বাঁচানোর জন্যই ধ্বংস করতে হয়েছিল গ্রামটি by জাফর সোবহান
দুই পক্ষের কাছেই দেশটাকে পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়াই হলো যুদ্ধজয়ের গ্রহণযোগ্য প্রতিদান।
ভিয়েতনামের মেকং দ্বীপের বেন ট্রি নামের এক অখ্যাত নগরী, হঠাৎই সংবাদ সংস্থা এপিতে মার্কিন সাংবাদিক পিটার আরনেটের করা এক প্রতিবেদনের কারণে বিখ্যাত হয়ে যায়।
তখন ভিয়েতনাম যুদ্ধ চলছিল, যুক্তরাষ্ট্রের অজ্ঞাতনামা এক সেনা সদস্যের সাক্ষাতকার নিয়েছিলেন বার্তাসংস্থা এপির প্রতিনিধি পিটার। ওই সময় মার্কিন বিমানবাহিনীর হামলায় ধ্বংস হয়েছিল শহরটি। ১৯৬৮ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি প্রকাশ হওয়া সাক্ষাতকারটি থেকে একটি উদ্ধৃতি পরে মুখে মুখে রটে যায়। এখনও জনপ্রিয় সেই কথাটি হচ্ছে, শহরটাকে বাঁচানোর জন্যই শহরটিকে ধ্বংস করতে হয়েছিল।
লোকের মুখে মুখে বদলে যাওয়া কথাটি থেকেই এই লেখার শিরোনাম। যুদ্ধের বোকামির একটি ক্ল্যাসিক উদাহরণ হয়ে থাকা কথাটিই বুঝিয়ে দেয় যে মানুষের মুর্খতা কত গভীরে ডুবে যেতে পারে। যে অজ্ঞতা সবসময় আমাদের বিশ্বাস করাবে যে আমিই ঠিক পক্ষে আছি, বাকিরা সব ভুল দিকে।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, বাংলাদেশের প্রধান দুই দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগ, ও এই দলের নেতানেত্রীরা এই মতবাদটার গ্রাহক হয়ে বসে আছেন। তারা উভয়েই মনেপ্রাণে দেশটাকে বাঁচাতে গিয়ে ধ্বংস করে ফেলতে চান। তারা প্রত্যেকেই মনে করেন, অপরপক্ষকে উড়িয়ে দেওয়ার জন্য যে মূল্য দিতে হয়, তা অতি সামান্য!
বিএনপিকে দিয়েই শুরু করা যাক। ধরে নেওয়া যাক, ক্ষমতাসীন দলের কর্মীরাই এই সমস্ত বিচ্ছিন্ন নাশকতার ঘটনা ঘটাচ্ছে। কিন্তু এটা বিশ্বাস করা খুব শক্ত যে, বিএনপি বা তাদের জোটের কেউ এই সহিংসতার পেছনে নেই।
এই আন্দোলনের মূলকথা বা যৌক্তিকতা হচ্ছে, তারা কৌশলগত কারণেই দেশটাকে জ্বালিয়ে দেবে। এ ছাড়া আর কিভাবেই বা তারা সরকারকে সংলাপ বা সমঝোতার দিকে চালিত করতে পারে? অথবা, এ ধরনের ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করে সেনা হস্তক্ষেপ অবশ্যম্ভাবী করে তুলবে, নইলে দেশটাকে অচল করে সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব নিতে বাধ্য করার প্রয়োজন আর কী হতে পারে?
এ ছাড়া আর কোনও কৌশল বা পরিকল্পনা তাদের নেই। ফলে, সাম্প্রতিক সহিংসতার পেছনে তাদের হাত নেই, এই দাবি কোনওভাবেই গ্রহণযোগ্য হয় না।
বিএনপি ২০১৩ সালের শেষ কয়েক মাস এই ধরনের সহিংসতা চালিয়েছে, হাজার হাজার মানুষের দুর্ভোগের কারণ হয়েছে, মৃত্যুর কারণ হয়েছে। অনেকে পঙ্গু হয়ে গেছে, জীবন তাদের জন্য হয়ে গেছে বোঝার মত। অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে দেশের অর্থনীতির। বাইরের দুনিয়ায় দুর্নাম হয়েছে আমাদের দেশের। এই পুরো বিষয়টি ঘটেছে দেশকে আওয়ামী লীগের শাসন থেকে মুক্ত করার জন্য। যা আমাদের এনে দিয়েছে পুনরায় আওয়ামী লীগ সরকার।
আমাদের প্রশ্ন করা দরকার, এই দুঃসহ সময় বিএনপিকে কী দিয়েছে? একদা সুখ্যাত এই রাজনৈতিক দল, যে দল তিনবার দেশের ক্ষমতায় গেছে, আমাদের শাসন করেছে, যে দল চায় যে কোনও মূল্যে ক্ষমতা থেকে আওয়ামী লীগের পতন?
