ভিন্নমত-কিছু প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় আসতে দিন by আবু আহমেদ
আমরা কিছুদিন যাবৎ অতীব দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করছি ব্যক্তিখাতে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করে কিছু লোক রীতিমতো শিক্ষা দেওয়ার নামে সার্টিফিকেট বিক্রির বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। ব্যক্তিখাতকে উচ্চশিক্ষার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার পেছনে আমরা কোনোদিনই ভাবিনি যে এভাবে উচ্চশিক্ষার নামে সনদ বিক্রির বাণিজ্য হতে পারে।
মান খারাপ-ভালো না হয় মেনে নেওয়া যায়; কিন্তু টাকার বিনিময়ে পড়ানোর নামে সনদ বেচে কি অর্থ আয়কে মেনে নেওয়া যায়? এ বিষয়টি সমাজে যে ক্ষত সৃষ্টি করেছে, তা বোধকরি কিছুটা শুকাবে যদি যারা এসব অপরাধ করে চলেছে তাদের বাণিজ্যটাকে বন্ধ করে দেওয়া যায়। কেন বন্ধ করা যাবে না? UGC বা ইউনিভার্সিটি গ্রান্ট কমিশন কি এসব শিক্ষা ব্যবসাকে বন্ধ করার ক্ষমতা রাখে না? আমি মনে করি UGC-কে এমন একটা ক্ষমতা দেওয়া উচিত, শুধু হিয়ারিং বা শুনানি করে এই সংস্থা যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্স বা প্রয়োজন মনে করলে পুরো বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দিতে পারবে। এ ক্ষমতা UGC না পেলে এ সংস্থা শুধু অনুরোধ আর ধমক দিতে পারবে- বাস্তবে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারবে না। এ সংস্থাকে রুলস প্রণয়নের ক্ষমতা দেওয়া উচিত। তবে আমি ভাবি আইন থাকলে তো রুলস এবং রেগুলেশনস প্রণয়নের ক্ষমতা থাকার কথা। যদি ক্ষমতা পেয়েও দেশের উচ্চশিক্ষার মান রক্ষার্থে এ সংস্থা তার ক্ষমতা প্রয়োগ না করে, তাহলে বুঝতে হবে এটাও অন্য সরকারি সংস্থার মতো একটি অকেজো সংস্থা। আইনের ঘাটতি থাকলে UGC নিজেরই উদ্যোগী হওয়া উচিত নিজকে শক্তিশালী করার জন্য। আমরা যখন নব্বই দশকে ব্যক্তিখাতে উচ্চশিক্ষাকে উন্মুক্ত করার পক্ষে বলেছিলাম, তখন বর্তমানের মতো অতি সহজে ডিগ্রি প্রাপ্তির বিষয়টি চিন্তাও করিনি। শক্তভাবে রেগুলেশন না করা হলে এমনি হতে পারে বলে একটা আশঙ্কা সব সময় ছিল।
দুটো ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভুল করেছে। সেই দুটো ক্ষেত্র হলো- এক. ব্যক্তি খাতের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য শক্ত আইন না করে অতি তাড়াতাড়ি অনেক বিশ্ববিদ্যালয়কে উচ্চশিক্ষার ডিগ্রি প্রদানের অনুমতি দেওয়া। দুই. যেসব বিশ্ববিদ্যালয় খোলা হয়েছে, ওইসব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথমেই অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও বিনির্মাণের জন্য নূ্যনতম অর্থ জমা রাখার বিধান করা। এসব শর্ত না দেওয়ার ফলে ভাড়া বাড়িতে বা হোটেল-মোটেলের ওপর অনেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইনবোর্ড টাঙিয়ে শিক্ষা বেচার ব্যবসাটা করার সুযোগ পেয়েছে। ভারত-পাকিস্তানেও ব্যক্তিখাতে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তবে এত বিশ্ববিদ্যালয়কে দেয়নি। আজও শুনি অনেকে নতুন করে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার অনুমতি চাচ্ছে। উদ্দেশ্য কী? সমাজসেবা না শিক্ষা বেচা? UGC-কে অতি ভালো করে চিন্তা করতে হবে যারা বিশ্ববিদ্যালয় চাচ্ছে, তাদের ভেতরের উদ্দেশ্যটা কী?
