বার্ন ইউনিট ও এসএসসি by ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
গত
দু’সপ্তাহ ধরে ঢাকার টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে এসএসসি পরীক্ষা ও ঢাকা
মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিট নিয়ে তোলপাড় চলছিল। বলতে পারেন,
এখনো চলছে। এটা খুব স্বাভাবিক এবং মানবিক।
গত মাসের ৩ তারিখ থেকে সারা দেশে অবরোধ চলছে। এ অবরোধ শুরু করেছিল সরকার। পলায়নপর মনোবৃত্তি থেকেই সরকার ঢাকায় ২০ দলীয় জোটের জনসভা ভণ্ডুল করতে চেয়েছিল। ৫ তারিখে ঘোষিত ওই জনসভায় যাতে ২০ দলীয় জোট সমর্থক ও সরকারের প্রতি বিক্ষুব্ধ মানুষজন যোগ দিতে না পারে, সে জন্য কার্যত সৃষ্টি করা হয়েছিল অবরোধ। বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল ঢাকামুখী সব যানবাহন। এতেই ক্ষান্ত হয়নি। ৩ তারিখ রাত থেকেই ২০ দলীয় জোটনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে তার কার্যালয়ে তালা মেরে অবরুদ্ধ করে ফেলে। নিজেরাও একটি জনসভার ঘোষণা দিয়েছিল বটে, কিন্তু ঢাকামুখী সব যান চলাচল বন্ধ করে দিয়ে তারা প্রমাণ করে যে, ওই জনসভা আসলে তারা করতে চায়নি। বরং ২০ দলের জনসমাবেশ বন্ধ করার জন্যই ছিল ওই আয়োজন।
নিজ কার্যালয়ে সরকার কর্তৃক অবরুদ্ধ (কার্যত বন্দী) বেগম জিয়া যখন ৫ জানুয়ারি বিকেলে তার কার্যালয় থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করলেন, ততক্ষণে অনেক দক্ষ-যজ্ঞ কাণ্ড ঘটে গেছে। ডজনখানেক ইট-বালুর ট্রাক এনে তার বাড়ির চার পাশে রেখে দেয় পুলিশ। নিয়োগ করা হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শত শত সদস্য। খালেদা জিয়ার কার্যালয়টি কার্যত একটি কারাগারে পরিণত হয়। ৫ জানুয়ারি তাকে কার্যালয় থেকে বের হতে পুলিশ বাধা দেয়। তিনি ও তার দলের নেতানেত্রীদের ওপর নিষিদ্ধ ঘোষিত বিষাক্ত মরিচের গুঁড়া ছিটিয়ে দেয়া হয়। পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হয়ে ওঠে। তার কার্যালয়ের সব গেটে তালা লাগিয়ে দেয়া হলো। তিনি বের হতে পারেননি। এতে বাস্তবে সরকার যে অবরোধের নির্দেশ আগেই দিয়েছিল, সে অবরোধ অনির্দিষ্টকাল চলবে বলে ঘোষণা দেন বেগম জিয়া।
সরকারের প্রতি ক্ষুব্ধ শোষিত নিপীড়িত সাধারণ মানুষ। ফলে এই ঘোষণার সাথে সাথে কার্যত গোটা দেশ অচল হয়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় রাজপথ, নৌপথ, রেলপথ। জেলা-উপজেলায় অপশাসন থেকে মুক্তির লড়াইয়ে বের করা মিছিল প্রতিদিন দীর্ঘতর হতে থাকে। সরকার যত হুমকি দেয়, আন্দোলন হয়ে ওঠে আরো জোরদার। বলা বাহুল্য, বিরোধী দলের দাবি অত্যন্ত যৌক্তিকÑ একটি নিরপেক্ষ কর্তৃত্বের অধীনে সব দলের অংশগ্রহণমূলক অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। প্রথম দিকে সরকারও বলেছিল, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, তা নিতান্তই ‘নিয়ম রক্ষা’র নির্বাচন। এখন বলছে, এই সরকার পুরো পাঁচ বছরই ক্ষমতায় থাকবে এবং ২০১৯ সালের আগে কোনো নির্বাচন নয়। অথচ গত বছর সরকার যে নির্বাচন করেছে, তা পৃথিবীর কেউ-ই নির্বাচন বলে স্বীকার করেননি। তখন গোটা বিশ্বই দাবি করেছিল, অবিলম্বে সব দলের অংশগ্রহণমূলক একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দেয়া হোক। কিন্তু সরকার তাতে নারাজ।