কারণ খুঁজে বের করা কঠিন নয়- কারণ, আওয়ামী লীগ ঠিক এমনটাই চায়। আওয়ামী লীগই সেই দল যে বিএনপিকে নিংড়ে দলটির জীবনীশক্তি শুষে নিয়েছে, একটি রাজনৈতিক দল সুষ্ঠুভাবে চলার মতো কোনও পরিস্থিতি বা পরিসর কোনটাই দেয়নি। আওয়ামী লীগই ৫ জানুয়ারির লজ্জাজনক নির্বাচনটি করেছে। আওয়ামী লীগই বিএনপিকে পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার জন্য নিজেদের উৎসর্গ করে দিয়েছে।
বিএনপি যদি ফাঁদে পড়ে কোণঠাসা হয়ে যাওয়া বন্য জন্তুর মত হিংস্র আচরণ করে, তবে মনে রাখতে হবে, কে বা কারা তাদের সেখানে ঠেলে দিয়েছে। তবে এখন সরকার বলতে পারে, জঙ্গিবাদকে কোনভাবেই জায়েজ করা যায় না, বিএনপি যা করছে তাকে কোনও অজুহাতেই যৌক্তিক বলা যায় না- সেটাও পুরোপুরি হক কথা।
কিন্তু আওয়ামী লীগ চাইলেই নিজের হাত থেকে রক্তের দাগ মুছে ফেলতে পারবে না। তারাও জানে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অস্বীকার করে, একতরফা নির্বাচন করে, বিএনপিকে রাজনৈতিক দলের মর্যাদা না দিয়ে, পিছু হটতে, আত্মগোপন করতে বাধ্য করে, তারাই এই পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে।
কিন্তু আওয়ামী লীগও কি ঠিক এমনটাই চায় না? বিএনপির ভাবমূর্তির যে কোনও ক্ষতি আওয়ামী লীগের পক্ষে যায়- আর আওয়ামী লীগের কৌশলও তাই। আওয়ামী লীগ ফাঁদ পেতেছে, বিএনপি তাতে ধরা দিয়েছে।
উপরন্তু, বিএনপির প্রত্যেকটি পোড়ানো বাস, বাসের মধ্যে পুড়ে মরা সাধারণ নিরীহ নাগরিকের মৃতদেহ, সরকারের ক্ষমতার হাতকে আরও একটু শক্তিশালী করে। আইন-শৃঙ্খলা জোরদার করাসহ নাশকতা নিরোধে নেওয়া সরকারের প্রত্যেকটি পদক্ষেপ আওয়ামী লীগকে তাদের গন্তব্যের দিকে আরও একটু এগিয়ে দেয়। তারা যেভাবে দেশ চালাতে চায়, সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী একমাত্র রাজনৈতিক দল হয়ে, আওয়ামী লীগের সেই স্বপ্ন সত্যি হতে সাহায্য করে।
দুই পক্ষের কাছেই দেশটাকে পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়াই হলো যুদ্ধজয়ের গ্রহণযোগ্য প্রতিদান। আমাদের দেশ যদি পোড়া বাস আর অঙ্গার হয়ে যাওয়া শবের দেশ হয়ে যায়, জনগণ জানে, এর জন্য কে বা কারা দায়ী থাকবে।
এমন যদি সত্যিই ঘটে, ক্ষমতার দ্বৈরথে জিতে যাওয়া একটি দল যখন ক্ষমতার ঝাণ্ডা হাতে একদা সুন্দর বাংলাদেশের ধ্বংসপ্রায় ভূমিতে দাঁড়িয়ে থাকেন; আর আমাদের বাকি সবার মনে তখন একটাই প্রশ্ন ঘুরে ফিরে আসবে- গ্রামটিকে বাঁচানোর জন্য ধ্বংস করা কি সত্যি জরুরি ছিল?