শর্ত দেওয়া যেতে পারে, বিশ্ববিদ্যালয় পেতে হলে ৫০ কোটি টাকা সব সময়ই ব্যাংকে জমা রাখতে হবে। ১০ বছরের মধ্যে কোনোরকম শাখা খোলা যাবে না। কোনোরকম ভাড়াবাড়িতে বিশ্ববিদ্যালয় খোলা যাবে না। যদি UGC এসব ন্যায্য শর্ত আরোপ করে, তখন লাইনে দাঁড়ানো লোকগুলোর অনেকেই পিছিয়ে যাবে। অন্য শর্ত হতে পারে লাইব্রেরি ও ল্যাব স্থাপন করেই কেবল নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অনুমতি চাইতে পারবে। এখন তো ঢাকা এবং চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেটে শিক্ষার অতি সস্তা ব্যবসা চলছে, অতি সহজে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতি দিলে শিক্ষা বেচার এই ব্যাধি জেলা সদরগুলোতেও ছড়িয়ে পড়বে।
আমরা ব্যক্তি খাতে উচ্চশিক্ষার অনুমতি দেওয়া চেয়েছিলাম এ জন্যই যে তখন এবং এখনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এত ছাত্রকে উচ্চশিক্ষা দিতে ব্যর্থ হচ্ছিল।
আমাদের মনে আশা ছিল ব্যক্তি খাতের সম্পদ উচ্চশিক্ষায় নিয়োজিত হলে শিক্ষার প্রসার যেমন হবে, তেমনি প্রতিযোগিতা বেড়ে দেশের এ ক্ষেত্রে ডিগ্রি স্ট্র্যাটেজি ও গবেষণার মানও বাড়বে। কিন্তু সেটা হয়নি। হয়নি রেগুলেশনের দুর্বলতার কারণে।
দেশে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস (Campus) স্থাপন করা নিষেধ আছে। কেন আছে সেটা আমার বোধের বাইরে। অর্থ দিয়ে যদি দেশীয় ব্যক্তি খাতের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে অতি নিম্নমানের ডিগ্রি অর্জন করা যায়, তাহলে অর্থ দিয়ে পড়ে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্যাম্পাস থেকে তাদেরই দেয় সমমানের ডিগ্রি কেন নেওয়া যাবে না? আজকাল মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্য অনেক দেশ আমেরিকান ও ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখাকে তাদের দেশে স্থাপন করতে দিচ্ছে। সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি এক নামি মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে মিলে গইঅ ডিগ্রি দিচ্ছে। ওই ডিগ্রিতে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই বিজনেস স্কুলের নাম লেখা আছে। পার্থক্যটা হলো অপেক্ষাকৃত কম ব্যয়ে সিঙ্গাপুরে বসেই ওই নামি মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিটা অর্জন করা সম্ভব হচ্ছে। মালয়েশিয়াও বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়কে আসতে দিয়েছে। তাতে উপকৃত হচ্ছে মালয়েশিয়ার ছাত্ররাই। ভারতও সম্প্রতি বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় আসার পক্ষে আইন পাস করেছে। বাংলাদেশে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি অর্জনের একটি বিরাট চাহিদা আছে। কম ব্যয়ে মেধাবী উচ্চবিত্তের ছেলেরা বাংলাদেশে বসে যদি ভালো বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি অর্জন করতে পারে, তাহলে ক্ষতি কী?
