সংসদীয় গণতান্ত্রিক ধারা by এ এম এম শওকত আলী
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) জন্মলগ্নে খোঁড়া হাঁস হিসেবে আখ্যায়িত ছিল। কমিশনের চেয়ারম্যানসহ সদস্যদের মধ্যে কার্যসম্পাদন প্রক্রিয়া নিয়ে তীব্র মতবিরোধের কারণে শুরুতে দুদক খুব একটা কাজ করতে সক্ষম হয়নি। জনবলসহ অন্যান্য সাংগঠনিক সমস্যাও ছিল এর অন্যতম কারণ।
দুদক প্রতিষ্ঠা সংক্রান্ত আইন প্রণয়নের সময়ও নাগরিক সমাজ, বিশেষ করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ও সরকারের মধ্যে কয়েকটি বিষয়ে মতভেদও ছিল তীব্র। সংসদীয় গণতান্ত্রিক প্রথায় যেকোনো বিষয়ে আইন প্রণয়নের বিষয়ে সংসদই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণে ক্ষমতাবান। সংসদের এ ক্ষমতা অনেকাংশে নির্বাহী বিভাগ খর্ব করে থাকে। দুদক সংক্রান্ত খসড়া বিল যখন সংশ্লিষ্ট সংসদীয় কমিটিতে আলোচিত হয়, তখন আইনমন্ত্রী ও কমিটির চেয়ারম্যানের মধ্যে কয়েকটি বিষয়ে মতবিরোধ ছিল দৃশ্যমান, যা মিডিয়া প্রকাশ করে।
উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায়, দুদকের ক্ষমতার বিষয়ে এ মতভেদ দেখা যায়। কমিটির চেয়ারম্যান মন্ত্রিসভা কর্তৃক অনুমোদিত খসড়া বিলে কিছু পরিবর্তন করার প্রস্তাব দিলে সভায় উপস্থিত আইনমন্ত্রী এর তীব্র বিরোধিতা করেন। তাঁর মতে, মন্ত্রিসভা কর্তৃক অনুমোদিত খসড়ায় কোনো পরিবর্তন বা সংশোধন করা যাবে না। এটাই ছিল নির্বাহী কায়দায় আইন প্রণয়ন করার প্রক্রিয়া। এ ধরনের উদাহরণ অনেক রয়েছে। সংসদের অভ্যন্তরে অর্থাৎ খসড়া বিল উত্থাপিত হওয়ার পরও একই দৃশ্য দেখা যায়। অনেক সময় একাধিক বিল কোনো সংসদ সদস্য জনমত যাচাইয়ের প্রস্তাব করলেও তা বিপুল কণ্ঠভোটে নাকচ করা হয়। অবশ্য সরকারি দলের সংসদ সদস্যদের সংখ্যাধিক্যের কারণেই এটা হয়। অন্যদিকে কোনো এক সংসদীয় কমিটি কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের উপস্থিতি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ওয়ারেন্ট জারি করার ক্ষমতা সংক্রান্ত প্রস্তাব মন্ত্রিসভা নাকচ করে দেয়। কোনো সংসদীয় গণতান্ত্রিক দেশে এ ক্ষমতা রয়েছে কি না তা অনুসন্ধানযোগ্য। তবে এ ক্ষেত্রে প্রস্তাবটি মন্ত্রিসভায় সরাসরি নাকচ না করে সংসদে নাকচ করাই মানানসই হতো।
ভারতে এ ধারা দৃশ্যমান নয়। ওই দেশে সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে, যা বাংলাদেশে নেই। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে_এক. দলপ্রধান ও সরকার প্রধান একই ব্যক্তি নন। দল সরকারের বাইরে থেকেও নীতি ও অন্যান্য জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সরকারি সিদ্ধান্তের ওপর নজরদারি করে। কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট নীতিনির্ধারণী বিষয়ে একটি জাতীয় পরামর্শক কমিটি গঠন করেছে। দলীয় প্রধান এ কমিটির চেয়ারপারসন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দল একটি পরামর্শক কমিটি গঠন করেছে, যার প্রধান হলেন সরকারপ্রধান। সরকারপ্রধান আবার দলের প্রধানও বটে। এ কারণে এ কমিটি কতটা স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে সক্ষম তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধান একীভূত ব্যবস্থায় কমিটির সদস্যরা স্বাভাবিকভাবেই কোনো বিষয়ে শক্ত অবস্থান গ্রহণ করতে অপারগ।
