বৃত্তের ভেতর বৃত্ত-বাপেক্সকে শক্তিশালী করতে বাধা কোথায়? by দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু
বাপেক্স বাংলাদেশ সরকারের মালিকাধীন একটি প্রতিষ্ঠান। আমরা জানি, এই প্রতিষ্ঠানের কাজ হলো দেশের গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার এবং ভূগর্ভের গ্যাস উত্তোলন। কিন্তু বাপেক্সে অবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে-'ঢাল নেই, তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দার'-এর মতো। দীর্ঘদিন ধরে বিশেষজ্ঞ মহল থেকে এ প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করার কিংবা সক্ষমতা অর্জনের পথ বাতলে দেওয়া হলেও কোন কারণে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে উদাসীন, তা বলা মুশকিল।
যে লক্ষ্য-উদ্দেশ্যে বাপেঙ্ নামক প্রতিষ্ঠানটির জন্ম দেওয়া হয়েছিল, তা ভেস্তে গেছে-এমনটি বললে অত্যুক্তি হবে না। সরকারের দায়িত্বশীলরা (প্রায় সব সরকারেরই) অহরহ বলে আসছেন, এই কম্পানির গ্যাস উত্তোলনের সামর্থ্য নেই। তাই তাঁদের ভাষায়, গ্যাস উত্তোলনের জন্য পুরো ব্লক বিদেশি তেল-গ্যাস কম্পানির কাছে ইজারা দিতে হবে, নয়তো জয়েন্ট ভেঞ্চারের মাধ্যমে বাপেঙ্কে ১০ শতাংশ অংশ দিয়ে (এই অংশ নামমাত্র বললে অত্যুক্তি হবে না) বিদেশি কম্পানির মাধ্যমে গ্যাস উত্তোলন করতে হবে। এই যে জয়েন্ট ভেঞ্চারের কথা বলা হয়, এর রূপ সচেতনদের চেনা-জানা। কথিত জয়েন্ট ভেঞ্চারের নামে বিদেশি কম্পানিগুলো তাদের স্বার্থ হাসিল করছে এবং আমাদের সম্পদ নিয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ লাভের দিকটা তাদেরই পুষ্ট।
নাইকোর কথা ভুলে যাওয়ার বিষয় নয়। নাইকো এ দেশে বহু কেলেঙ্কারি করেছে এবং এ জন্য সম্প্রতি কম্পানিটিকে নিজ দেশের (কানাডা) আদালতের রায়ে বিপুল অঙ্কের ডলার জরিমানা গুনতে হয়েছে। বিষয়টির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বাংলাদেশ সরকারের তৎকালীন জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী গত বিএনপি সরকারের আমলে মন্ত্রিপরিষদ থেকে বাদ পড়েন। শুধু দামি গাড়িই নয়, কয়েক হাজার ডলার উৎকোচও তিনি গ্রহণ করেছিলেন। এই নীতিবিবর্জিত-অন্যায়-অবৈধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তিনি তাঁর সম্পৃক্ততার কথা বরাবরই অস্বীকার করে এলেও নাইকোর সিইও সে দেশের (কানাডা) আদালতের রায়ের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে বলেছেন, এমন অন্যায়ের বিরুদ্ধে গৃহীত ব্যবস্থার জন্য তাঁরা অখুশি নন। ওই রায়কে তাঁরা স্বাগত