রঙ্গব্যঙ্গ-'আমি দারোগা হব না, বাবা!' by মোস্তফা কামাল
আগেকার দিনে গ্রামগঞ্জে বড় চাকরি বলতেই দারোগার চাকরি বোঝাত। গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছে দারোগারা ছিলেন দেবতুল্য। কারণ তাঁদের ছিল বেসুমার ক্ষমতা। গ্রামে দারোগা গেলে ভয়ে গ্রামছাড়া হতো মানুষ। গ্রামে দারোগা এসেছেন বলে রব ওঠে যেত।
সে জামানা এখন আর নেই। কিন্তু দারোগার নাম ডাক এখনো গ্রামে ছড়িয়ে আছে। এ প্রসঙ্গে একটা পুরনো গল্প বলি।
জুলফিকার আলী লন্ডন থেকে ব্যারিস্টারি পাস করে গ্রামে বেড়াতে গেছেন। আমাদের দেশে বিত্তশালীদের ছেলেমেয়েরা সাধারণত লন্ডনে ব্যারিস্টারি পড়াশোনা করতে যায়। লন্ডনে ব্যারিস্টারি পড়লে নাকি ইজ্জত বাড়ে। কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ব্যারিস্টারি পড়ল তা দেখার বিষয় না। কেউ কোনোদিন দেখেও না। যাকগে, জুলফিকার আলী তাঁর দাদিকে সালাম করে বললেন, দাদিমা, আমি ব্যারিস্টারি পাস করেছি। আমাকে দোয়া করবেন। আমি যেন আরো বড় হতে পারি।
জুলফিকার আলীর দাদি আগেকার দিনের মানুষ। তিনি কি আর ব্যারিস্টারির মানে বোঝেন! তিনি বোঝেন, বড় হওয়ার মানে হচ্ছে দারোগার চাকরি পাওয়া। কাজেই তিনি বললেন, তুমি আরো বড় হও ভাই। তুমি দারোগার চাকরি পেয়ে আমাদের মুখ উজ্জ্বল কর।
জুলফিকার আলী তাঁর অশিক্ষিত দাদিকে কী বলে বোঝাবেন! বোঝাতে গেলে আবার কোন ঝামেলায় পড়েন! তাই তিনি কথা না বাড়িয়ে চুপ করে রইলেন। আর মনে মনে বললেন, হায়রে! দাদীমা আমাকে কী দোয়া করলেন! দারোগা হয়ে নাকি আমি তাঁদের মুখ উজ্জ্বল করব! এতো পড়াশোনা করলাম কি দারোগা হওয়ার জন্য?
২.
মতিয়ারের বাবা একজন জেলে। তাঁর নাম আতিয়ার। তিনি তুরাগ নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। ছেলে পড়ার ফাঁকে বাবাকে সহায়তা করে। প্রতি রাতে সে বাবার সঙ্গে মাছ ধরতে যায়। দিনে বাবা মাছ বিক্রি করেন আর ছেলে চলে যায় স্কুলে। মতিয়ার পড়াশোনা করে দারোগা হবে। সে তার বাবাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, বাবা, আমি পড়াশোনা করে কি হব?
আতিয়ার বলেছেন, তুমি বাবা দারোগা হইয়া আমার আশা পূরণ করবা।
কেন আমি দারোগা হব?
কারণ দারোগার অনেক ক্ষমতা! দারোগা দিনকে রাত আর রাতকে দিন বানাইতে পারে। তুমি দারোগা হইতে পারলে আমি সবচাইতে খুশি হইব।
ঠিক আছে বাবা। আমি দারোগা হওয়ার চেষ্টা করব।
তারপর একদিন রাতে তুরাগ নদীতে মাছ ধরতে যান আতিয়ার। মতিয়ারও তাঁর সঙ্গে যায়। সেই রাতে পুলিশ এক সন্ত্রাসীকে খুঁজতে বের হয়। ওপরের নির্দেশ, সন্ত্রাসীকে রাতের মধ্যে ধরতে হবে। কয়েকজন পুলিশ তুরাগের তীরে দাঁড়িয়ে আতিয়ারকে ডাকে।
এই! নৌকায় কে রে?
আমি, আতিয়ার।
কি করিস?
মাছ ধরি।
মাছ ধরিস! এই! তুই জানিস না, এই নদীতে মাছ ধরা মানা?
জে না। জানি না। আমরা তো এই নদীতে মাছ ধইরাই জীবন চালাই। কেউ তো কোনোদিন মানা করে নাই।
ঠিক আছে এদিকে আয়।
আতিয়ার নৌকা তীরে ভিড়ায়। আর ওমনি তিন-চার পুলিশ তাঁর নৌকায় ওঠে। দুই পুলিশ আতিয়ারকে দুই হাতে কষে ধরে বলে, চল।
কোথায়?
আমাদের সঙ্গে যাবি।
কেন, আমি আবার কী করলাম?
তোর নাম রুস্তম না?
জে না, আমার নাম আতিয়ার।
আরে না! তোর নাম রুস্তম। বল রুস্তম!