ভারতে মন্ত্রিসভা ছাড়াও জ্যেষ্ঠ মন্ত্রীদের সমন্বয়ে একটি গ্রুপ বিদ্যমান। একে সাধারণভাবে বলা হয় গ্রুপ অব মিনিস্টারস। নীতি বা কোনো জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এ গ্রুপ প্রধানমন্ত্রীকে পরামর্শ দিয়ে থাকে। বাংলাদেশে এ ধরনের কোনো ব্যবস্থা নেই। মাঝেমধ্যে শোনা যায় কিচেন ক্যাবিনেটের কথা। অর্থাৎ কিছু মন্ত্রী নির্দিষ্ট বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীকে পরামর্শ দিয়ে থাকেন। তবে এর কোনো আনুষ্ঠানিক অস্তিত্ব নেই। এসব কারণে কিছু সমালোচক বাংলাদেশের সংসদীয় শাসনব্যবস্থাকে প্রধানমন্ত্রীশাসিত সরকার মর্মে আখ্যায়িত করেন। ইন্দিরা গান্ধী প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ভারতের একই সমালোচনা করা হতো। বর্তমানে ভারতে এর ব্যতিক্রম দেখা যায়। প্রধানমন্ত্রীর নীতি ও জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দলীয় প্রধান সোনিয়া গান্ধীর পরামর্শ গ্রহণ করার বিষয়টি দৃশ্যমান। বাংলাদেশে সম্প্রতি সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাব মন্ত্রিসভায় আলোচিত হয়। একজন প্রবীণ মন্ত্রী ইসলাম ধর্ম সম্পর্কিত কয়েকটি বাক্য ও বিধান গ্রহণ না করার পক্ষে প্রস্তাব দিলে প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং তা নাকচ করে দেন। এ বিষয়ে আলোচনা হলে ভালো হতো। তবে এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর স্বপক্ষে বলা যায় যে এ সিদ্ধান্ত গ্রহণে তিনি বিদ্যমান রাজনৈতিক মতামত দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন।
বর্তমানে বিরোধী দলের সঙ্গে সংবিধান সংশোধন প্রক্রিয়া নিয়ে যে তীব্র বিরোধ রয়েছে, তার সঙ্গে আরো কোনো ইস্যু উত্থাপন করার সুযোগ বিরোধী জোট না পায় সে কারণেই প্রধানমন্ত্রীর এ ধরনের সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক বিচক্ষণতার পরিচায়ক। এ সিদ্ধান্তের ফলে অসাম্প্রদায়িক নীতির পাশাপাশি একটি বিশেষ ধর্মের প্রাধান্যও স্বীকৃতি পাবে। তবে এ ধরনের পরস্পরবিরোধী সহাবস্থান তাত্তি্বক দৃষ্টিকোণ থেকে গ্রহণযোগ্য নয়। পক্ষান্তরে এ ধরনের স্বীকৃতি বাংলাদেশের বা বাংলাদেশিদের জন্য যে পরিচয় সংক্রান্ত দুর্বলতা (Identity Crisis), সে বিষয়টিই প্রমাণ করে। এ বিষয়টি নিয়ে অতীতে গবেষকরা যথেষ্ট আলোচনা করেছেন।
সার্বিকভাবে বলা যায়, প্রধানমন্ত্রীনির্ভর শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত ও নির্ভেজাল সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বিকৃতি। এ ধরনের বিকৃতিকে অনেকে গ্রহণযোগ্য বলে যুক্তি প্রদর্শন করেন। যুক্তিটি হলো, সংসদীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ এখনো শৈশবে। এ কারণেই নির্ভেজাল গণতান্ত্রিক শাসন কাঠামো এখনই আশা করা যায় না। এর সঙ্গে যুক্ত হয় ১৯৭৫ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত সামরিক শাসনব্যবস্থার বিষয়টি। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন হয়। এর আয়ুষ্কাল ছিল প্রায় দুই বছর। কারণ ১৯৭৫ সালের প্রথমার্ধে নির্বাচিত সংসদই একদলীয় শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন করে। এ কারণে বলা যায় যে সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার অপমৃত্যু ঘটে নির্বাচিত সংসদের কারণে, সামরিক হস্তক্ষেপের জন্য নয়। সামরিক শাসনব্যবস্থা চালু হয় ১৯৭৫-এর দ্বিতীয়ার্ধে। এর পর থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত পরপর দুইবার সামরিক শাসকদের মধ্যে ক্ষমতার পটপরিবর্তন হয়। দুই সামরিক শাসকই অবশ্য পরবর্তী সময়ে নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনীতিতে অনুপ্রবেশ করেন। নিজ নিজ দলও গঠন করেন। এরপর ১৯৯১ সালে আবার সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। পুরো সময়টা প্রায় ২০ বছর (১৯৯১-২০১১)। তবে এর মধ্যে দুই বছর সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় ছিল। রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের বয়স প্রায় ৪০ বছর। এ সময়ের মধ্যে প্রায় ২২ বছর সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ছিল। ২২ বছর কম সময় নয়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথার অস্তিত্ব নিয়েই প্রধান বিরোধী দলের সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের মতবিরোধ, যা এখন তুঙ্গে। প্রধান বিরোধী দলের অন্যতম সহযোগী দল বর্তমানে দুর্বল। প্রধান বিরোধী দলও যে বর্তমানে সবল, তা বলা যাবে না। মূল কারণ সাংগঠনিক দুর্বলতা। তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে আন্দোলন করার চেয়ে কিভাবে পরবর্তী নির্বাচনে জয়ী হওয়া যায়, সে দিকেই বিরোধী দলের দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। চলমান সংসদীয় গণতান্ত্রিক ধারায় সংসদ বর্জনসহ রাজপথে আন্দোলনের প্রবণতা ১৯৯১ সাল থেকেই দৃশ্যমান। এ প্রবণতা কমবেশি সব রাজনৈতিক দলের রয়েছে। এ প্রবণতাই সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে স্থায়ী রূপ দেওয়ার অন্যতম প্রধান অন্তরায়।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা
উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায়, দুদকের ক্ষমতার বিষয়ে এ মতভেদ দেখা যায়। কমিটির চেয়ারম্যান মন্ত্রিসভা কর্তৃক অনুমোদিত খসড়া বিলে কিছু পরিবর্তন করার প্রস্তাব দিলে সভায় উপস্থিত আইনমন্ত্রী এর তীব্র বিরোধিতা করেন। তাঁর মতে, মন্ত্রিসভা কর্তৃক অনুমোদিত খসড়ায় কোনো পরিবর্তন বা সংশোধন করা যাবে না। এটাই ছিল নির্বাহী কায়দায় আইন প্রণয়ন করার প্রক্রিয়া। এ ধরনের উদাহরণ অনেক রয়েছে। সংসদের অভ্যন্তরে অর্থাৎ খসড়া বিল উত্থাপিত হওয়ার পরও একই দৃশ্য দেখা যায়। অনেক সময় একাধিক বিল কোনো সংসদ সদস্য জনমত যাচাইয়ের প্রস্তাব করলেও তা বিপুল কণ্ঠভোটে নাকচ করা হয়। অবশ্য সরকারি দলের সংসদ সদস্যদের সংখ্যাধিক্যের কারণেই এটা হয়। অন্যদিকে কোনো এক সংসদীয় কমিটি কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের উপস্থিতি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ওয়ারেন্ট জারি করার ক্ষমতা সংক্রান্ত প্রস্তাব মন্ত্রিসভা নাকচ করে দেয়। কোনো সংসদীয় গণতান্ত্রিক দেশে এ ক্ষমতা রয়েছে কি না তা অনুসন্ধানযোগ্য। তবে এ ক্ষেত্রে প্রস্তাবটি মন্ত্রিসভায় সরাসরি নাকচ না করে সংসদে নাকচ করাই মানানসই হতো।
