পাতা; উপন্যাস: এঘর ওঘর, অরণ্যানী, কুলিমেম, বাতাসীর মা, রজনগর, সুজন মাঝির ঘাট এবং ইতিহাসগ্রন্থ: নানকার বিদ্রোহ (১ম, ২য়, ৩য় খণ্ড) এবং অর্ধশতাব্দী আগে এ দেশে গণ-আন্দোলন কেমন ছিল উল্লেখযোগ্য। দীর্ঘ প্রায় ৬০ বছরের রাজনৈতিক জীবনের সায়াহ্নে ৮৬ বছর বয়সে ১৯৯৯ সালের ১৩ অক্টোবর প্রয়াত হন এই মহান বিপ্লবী বীর। আজ ২০১১ সালের ১৩ অক্টোবর মেহনতি মানুষের হূদয় থেকে কমরেড অজয় ভট্টাচার্যকে অকৃত্রিম শ্রদ্ধাঞ্জলি।
এমাদ উল্লাহ শহিদুল ইসলাম
সভাপতি, সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতি।

No comments

Powered by Blogger.