২০ দলীয় জোটনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ডাকা অবরোধ কর্মসূচি ভালোভাবেই চলছিল। প্রতিদিন তা দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হচ্ছিল। প্রশাসন ক্রমেই সারা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অনেকটা ঢাকায় বন্দী হয়ে পড়ছিল। তখন এ আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে সরকার এক নতুন কৌশল গ্রহণ করল। হরতাল-অবরোধে সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ থাকে। কিন্তু পুরোপুরিই কি থাকে? ষাটের দশকে হরতাল চলাকালে আমরা সড়ক দিয়ে বাইসাইকেলও চলতে দিতাম না। এখন বাইসাইকেল, রিকশা, সিএনজিÑ এগুলোকে আর হরতাল-অবরোধের আওতাভুক্ত ধরা হয় না। হরতাল চলে, রিকশা সিএনজিও চলে। মাঝে মাঝে সরকারের অতি উৎসাহে হুট করে চলে যায় দু-একটা মিনি বাস। তাতে যাত্রী থাকে খুবই কম। যে দু’পাঁচ যাত্রী থাকে, অনেক ক্ষেত্রে তারা কোথায়ও নেমে যায় না। নতুন কোনো যাত্রীও উঠানো হয় না। দেখা যায়, এরা হলো সরকারের লোক। মূলত এভাবেই ‘হরতাল-অবরোধ হচ্ছে না’Ñ এটা দেখানোর চেষ্টা চলে।
এবার অবশ্য একটা নতুন দৃশ্যও দেখলাম। ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে চাতুরী। রাস্তাঘাট ফাঁকা। কিছু রিকশা, সিএনজি, মোটরসাইকেল, দু-একটা হাফটনি ট্রাক, দুই-একটা বাস এগুলো ট্রাফিক সিগন্যালে আটকে দিয়ে একধরনের যানজটের সৃষ্টি করা হয়। তারপর সিগন্যাল ছেড়ে দেয়া হয়। টিভি ক্যামেরায় ফুটেজ ধারণ করে সে দৃশ্য প্রচার করে এই বলে আত্মতৃপ্তি লাভ করা হয়, হরতাল-অবরোধ হয়নি। এই কৃত্রিম দৃশ্য তৈরি করে জনগণকে বিভ্রান্ত করা যাবে না। এখন মানুষই নিজ চোখে দেখছে, কী ঘটছে।
তবে দু’টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মানুষ ও মিডিয়ার মুখে মুখে। তার একটি হলো, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিট। অপরটি এসএসসি পরীক্ষা। ২০ দলীয় জোট আহূত অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট আহ্বানের পর প্রায় পনের দিন ধরে পেট্রলবোমা নামক বস্তুটির প্রয়োগ এ দেশে ছিল না। গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ক্রমেই অধিকসংখ্যক মানুষ তথা সর্বস্তরের মানুষ এই আন্দোলনে শরিক হয়েছে। অবরোধ কর্মসূচিতে দেশবাসী অত্যন্ত স্বতঃস্ফূর্তভাবে সরকারকে ‘না’ বলতে শুরু করে। সারা দেশে সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় বাস, ট্রাক, রেল, লঞ্চ চলাচল। এতে মানুষের যে অসুবিধা হয়নি, তা নয়। কিন্তু সেটি তারা বৃহত্তর স্বার্থে মেনেও নিয়েছে।
সরকার র্যাব, পুলিশ, বিজিবি দিয়ে জোর করে কিছু ট্রাক-বাস চালানোর চেষ্টা করেছে। প্রাথমিকভাবে সে প্রচেষ্টা অসহযোগিতার মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। ট্রাকচালকেরা যানবাহন চালাতে অস্বীকার করেছেন। সেটি শুধু নিরাপত্তাজনিত কারণে নয়, তার পেছনে ছিল অনির্বাচিত সরকারকে প্রত্যাখ্যানের মনোভাবও। দূরপাল্লার বাস চালু করা যায়নি। এ ক্ষেত্রে সরকারি লোকেরা বলছেন, বাস চালু করা যাচ্ছে না নিরাপত্তার অভাবে। অথচ মালিকেরা বলছেন, তারা বাস চালাতে পারছেন না যাত্রীর অভাবে। সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণাধীন মিডিয়া যাত্রীদের কথা তুলে ধরেনি। পঞ্চগড় থেকে সম্ভাব্য ঢাকা যাত্রীর সাক্ষাৎকার যদি ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রচারিত হতো, তাহলে আমরা বুঝতে পারতাম বাস চলছে, তবু তিনি ঢাকা যাবেন না কেন? সেটি কখনো প্রচারিত হয়নি। তিনিও সম্ভবত মনে করেছেন কিছু দিন অসুবিধা হলে হোক, পরিস্থিতির একটি হিল্লে হোক আগে।
কিন্তু সপ্তাহ দুয়েক পরে দৃশ্যপট একেবারেই বদলে গেল। সরকার দূরপাল্লার বাস মালিকদের দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করলÑ আমরা র্যাব পুলিশ ও সীমান্তে নিয়োজিত গার্ডদের দিচ্ছি। তারা তোমাদের গাড়ির সামনে থাকবে। পেছনে থাকবে। তোমরা বাস চালাও। দেখা গেল, বাস এসেছে তিনটি। তিন বাস মিলে যাত্রী সংখ্যা ১৬। কিন্তু মানুষকে তো দূরান্তে যেতে হবে। কিভাবে যাবে, যাদের খুব জরুরি প্রয়োজন নেই, তারা ঘর থেকে বেরই হতে চাননি। এমনকি ঢাকায়ও এখন মানুুুষ সন্ধ্যার পরে নিজস্ব যানবাহন নিয়ে চলাচলে ভয় পান।