ভারতে এ ধারা দৃশ্যমান নয়। ওই দেশে সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে, যা বাংলাদেশে নেই। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে_এক. দলপ্রধান ও সরকার প্রধান একই ব্যক্তি নন। দল সরকারের বাইরে থেকেও নীতি ও অন্যান্য জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সরকারি সিদ্ধান্তের ওপর নজরদারি করে। কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট নীতিনির্ধারণী বিষয়ে একটি জাতীয় পরামর্শক কমিটি গঠন করেছে। দলীয় প্রধান এ কমিটির চেয়ারপারসন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দল একটি পরামর্শক কমিটি গঠন করেছে, যার প্রধান হলেন সরকারপ্রধান। সরকারপ্রধান আবার দলের প্রধানও বটে। এ কারণে এ কমিটি কতটা স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে সক্ষম তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধান একীভূত ব্যবস্থায় কমিটির সদস্যরা স্বাভাবিকভাবেই কোনো বিষয়ে শক্ত অবস্থান গ্রহণ করতে অপারগ।
ভারতে মন্ত্রিসভা ছাড়াও জ্যেষ্ঠ মন্ত্রীদের সমন্বয়ে একটি গ্রুপ বিদ্যমান। একে সাধারণভাবে বলা হয় গ্রুপ অব মিনিস্টারস। নীতি বা কোনো জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এ গ্রুপ প্রধানমন্ত্রীকে পরামর্শ দিয়ে থাকে। বাংলাদেশে এ ধরনের কোনো ব্যবস্থা নেই। মাঝেমধ্যে শোনা যায় কিচেন ক্যাবিনেটের কথা। অর্থাৎ কিছু মন্ত্রী নির্দিষ্ট বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীকে পরামর্শ দিয়ে থাকেন। তবে এর কোনো আনুষ্ঠানিক অস্তিত্ব নেই। এসব কারণে কিছু সমালোচক বাংলাদেশের সংসদীয় শাসনব্যবস্থাকে প্রধানমন্ত্রীশাসিত সরকার মর্মে আখ্যায়িত করেন। ইন্দিরা গান্ধী প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ভারতের একই সমালোচনা করা হতো। বর্তমানে ভারতে এর ব্যতিক্রম দেখা যায়। প্রধানমন্ত্রীর নীতি ও জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দলীয় প্রধান সোনিয়া গান্ধীর পরামর্শ গ্রহণ করার বিষয়টি দৃশ্যমান। বাংলাদেশে সম্প্রতি সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাব মন্ত্রিসভায় আলোচিত হয়। একজন প্রবীণ মন্ত্রী ইসলাম ধর্ম সম্পর্কিত কয়েকটি বাক্য ও বিধান গ্রহণ না করার পক্ষে প্রস্তাব দিলে প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং তা নাকচ করে দেন। এ বিষয়ে আলোচনা হলে ভালো হতো। তবে এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর স্বপক্ষে বলা যায় যে এ সিদ্ধান্ত গ্রহণে তিনি বিদ্যমান রাজনৈতিক মতামত দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন।
বর্তমানে বিরোধী দলের সঙ্গে সংবিধান সংশোধন প্রক্রিয়া নিয়ে যে তীব্র বিরোধ রয়েছে, তার সঙ্গে আরো কোনো ইস্যু উত্থাপন করার সুযোগ বিরোধী জোট না পায় সে কারণেই প্রধানমন্ত্রীর এ ধরনের সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক বিচক্ষণতার পরিচায়ক। এ সিদ্ধান্তের ফলে অসাম্প্রদায়িক নীতির পাশাপাশি একটি বিশেষ ধর্মের প্রাধান্যও স্বীকৃতি পাবে। তবে এ ধরনের পরস্পরবিরোধী সহাবস্থান তাত্তি্বক দৃষ্টিকোণ থেকে গ্রহণযোগ্য নয়। পক্ষান্তরে এ ধরনের স্বীকৃতি বাংলাদেশের বা বাংলাদেশিদের জন্য যে পরিচয় সংক্রান্ত দুর্বলতা (Identity Crisis), সে বিষয়টিই প্রমাণ করে। এ বিষয়টি নিয়ে অতীতে গবেষকরা যথেষ্ট আলোচনা করেছেন।
