১৯৫৭’র কাগমারী সম্মেলন স্বাধিকার আন্দোলনের সূচনা by এম গোলাম মোস্তফা ভুইয়া
মজলুম
জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে অসংখ্য
রাজনৈতিক কর্মসূচির আয়োজন করেছিলেন। এর মধ্যে তার অবিস্মরণীয় কীর্তি এবং
উপমহাদেশের তথা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আজকের বাংলাদেশের একটি ঐতিহাসিক
ঘটনা হচ্ছে ১৯৫৭ সালের ‘ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলন।’ উপমহাদেশ ও পূর্ব বাংলা
তথা আজকের বাংলাদেশের রাজনীতিতে এর তাৎপর্য অনাগত কালের গবেষকদের কাছে
স্বীকৃত।
পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক অস্থিরতা মধ্যে ১৯৫৫ সালের ২১-২৩ অক্টোবর পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের তিন দিনব্যাপী দ্বিবার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় ঢাকায় রূপমহল সিনেমা হলে। এই অধিবেশনে বলা হয়েছিলÑ ‘... পাকিস্তান সরকারের গত কয়েক বছর পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি, বাগদাদ চুক্তি, সিয়াটো চুক্তি প্রভৃতি এমন সব চুক্তিতে আবদ্ধ হইয়াছে, যেসব চুক্তির দ্বারা দেশের সার্বভৌমত্ব এবং দেশের অর্থনৈতিক, ব্যবসাগত ও বাণিজ্যিক স্বাধীনতা ুণœ হইয়াছে।’ ’৫৬-এর ১৯-২০ মে ঢাকায় আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনেও যুদ্ধ জোটের বিরুদ্ধে প্রস্তাব নেয়া হয়। তাতে বলা হয়, ‘কোনো বৈদেশিক শক্তির লেজুর’Ñ হিসেবে না থেকে পাকিস্তান সরকারের উচিত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বৈদেশিক নীতি অনুসরণ করা। এই জাতীয় প্রস্তাব আওয়ামী লীগের অনেক প্রবীণ নেতার বিতৃষ্ণার কারণ হয় এবং মওলানা ভাসানী হন তাদের বিরাগভাজন।
দু’টি প্রধান বিষয়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে মওলানা ভাসানীর মতপার্থক্য শেষ পর্যন্ত মীমাংসার অযোগ্য বিরোধে পর্যবসিত হয়, যার একটি অবহেলিত শোষিত পূর্ব বাংলার পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন আর অপরটি সব সামরিক চুক্তি বাতিল করে জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ। এই দু’টি বিষয়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন আপসপ্রবণ ও নমনীয় পক্ষান্তরে মওলানা ভাসানী ছিলেন অনড় ও আপসহীন। অবশ্য এই দু’টি বিষয় কোনো ব্যক্তিগত ব্যাপার ছিল না, এগুলো ছিল আওয়ামী লীগেরই নীতি।
৩ ফেব্রুয়ারি মওলানা ভাসানী ‘কাগমারীর ডাক’ শীর্ষক আর একটি প্রচারপত্র প্রকাশ করেন। তাতে বলা হয়Ñ ‘সাড়ে চার কোটি বাঙালির বাঁচার দাবি আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন আদায়ের ডাক; ঐতিহাসিক ২১ দফা আদায়ের ডাক; চাষি-মজুর, কামার-কুমার, ব্যবসায়ী, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী সবশ্রেণীর মিলনের ডাক; পূর্ব বাংলার ৬০ হাজার গ্রামে আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করার ডাক; ২১ দফার পূর্ণ রূপায়নের জন্য আমাদের নিরবচ্ছিন্ন আন্দোলন চালাইয়া যাইতে হইবে। ইহা সারা পাকিস্তানের সামাজিক ও আর্থিক পরাধীনতার হাত হইতে মুক্তির মহান সনদ, ইহা যেন আমরা কখনো বিস্মৃত না হই।’ Ñমওলানা ভাসানী।
