সঙ্কটের উৎসমূল এবং উপশমে বড় ভুল by ড. আবদুল লতিফ মাসুম
সঙ্কট
থেকে সঙ্কট। সঙ্কটের যেন আর শেষ নেই। খ্যাতনামা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জিল্লুর
আর খান বাংলাদেশসম্পর্কিত একটি গ্রন্থের শিরোনাম দিয়েছিলেন : ক্রাইসিস টু
ক্রাইসিস। বিগত ৪৪ বছর ধরে সঙ্কটের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে বাংলাদেশ।
রাজনৈতিক এলিটরা সম্ভবত বাংলাদেশকে একটি ‘ফেইল্ড স্টেট’ বা ব্যর্থ রাষ্ট্র
বানানোর প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত। বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মায়রন উইনার তৃতীয়
বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর এ অবস্থা দৃষ্টে বলেছিলেন : ‘দে আর অনলি ন্যাশনস ইন
হোপ’। জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভের পর রাষ্ট্র গঠনের জন্য আমরা যে দীর্ঘ
সময় অতিক্রম করেছি তাতে আজকের এই বিচলিত বর্তমান অর্থাৎ শঙ্কা এবং সঙ্কটের
অতিক্রান্ত সময়কে দুর্ভাগ্যজনকই বলতে হয়।
বর্তমান সঙ্কটের উৎস নাগরিক সাধারণের জানা কথা। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে শঠতা, ষড়যন্ত্র, প্রতারণা ও দুর্বৃত্তায়নের ইতিহাস এখনো দগদগে। গণতন্ত্রের বিধিবিধান মোতাবেক মানুষ চেয়েছিল সম্মতির মাধ্যমে তাদের শাসক নির্ধারণ করবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় শক্তির মাধ্যমে তাদের শাসক বহাল থেকেছে। প্রধান বিরোধী দল দৃশ্যত জনগণের আস্থা লাভ করলেও সরকারের ষড়যন্ত্রের কবলে পরাজিত হয়েছে। রাজনীতির নাম যদি হয় ‘পলিট্রিকস’ অর্থাৎ বহুমুখী কারসাজিÑ তাতে বিএনপি কৌশলগতভাবে হেরে গেছে। আর রাজনীতি যদি হয় নীতি নৈতিকতা, সহজ-সরলতা এবং দায়দায়িত্ব তা হলে মনে করতে হবে বিএনপি জিতে আছে মানুষের মনের গভীরে।
বাংলাদেশের একজন স্বনামধন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানী নির্বাচনের আগে মন্তব্য করেছিলেনÑ শাসক দলের প্রতি সাধারণ মানুষের এত দুঃখ-কষ্ট, ক্ষোভ-ক্রোধ এবং অসন্তুষ্টি লুকিয়ে আছে যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়াই বিএনপি জয়লাভ করবে। বিএনপি নেতৃত্ব ক্ষমতার চেয়ে বিকৃত নির্বাচনব্যবস্থাকে একটি প্রতিষ্ঠানিকতা দিতে চেয়েছে বলেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে অনড় থেকেছে। সাজানো নির্বাচন অবশেষে অব্যাহত অবরোধকে কেন ব্যাহত করা হলো সে প্রশ্ন সঙ্গতভাবেই উত্থাপন করা যায়। বিএনপি হয়তো সরকারের পুনর্নির্বাচনের আশ্বাসকে বিশ্বাস করেছে। বেগম জিয়া যেমন দায় ঠেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬-এ নির্বাচন দিয়েছিলেন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংযোজন শেষে