কারণ ২০ দলীয় জোটের চলতি আন্দোলনের দুই সপ্তাহের মাথায় দৃশ্যপটে বিরাট পরিবর্তন ঘটে গেল। এ দেশে ককটেল কালচার শুরু হয়েছে বিগত শতাব্দীর ষাটের দশক থেকে। তার আগেও সম্ভবত ছিল। কিন্তু তা ছিল বিচ্ছিন্ন ঘটনা। বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকে তা প্রায় নিয়মিত ব্যাপারে পরিণত হয়। পেট্রলবোমা কনসেপ্টের বয়স ১০-১৫ বছর হবে কি না সন্দেহ। সরকার ২০ দলীয় জোটের ডাকা কর্মসূচি ভণ্ডুল করতে যখন বিজিবি আর র্যাব পুলিশ পাহারায় দেশের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত পর্যন্ত জোর করে বাস ট্রাক চালানোর চেষ্টা করল, ২০ দলীয় জোট এর প্রতিবাদ করেনি। জনগণ যদি সমর্থন না দেয়, তাহলে তাদের কী করার আছে? আর সরকারের চিন্তা হলো, বাস চালানোর জন্য যাত্রীও পাওয়া যাচ্ছে, ট্রাক চালানোর জন্য মালিক-চালকও পাওয়া যাচ্ছে না। সুতরাং সামনে র্যাব-পুলিশ-বিজিবির গাড়ি। মাঝখানে ১০-১৫টা বাস-ট্রাক। পেছনে র্যাব-পুলিশ-বিজিবির গাড়ি। পারলে চলুক।
এরকম পরিস্থিতিতেই হঠাৎ শুরু হয়ে গেল বাস-ট্রাকে পেট্রলবোমা হামলা। সামনে পেছনে পাহারাদার। অথচ গায়েবি এলাকা থেকে হুট করে ছুটে এলো পেট্রলবোমা। পেট্রলবোমার যেসব ছবি আমরা দেখলাম, সেগুলো দেখতে অতি সাধারণ। একটা সেভেন আপ বা স্প্রাইটের বোতলে কিছু একটা তরল পদার্থ তার মুখে সলতেজাতীয় কিছু জিনিস শক্ত করে লাগিয়ে দেয়া। সেটা আবার স্কচটেপ দিয়ে শক্ত করে পেঁচানো। এই সলতেতে আগুন দিয়ে খুব জোরে যানবাহনে ছুড়ে মারলেই কাজ হয়ে যায়।
পেট্রলবোমার আঘাতে পোড়ার সে দৃশ্য! ওহ্। সে ভয়ঙ্কর দৃশ্য কল্পনাও করা যায় না। জীবন্ত মানুষ পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেল। ঝলসে গেল নিরীহ নিরপরাধ সাধারণ মানুষের শরীর। ঝলসে গেল অনেক সম্পদ, সন্তান ও সম্ভাবনা। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিট মানুষ পোড়ার গন্ধে শোক-বিহ্বল হয়ে উঠল। কে দেখতে চায় মানুষের ওপর মানুষের এমন বীভৎস নারকীয় আক্রমণের দৃশ্য! সরকার সে সুযোগটা সম্পূর্ণ কাজে লাগাল। দোষারোপ করতে থাকল, ২০ দলীয় জোট অবরোধের ডাক দিয়েছে, অতএব তারাই এই পেট্রলবোমা মারল। মেরে মানুষ পুড়িয়ে হত্যা করছে। বহু মানুষকে অসহ্য, অমানবিক পৈশাচিক বর্বরতার শিকার করছে।
বিশ দলীয় জোট যতই বলতে থাকে, এ ধরনের হিংস্্র ঘটনার সাথে তারা কোনোভাবেই জড়িত নয়, তারা গণতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করছে, সে কথা সরকার নিয়ন্ত্রণাধীন মিডিয়ায় হালে পানি পেল না। বার্ন ইউনিট নিয়ে প্রতিদিন যে স্টোরি প্রকাশিত হতে থাকে, তা সত্যিই হৃদয়বিদারক। ঘটনা যে খুবই হৃদয়বিদারক, মর্মান্তিক, পৈশাচিক, তাতে কোনো সন্দেহ নেই কারো।
সর্বশেষ দু’টি ঘটনা ঘটল কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম এবং বরিশালের গৌরনদীতে। কক্সবাজার থেকে ঢাকার দিকে আসছিল ‘আইকন’ পরিবহনের একটি বাস। সে বাসের সামনে বিজিবির পাহারা ছিল। সে পাহারাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ওই বাসটিতে পেট্রলবোমা নিক্ষেপ করে দুষ্কৃতকারীরা। এতে সাতজন পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেলেন। আরো অনেকে অগ্নিদগ্ধ হয়ে হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন। সে হৃদয়বিদারক দৃশ্য মানুষ হিসেবে চোখে দেখা যায় না। একই ঘটনা ঘটেছে গৌরনদীতেও। সামনে বিজিবি পাহারা। পেছনে ছিল কয়েকটি ট্রাক। তার পেছনেও ছিল সরকারি পাহারা। তার মাঝখানেই একটি ট্রাকে পেট্রলবোমা ছোড়ে দুষ্কৃতকারীরা। সেখানেও পুড়ে মারা যায় ট্রাকচালক ও হেলপার। তা-ও মর্মান্তিক, নিষ্ঠুর ও হৃদয়বিদারক। এই অপরাধীদের কিছুতেই ক্ষমা নেই।