জানিয়েছেন এবং নিজেদের কৃতকর্মের দায়ও ঘাড়ে তুলে নিয়ে মিডিয়ায় অন্যায় স্বীকার করতে দ্বিধা করেননি। নাইকো আমাদের যে ক্ষতি করেছিল, সেই ক্ষতিপূরণ আদায়ের জন্য বাংলাদেশের আদালতে মামলা হলেও শেষ পর্যন্ত মামলাটি চলে যায় আন্তর্জাতিক বিরোধ নিষ্পত্তি ট্রাইব্যুনালে। এ নিয়েও নানা রকম কথা আছে। কিন্তু বর্তমানে মামলাটি কী অবস্থায় আছে, তা আমরা জানি না। সচেতন মহলের জানা আছে, ক্ষতিপূরণের অর্থ পাওয়ার আগ পর্যন্ত নাইকোকে গ্যাস বিক্রির বিপরীতে অর্থ প্রদানের ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। কিন্তু পরে জানা গেল, ওই নিষেধাজ্ঞা একপর্যায়ে উঠে যায় এবং এ ক্ষেত্রে পেট্রোবাংলার তদবির ছিল জোরদার। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন? পেট্রোবাংলার এর পেছনে কী স্বার্থ কাজ করেছিল? নাইকোর জন্য পেট্রোবাংলার তদবির করার পেছনে কোন রহস্য লুকিয়ে ছিল, তা আজও অনুদ্ঘাটিত। এখন তো ট্যাংরাটিলার গ্যাসফিল্ড ধ্বংসের বিষয়টিও প্রায় ধূসর হয়ে গেছে। কানাডার আদালত নাইকোকে যে বিপুল পরিমাণ ডলার জরিমানা করেছেন, এরপর বাংলাদেশে যাঁরা বিদেশি কম্পানিপ্রেমী রয়েছেন, তাঁদের বক্তব্য কী? তাঁরা এখনো তাঁদের অবস্থানেই আছেন? তাঁরা কি এ ঘটনা থেকে কোনো শিক্ষা নেবেন?
তেল-গ্যাস উত্তোলনকারী বিদেশি কম্পানিগুলো ইতিমধ্যে বাংলাদেশের জাতীয় সম্পদের নানা রকম ক্ষতি করেছে, পরিবেশের ওপর আঘাত হেনেছে। মানুষ এদের কৃতকর্মের কুফল ভোগ করেছে এবং এখনো করছে। কিন্তু এর বিপরীতে কোনো ক্ষতিপূরণ আদায় করা যায়নি! আমাদের সামনে দৃষ্টান্ত রয়েছে-ব্রিটিশ পেট্রোলিয়াম কম্পানি মেঙ্েিকা উপসাগরে তাদের অদূরদর্শিতা ও অদক্ষতার কারণে তেলক্ষেত্রের যে ক্ষতি করেছিল, সে জন্য কম্পানিটিকে বিপুল পরিমাণ ডলার ক্ষতিপূরণ দিতে হয়েছে। ওই ব্রিটিশ কম্পানিটিকে নিজ দেশেও কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়েছিল। তাদের শেয়ারবাজারে এর বিরূপ ধাক্কা লেগেছিল। শেষ পর্যন্ত ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তাদের ক্ষতিপূরণ দিতে হয়েছে। কিন্তু আমরা আমাদের ক্ষতিপূরণ আজও কোনো কম্পানির কাছ থেকে আদায় করতে সক্ষম হইনি। নানা রকম স্ববিরোধী কর্মকাণ্ডের কারণে আমাদের পক্ষে তা সম্ভব হয়নি, সম্ভব হবেও না। কারণ কথিত জয়েন্ট ভেঞ্চারের নামে যে চুক্তিগুলো হয়েছে বা হচ্ছে, সেখানে আমাদের স্বার্থের দিকটির ভিত্তি বরাবরই দুর্বল থাকছে-এই অভিযোগ বিশেষজ্ঞ মহলের এবং অভিযোগটি পুরনো। সম্প্রতি কনোকো-ফিলিপসকে (মার্কিন কম্পানি) বঙ্গোপসাগরে যে ব্লক লিজ দেওয়া হলো, এ নিয়েও সংগতই প্রতিবাদ ক্রমে পুষ্ট হচ্ছে। সম্পাদিত ওই চুক্তিতেও আমাদের কোনো ক্ষতি হলে ক্ষতিপূরণ আদায়ের জুতসই কোনো ধারা-উপধারা সংযোজিত হয়নি বলে বিশেষজ্ঞ মহল থেকে বলা হচ্ছে। এই চুক্তি এমন কোনো চুক্তি নয় যে তা গোপন রাখতে হবে, জনগণ এ ব্যাপারে অন্ধকারে থাকবে। কেন চুক্তির ব্যাপারে দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের প্রকৃত মালিক জনগণকে কিছুই অবহিত করা হচ্ছে না-এটি অবশ্যই জরুরি প্রশ্ন। আজ যাঁরা এই চুক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে জাতীয় সম্পদ রক্ষায় পুলিশের লাঠিপেটার শিকার হচ্ছেন, তাঁরা দেশের শত্রু নন। তাঁদের সামাজিক অবস্থানও যেনতেন নয়। অধ্যাপক আনু মুহাম্মদসহ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার অগ্রগণ্যদের পাশাপাশি অনেক বাম রাজনীতিকও এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। সচেতন অনেকেরই অভিমত, তাঁদের মতো মানুষ রাস্তায় নেমেছেন বিধায়ই আমরা কয়লা-গ্যাসের মতো জাতীয় সম্পদ রক্ষায় আন্দোলনকারীদের তালিকা ক্রমদীর্ঘ হতে দেখছি। বলা হচ্ছে, তাঁদের আন্দোলনের কোনো ন্যায্যতা নেই এবং বিদেশি চক্রের ইঙ্গিতে তাঁরা লাফাচ্ছেন! কিন্তু এমন বক্তব্য যাঁরা রাখছেন, তাঁরা ভূগর্ভস্থ দেশীয় সম্পদ চিহ্নিতকরণ, আহরণ কিংবা বাজারজাতকরণের জন্য বাপেঙ্রে মতো প্রতিষ্ঠানের পঙ্গুত্ব ঘুচানোর কথা বলেন না। কেন বলেন না? এই কাজ যদি বাপেঙ্ করতে পারত, তাহলে আমাদের কী পরিমাণ সম্পদ রক্ষা হতো? জাতীয় অর্থনীতি কতটা চাঙ্গা হতো? আমাদের সার্বিক চিত্র কতটা উজ্জ্বল হতো? নিশ্চয়ই এসব প্রশ্নের উত্তর তাঁদের জানা আছে, কিন্তু সেদিকে হাঁটতে তাঁদের বড় অনীহা। ৮ জুলাই একটি দৈনিকে প্রকাশ, কনোকো ফিলিপসের কাছ থেকে দেড় গুণেরও বেশি দামে সরকারকে গ্যাস কিনতে হবে। আমাদের সম্পদ আমাদেরই কিনতে হবে এত চড়া মূল্য দিয়ে!
বাপেঙ্ যে অতীতে কিছুই করেনি, তা তো নয়। কয়েক বছর ধরে তবে কেন বলা হচ্ছে, বাপেঙ্রে সামর্থ্য নেই? স্পষ্ট কথা হচ্ছে, সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল চায়নি বলেই বাপেঙ্ সামর্থ্যহীন প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। বাপেঙ্কে পঙ্গু করে রেখে স্থলভাগের গ্যাস ব্লকগুলো বিদেশিদের কাছে ইজারা দেওয়ার পুনঃ পরিকল্পনার কথাও শোনা যাচ্ছে। আমাদের গ্যাসক্ষেত্র বিদেশিদের কাছে ইজারা দিয়ে কয়েকগুণ চড়া দামে সেই গ্যাস আবার তাদের কাছ থেকেই কিনতে হচ্ছে! হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ আনা হচ্ছে অনুৎপাদনশীল খাতের জন্য। ঋণ করে ঘি খাওয়ার অপপ্রবণতাটি আমাদের ক্ষেত্রে খুব পুরনো। ঋণ করে ঘি না খেয়ে ঋণ করে দেশীয় একটি প্রতিষ্ঠানকে জাতীয় স্বার্থে শক্তিশালী কিংবা স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে এত উদাসীনতা কিংবা অনীহা কেন? বাপেঙ্কে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে কেন ঋণ নেওয়ার প্রচেষ্টা নেই? বাপেঙ্কে স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে যত ঋণ দরকার, তা অনায়াসেই যেমন নেওয়া সম্ভব, তেমনি বাপেঙ্রে আয় দিয়েই তা পরিশোধও সম্ভব। কিন্তু দুর্ভাগ্য, আমাদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণকদের কেউ কেউ কোন লাভালাভের অঙ্ক কষে বিদেশিদের হাতে সব কিছু তুলে দেওয়ার জন্য এত আগ্রহী, তা তাঁরা দেশের মানুষকে না বোঝাতে চাইলেও মানুষ খুব সহজেই এসব বোঝে। তেল-গ্যাস ও কয়লার বিষয়গুলো শুধু জিওলজিক্যাল বিষয় নয়। আমাদের সম্পদ কাদের মাধ্যমে, কোন পদ্ধতিতে এবং কাদের মালিকানায় তোলা হবে, এসব তো অবশ্যই অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। নীতিনির্ধারকরা নিশ্চয়ই বোঝেন এবং জানেন, জাতীয় স্বার্থ কিভাবে রক্ষা পাবে। বিশ্বের এমন অনেক দেশ রয়েছে, যেসব দেশ তাদের খনিজ সম্পদ মাটির নিচেই রেখে দিচ্ছে, তবুও তা অন্যের হাতে তুলে দিয়ে নিঃস্ব হওয়ার মতো বোকামি করছে না। তাদেরও চাহিদা আছে ব্যাপক। কিন্তু তারা এ-ও জানে, ভবিষ্যতে এই সম্পদ আরো অমূল্য হবে এবং তখন তারা তা কৌশলে অন্যদের দিয়ে উত্তোলন করিয়েও নিজেদের লাভের পাল্লাটি ভারীই রাখতে পারবে। আবার কোনো কোনো দেশ নিজেরাই শক্তি-সামর্থ্য অর্জন করে খনিজ সম্পদ উত্তোলনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। এসব বিষয়ে আমাদের নীতিনির্ধারকদের অদূরদর্শিতা রয়েছে, তা কোনোভাবেই বলা যাবে না। তবে এখানে যে নানা রকম ব্যক্তি-লাভালাভের বিষয় আছে, এটা জোর দিয়েই বলা হচ্ছে। নিশ্চয়ই এমনটি যদি সত্য হয়, তাহলে তা জাতীয় স্বার্থবিরোধী কাজ। জাতীয় স্বার্থবিরোধী এমন কাজের অভিযোগ যে নতুন, তা-ও কিন্তু নয়। সব কিছু বাদ দিয়ে আগে বাপেঙ্কে শক্তিশালী করা হোক, তা হলে অনেক সমস্যা এমনিতেই লাঘব হবে। জাতীয় সম্পদ আমাদের হাতে থাকবে, এ নিয়ে আমরা তখন দর কষাকষি করতে পারব এবং এর ফলে আমরাই সমৃদ্ধ হব।
লেখক : সাংবাদিক
deba_bishnu@yahoo.com