পুনর্নির্বাচনের ব্যবস্থা করেছিলেনÑ তিনি ৫ জানুয়ারি নির্বাচন শেষে তেমনই নির্বাচনের আশা পোষণ করেছিলেন। এখন আওয়ামী লীগের যেসব নেতা-পাতিনেতা তারস্বরে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কথা বলছেনÑ তারাই সে দিন জাতিকে পুনর্নির্বাচনের নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন। সে সময়ের সংবাদপত্রগুলোর পৃষ্ঠা উল্টালে ওই সত্যই প্রমাণিত হবে। বিএনপির পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগকে বিশ্বাস করা কি অন্যায় হয়েছে? ছোট সময়ে আদর্শলীপিতে পড়েছিলাম, ‘খলের আশ্বাস বাক্য না করিবে বিশ্বাস’।
নিয়মতান্ত্রিকভাবে বিএনপি আওয়ামী লীগকে পুনর্নির্বাচনের জন্য পুরো এক বছর সময় দিয়েছে। আওয়ামী লীগের তরফ থেকে কোনো ইতিবাচক সাড়া না পেয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন এবং ২০ দলীয় ঐক্যজোট প্রধান বেগম খালেদা জিয়া সঙ্কট সমাধানের লক্ষ্যে সাত দফা প্রস্তাবনা পেশ করেছেন। উপস্থাপিত সাত দফায় সঙ্কট উত্তরণের উপায় যেমন আছে, তেমনি আছে প্রকারান্তরে সমঝোতার আভাস। গত এক বছরের অপেক্ষা অবশেষে উৎকণ্ঠিত জাতি আশা করেছিল আওয়ামী লীগ ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। রাজনীতি দিয়ে রাজনীতির মোকাবেলা করবে। কিন্তু হতাশ জনগণ দেখল যে, বেগম খালেদা জিয়ার সংলাপ প্রস্তাব তাৎক্ষণিকভাবেই প্রত্যাখ্যাত হলো। শুধু তাই নয়, গণতান্ত্রিক অধিকারকে অস্বীকার করে বিএনপিকে জনসভা করার অনুমতি দেয়া হলো না। শাসক দলের পূর্বঅনুসৃত নোংরা খেলা অনুযায়ী বিএনপি প্রস্তাবিত জনসভার সময়কালে ‘সরকারি হরতাল’ আয়োজিত হলো।
ক্ষমতাসীন সরকারের সবচেয়ে দৃষ্টিকটু আচরণটি লক্ষ করা গেল বেগম খালেদা জিয়াকে কেন্দ্র করে। তথাকথিত নিরাপত্তার বানোয়াট অজুহাতে তাকে টানা ১৫ দিন অবরুদ্ধ থাকতে হলো। তার কার্যালয়ের সামনে বালু, রড, সিমেন্ট ভর্তি ট্রাক, লড়ি এবং শত শত পুলিশ, বিজিবি মোতায়েন করে তারা রাজনৈতিক নীচুতার প্রমাণ দিয়েছে। অবশেষে বেগম খালেদা জিয়ার সন্তান বিয়োগের মর্মান্তিক ঘটনা থেকেও রাজনৈতিক ফায়াদা হাসিলের চেষ্টা করেছে সরকার। দেশনেত্রী যখন সন্তানহারা বেদনায় মুহ্যমান, তখন ক্ষমতাসীনদের তরফ থেকে হত্যা, অগ্নিসংযোগ এবং পেট্রলবোমা নিক্ষেপের দায় তার ওপর চাপানোর জন্য হুকুমের আসামি করে বেশ কয়েকটি মামলা করা হয়েছে। এই মামলা থেকে বোঝা যায় যে, তাদের তথাকথিত সহানুভূতি প্রদর্শন কৃত্রিম এবং লোকদেখানো। এই দুঃসময়ে যে ভাষায় আওয়ামী নেতা-পাতিনেতারা তাকে গালাগালি করছে তা সভ্যতা-ভব্যতার সীমালঙ্ঘন করেছে। দায়িত্বশীল মন্ত্রীরা কোনো রকম রাখঢাক না করে তাকে গ্রেফতারের কথা বলছেন।