এর একটা লিংক আমাদের দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক উপদেষ্টা, বহুল বিতর্কিত এইচ টি ইমাম। তিনি কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে নৈশকোচের নাশকতাকে ‘মিলিটারি অপারেশনে’র মতো বলে মনে করেন। তার মতে, যারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে তারা প্রশিক্ষিত, রেকি করে এমন নাশকতা করেছে। তবে কারা এই প্রশিক্ষিত শক্তি, তা তিনি স্পষ্ট করেননি। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক সহায়তায় দেশে নাশকতা চলছে। এইচ টি ইমাম বলেন, ‘বাস-ট্রাকে যেসব বোমা হামলা চলছে, তাতে বিশেষ ধরনের রাসায়নিক ব্যবহার করায় হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে। আন্তর্জাতিক সহায়তা ছাড়া এসব রাসায়নিক তারা পেত না।’
তার এই বক্তব্যে কী তথ্য উন্মোচিত হলো, তা বিবেচনার ভার দেশবাসীর ওপরেই ছেড়ে দেয়া ভালো। এ দিকে আইকন পরিবহনের যে বাসটি কক্সবাজারের কোনো এক স্থান থেকে যাত্রী নিয়ে বিজিবি পাহারায় ঢাকার দিকে যাত্রা করল, তা নিয়েও অনেক প্রশ্ন। মানুষ পুড়ে মরেছে, এর চেয়ে বেদনার আর কিছু হতে পারে না। কিন্তু এই রহস্যময় বাস কোথা থেকে এলো? কক্সবাজার-ঢাকা রুটে ‘আইকন’ কোম্পানির কোনো বাস চলে না। আমরা কক্সবাজারের সব সূত্রে জেনেছি, কক্সবাজার-ঢাকা রুটে যেসব বাস চলাচল করে, কক্সবাজারের সব সাংবাদিক সেগুলো চেনেন। এদের প্রত্যেকেরই কাউন্টার আছে। কক্সবাজারের সাংবাদিকেরা আইকন পরিবহনের নাম এই প্রথম শুনেছেন। সেই বাস এলো এবং এইচ টি ইমাম ঘোষিত ‘রাসায়নিক’ দ্বারা তৈরি পেট্রলবোমা দিয়ে তারা এই আইকন পরিবহনের গাড়িটির ওপরেই হামলা চালাল। ঘটল বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসের বর্বরতম ঘটনা। এটা বিরাট প্রশ্ন। কিন্তু জবাব জানা নেই।
সর্বশেষ প্রসঙ্গ এসএসসি পরীক্ষা। এই পরীক্ষা তরুণসমাজের জীবনের এক মাইলফলক। আমার জীবনেও এমন দিন এসেছিল। আমার সন্তানদের জীবনেও এসেছে। কিন্তু ২০ দলীয় জোট আন্দোলন ডাকায় এসএসসি পরীক্ষার্থীদের বিরাট ক্ষতি হয়ে গেছে। এমন কথা শত কণ্ঠে উচ্চারিত হচ্ছে। হবেই। সেটাই স্বাভাবিক। এই কোমলমতি কিশোর-কিশোরীরা এসএসসি পাস করে কলেজের এক নতুন জীবনে প্রবেশ করার অপেক্ষায়। ১৯৬৮ সালে আমি যখন এসএসসি পাস করে কলেজে ভর্তি হলাম, হঠাৎ করেই আমার মনে হলো, ‘আর বাবা-মায়ের হাতে বন্দী নই। আমি স্বাধীন।’ এ এক আশ্চর্য অনুভূতি! যেন তার অপেক্ষায়ই ছিল প্রায় ১৫ লাখ পরীক্ষার্থী।
গণতন্ত্র বৈরী সরকার এসএসসি পরীক্ষার্থীদের জন্য সে যে কী মায়াকান্না শুরু করল, তা দেখার মতো। তাদের এককথা, ১৫ লাখ ছাত্রছাত্রীর জীবন ধ্বংস করে দিচ্ছে ২০ দলীয় জোট। আওয়ামী নেতানেত্রীদের কাছে মানুষ প্রশ্ন রাখছে, আপনারাও এভাবে ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষা জীবন ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। সম্প্রতি পাবলিক পরীক্ষার মান ধ্বংস করে দিয়েছেন। পঞ্চম শ্রেণীতে আপনারা একটি সার্টিফিকেট পরীক্ষা চালু করেছেন। অষ্টম শ্রেণীতে আরো একটি। তারপর এসএসসি। যদি এসএসসি এতই গুরুত্বপূর্ণ হবে, তাহলে ওই পঞ্চম এবং অষ্টম শ্রেণীর এই ‘স্টুপিড ব্যবস্থা’ কেন চালু করলেন?
এ দিকে পঞ্চম শ্রেণী, অষ্টম শ্রেণী, এসএসসি প্রতিটি প্রশ্নপত্র ফাঁস স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। যে ছেলেমেয়ে তেমন কিছুই শেখেনি, তারা প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়টি শিখেছে। সর্বত্র প্রশ্নপত্র ফাঁস এবং সেভাবে ৯৯ ভাগ ছেলেমেয়ে পাস। হাজার লাখ গোল্ডেন জিপিএ। তা নিয়ে পরিতৃপ্তির ঢেঁকুর তুললেন শিক্ষামন্ত্রী। আমাদের দুর্ভাগ্য, এমন এক লোক আমাদের মন্ত্রী। সব কিছু কি শেষ হয়ে যাচ্ছে শুধুই অবরোধে? নাকি অযোগ্য, অদূরদর্শী ব্যক্তিদের কারণে?
সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
গত মাসের ৩ তারিখ থেকে সারা দেশে অবরোধ চলছে। এ অবরোধ শুরু করেছিল সরকার। পলায়নপর মনোবৃত্তি থেকেই সরকার ঢাকায় ২০ দলীয় জোটের জনসভা ভণ্ডুল করতে চেয়েছিল। ৫ তারিখে ঘোষিত ওই জনসভায় যাতে ২০ দলীয় জোট সমর্থক ও সরকারের প্রতি বিক্ষুব্ধ মানুষজন যোগ দিতে না পারে, সে জন্য কার্যত সৃষ্টি করা হয়েছিল অবরোধ। বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল ঢাকামুখী সব যানবাহন। এতেই ক্ষান্ত হয়নি। ৩ তারিখ রাত থেকেই ২০ দলীয় জোটনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে তার কার্যালয়ে তালা মেরে অবরুদ্ধ করে ফেলে। নিজেরাও একটি জনসভার ঘোষণা দিয়েছিল বটে, কিন্তু ঢাকামুখী সব যান চলাচল বন্ধ করে দিয়ে তারা প্রমাণ করে যে, ওই জনসভা আসলে তারা করতে চায়নি। বরং ২০ দলের জনসমাবেশ বন্ধ করার জন্যই ছিল ওই আয়োজন।
নিজ কার্যালয়ে সরকার কর্তৃক অবরুদ্ধ (কার্যত বন্দী) বেগম জিয়া যখন ৫ জানুয়ারি বিকেলে তার কার্যালয় থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করলেন, ততক্ষণে অনেক দক্ষ-যজ্ঞ কাণ্ড ঘটে গেছে। ডজনখানেক ইট-বালুর ট্রাক এনে তার বাড়ির চার পাশে রেখে দেয় পুলিশ। নিয়োগ করা হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শত শত সদস্য। খালেদা জিয়ার কার্যালয়টি কার্যত একটি কারাগারে পরিণত হয়। ৫ জানুয়ারি তাকে কার্যালয় থেকে বের হতে পুলিশ বাধা দেয়। তিনি ও তার দলের নেতানেত্রীদের ওপর নিষিদ্ধ ঘোষিত বিষাক্ত মরিচের গুঁড়া ছিটিয়ে দেয়া হয়। পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হয়ে ওঠে। তার কার্যালয়ের সব গেটে তালা লাগিয়ে দেয়া হলো। তিনি বের হতে পারেননি। এতে বাস্তবে সরকার যে অবরোধের নির্দেশ আগেই দিয়েছিল, সে অবরোধ অনির্দিষ্টকাল চলবে বলে ঘোষণা দেন বেগম জিয়া।
সরকারের প্রতি ক্ষুব্ধ শোষিত নিপীড়িত সাধারণ মানুষ। ফলে এই ঘোষণার সাথে সাথে কার্যত গোটা দেশ অচল হয়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় রাজপথ, নৌপথ, রেলপথ। জেলা-উপজেলায় অপশাসন থেকে মুক্তির লড়াইয়ে বের করা মিছিল প্রতিদিন দীর্ঘতর হতে থাকে। সরকার যত হুমকি দেয়, আন্দোলন হয়ে ওঠে আরো জোরদার। বলা বাহুল্য, বিরোধী দলের দাবি অত্যন্ত যৌক্তিকÑ একটি নিরপেক্ষ কর্তৃত্বের অধীনে সব দলের অংশগ্রহণমূলক অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। প্রথম দিকে সরকারও বলেছিল, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, তা নিতান্তই ‘নিয়ম রক্ষা’র নির্বাচন। এখন বলছে, এই সরকার পুরো পাঁচ বছরই ক্ষমতায় থাকবে এবং ২০১৯ সালের আগে কোনো নির্বাচন নয়। অথচ গত বছর সরকার যে নির্বাচন করেছে, তা পৃথিবীর কেউ-ই নির্বাচন বলে স্বীকার করেননি। তখন গোটা বিশ্বই দাবি করেছিল, অবিলম্বে সব দলের অংশগ্রহণমূলক একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দেয়া হোক। কিন্তু সরকার তাতে নারাজ।
২০ দলীয় জোটনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ডাকা অবরোধ কর্মসূচি ভালোভাবেই চলছিল। প্রতিদিন তা দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হচ্ছিল। প্রশাসন ক্রমেই সারা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অনেকটা ঢাকায় বন্দী হয়ে পড়ছিল। তখন এ আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে সরকার এক নতুন কৌশল গ্রহণ করল। হরতাল-অবরোধে সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ থাকে। কিন্তু পুরোপুরিই কি থাকে? ষাটের দশকে হরতাল চলাকালে আমরা সড়ক দিয়ে বাইসাইকেলও চলতে দিতাম না। এখন বাইসাইকেল, রিকশা, সিএনজিÑ এগুলোকে আর হরতাল-অবরোধের আওতাভুক্ত ধরা হয় না। হরতাল চলে, রিকশা সিএনজিও চলে। মাঝে মাঝে সরকারের অতি উৎসাহে হুট করে চলে যায় দু-একটা মিনি বাস। তাতে যাত্রী থাকে খুবই কম। যে দু’পাঁচ যাত্রী থাকে, অনেক ক্ষেত্রে তারা কোথায়ও নেমে যায় না। নতুন কোনো যাত্রীও উঠানো হয় না। দেখা যায়, এরা হলো সরকারের লোক। মূলত এভাবেই ‘হরতাল-অবরোধ হচ্ছে না’Ñ এটা দেখানোর চেষ্টা চলে।