তখন তার দল হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে কেন্দ্রে এবং আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত তখন এই বক্তব্য দিয়ে একটি মহাসম্মেলনের আয়োজন খুবই তাৎপর্যপূর্ণ এবং সহজবোধ্যও বটে। কাগমারী সম্মেলনে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আতাউর রহমান খানসহ কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক মন্ত্রিসভার প্রায় সব মন্ত্রীই যোগ দিয়েছিলেন। কাগমারী সম্মেলন সফল করতে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে যে প্রস্তুতি কমিটি গঠন হয়েছিল তার অন্যতম সদস্যরা হলেনÑ ইয়ার মোহাম্মদ খান, কাজী মো: ইদরীস, ফকির সাহবুদ্দিন আহমেদ, খায়রুল কবির, খন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস, সদর ইস্পাহানী, আবু জাফর শামসুদ্দিন। সম্মেলনের আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে যে, এই সম্মেলন উপলক্ষে টাঙ্গাইল শহর থেকে সন্তোষের কাগমারী পর্যন্ত প্রায় পাঁচ কিলোমিটার রাস্তায় অসংখ্য তোরণ নির্মিত হয়েছিল। আবার সেই তোরণগুলোর নাম দেয়া হয়েছিল বিশ্ব মানবতার মুক্তির দূত বিশ্বনবী হজরত মোহাম্মদ সা: থেকে শুরু করে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় এবং ব্রিটিশবিরোধী উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ও সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী নেতাদের নামে। উল্লেখযোগ্য তোরণগুলোর নাম হলো হজরত মোহাম্মদ সা: তোরণ, মহাত্মা গান্ধী তোরণ, মাওলানা মোহাম্মদ আলী, কাজী নজরুল ইসলাম, মহাকবি ইকবাল, নেতাজী সুভাস বোস, হাজী শরীয়তউল্লাহ, শহীদ তিতুমীর, পণ্ডিত জওয়াহেরলাল নেহরু, হাজী মুহাম্মদ মহসীন, সিআর দাস, লেনিন, স্ট্যালিন, মাও সেতুং, ওয়ার্ড ওয়ার্থ, বায়রন, শেলী, মাওলানা রুমী, হজরত ইমাম আবু হানিফা, হজরত ইমাম গাজ্জালী এভাবে ৫১টি তোরণের নাম দিয়েছিলেন মওলানা ভাসানী। সর্বশেষ তোরণটি ছিল কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তোরণ।
এই সম্মেলনে অংশগ্রহণের জন্য মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন বেশ কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রনায়কদের। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেনÑ ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওয়াহেরলাল নেহরু, মিসরের প্রেসিডেন্ট জামাল আবদুল নাসের, চীনের উপপ্রধানমন্ত্রী, ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট আহমেদ সুকর্নো অথবা তার প্রতিনিধি, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বিধান চন্দ্র রায় ও ব্রিটেনের বিরোধী দলের নেতা। জওয়াহেরলাল নেহরু, বিধান চন্দ্র রায় ও জামাল আবদুল নাসের চিঠি দিয়ে সম্মেলনের সাফল্য কামনা করে মওলানা ভাসানীকে ব্যক্তিগত চিঠি দিয়েছিলেন। কাগমারী সম্মেলনে মওলানা ভাসানী তার ভাষণের এক পর্যায়ে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর উদ্দেশে তার সুপরিচিত ও সুবিখ্যাত ‘আসসালামু আলাইকুম’ উচ্চারণ করেন। ওই ‘আসসালামু আলাইকুম’-এর তাৎপর্য উপস্থিত শ্রোতা যাদের মতে, ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতার প্রথম স্পষ্ট দাবি এবং তার জন্যে প্রয়োজনীয় সংগ্রাম ও ত্যাগের সংকল্প ওই ‘আসসালামু আলাইকুম’ ধ্বনি মাধ্যমে ঘোষিত হয়েছিল।’
কাগমারী সম্মেলন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলনের ইতিহাসে এক স্মরণীয় ঘটনা। সম্মেলনের সময় মওলানা ভাসানী টাঙ্গাইল-কাগমারী সড়কের নাম দিয়েছিলেন বিশ্বভ্রাতৃত্ব ও স্বাধীনতা সড়ক। এ নামকরণ যে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ তা আলোচনার প্রয়োজন নেই। কাগমারী সম্মেলনে অধিবেশনের আলোচনা ও প্রস্তাবগুলো সর্বসম্মত না হলেও সাংস্কৃতিক সম্মেলনটি সুচারুরূপে সমাপ্ত হয়। এ সম্মেলনের পর মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী ও তার সমর্থিত নেতাকর্মীদের আওয়ামী লীগের সাথে থাকা অসম্ভব হয়ে ওঠে।