নাইকোর কথা ভুলে যাওয়ার বিষয় নয়। নাইকো এ দেশে বহু কেলেঙ্কারি করেছে এবং এ জন্য সম্প্রতি কম্পানিটিকে নিজ দেশের (কানাডা) আদালতের রায়ে বিপুল অঙ্কের ডলার জরিমানা গুনতে হয়েছে। বিষয়টির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বাংলাদেশ সরকারের তৎকালীন জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী গত বিএনপি সরকারের আমলে মন্ত্রিপরিষদ থেকে বাদ পড়েন। শুধু দামি গাড়িই নয়, কয়েক হাজার ডলার উৎকোচও তিনি গ্রহণ করেছিলেন। এই নীতিবিবর্জিত-অন্যায়-অবৈধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তিনি তাঁর সম্পৃক্ততার কথা বরাবরই অস্বীকার করে এলেও নাইকোর সিইও সে দেশের (কানাডা) আদালতের রায়ের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে বলেছেন, এমন অন্যায়ের বিরুদ্ধে গৃহীত ব্যবস্থার জন্য তাঁরা অখুশি নন। ওই রায়কে তাঁরা স্বাগত জানিয়েছেন এবং নিজেদের কৃতকর্মের দায়ও ঘাড়ে তুলে নিয়ে মিডিয়ায় অন্যায় স্বীকার করতে দ্বিধা করেননি। নাইকো আমাদের যে ক্ষতি করেছিল, সেই ক্ষতিপূরণ আদায়ের জন্য বাংলাদেশের আদালতে মামলা হলেও শেষ পর্যন্ত মামলাটি চলে যায় আন্তর্জাতিক বিরোধ নিষ্পত্তি ট্রাইব্যুনালে। এ নিয়েও নানা রকম কথা আছে। কিন্তু বর্তমানে মামলাটি কী অবস্থায় আছে, তা আমরা জানি না। সচেতন মহলের জানা আছে, ক্ষতিপূরণের অর্থ পাওয়ার আগ পর্যন্ত নাইকোকে গ্যাস বিক্রির বিপরীতে অর্থ প্রদানের ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। কিন্তু পরে জানা গেল, ওই নিষেধাজ্ঞা একপর্যায়ে উঠে যায় এবং এ ক্ষেত্রে পেট্রোবাংলার তদবির ছিল জোরদার। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন? পেট্রোবাংলার এর পেছনে কী স্বার্থ কাজ করেছিল? নাইকোর জন্য পেট্রোবাংলার তদবির করার পেছনে কোন রহস্য লুকিয়ে ছিল, তা আজও অনুদ্ঘাটিত। এখন তো ট্যাংরাটিলার গ্যাসফিল্ড ধ্বংসের বিষয়টিও প্রায় ধূসর হয়ে গেছে। কানাডার আদালত নাইকোকে যে বিপুল পরিমাণ ডলার জরিমানা করেছেন, এরপর বাংলাদেশে যাঁরা বিদেশি কম্পানিপ্রেমী রয়েছেন, তাঁদের বক্তব্য কী? তাঁরা এখনো তাঁদের অবস্থানেই আছেন? তাঁরা কি এ ঘটনা থেকে কোনো শিক্ষা নেবেন?
তেল-গ্যাস উত্তোলনকারী বিদেশি কম্পানিগুলো ইতিমধ্যে বাংলাদেশের জাতীয় সম্পদের নানা রকম ক্ষতি করেছে, পরিবেশের ওপর আঘাত হেনেছে। মানুষ এদের কৃতকর্মের কুফল ভোগ করেছে এবং এখনো করছে। কিন্তু এর বিপরীতে কোনো ক্ষতিপূরণ আদায় করা যায়নি! আমাদের সামনে দৃষ্টান্ত রয়েছে-ব্রিটিশ পেট্রোলিয়াম কম্পানি মেঙ্েিকা উপসাগরে তাদের অদূরদর্শিতা ও অদক্ষতার কারণে তেলক্ষেত্রের যে ক্ষতি করেছিল, সে জন্য কম্পানিটিকে বিপুল পরিমাণ ডলার ক্ষতিপূরণ দিতে হয়েছে। ওই ব্রিটিশ কম্পানিটিকে নিজ দেশেও কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়েছিল। তাদের