মতিয়ার দৌড়ে এসে তার বাবাকে ধরে। আমার বাবার নাম রুস্তম না, আতিয়ার। গ্রামের সবাই জানে, আমার বাবার নাম আতিয়ার।
পুলিশ ছেলেটির মুখের ওপর অস্ত্রের নল ধরে বলল, এই চুপ, একদম চুপ! তোর বাবা সন্ত্রাসী। তার নাম রুস্তম।
মতিয়ার চিৎকার করে বলে, আমার বাবা সন্ত্রাসী না! আমার বাবা জেলে। আপনারা আমার বাবাকে সন্ত্রাসী বানাবেন না! আমার বাবা ভালো মানুষ।
কিন্তু কে শোনে কার কথা! পুলিশ আতিয়ারকে ধরে নিয়ে যায়। ছেলে নৌকায় বসে কাঁদে আর বলে, বাবা, যেই পুলিশ মানুষের ওপর এত জুলুম করে, তুমি আমাকে সেই পুলিশের দারোগা হতে বললা। না বাবা, আমি পারব না। আমি দারোগা হব না! আমি জুলুম করতে পারব না!
মতিয়ার কাঁদতে থাকে।
৩.
বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নাল আবদিন ফারুককে নির্মমভাবে মারধর করা হয়েছে। তাঁকে মারধরের দৃশ্যটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের কল্যাণে আমরা দেখতে পেয়েছি। শুধু মারধরই করেনি; তাঁর গায়ের গেঞ্জি খুলে নিয়েছে পুলিশ। তারপর তিনি দৌড়ে পালাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাতেও রক্ষা হয়নি। পুলিশ সেখানে গিয়েও তাঁর ওপর হামলা চালিয়েছে। ফারুকের কথাবার্তা, আচার-আচরণে দোষ থাকতে পারে। তাই বলে একজন এমপিকে এভাবে পুলিশ পেটাবে?
আমাদের গল্পে আতিয়ার যেমন বলেছেন, পুলিশ দিনকে রাত আর রাতকে দিন বানাতে পারে। জয়নাল আবদিন ফারুকের ঘটনাটিও সেদিকেই যাচ্ছে। পুলিশ যাঁকে মারধর করেছে তাঁর বিরুদ্ধেই মামলা দিয়েছে। তিনি নাকি পুলিশের ওপর হামলা চালিয়েছেন এবং পুলিশের কাজে বাধা দিয়েছেন! আর ফারুকের মামলা পুলিশ গ্রহণই করেনি। গল্পের সঙ্গে বাস্তবের কাহিনীর কত মিল! অবশ্য এই দৃশ্য আমরা বিএনপির আমলেও দেখেছিলাম। সেই একই দৃশ্য এখন দেখছি। সবই গল্পের মতো মনে হয়।
এ মুহূর্তে আমার গল্পের মতিয়ারের সেই কথাটি বার বার কানে বাজছে_'আমি দারোগা হব না বাবা!'
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
জুলফিকার আলী লন্ডন থেকে ব্যারিস্টারি পাস করে গ্রামে বেড়াতে গেছেন। আমাদের দেশে বিত্তশালীদের ছেলেমেয়েরা সাধারণত লন্ডনে ব্যারিস্টারি পড়াশোনা করতে যায়। লন্ডনে ব্যারিস্টারি পড়লে নাকি ইজ্জত বাড়ে। কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ব্যারিস্টারি পড়ল তা দেখার বিষয় না। কেউ কোনোদিন দেখেও না। যাকগে, জুলফিকার আলী তাঁর দাদিকে সালাম করে বললেন, দাদিমা, আমি ব্যারিস্টারি পাস করেছি। আমাকে দোয়া করবেন। আমি যেন আরো বড় হতে পারি।
জুলফিকার আলীর দাদি আগেকার দিনের মানুষ। তিনি কি আর ব্যারিস্টারির মানে বোঝেন! তিনি বোঝেন, বড় হওয়ার মানে হচ্ছে দারোগার চাকরি পাওয়া। কাজেই তিনি বললেন, তুমি আরো বড় হও ভাই। তুমি দারোগার চাকরি পেয়ে আমাদের মুখ উজ্জ্বল কর।
জুলফিকার আলী তাঁর অশিক্ষিত দাদিকে কী বলে বোঝাবেন! বোঝাতে গেলে আবার কোন ঝামেলায় পড়েন! তাই তিনি কথা না বাড়িয়ে চুপ করে রইলেন। আর মনে মনে বললেন, হায়রে! দাদীমা আমাকে কী দোয়া করলেন! দারোগা হয়ে নাকি আমি তাঁদের মুখ উজ্জ্বল করব! এতো পড়াশোনা করলাম কি দারোগা হওয়ার জন্য?
২.
মতিয়ারের বাবা একজন জেলে। তাঁর নাম আতিয়ার। তিনি তুরাগ নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। ছেলে পড়ার ফাঁকে বাবাকে সহায়তা করে। প্রতি রাতে সে বাবার সঙ্গে মাছ ধরতে যায়। দিনে বাবা মাছ বিক্রি করেন আর ছেলে চলে যায় স্কুলে। মতিয়ার পড়াশোনা করে দারোগা হবে। সে তার বাবাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, বাবা, আমি পড়াশোনা করে কি হব?