প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান এবং তাদের সহকর্মী ও সমর্থকদের সাথে নীতির প্রশ্নে আপসের কোনো সুযোগ ছিল না। তারা বলেছিলেন পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন হয়েই গেছে এবং মার্কিনপন্থী জোটভুক্ত পররাষ্ট্রনীতি পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। পশ্চিম পাকিস্তানের এক ইউনিট বাতিলেও প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অনীহা ছিল। আর অন্য দিকে এসব প্রশ্নে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী ছিলেন অবিচল ও আপসহীন। তিনি তার মনস্থির করে ফেলেছিলেন, তবে দল ত্যাগের ব্যাপারে প্রকাশ্যে কোনো উচ্চবাচ্য করেননি। যে দলটির তিনি শুধু প্রতিষ্ঠাতাই ননÑ আপ্রাণ চেষ্টায় দিনের পর দিন অকান্ত পরিশ্রমে তিল তিল করে গড়ে তুলেছিলেন, যে দলটির পতাকার নিচে সমবেত করেছেন দেশের সব এলাকার সব সম্প্রদায়ের মানুষকে, যে দলটি কেন্দ্রে ও প্রদেশে ক্ষমতাসীন, দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি সত্ত্বেও পূর্ব বাংলায় আওয়ামী লীগ সরকার বেশ কিছু প্রগতিশীল কাজও করেছে, যে দলের প্রধান তিনি, সেই দল পরিত্যাগ করার মুহূর্তে তিনি মানসিকভাবে আঘাত পেয়েছিলেন বটে; কিন্তু আদর্শের ও নীতির সাথে আপস করা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না।
কাগমারী সম্মেলনে মওলানা ভাসানীর কঠোর ভাষণ এবং তার ‘আসসালামু আলাইকুম’ যে বিতর্কের সূচনা করে তাতে প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী যিনি আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাও বটে, বিব্রত হন, পরিস্থিতি আয়ত্তে আনতে তিনি মওলানা ভাসানীর সমর্থনে একটি নমনীয় বিবৃতিও প্রদান করেন, যা ’৫৭-এর ১৬ ফেব্রুয়ারি দেশের সব পত্রপত্রিকার প্রকাশিত হয়। কাগমারী সম্মেলনে মওলানা ভাসানী স্বায়ত্তশাসনের দাবি তুললেন, পক্ষান্তরে সম্মেলন থেকে ঢাকায় ফিরে সলিমুল্লাহ হলে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ঘোষণা করেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের ৯৮ শতাংশ স্বায়ত্তশাসন অর্জিত হয়ে গেছে। এই নিয়ে দুই দল ছাত্রদের মধ্যে প্রচণ্ড মারামারিও হয়। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আওয়ামী লীগের কাউন্সিল সভায় বামপন্থীদের সাথে একটি বোঝাপড়ার চেষ্টা চালান; কিন্তু তা ব্যর্থ হয়। ১৯৫৫ সালের মে অধিবেশনের প্রস্তাবগুলো যেমন পূর্ব বাংলার পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন, পাকিস্তানের জোট নিরপেক্ষ বৈদেশিক নীতি, বাগদাদ চুক্তি বাতিলের দাবি প্রভৃতি নিয়ে সে সভায় দীর্ঘ আলোচন চলে; কিন্তু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও তার সমর্থকদের মার্কিন ঘেঁষা ও পশ্চিম পাকিস্তানিদের সাথে সহযোগিতার নীতির বিরুদ্ধে মওলানা ভাসানী ও তার অনুগতরা অবিচল থাকেন। উভয় পক্ষই তাদের এই অনমনীয় মনোভাবের পরিণতি কী তা-ও তারা জানতেন। তবুও আদর্শগত অবস্থানের কারণে আওয়ামী লীগের ভাঙন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে।
শেষ করতে চাই এভাবে যে, বাংলাদেশের স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলন গড়ে তুলতে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী যে অবদান রেখেছেনÑ যে সম্মানী তিনি প্রাপ্য ছিলেন স্বাধীনতার ৪৪ বছরের সরকারগুলো তাকে তার প্রাপ্য সম্মান ও মর্যাদা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। আমাদের দেশের সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের প্রয়োজনে মওলানা ভাসানীকে ব্যবহার করলেও প্রকৃত অর্থে তাকে তার যথাযোগ্য মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করার কোনো কর্মসূচিই গ্রহণ করেনি। নিরপেক্ষ চিন্তায় অবশ্যই তিনি রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পাওয়ার অধিকারী।