এসবের কারণ হিসেবে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে সবাই মিলে যা বলছেন তার সারমর্ম হলো বিএনপি চেয়ারপারসন যে অব্যাহত অবরোধের ঘোষণা দিয়েছেন তাতে ভায়োলেন্স হচ্ছে। মানুষ পেট্রলবোমার আঘাতে অগ্নিদগ্ধ হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। অভিযোগের উত্তরে বেগম খালেদা জিয়া ওই সব অন্যায় অপকর্মের জন্য আওয়ামী লীগকে দায়ী করেছেন। সর্বশেষ সংবাদ সম্মেলনে তিনি পুনর্নির্বাচন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি পুনর্ব্যক্ত করেন। সরকার যেভাবে বহমান আন্দোলনকে আইনশৃঙ্খলার সমস্যা বলছে তা নাকচ করে দিয়ে বেগম খালেদা জিয়া বলেন এটি রাজনৈতিক সমস্যা, রাজনৈতিকভাবেই মোকাবেলা করতে হবে।
এক বছরের ধূমায়িত অসন্তোষ অবশেষে যখন বিএনপি গণ-আন্দোলনের সূচনা করে, তখন আওয়ামী লীগ নিয়মতান্ত্রিক পথ অনুসরণ না করে দুই ধরনের নেতিবাচক কর্মপন্থা গ্রহণ করে। প্রথমত তারা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবসহ প্রায় সব শীর্ষ নেতাকে গ্রেফতার করে। পুলিশ, বিজিবি ও র্যাব মোতায়েন করে নয়াপল্টন অফিসসহ সর্বত্র ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) ১৪৪ ধারা জারি করে বিএনপির জনসভা ভণ্ডুল করে দেয়। দ্বিতীয়ত আওয়ামী লীগ বিএনপির জনসভার বিপরীতে ২২টি স্থানে সমাবেশসহ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মহাসমাবেশের ঘোষণা দেয়। তারা প্রকাশ্যে প্রতিরোধের কথা বলে। তাদের ছাত্রলীগ বিএনপি নেতাদের নেড়িকুত্তার মতো পিটুনির কথা বলে। সর্বত্র যুদ্ধংদেহি পরিবেশ পরিলক্ষিত হয়। সাধারণ মানুষ বিচলিত হয়ে ওঠে।
বেগম খালেদা জিয়া ৫ জানুয়ারি অবরুদ্ধ অবস্থায় অনির্দিষ্টকালের জন্য অবরোধ ঘোষণা করেন। অবরোধে সারা দেশ অচল হয়ে পড়ে। সড়ক, নৌ ও রেলপথ একরকম বন্ধ হয়ে যায়। বেসরকারি বা ব্যক্তিগত যানবহন সীমিত হয়ে পড়ে। ব্যবসাবাণিজ্য মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমদানি-রফতানি ব্যাহত হয়। শিক্ষাব্যবস্থা তথা পরীক্ষা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। সর্বত্র খাদ্যশস্যসহ সব ধরনের সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হয়। সীমান্ত বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যায়। দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ প্রান্তিকপর্যায়ে পৌঁছায়। এককথায় বিএনপি তথা ২০ দলীয় জোটের আহূত রাজনৈতিক কর্মসূচি সফল হয়। যদিও জনসাধারণকে ভোগান্তিতে পড়তে হয় তবুও মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় আন্দোলনের অপরিহার্যতায় তাদের এ ত্যাগ স্বীকার করতে হয়।