সার্বিকভাবে বলা যায়, প্রধানমন্ত্রীনির্ভর শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত ও নির্ভেজাল সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বিকৃতি। এ ধরনের বিকৃতিকে অনেকে গ্রহণযোগ্য বলে যুক্তি প্রদর্শন করেন। যুক্তিটি হলো, সংসদীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ এখনো শৈশবে। এ কারণেই নির্ভেজাল গণতান্ত্রিক শাসন কাঠামো এখনই আশা করা যায় না। এর সঙ্গে যুক্ত হয় ১৯৭৫ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত সামরিক শাসনব্যবস্থার বিষয়টি। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন হয়। এর আয়ুষ্কাল ছিল প্রায় দুই বছর। কারণ ১৯৭৫ সালের প্রথমার্ধে নির্বাচিত সংসদই একদলীয় শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন করে। এ কারণে বলা যায় যে সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার অপমৃত্যু ঘটে নির্বাচিত সংসদের কারণে, সামরিক হস্তক্ষেপের জন্য নয়। সামরিক শাসনব্যবস্থা চালু হয় ১৯৭৫-এর দ্বিতীয়ার্ধে। এর পর থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত পরপর দুইবার সামরিক শাসকদের মধ্যে ক্ষমতার পটপরিবর্তন হয়। দুই সামরিক শাসকই অবশ্য পরবর্তী সময়ে নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনীতিতে অনুপ্রবেশ করেন। নিজ নিজ দলও গঠন করেন। এরপর ১৯৯১ সালে আবার সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। পুরো সময়টা প্রায় ২০ বছর (১৯৯১-২০১১)। তবে এর মধ্যে দুই বছর সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় ছিল। রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের বয়স প্রায় ৪০ বছর। এ সময়ের মধ্যে প্রায় ২২ বছর সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ছিল। ২২ বছর কম সময় নয়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথার অস্তিত্ব নিয়েই প্রধান বিরোধী দলের সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের মতবিরোধ, যা এখন তুঙ্গে। প্রধান বিরোধী দলের অন্যতম সহযোগী দল বর্তমানে দুর্বল। প্রধান বিরোধী দলও যে বর্তমানে সবল, তা বলা যাবে না। মূল কারণ সাংগঠনিক দুর্বলতা। তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে আন্দোলন করার চেয়ে কিভাবে পরবর্তী নির্বাচনে জয়ী হওয়া যায়, সে দিকেই বিরোধী দলের দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। চলমান সংসদীয় গণতান্ত্রিক ধারায় সংসদ বর্জনসহ রাজপথে আন্দোলনের প্রবণতা ১৯৯১ সাল থেকেই দৃশ্যমান। এ প্রবণতা কমবেশি সব রাজনৈতিক দলের রয়েছে। এ প্রবণতাই সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে স্থায়ী রূপ দেওয়ার অন্যতম প্রধান অন্তরায়।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা
No comments