লেখক : মহাসচিব, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পাটির্ Ñ বাংলাদেশ ন্যাপ
পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক অস্থিরতা মধ্যে ১৯৫৫ সালের ২১-২৩ অক্টোবর পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের তিন দিনব্যাপী দ্বিবার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় ঢাকায় রূপমহল সিনেমা হলে। এই অধিবেশনে বলা হয়েছিলÑ ‘... পাকিস্তান সরকারের গত কয়েক বছর পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি, বাগদাদ চুক্তি, সিয়াটো চুক্তি প্রভৃতি এমন সব চুক্তিতে আবদ্ধ হইয়াছে, যেসব চুক্তির দ্বারা দেশের সার্বভৌমত্ব এবং দেশের অর্থনৈতিক, ব্যবসাগত ও বাণিজ্যিক স্বাধীনতা ুণœ হইয়াছে।’ ’৫৬-এর ১৯-২০ মে ঢাকায় আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনেও যুদ্ধ জোটের বিরুদ্ধে প্রস্তাব নেয়া হয়। তাতে বলা হয়, ‘কোনো বৈদেশিক শক্তির লেজুর’Ñ হিসেবে না থেকে পাকিস্তান সরকারের উচিত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বৈদেশিক নীতি অনুসরণ করা। এই জাতীয় প্রস্তাব আওয়ামী লীগের অনেক প্রবীণ নেতার বিতৃষ্ণার কারণ হয় এবং মওলানা ভাসানী হন তাদের বিরাগভাজন।
দু’টি প্রধান বিষয়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে মওলানা ভাসানীর মতপার্থক্য শেষ পর্যন্ত মীমাংসার অযোগ্য বিরোধে পর্যবসিত হয়, যার একটি অবহেলিত শোষিত পূর্ব বাংলার পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন আর অপরটি সব সামরিক চুক্তি বাতিল করে জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ। এই দু’টি বিষয়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন আপসপ্রবণ ও নমনীয় পক্ষান্তরে মওলানা ভাসানী ছিলেন অনড় ও আপসহীন। অবশ্য এই দু’টি বিষয় কোনো ব্যক্তিগত ব্যাপার ছিল না, এগুলো ছিল আওয়ামী লীগেরই নীতি।
৩ ফেব্রুয়ারি মওলানা ভাসানী ‘কাগমারীর ডাক’ শীর্ষক আর একটি প্রচারপত্র প্রকাশ করেন। তাতে বলা হয়Ñ ‘সাড়ে চার কোটি বাঙালির বাঁচার দাবি আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন আদায়ের ডাক; ঐতিহাসিক ২১ দফা আদায়ের ডাক; চাষি-মজুর, কামার-কুমার, ব্যবসায়ী, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী সবশ্রেণীর মিলনের ডাক; পূর্ব বাংলার ৬০ হাজার গ্রামে আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করার ডাক; ২১ দফার পূর্ণ রূপায়নের জন্য আমাদের নিরবচ্ছিন্ন আন্দোলন চালাইয়া যাইতে হইবে। ইহা সারা পাকিস্তানের সামাজিক ও আর্থিক পরাধীনতার হাত হইতে মুক্তির মহান সনদ, ইহা যেন আমরা কখনো বিস্মৃত না হই।’ Ñমওলানা ভাসানী।
তখন তার দল হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে কেন্দ্রে এবং আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত তখন এই বক্তব্য দিয়ে একটি মহাসম্মেলনের আয়োজন খুবই তাৎপর্যপূর্ণ এবং সহজবোধ্যও বটে। কাগমারী সম্মেলনে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আতাউর রহমান খানসহ কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক মন্ত্রিসভার প্রায় সব মন্ত্রীই যোগ দিয়েছিলেন। কাগমারী সম্মেলন সফল করতে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে যে প্রস্তুতি কমিটি গঠন হয়েছিল তার অন্যতম সদস্যরা হলেনÑ ইয়ার মোহাম্মদ খান, কাজী মো: ইদরীস, ফকির সাহবুদ্দিন আহমেদ, খায়রুল