শেয়ারবাজারে এর বিরূপ ধাক্কা লেগেছিল। শেষ পর্যন্ত ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তাদের ক্ষতিপূরণ দিতে হয়েছে। কিন্তু আমরা আমাদের ক্ষতিপূরণ আজও কোনো কম্পানির কাছ থেকে আদায় করতে সক্ষম হইনি। নানা রকম স্ববিরোধী কর্মকাণ্ডের কারণে আমাদের পক্ষে তা সম্ভব হয়নি, সম্ভব হবেও না। কারণ কথিত জয়েন্ট ভেঞ্চারের নামে যে চুক্তিগুলো হয়েছে বা হচ্ছে, সেখানে আমাদের স্বার্থের দিকটির ভিত্তি বরাবরই দুর্বল থাকছে-এই অভিযোগ বিশেষজ্ঞ মহলের এবং অভিযোগটি পুরনো। সম্প্রতি কনোকো-ফিলিপসকে (মার্কিন কম্পানি) বঙ্গোপসাগরে যে ব্লক লিজ দেওয়া হলো, এ নিয়েও সংগতই প্রতিবাদ ক্রমে পুষ্ট হচ্ছে। সম্পাদিত ওই চুক্তিতেও আমাদের কোনো ক্ষতি হলে ক্ষতিপূরণ আদায়ের জুতসই কোনো ধারা-উপধারা সংযোজিত হয়নি বলে বিশেষজ্ঞ মহল থেকে বলা হচ্ছে। এই চুক্তি এমন কোনো চুক্তি নয় যে তা গোপন রাখতে হবে, জনগণ এ ব্যাপারে অন্ধকারে থাকবে। কেন চুক্তির ব্যাপারে দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের প্রকৃত মালিক জনগণকে কিছুই অবহিত করা হচ্ছে না-এটি অবশ্যই জরুরি প্রশ্ন। আজ যাঁরা এই চুক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে জাতীয় সম্পদ রক্ষায় পুলিশের লাঠিপেটার শিকার হচ্ছেন, তাঁরা দেশের শত্রু নন। তাঁদের সামাজিক অবস্থানও যেনতেন নয়। অধ্যাপক আনু মুহাম্মদসহ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার অগ্রগণ্যদের পাশাপাশি অনেক বাম রাজনীতিকও এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। সচেতন অনেকেরই অভিমত, তাঁদের মতো মানুষ রাস্তায় নেমেছেন বিধায়ই আমরা কয়লা-গ্যাসের মতো জাতীয় সম্পদ রক্ষায় আন্দোলনকারীদের তালিকা ক্রমদীর্ঘ হতে দেখছি। বলা হচ্ছে, তাঁদের আন্দোলনের কোনো ন্যায্যতা নেই এবং বিদেশি চক্রের ইঙ্গিতে তাঁরা লাফাচ্ছেন! কিন্তু এমন বক্তব্য যাঁরা রাখছেন, তাঁরা ভূগর্ভস্থ দেশীয় সম্পদ চিহ্নিতকরণ, আহরণ কিংবা বাজারজাতকরণের জন্য বাপেঙ্রে মতো প্রতিষ্ঠানের পঙ্গুত্ব ঘুচানোর কথা বলেন না। কেন বলেন না? এই কাজ যদি বাপেঙ্ করতে পারত, তাহলে আমাদের কী পরিমাণ সম্পদ রক্ষা হতো? জাতীয় অর্থনীতি কতটা চাঙ্গা হতো? আমাদের সার্বিক চিত্র কতটা উজ্জ্বল হতো? নিশ্চয়ই এসব প্রশ্নের উত্তর তাঁদের জানা আছে, কিন্তু সেদিকে হাঁটতে তাঁদের বড় অনীহা। ৮ জুলাই একটি দৈনিকে প্রকাশ, কনোকো ফিলিপসের কাছ থেকে দেড় গুণেরও বেশি দামে সরকারকে গ্যাস কিনতে হবে। আমাদের সম্পদ আমাদেরই কিনতে হবে এত চড়া মূল্য দিয়ে!