অবরোধের ব্যাপকতা পত্রপত্রিকা এবং চ্যানেলগুলোর প্রতিবেদনে দৃশ্যমান হয়। কিন্তু সরকার অবরোধকে ব্যর্থ বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করে। আওয়ামী লোকেরা প্রতিদিন ঢাকা শহরের কেন্দ্রস্থলে ‘শান্তির মহড়া’ দেয়। সব ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সাথে আওয়ামী লীগ এবং এর সহযোগী সংগঠনকে অবরোধ শক্তিকে প্রতিরোধ করতে দেখা যায়। এখন বাহিনীগুলোর প্রধানেরা রাজনীতির ভাষায় কথা বলছেন। এ ভাষা এ দেশে এর আগে এভাবে কেউ বলতে পারেনি। প্রকাশ্যে দেখামাত্র গুলি করা হচ্ছে। তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধের নামে অথবা র্যাবের গাড়ি থেকে পালানোর নামে সম্ভাবনাময় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্মূল করা হচ্ছে। অবশেষে প্রধানমন্ত্রীও খুনের লাইসেন্স রিনিউ করলেন।
সন্দেহ নেই বিরোধী দলের ‘সব কটা জানালা’ বন্ধ করে দেয়ার পর আন্দোলন সহিংসতা রূপ নিচ্ছে। এ দেশে যেকোনো সংক্ষুব্ধতার প্রকাশ ঘটে গাড়ি ভাঙচুরের মধ্য দিয়ে। অবরোধ আন্দোলনের শেষ দিকে পেট্রলবোমার আমদানি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে শত্রু বানানোর অপকৌশল বলে বিরোধী পক্ষ অভিযোগ করছে। কারণ এখন পর্যন্ত পেট্রলবোমা নিক্ষেপকারী কেউ হাতেনাতে ধরা পড়েনি। অথচ পুলিশের বেষ্টনীর মধ্যেই এই হামলা হচ্ছে। সুতরাং কারা বোমা নিক্ষেপ করছে তা নিয়ে সঙ্গতভাবেই প্রশ্ন তোলা যায়। যেকোনো সাধারণ লোকের এটা বোঝার কথা যে, এই নির্মমতা, নৃশংসতা এবং পোড়ামুখ কি গণ-আন্দোলনে সহায়ক হবে? নিশ্চয়ই না। অতীতে যারা মানুষ মারার রাজনীতি করেছে তারাই এসব করছে বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করে। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া সুস্পষ্ট ভাষায় এসব সহিংসতার নিন্দা করেছেন। বিরোধী নেতৃবৃন্দ অভিযোগ করছেন এসব সরকারের এজেন্সিগুলোর কারসাজি! সে যাই হোক, বিরোধী অথবা সরকার যারাই এসব হত্যাকাণ্ড করছে তারা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করছে। আর এতে সাধারণ মানুষ নিদারুণ উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা এবং চরম উত্তেজনায় বসবাস করছে।
সরকার এবং তার নির্দেশিত গণমাধ্যম চলমান আন্দোলনকে সহিংস প্রমাণ করতে সদাব্যস্ত। অথচ এর উৎসমূল হচ্ছে মানুষের মৌলিক অধিকারকে পদদলিত করা। ‘অবৈধ সরকার’-এর পুনর্বার নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে বিএনপি যখন রাজনৈতিক উপায়ে প্রতিবাদ করতে চাইল, তখন সে স্বাভাবিক আন্দোলনকে কারা অস্বাভাবিকতার দিকে ধাবিত করল? আর ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনী তামাশার মাধ্যমে গণমানুষের চিরায়ত গণতান্ত্রিক অধিকারকে যেভাবে অস্বীকার করা হয়েছে এবং ছলেবলে-কলেকৌশলে ‘বিজয়’ হাইজ্যাক করা হয়েছে তাতে গণতান্ত্রিক আন্দোলন কি সতত স্বাভাবিক নয়?