কবির, খন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস, সদর ইস্পাহানী, আবু জাফর শামসুদ্দিন। সম্মেলনের আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে যে, এই সম্মেলন উপলক্ষে টাঙ্গাইল শহর থেকে সন্তোষের কাগমারী পর্যন্ত প্রায় পাঁচ কিলোমিটার রাস্তায় অসংখ্য তোরণ নির্মিত হয়েছিল। আবার সেই তোরণগুলোর নাম দেয়া হয়েছিল বিশ্ব মানবতার মুক্তির দূত বিশ্বনবী হজরত মোহাম্মদ সা: থেকে শুরু করে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় এবং ব্রিটিশবিরোধী উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ও সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী নেতাদের নামে। উল্লেখযোগ্য তোরণগুলোর নাম হলো হজরত মোহাম্মদ সা: তোরণ, মহাত্মা গান্ধী তোরণ, মাওলানা মোহাম্মদ আলী, কাজী নজরুল ইসলাম, মহাকবি ইকবাল, নেতাজী সুভাস বোস, হাজী শরীয়তউল্লাহ, শহীদ তিতুমীর, পণ্ডিত জওয়াহেরলাল নেহরু, হাজী মুহাম্মদ মহসীন, সিআর দাস, লেনিন, স্ট্যালিন, মাও সেতুং, ওয়ার্ড ওয়ার্থ, বায়রন, শেলী, মাওলানা রুমী, হজরত ইমাম আবু হানিফা, হজরত ইমাম গাজ্জালী এভাবে ৫১টি তোরণের নাম দিয়েছিলেন মওলানা ভাসানী। সর্বশেষ তোরণটি ছিল কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তোরণ।
এই সম্মেলনে অংশগ্রহণের জন্য মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন বেশ কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রনায়কদের। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেনÑ ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওয়াহেরলাল নেহরু, মিসরের প্রেসিডেন্ট জামাল আবদুল নাসের, চীনের উপপ্রধানমন্ত্রী, ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট আহমেদ সুকর্নো অথবা তার প্রতিনিধি, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বিধান চন্দ্র রায় ও ব্রিটেনের বিরোধী দলের নেতা। জওয়াহেরলাল নেহরু, বিধান চন্দ্র রায় ও জামাল আবদুল নাসের চিঠি দিয়ে সম্মেলনের সাফল্য কামনা করে মওলানা ভাসানীকে ব্যক্তিগত চিঠি দিয়েছিলেন। কাগমারী সম্মেলনে মওলানা ভাসানী তার ভাষণের এক পর্যায়ে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর উদ্দেশে তার সুপরিচিত ও সুবিখ্যাত ‘আসসালামু আলাইকুম’ উচ্চারণ করেন। ওই ‘আসসালামু আলাইকুম’-এর তাৎপর্য উপস্থিত শ্রোতা যাদের মতে, ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতার প্রথম স্পষ্ট দাবি এবং তার জন্যে প্রয়োজনীয় সংগ্রাম ও ত্যাগের সংকল্প ওই ‘আসসালামু আলাইকুম’ ধ্বনি মাধ্যমে ঘোষিত হয়েছিল।’
কাগমারী সম্মেলন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলনের ইতিহাসে এক স্মরণীয় ঘটনা। সম্মেলনের সময় মওলানা ভাসানী টাঙ্গাইল-কাগমারী সড়কের নাম দিয়েছিলেন বিশ্বভ্রাতৃত্ব ও স্বাধীনতা সড়ক। এ নামকরণ যে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ তা আলোচনার প্রয়োজন নেই। কাগমারী সম্মেলনে অধিবেশনের আলোচনা ও প্রস্তাবগুলো সর্বসম্মত না হলেও সাংস্কৃতিক সম্মেলনটি সুচারুরূপে সমাপ্ত হয়। এ সম্মেলনের পর মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী ও তার সমর্থিত নেতাকর্মীদের আওয়ামী লীগের সাথে থাকা অসম্ভব হয়ে ওঠে।