জাফর সোবহান: সম্পাদক, ঢাকা ট্রিবিউন
সুত্র- বাংলা ট্রিবিউন
ভিয়েতনামের মেকং দ্বীপের বেন ট্রি নামের এক অখ্যাত নগরী, হঠাৎই সংবাদ সংস্থা এপিতে মার্কিন সাংবাদিক পিটার আরনেটের করা এক প্রতিবেদনের কারণে বিখ্যাত হয়ে যায়।
তখন ভিয়েতনাম যুদ্ধ চলছিল, যুক্তরাষ্ট্রের অজ্ঞাতনামা এক সেনা সদস্যের সাক্ষাতকার নিয়েছিলেন বার্তাসংস্থা এপির প্রতিনিধি পিটার। ওই সময় মার্কিন বিমানবাহিনীর হামলায় ধ্বংস হয়েছিল শহরটি। ১৯৬৮ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি প্রকাশ হওয়া সাক্ষাতকারটি থেকে একটি উদ্ধৃতি পরে মুখে মুখে রটে যায়। এখনও জনপ্রিয় সেই কথাটি হচ্ছে, শহরটাকে বাঁচানোর জন্যই শহরটিকে ধ্বংস করতে হয়েছিল।
লোকের মুখে মুখে বদলে যাওয়া কথাটি থেকেই এই লেখার শিরোনাম। যুদ্ধের বোকামির একটি ক্ল্যাসিক উদাহরণ হয়ে থাকা কথাটিই বুঝিয়ে দেয় যে মানুষের মুর্খতা কত গভীরে ডুবে যেতে পারে। যে অজ্ঞতা সবসময় আমাদের বিশ্বাস করাবে যে আমিই ঠিক পক্ষে আছি, বাকিরা সব ভুল দিকে।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, বাংলাদেশের প্রধান দুই দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগ, ও এই দলের নেতানেত্রীরা এই মতবাদটার গ্রাহক হয়ে বসে আছেন। তারা উভয়েই মনেপ্রাণে দেশটাকে বাঁচাতে গিয়ে ধ্বংস করে ফেলতে চান। তারা প্রত্যেকেই মনে করেন, অপরপক্ষকে উড়িয়ে দেওয়ার জন্য যে মূল্য দিতে হয়, তা অতি সামান্য!
বিএনপিকে দিয়েই শুরু করা যাক। ধরে নেওয়া যাক, ক্ষমতাসীন দলের কর্মীরাই এই সমস্ত বিচ্ছিন্ন নাশকতার ঘটনা ঘটাচ্ছে। কিন্তু এটা বিশ্বাস করা খুব শক্ত যে, বিএনপি বা তাদের জোটের কেউ এই সহিংসতার পেছনে নেই।
এই আন্দোলনের মূলকথা বা যৌক্তিকতা হচ্ছে, তারা কৌশলগত কারণেই দেশটাকে জ্বালিয়ে দেবে। এ ছাড়া আর কিভাবেই বা তারা সরকারকে সংলাপ বা সমঝোতার দিকে চালিত করতে পারে? অথবা, এ ধরনের ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করে সেনা হস্তক্ষেপ অবশ্যম্ভাবী করে তুলবে, নইলে দেশটাকে অচল করে সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব নিতে বাধ্য করার প্রয়োজন আর কী হতে পারে?
এ ছাড়া আর কোনও কৌশল বা পরিকল্পনা তাদের নেই। ফলে, সাম্প্রতিক সহিংসতার পেছনে তাদের হাত নেই, এই দাবি কোনওভাবেই গ্রহণযোগ্য হয় না।
বিএনপি ২০১৩ সালের শেষ কয়েক মাস এই ধরনের সহিংসতা চালিয়েছে, হাজার হাজার মানুষের দুর্ভোগের কারণ হয়েছে, মৃত্যুর কারণ হয়েছে। অনেকে পঙ্গু হয়ে গেছে, জীবন তাদের জন্য হয়ে গেছে বোঝার মত। অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে দেশের অর্থনীতির। বাইরের দুনিয়ায় দুর্নাম হয়েছে আমাদের দেশের। এই পুরো বিষয়টি ঘটেছে দেশকে আওয়ামী লীগের শাসন থেকে মুক্ত করার জন্য। যা আমাদের এনে দিয়েছে পুনরায় আওয়ামী লীগ সরকার।
আমাদের প্রশ্ন করা দরকার, এই দুঃসহ সময় বিএনপিকে কী দিয়েছে? একদা সুখ্যাত এই রাজনৈতিক দল, যে দল তিনবার দেশের ক্ষমতায় গেছে, আমাদের শাসন করেছে, যে দল চায় যে কোনও মূল্যে ক্ষমতা থেকে আওয়ামী লীগের পতন?