লেখক: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অর্থনীতিবিদ
দুটো ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভুল করেছে। সেই দুটো ক্ষেত্র হলো- এক. ব্যক্তি খাতের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য শক্ত আইন না করে অতি তাড়াতাড়ি অনেক বিশ্ববিদ্যালয়কে উচ্চশিক্ষার ডিগ্রি প্রদানের অনুমতি দেওয়া। দুই. যেসব বিশ্ববিদ্যালয় খোলা হয়েছে, ওইসব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথমেই অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও বিনির্মাণের জন্য নূ্যনতম অর্থ জমা রাখার বিধান করা। এসব শর্ত না দেওয়ার ফলে ভাড়া বাড়িতে বা হোটেল-মোটেলের ওপর অনেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইনবোর্ড টাঙিয়ে শিক্ষা বেচার ব্যবসাটা করার সুযোগ পেয়েছে। ভারত-পাকিস্তানেও ব্যক্তিখাতে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তবে এত বিশ্ববিদ্যালয়কে দেয়নি। আজও শুনি অনেকে নতুন করে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার অনুমতি চাচ্ছে। উদ্দেশ্য কী? সমাজসেবা না শিক্ষা বেচা? UGC-কে অতি ভালো করে চিন্তা করতে হবে যারা বিশ্ববিদ্যালয় চাচ্ছে, তাদের ভেতরের উদ্দেশ্যটা কী?
শর্ত দেওয়া যেতে পারে, বিশ্ববিদ্যালয় পেতে হলে ৫০ কোটি টাকা সব সময়ই ব্যাংকে জমা রাখতে হবে। ১০ বছরের মধ্যে কোনোরকম শাখা খোলা যাবে না। কোনোরকম ভাড়াবাড়িতে বিশ্ববিদ্যালয় খোলা যাবে না। যদি UGC এসব ন্যায্য শর্ত আরোপ করে, তখন লাইনে দাঁড়ানো লোকগুলোর অনেকেই পিছিয়ে যাবে। অন্য শর্ত হতে পারে লাইব্রেরি ও ল্যাব স্থাপন করেই কেবল নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অনুমতি চাইতে পারবে। এখন তো ঢাকা এবং চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেটে শিক্ষার অতি সস্তা ব্যবসা চলছে, অতি সহজে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতি দিলে শিক্ষা বেচার এই ব্যাধি জেলা সদরগুলোতেও ছড়িয়ে পড়বে।
আমরা ব্যক্তি খাতে উচ্চশিক্ষার অনুমতি দেওয়া চেয়েছিলাম এ জন্যই যে তখন এবং এখনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এত ছাত্রকে উচ্চশিক্ষা দিতে ব্যর্থ হচ্ছিল।
আমাদের মনে আশা ছিল ব্যক্তি খাতের সম্পদ উচ্চশিক্ষায় নিয়োজিত হলে শিক্ষার প্রসার যেমন হবে, তেমনি প্রতিযোগিতা বেড়ে দেশের এ ক্ষেত্রে ডিগ্রি স্ট্র্যাটেজি ও গবেষণার মানও বাড়বে। কিন্তু সেটা হয়নি। হয়নি রেগুলেশনের দুর্বলতার কারণে।
দেশে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস (Campus) স্থাপন করা নিষেধ আছে। কেন আছে সেটা আমার বোধের বাইরে। অর্থ দিয়ে যদি দেশীয় ব্যক্তি খাতের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে অতি নিম্নমানের ডিগ্রি অর্জন করা যায়, তাহলে অর্থ দিয়ে পড়ে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্যাম্পাস থেকে তাদেরই দেয় সমমানের ডিগ্রি কেন নেওয়া যাবে না? আজকাল মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্য অনেক দেশ আমেরিকান ও ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখাকে তাদের দেশে স্থাপন করতে দিচ্ছে। সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি এক নামি মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে মিলে গইঅ ডিগ্রি দিচ্ছে। ওই ডিগ্রিতে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই বিজনেস স্কুলের নাম লেখা আছে। পার্থক্যটা হলো অপেক্ষাকৃত কম ব্যয়ে সিঙ্গাপুরে বসেই ওই নামি মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিটা অর্জন করা সম্ভব হচ্ছে। মালয়েশিয়াও বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়কে আসতে দিয়েছে। তাতে উপকৃত হচ্ছে মালয়েশিয়ার ছাত্ররাই। ভারতও সম্প্রতি বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় আসার পক্ষে আইন পাস করেছে। বাংলাদেশে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি অর্জনের একটি বিরাট চাহিদা আছে। কম ব্যয়ে মেধাবী উচ্চবিত্তের ছেলেরা বাংলাদেশে বসে যদি ভালো বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি অর্জন করতে পারে, তাহলে ক্ষতি কী?
লেখক: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অর্থনীতিবিদ
No comments