এবার অবশ্য একটা নতুন দৃশ্যও দেখলাম। ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে চাতুরী। রাস্তাঘাট ফাঁকা। কিছু রিকশা, সিএনজি, মোটরসাইকেল, দু-একটা হাফটনি ট্রাক, দুই-একটা বাস এগুলো ট্রাফিক সিগন্যালে আটকে দিয়ে একধরনের যানজটের সৃষ্টি করা হয়। তারপর সিগন্যাল ছেড়ে দেয়া হয়। টিভি ক্যামেরায় ফুটেজ ধারণ করে সে দৃশ্য প্রচার করে এই বলে আত্মতৃপ্তি লাভ করা হয়, হরতাল-অবরোধ হয়নি। এই কৃত্রিম দৃশ্য তৈরি করে জনগণকে বিভ্রান্ত করা যাবে না। এখন মানুষই নিজ চোখে দেখছে, কী ঘটছে।
তবে দু’টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মানুষ ও মিডিয়ার মুখে মুখে। তার একটি হলো, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিট। অপরটি এসএসসি পরীক্ষা। ২০ দলীয় জোট আহূত অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট আহ্বানের পর প্রায় পনের দিন ধরে পেট্রলবোমা নামক বস্তুটির প্রয়োগ এ দেশে ছিল না। গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ক্রমেই অধিকসংখ্যক মানুষ তথা সর্বস্তরের মানুষ এই আন্দোলনে শরিক হয়েছে। অবরোধ কর্মসূচিতে দেশবাসী অত্যন্ত স্বতঃস্ফূর্তভাবে সরকারকে ‘না’ বলতে শুরু করে। সারা দেশে সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় বাস, ট্রাক, রেল, লঞ্চ চলাচল। এতে মানুষের যে অসুবিধা হয়নি, তা নয়। কিন্তু সেটি তারা বৃহত্তর স্বার্থে মেনেও নিয়েছে।
সরকার র্যাব, পুলিশ, বিজিবি দিয়ে জোর করে কিছু ট্রাক-বাস চালানোর চেষ্টা করেছে। প্রাথমিকভাবে সে প্রচেষ্টা অসহযোগিতার মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। ট্রাকচালকেরা যানবাহন চালাতে অস্বীকার করেছেন। সেটি শুধু নিরাপত্তাজনিত কারণে নয়, তার পেছনে ছিল অনির্বাচিত সরকারকে প্রত্যাখ্যানের মনোভাবও। দূরপাল্লার বাস চালু করা যায়নি। এ ক্ষেত্রে সরকারি লোকেরা বলছেন, বাস চালু করা যাচ্ছে না নিরাপত্তার অভাবে। অথচ মালিকেরা বলছেন, তারা বাস চালাতে পারছেন না যাত্রীর অভাবে। সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণাধীন মিডিয়া যাত্রীদের কথা তুলে ধরেনি। পঞ্চগড় থেকে সম্ভাব্য ঢাকা যাত্রীর সাক্ষাৎকার যদি ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রচারিত হতো, তাহলে আমরা বুঝতে পারতাম বাস চলছে, তবু তিনি ঢাকা যাবেন না কেন? সেটি কখনো প্রচারিত হয়নি। তিনিও সম্ভবত মনে করেছেন কিছু দিন অসুবিধা হলে হোক, পরিস্থিতির একটি হিল্লে হোক আগে।
কিন্তু সপ্তাহ দুয়েক পরে দৃশ্যপট একেবারেই বদলে গেল। সরকার দূরপাল্লার বাস মালিকদের দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করলÑ আমরা র্যাব পুলিশ ও সীমান্তে নিয়োজিত গার্ডদের দিচ্ছি। তারা তোমাদের গাড়ির সামনে থাকবে। পেছনে থাকবে। তোমরা বাস চালাও। দেখা গেল, বাস এসেছে তিনটি। তিন বাস মিলে যাত্রী সংখ্যা ১৬। কিন্তু মানুষকে তো দূরান্তে যেতে হবে। কিভাবে যাবে, যাদের খুব জরুরি প্রয়োজন নেই, তারা ঘর থেকে বেরই হতে চাননি। এমনকি ঢাকায়ও এখন মানুুুষ সন্ধ্যার পরে নিজস্ব যানবাহন নিয়ে চলাচলে ভয় পান।