প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান এবং তাদের সহকর্মী ও সমর্থকদের সাথে নীতির প্রশ্নে আপসের কোনো সুযোগ ছিল না। তারা বলেছিলেন পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন হয়েই গেছে এবং মার্কিনপন্থী জোটভুক্ত পররাষ্ট্রনীতি পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। পশ্চিম পাকিস্তানের এক ইউনিট বাতিলেও প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অনীহা ছিল। আর অন্য দিকে এসব প্রশ্নে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী ছিলেন অবিচল ও আপসহীন। তিনি তার মনস্থির করে ফেলেছিলেন, তবে দল ত্যাগের ব্যাপারে প্রকাশ্যে কোনো উচ্চবাচ্য করেননি। যে দলটির তিনি শুধু প্রতিষ্ঠাতাই ননÑ আপ্রাণ চেষ্টায় দিনের পর দিন অকান্ত পরিশ্রমে তিল তিল করে গড়ে তুলেছিলেন, যে দলটির পতাকার নিচে সমবেত করেছেন দেশের সব এলাকার সব সম্প্রদায়ের মানুষকে, যে দলটি কেন্দ্রে ও প্রদেশে ক্ষমতাসীন, দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি সত্ত্বেও পূর্ব বাংলায় আওয়ামী লীগ সরকার বেশ কিছু প্রগতিশীল কাজও করেছে, যে দলের প্রধান তিনি, সেই দল পরিত্যাগ করার মুহূর্তে তিনি মানসিকভাবে আঘাত পেয়েছিলেন বটে; কিন্তু আদর্শের ও নীতির সাথে আপস করা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না।
কাগমারী সম্মেলনে মওলানা ভাসানীর কঠোর ভাষণ এবং তার ‘আসসালামু আলাইকুম’ যে বিতর্কের সূচনা করে তাতে প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী যিনি আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাও বটে, বিব্রত হন, পরিস্থিতি আয়ত্তে আনতে তিনি মওলানা ভাসানীর সমর্থনে একটি নমনীয় বিবৃতিও প্রদান করেন, যা ’৫৭-এর ১৬ ফেব্রুয়ারি দেশের সব পত্রপত্রিকার প্রকাশিত হয়। কাগমারী সম্মেলনে মওলানা ভাসানী স্বায়ত্তশাসনের দাবি তুললেন, পক্ষান্তরে সম্মেলন থেকে ঢাকায় ফিরে সলিমুল্লাহ হলে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ঘোষণা করেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের ৯৮ শতাংশ স্বায়ত্তশাসন অর্জিত হয়ে গেছে। এই নিয়ে দুই দল ছাত্রদের মধ্যে প্রচণ্ড মারামারিও হয়। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আওয়ামী লীগের কাউন্সিল সভায় বামপন্থীদের সাথে একটি বোঝাপড়ার চেষ্টা চালান; কিন্তু তা ব্যর্থ হয়। ১৯৫৫ সালের মে অধিবেশনের প্রস্তাবগুলো যেমন পূর্ব বাংলার পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন, পাকিস্তানের জোট নিরপেক্ষ বৈদেশিক নীতি, বাগদাদ চুক্তি বাতিলের দাবি প্রভৃতি নিয়ে সে সভায় দীর্ঘ আলোচন চলে; কিন্তু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও তার সমর্থকদের মার্কিন ঘেঁষা ও পশ্চিম পাকিস্তানিদের সাথে সহযোগিতার নীতির বিরুদ্ধে মওলানা ভাসানী ও তার অনুগতরা অবিচল থাকেন। উভয় পক্ষই তাদের এই অনমনীয় মনোভাবের পরিণতি কী তা-ও তারা জানতেন। তবুও আদর্শগত অবস্থানের কারণে আওয়ামী লীগের ভাঙন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে।
শেষ করতে চাই এভাবে যে, বাংলাদেশের স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলন গড়ে তুলতে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী যে অবদান রেখেছেনÑ যে সম্মানী তিনি প্রাপ্য ছিলেন স্বাধীনতার ৪৪ বছরের সরকারগুলো তাকে তার প্রাপ্য সম্মান ও মর্যাদা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। আমাদের দেশের সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের প্রয়োজনে মওলানা ভাসানীকে ব্যবহার করলেও প্রকৃত অর্থে তাকে তার যথাযোগ্য মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করার কোনো কর্মসূচিই গ্রহণ করেনি। নিরপেক্ষ চিন্তায় অবশ্যই তিনি রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পাওয়ার অধিকারী।
লেখক : মহাসচিব, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পাটির্ Ñ বাংলাদেশ ন্যাপ
No comments