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করেছিলেন। রাজনীতির ভাষায় কথা বলেছিলেন। তার বিনিময়ে জুলফিকার আলী ভুট্টো অস্ত্রের ভাষায় কথা বলেছিলেন। অবশেষে পাকিস্তানের নির্বোধ জেনারেলরা অস্ত্র প্রয়োগও করেছিলেন। আমাদের স্বৈরাচারও ১৯৯০ সালে অনিবার্য পতন ঠেকানোর জন্য অস্ত্র প্রয়োগ করেছিলেন। স্বতঃসিদ্ধ এই যে, এ ধরনের অস্ত্রের প্রয়োগ কোনো স্বৈরাচারের পতন ঠেকাতে পারে না। সুতরাং জনগণের কাক্সিত উচ্চারণ সহিংসতা নয়, সংলাপ। একটি রাজনৈতিক সরকার সংলাপের আহ্বান নিয়ে যত শিগগির এগিয়ে আসবে, তত শিগগিরই দেশে শান্তি, স্বস্তি ও স্বাভাবিকতা ফিরে আসবে।
বর্তমান সঙ্কটের উৎস নাগরিক সাধারণের জানা কথা। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে শঠতা, ষড়যন্ত্র, প্রতারণা ও দুর্বৃত্তায়নের ইতিহাস এখনো দগদগে। গণতন্ত্রের বিধিবিধান মোতাবেক মানুষ চেয়েছিল সম্মতির মাধ্যমে তাদের শাসক নির্ধারণ করবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় শক্তির মাধ্যমে তাদের শাসক বহাল থেকেছে। প্রধান বিরোধী দল দৃশ্যত জনগণের আস্থা লাভ করলেও সরকারের ষড়যন্ত্রের কবলে পরাজিত হয়েছে। রাজনীতির নাম যদি হয় ‘পলিট্রিকস’ অর্থাৎ বহুমুখী কারসাজিÑ তাতে বিএনপি কৌশলগতভাবে হেরে গেছে। আর রাজনীতি যদি হয় নীতি নৈতিকতা, সহজ-সরলতা এবং দায়দায়িত্ব তা হলে মনে করতে হবে বিএনপি জিতে আছে মানুষের মনের গভীরে।
বাংলাদেশের একজন স্বনামধন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানী নির্বাচনের আগে মন্তব্য করেছিলেনÑ শাসক দলের প্রতি সাধারণ মানুষের এত দুঃখ-কষ্ট, ক্ষোভ-ক্রোধ এবং অসন্তুষ্টি লুকিয়ে আছে যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়াই বিএনপি জয়লাভ করবে। বিএনপি নেতৃত্ব ক্ষমতার চেয়ে বিকৃত নির্বাচনব্যবস্থাকে একটি প্রতিষ্ঠানিকতা দিতে চেয়েছে বলেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে অনড় থেকেছে। সাজানো নির্বাচন অবশেষে অব্যাহত অবরোধকে কেন ব্যাহত করা হলো সে প্রশ্ন সঙ্গতভাবেই উত্থাপন করা যায়। বিএনপি হয়তো সরকারের পুনর্নির্বাচনের আশ্বাসকে বিশ্বাস করেছে। বেগম জিয়া যেমন দায় ঠেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬-এ নির্বাচন দিয়েছিলেন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংযোজন শেষে পুনর্নির্বাচনের ব্যবস্থা করেছিলেনÑ তিনি ৫ জানুয়ারি নির্বাচন শেষে তেমনই নির্বাচনের আশা পোষণ করেছিলেন। এখন আওয়ামী লীগের যেসব নেতা-পাতিনেতা তারস্বরে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কথা বলছেনÑ তারাই সে দিন জাতিকে পুনর্নির্বাচনের নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন। সে সময়ের সংবাদপত্রগুলোর পৃষ্ঠা উল্টালে ওই সত্যই প্রমাণিত হবে। বিএনপির পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগকে বিশ্বাস করা কি অন্যায় হয়েছে? ছোট সময়ে আদর্শলীপিতে পড়েছিলাম, ‘খলের আশ্বাস বাক্য না করিবে বিশ্বাস’।