কারণ ২০ দলীয় জোটের চলতি আন্দোলনের দুই সপ্তাহের মাথায় দৃশ্যপটে বিরাট পরিবর্তন ঘটে গেল। এ দেশে ককটেল কালচার শুরু হয়েছে বিগত শতাব্দীর ষাটের দশক থেকে। তার আগেও সম্ভবত ছিল। কিন্তু তা ছিল বিচ্ছিন্ন ঘটনা। বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকে তা প্রায় নিয়মিত ব্যাপারে পরিণত হয়। পেট্রলবোমা কনসেপ্টের বয়স ১০-১৫ বছর হবে কি না সন্দেহ। সরকার ২০ দলীয় জোটের ডাকা কর্মসূচি ভণ্ডুল করতে যখন বিজিবি আর র্যাব পুলিশ পাহারায় দেশের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত পর্যন্ত জোর করে বাস ট্রাক চালানোর চেষ্টা করল, ২০ দলীয় জোট এর প্রতিবাদ করেনি। জনগণ যদি সমর্থন না দেয়, তাহলে তাদের কী করার আছে? আর সরকারের চিন্তা হলো, বাস চালানোর জন্য যাত্রীও পাওয়া যাচ্ছে, ট্রাক চালানোর জন্য মালিক-চালকও পাওয়া যাচ্ছে না। সুতরাং সামনে র্যাব-পুলিশ-বিজিবির গাড়ি। মাঝখানে ১০-১৫টা বাস-ট্রাক। পেছনে র্যাব-পুলিশ-বিজিবির গাড়ি। পারলে চলুক।
এরকম পরিস্থিতিতেই হঠাৎ শুরু হয়ে গেল বাস-ট্রাকে পেট্রলবোমা হামলা। সামনে পেছনে পাহারাদার। অথচ গায়েবি এলাকা থেকে হুট করে ছুটে এলো পেট্রলবোমা। পেট্রলবোমার যেসব ছবি আমরা দেখলাম, সেগুলো দেখতে অতি সাধারণ। একটা সেভেন আপ বা স্প্রাইটের বোতলে কিছু একটা তরল পদার্থ তার মুখে সলতেজাতীয় কিছু জিনিস শক্ত করে লাগিয়ে দেয়া। সেটা আবার স্কচটেপ দিয়ে শক্ত করে পেঁচানো। এই সলতেতে আগুন দিয়ে খুব জোরে যানবাহনে ছুড়ে মারলেই কাজ হয়ে যায়।
পেট্রলবোমার আঘাতে পোড়ার সে দৃশ্য! ওহ্। সে ভয়ঙ্কর দৃশ্য কল্পনাও করা যায় না। জীবন্ত মানুষ পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেল। ঝলসে গেল নিরীহ নিরপরাধ সাধারণ মানুষের শরীর। ঝলসে গেল অনেক সম্পদ, সন্তান ও সম্ভাবনা। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিট মানুষ পোড়ার গন্ধে শোক-বিহ্বল হয়ে উঠল। কে দেখতে চায় মানুষের ওপর মানুষের এমন বীভৎস নারকীয় আক্রমণের দৃশ্য! সরকার সে সুযোগটা সম্পূর্ণ কাজে লাগাল। দোষারোপ করতে থাকল, ২০ দলীয় জোট অবরোধের ডাক দিয়েছে, অতএব তারাই এই পেট্রলবোমা মারল। মেরে মানুষ পুড়িয়ে হত্যা করছে। বহু মানুষকে অসহ্য, অমানবিক পৈশাচিক বর্বরতার শিকার করছে।
বিশ দলীয় জোট যতই বলতে থাকে, এ ধরনের হিংস্্র ঘটনার সাথে তারা কোনোভাবেই জড়িত নয়, তারা গণতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করছে, সে কথা সরকার নিয়ন্ত্রণাধীন মিডিয়ায় হালে পানি পেল না। বার্ন ইউনিট নিয়ে প্রতিদিন যে স্টোরি প্রকাশিত হতে থাকে, তা সত্যিই হৃদয়বিদারক। ঘটনা যে খুবই হৃদয়বিদারক, মর্মান্তিক, পৈশাচিক, তাতে কোনো সন্দেহ নেই কারো।
সর্বশেষ দু’টি ঘটনা ঘটল কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম এবং বরিশালের গৌরনদীতে। কক্সবাজার থেকে ঢাকার দিকে আসছিল ‘আইকন’ পরিবহনের একটি বাস। সে বাসের সামনে বিজিবির পাহারা ছিল। সে পাহারাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ওই বাসটিতে পেট্রলবোমা নিক্ষেপ করে দুষ্কৃতকারীরা। এতে সাতজন পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেলেন। আরো অনেকে অগ্নিদগ্ধ হয়ে হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন। সে হৃদয়বিদারক দৃশ্য মানুষ হিসেবে চোখে দেখা যায় না। একই ঘটনা ঘটেছে গৌরনদীতেও। সামনে বিজিবি পাহারা। পেছনে ছিল কয়েকটি ট্রাক। তার পেছনেও ছিল সরকারি পাহারা। তার মাঝখানেই একটি ট্রাকে পেট্রলবোমা ছোড়ে দুষ্কৃতকারীরা। সেখানেও পুড়ে মারা যায় ট্রাকচালক ও হেলপার। তা-ও মর্মান্তিক, নিষ্ঠুর ও হৃদয়বিদারক। এই অপরাধীদের কিছুতেই ক্ষমা নেই।