কারণ খুঁজে বের করা কঠিন নয়- কারণ, আওয়ামী লীগ ঠিক এমনটাই চায়। আওয়ামী লীগই সেই দল যে বিএনপিকে নিংড়ে দলটির জীবনীশক্তি শুষে নিয়েছে, একটি রাজনৈতিক দল সুষ্ঠুভাবে চলার মতো কোনও পরিস্থিতি বা পরিসর কোনটাই দেয়নি। আওয়ামী লীগই ৫ জানুয়ারির লজ্জাজনক নির্বাচনটি করেছে। আওয়ামী লীগই বিএনপিকে পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার জন্য নিজেদের উৎসর্গ করে দিয়েছে।
বিএনপি যদি ফাঁদে পড়ে কোণঠাসা হয়ে যাওয়া বন্য জন্তুর মত হিংস্র আচরণ করে, তবে মনে রাখতে হবে, কে বা কারা তাদের সেখানে ঠেলে দিয়েছে। তবে এখন সরকার বলতে পারে, জঙ্গিবাদকে কোনভাবেই জায়েজ করা যায় না, বিএনপি যা করছে তাকে কোনও অজুহাতেই যৌক্তিক বলা যায় না- সেটাও পুরোপুরি হক কথা।
কিন্তু আওয়ামী লীগ চাইলেই নিজের হাত থেকে রক্তের দাগ মুছে ফেলতে পারবে না। তারাও জানে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অস্বীকার করে, একতরফা নির্বাচন করে, বিএনপিকে রাজনৈতিক দলের মর্যাদা না দিয়ে, পিছু হটতে, আত্মগোপন করতে বাধ্য করে, তারাই এই পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে।
কিন্তু আওয়ামী লীগও কি ঠিক এমনটাই চায় না? বিএনপির ভাবমূর্তির যে কোনও ক্ষতি আওয়ামী লীগের পক্ষে যায়- আর আওয়ামী লীগের কৌশলও তাই। আওয়ামী লীগ ফাঁদ পেতেছে, বিএনপি তাতে ধরা দিয়েছে।
উপরন্তু, বিএনপির প্রত্যেকটি পোড়ানো বাস, বাসের মধ্যে পুড়ে মরা সাধারণ নিরীহ নাগরিকের মৃতদেহ, সরকারের ক্ষমতার হাতকে আরও একটু শক্তিশালী করে। আইন-শৃঙ্খলা জোরদার করাসহ নাশকতা নিরোধে নেওয়া সরকারের প্রত্যেকটি পদক্ষেপ আওয়ামী লীগকে তাদের গন্তব্যের দিকে আরও একটু এগিয়ে দেয়। তারা যেভাবে দেশ চালাতে চায়, সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী একমাত্র রাজনৈতিক দল হয়ে, আওয়ামী লীগের সেই স্বপ্ন সত্যি হতে সাহায্য করে।
দুই পক্ষের কাছেই দেশটাকে পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়াই হলো যুদ্ধজয়ের গ্রহণযোগ্য প্রতিদান। আমাদের দেশ যদি পোড়া বাস আর অঙ্গার হয়ে যাওয়া শবের দেশ হয়ে যায়, জনগণ জানে, এর জন্য কে বা কারা দায়ী থাকবে।
এমন যদি সত্যিই ঘটে, ক্ষমতার দ্বৈরথে জিতে যাওয়া একটি দল যখন ক্ষমতার ঝাণ্ডা হাতে একদা সুন্দর বাংলাদেশের ধ্বংসপ্রায় ভূমিতে দাঁড়িয়ে থাকেন; আর আমাদের বাকি সবার মনে তখন একটাই প্রশ্ন ঘুরে ফিরে আসবে- গ্রামটিকে বাঁচানোর জন্য ধ্বংস করা কি সত্যি জরুরি ছিল?
জাফর সোবহান: সম্পাদক, ঢাকা ট্রিবিউন
সুত্র- বাংলা ট্রিবিউন
No comments