বাপেঙ্ যে অতীতে কিছুই করেনি, তা তো নয়। কয়েক বছর ধরে তবে কেন বলা হচ্ছে, বাপেঙ্রে সামর্থ্য নেই? স্পষ্ট কথা হচ্ছে, সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল চায়নি বলেই বাপেঙ্ সামর্থ্যহীন প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। বাপেঙ্কে পঙ্গু করে রেখে স্থলভাগের গ্যাস ব্লকগুলো বিদেশিদের কাছে ইজারা দেওয়ার পুনঃ পরিকল্পনার কথাও শোনা যাচ্ছে। আমাদের গ্যাসক্ষেত্র বিদেশিদের কাছে ইজারা দিয়ে কয়েকগুণ চড়া দামে সেই গ্যাস আবার তাদের কাছ থেকেই কিনতে হচ্ছে! হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ আনা হচ্ছে অনুৎপাদনশীল খাতের জন্য। ঋণ করে ঘি খাওয়ার অপপ্রবণতাটি আমাদের ক্ষেত্রে খুব পুরনো। ঋণ করে ঘি না খেয়ে ঋণ করে দেশীয় একটি প্রতিষ্ঠানকে জাতীয় স্বার্থে শক্তিশালী কিংবা স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে এত উদাসীনতা কিংবা অনীহা কেন? বাপেঙ্কে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে কেন ঋণ নেওয়ার প্রচেষ্টা নেই? বাপেঙ্কে স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে যত ঋণ দরকার, তা অনায়াসেই যেমন নেওয়া সম্ভব, তেমনি বাপেঙ্রে আয় দিয়েই তা পরিশোধও সম্ভব। কিন্তু দুর্ভাগ্য, আমাদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণকদের কেউ কেউ কোন লাভালাভের অঙ্ক কষে বিদেশিদের হাতে সব কিছু তুলে দেওয়ার জন্য এত আগ্রহী, তা তাঁরা দেশের মানুষকে না বোঝাতে চাইলেও মানুষ খুব সহজেই এসব বোঝে। তেল-গ্যাস ও কয়লার বিষয়গুলো শুধু জিওলজিক্যাল বিষয় নয়। আমাদের সম্পদ কাদের মাধ্যমে, কোন পদ্ধতিতে এবং কাদের মালিকানায় তোলা হবে, এসব তো অবশ্যই অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। নীতিনির্ধারকরা নিশ্চয়ই বোঝেন এবং জানেন, জাতীয় স্বার্থ কিভাবে রক্ষা পাবে। বিশ্বের এমন অনেক দেশ রয়েছে, যেসব দেশ তাদের খনিজ সম্পদ মাটির নিচেই রেখে দিচ্ছে, তবুও তা অন্যের হাতে তুলে দিয়ে নিঃস্ব হওয়ার মতো বোকামি করছে না। তাদেরও চাহিদা আছে ব্যাপক। কিন্তু তারা এ-ও জানে, ভবিষ্যতে এই সম্পদ আরো অমূল্য হবে এবং তখন তারা তা কৌশলে অন্যদের দিয়ে উত্তোলন করিয়েও নিজেদের লাভের পাল্লাটি ভারীই রাখতে পারবে। আবার কোনো কোনো দেশ নিজেরাই শক্তি-সামর্থ্য অর্জন করে খনিজ সম্পদ উত্তোলনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। এসব বিষয়ে আমাদের নীতিনির্ধারকদের অদূরদর্শিতা রয়েছে, তা কোনোভাবেই বলা যাবে না। তবে এখানে যে নানা রকম ব্যক্তি-লাভালাভের বিষয় আছে, এটা জোর দিয়েই বলা হচ্ছে। নিশ্চয়ই এমনটি যদি সত্য হয়, তাহলে তা জাতীয় স্বার্থবিরোধী কাজ। জাতীয় স্বার্থবিরোধী এমন কাজের অভিযোগ যে নতুন, তা-ও কিন্তু নয়। সব কিছু বাদ দিয়ে আগে বাপেঙ্কে শক্তিশালী করা হোক, তা হলে অনেক সমস্যা এমনিতেই লাঘব হবে। জাতীয় সম্পদ আমাদের হাতে থাকবে, এ নিয়ে আমরা তখন দর কষাকষি করতে পারব এবং এর ফলে আমরাই সমৃদ্ধ হব।
লেখক : সাংবাদিক
deba_bishnu@yahoo.com
No comments