এর একটা লিংক আমাদের দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক উপদেষ্টা, বহুল বিতর্কিত এইচ টি ইমাম। তিনি কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে নৈশকোচের নাশকতাকে ‘মিলিটারি অপারেশনে’র মতো বলে মনে করেন। তার মতে, যারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে তারা প্রশিক্ষিত, রেকি করে এমন নাশকতা করেছে। তবে কারা এই প্রশিক্ষিত শক্তি, তা তিনি স্পষ্ট করেননি। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক সহায়তায় দেশে নাশকতা চলছে। এইচ টি ইমাম বলেন, ‘বাস-ট্রাকে যেসব বোমা হামলা চলছে, তাতে বিশেষ ধরনের রাসায়নিক ব্যবহার করায় হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে। আন্তর্জাতিক সহায়তা ছাড়া এসব রাসায়নিক তারা পেত না।’
তার এই বক্তব্যে কী তথ্য উন্মোচিত হলো, তা বিবেচনার ভার দেশবাসীর ওপরেই ছেড়ে দেয়া ভালো। এ দিকে আইকন পরিবহনের যে বাসটি কক্সবাজারের কোনো এক স্থান থেকে যাত্রী নিয়ে বিজিবি পাহারায় ঢাকার দিকে যাত্রা করল, তা নিয়েও অনেক প্রশ্ন। মানুষ পুড়ে মরেছে, এর চেয়ে বেদনার আর কিছু হতে পারে না। কিন্তু এই রহস্যময় বাস কোথা থেকে এলো? কক্সবাজার-ঢাকা রুটে ‘আইকন’ কোম্পানির কোনো বাস চলে না। আমরা কক্সবাজারের সব সূত্রে জেনেছি, কক্সবাজার-ঢাকা রুটে যেসব বাস চলাচল করে, কক্সবাজারের সব সাংবাদিক সেগুলো চেনেন। এদের প্রত্যেকেরই কাউন্টার আছে। কক্সবাজারের সাংবাদিকেরা আইকন পরিবহনের নাম এই প্রথম শুনেছেন। সেই বাস এলো এবং এইচ টি ইমাম ঘোষিত ‘রাসায়নিক’ দ্বারা তৈরি পেট্রলবোমা দিয়ে তারা এই আইকন পরিবহনের গাড়িটির ওপরেই হামলা চালাল। ঘটল বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসের বর্বরতম ঘটনা। এটা বিরাট প্রশ্ন। কিন্তু জবাব জানা নেই।
সর্বশেষ প্রসঙ্গ এসএসসি পরীক্ষা। এই পরীক্ষা তরুণসমাজের জীবনের এক মাইলফলক। আমার জীবনেও এমন দিন এসেছিল। আমার সন্তানদের জীবনেও এসেছে। কিন্তু ২০ দলীয় জোট আন্দোলন ডাকায় এসএসসি পরীক্ষার্থীদের বিরাট ক্ষতি হয়ে গেছে। এমন কথা শত কণ্ঠে উচ্চারিত হচ্ছে। হবেই। সেটাই স্বাভাবিক। এই কোমলমতি কিশোর-কিশোরীরা এসএসসি পাস করে কলেজের এক নতুন জীবনে প্রবেশ করার অপেক্ষায়। ১৯৬৮ সালে আমি যখন এসএসসি পাস করে কলেজে ভর্তি হলাম, হঠাৎ করেই আমার মনে হলো, ‘আর বাবা-মায়ের হাতে বন্দী নই। আমি স্বাধীন।’ এ এক আশ্চর্য অনুভূতি! যেন তার অপেক্ষায়ই ছিল প্রায় ১৫ লাখ পরীক্ষার্থী।
গণতন্ত্র বৈরী সরকার এসএসসি পরীক্ষার্থীদের জন্য সে যে কী মায়াকান্না শুরু করল, তা দেখার মতো। তাদের এককথা, ১৫ লাখ ছাত্রছাত্রীর জীবন ধ্বংস করে দিচ্ছে ২০ দলীয় জোট। আওয়ামী নেতানেত্রীদের কাছে মানুষ প্রশ্ন রাখছে, আপনারাও এভাবে ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষা জীবন ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। সম্প্রতি পাবলিক পরীক্ষার মান ধ্বংস করে দিয়েছেন। পঞ্চম শ্রেণীতে আপনারা একটি সার্টিফিকেট পরীক্ষা চালু করেছেন। অষ্টম শ্রেণীতে আরো একটি। তারপর এসএসসি। যদি এসএসসি এতই গুরুত্বপূর্ণ হবে, তাহলে ওই পঞ্চম এবং অষ্টম শ্রেণীর এই ‘স্টুপিড ব্যবস্থা’ কেন চালু করলেন?
এ দিকে পঞ্চম শ্রেণী, অষ্টম শ্রেণী, এসএসসি প্রতিটি প্রশ্নপত্র ফাঁস স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। যে ছেলেমেয়ে তেমন কিছুই শেখেনি, তারা প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়টি শিখেছে। সর্বত্র প্রশ্নপত্র ফাঁস এবং সেভাবে ৯৯ ভাগ ছেলেমেয়ে পাস। হাজার লাখ গোল্ডেন জিপিএ। তা নিয়ে পরিতৃপ্তির ঢেঁকুর তুললেন শিক্ষামন্ত্রী। আমাদের দুর্ভাগ্য, এমন এক লোক আমাদের মন্ত্রী। সব কিছু কি শেষ হয়ে যাচ্ছে শুধুই অবরোধে? নাকি অযোগ্য, অদূরদর্শী ব্যক্তিদের কারণে?
সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
No comments