আতিয়ার বলেছেন, তুমি বাবা দারোগা হইয়া আমার আশা পূরণ করবা।
কেন আমি দারোগা হব?
কারণ দারোগার অনেক ক্ষমতা! দারোগা দিনকে রাত আর রাতকে দিন বানাইতে পারে। তুমি দারোগা হইতে পারলে আমি সবচাইতে খুশি হইব।
ঠিক আছে বাবা। আমি দারোগা হওয়ার চেষ্টা করব।
তারপর একদিন রাতে তুরাগ নদীতে মাছ ধরতে যান আতিয়ার। মতিয়ারও তাঁর সঙ্গে যায়। সেই রাতে পুলিশ এক সন্ত্রাসীকে খুঁজতে বের হয়। ওপরের নির্দেশ, সন্ত্রাসীকে রাতের মধ্যে ধরতে হবে। কয়েকজন পুলিশ তুরাগের তীরে দাঁড়িয়ে আতিয়ারকে ডাকে।
এই! নৌকায় কে রে?
আমি, আতিয়ার।
কি করিস?
মাছ ধরি।
মাছ ধরিস! এই! তুই জানিস না, এই নদীতে মাছ ধরা মানা?
জে না। জানি না। আমরা তো এই নদীতে মাছ ধইরাই জীবন চালাই। কেউ তো কোনোদিন মানা করে নাই।
ঠিক আছে এদিকে আয়।
আতিয়ার নৌকা তীরে ভিড়ায়। আর ওমনি তিন-চার পুলিশ তাঁর নৌকায় ওঠে। দুই পুলিশ আতিয়ারকে দুই হাতে কষে ধরে বলে, চল।
কোথায়?
আমাদের সঙ্গে যাবি।
কেন, আমি আবার কী করলাম?
তোর নাম রুস্তম না?
জে না, আমার নাম আতিয়ার।
আরে না! তোর নাম রুস্তম। বল রুস্তম!
মতিয়ার দৌড়ে এসে তার বাবাকে ধরে। আমার বাবার নাম রুস্তম না, আতিয়ার। গ্রামের সবাই জানে, আমার বাবার নাম আতিয়ার।
পুলিশ ছেলেটির মুখের ওপর অস্ত্রের নল ধরে বলল, এই চুপ, একদম চুপ! তোর বাবা সন্ত্রাসী। তার নাম রুস্তম।
মতিয়ার চিৎকার করে বলে, আমার বাবা সন্ত্রাসী না! আমার বাবা জেলে। আপনারা আমার বাবাকে সন্ত্রাসী বানাবেন না! আমার বাবা ভালো মানুষ।
কিন্তু কে শোনে কার কথা! পুলিশ আতিয়ারকে ধরে নিয়ে যায়। ছেলে নৌকায় বসে কাঁদে আর বলে, বাবা, যেই পুলিশ মানুষের ওপর এত জুলুম করে, তুমি আমাকে সেই পুলিশের দারোগা হতে বললা। না বাবা, আমি পারব না। আমি দারোগা হব না! আমি জুলুম করতে পারব না!
মতিয়ার কাঁদতে থাকে।
৩.
বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নাল আবদিন ফারুককে নির্মমভাবে মারধর করা হয়েছে। তাঁকে মারধরের দৃশ্যটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের কল্যাণে আমরা দেখতে পেয়েছি। শুধু মারধরই করেনি; তাঁর গায়ের গেঞ্জি খুলে নিয়েছে পুলিশ। তারপর তিনি দৌড়ে পালাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাতেও রক্ষা হয়নি। পুলিশ সেখানে গিয়েও তাঁর ওপর হামলা চালিয়েছে। ফারুকের কথাবার্তা, আচার-আচরণে দোষ থাকতে পারে। তাই বলে একজন এমপিকে এভাবে পুলিশ পেটাবে?
আমাদের গল্পে আতিয়ার যেমন বলেছেন, পুলিশ দিনকে রাত আর রাতকে দিন বানাতে পারে। জয়নাল আবদিন ফারুকের ঘটনাটিও সেদিকেই যাচ্ছে। পুলিশ যাঁকে মারধর করেছে তাঁর বিরুদ্ধেই মামলা দিয়েছে। তিনি নাকি পুলিশের ওপর হামলা চালিয়েছেন এবং পুলিশের কাজে বাধা দিয়েছেন! আর ফারুকের মামলা পুলিশ গ্রহণই করেনি। গল্পের সঙ্গে বাস্তবের কাহিনীর কত মিল! অবশ্য এই দৃশ্য আমরা বিএনপির আমলেও দেখেছিলাম। সেই একই দৃশ্য এখন দেখছি। সবই গল্পের মতো মনে হয়।
এ মুহূর্তে আমার গল্পের মতিয়ারের সেই কথাটি বার বার কানে বাজছে_'আমি দারোগা হব না বাবা!'
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
No comments