নিয়মতান্ত্রিকভাবে বিএনপি আওয়ামী লীগকে পুনর্নির্বাচনের জন্য পুরো এক বছর সময় দিয়েছে। আওয়ামী লীগের তরফ থেকে কোনো ইতিবাচক সাড়া না পেয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন এবং ২০ দলীয় ঐক্যজোট প্রধান বেগম খালেদা জিয়া সঙ্কট সমাধানের লক্ষ্যে সাত দফা প্রস্তাবনা পেশ করেছেন। উপস্থাপিত সাত দফায় সঙ্কট উত্তরণের উপায় যেমন আছে, তেমনি আছে প্রকারান্তরে সমঝোতার আভাস। গত এক বছরের অপেক্ষা অবশেষে উৎকণ্ঠিত জাতি আশা করেছিল আওয়ামী লীগ ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। রাজনীতি দিয়ে রাজনীতির মোকাবেলা করবে। কিন্তু হতাশ জনগণ দেখল যে, বেগম খালেদা জিয়ার সংলাপ প্রস্তাব তাৎক্ষণিকভাবেই প্রত্যাখ্যাত হলো। শুধু তাই নয়, গণতান্ত্রিক অধিকারকে অস্বীকার করে বিএনপিকে জনসভা করার অনুমতি দেয়া হলো না। শাসক দলের পূর্বঅনুসৃত নোংরা খেলা অনুযায়ী বিএনপি প্রস্তাবিত জনসভার সময়কালে ‘সরকারি হরতাল’ আয়োজিত হলো।
ক্ষমতাসীন সরকারের সবচেয়ে দৃষ্টিকটু আচরণটি লক্ষ করা গেল বেগম খালেদা জিয়াকে কেন্দ্র করে। তথাকথিত নিরাপত্তার বানোয়াট অজুহাতে তাকে টানা ১৫ দিন অবরুদ্ধ থাকতে হলো। তার কার্যালয়ের সামনে বালু, রড, সিমেন্ট ভর্তি ট্রাক, লড়ি এবং শত শত পুলিশ, বিজিবি মোতায়েন করে তারা রাজনৈতিক নীচুতার প্রমাণ দিয়েছে। অবশেষে বেগম খালেদা জিয়ার সন্তান বিয়োগের মর্মান্তিক ঘটনা থেকেও রাজনৈতিক ফায়াদা হাসিলের চেষ্টা করেছে সরকার। দেশনেত্রী যখন সন্তানহারা বেদনায় মুহ্যমান, তখন ক্ষমতাসীনদের তরফ থেকে হত্যা, অগ্নিসংযোগ এবং পেট্রলবোমা নিক্ষেপের দায় তার ওপর চাপানোর জন্য হুকুমের আসামি করে বেশ কয়েকটি মামলা করা হয়েছে। এই মামলা থেকে বোঝা যায় যে, তাদের তথাকথিত সহানুভূতি প্রদর্শন কৃত্রিম এবং লোকদেখানো। এই দুঃসময়ে যে ভাষায় আওয়ামী নেতা-পাতিনেতারা তাকে গালাগালি করছে তা সভ্যতা-ভব্যতার সীমালঙ্ঘন করেছে। দায়িত্বশীল মন্ত্রীরা কোনো রকম রাখঢাক না করে তাকে গ্রেফতারের কথা বলছেন।
এসবের কারণ হিসেবে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে সবাই মিলে যা বলছেন তার সারমর্ম হলো বিএনপি চেয়ারপারসন যে অব্যাহত অবরোধের ঘোষণা দিয়েছেন তাতে ভায়োলেন্স হচ্ছে। মানুষ পেট্রলবোমার আঘাতে অগ্নিদগ্ধ হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। অভিযোগের উত্তরে বেগম খালেদা জিয়া ওই সব অন্যায় অপকর্মের জন্য আওয়ামী লীগকে দায়ী করেছেন। সর্বশেষ সংবাদ সম্মেলনে তিনি পুনর্নির্বাচন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি পুনর্ব্যক্ত করেন। সরকার যেভাবে বহমান আন্দোলনকে আইনশৃঙ্খলার সমস্যা বলছে তা নাকচ করে দিয়ে বেগম খালেদা জিয়া বলেন এটি রাজনৈতিক সমস্যা, রাজনৈতিকভাবেই মোকাবেলা করতে হবে।
এক বছরের ধূমায়িত অসন্তোষ অবশেষে যখন বিএনপি গণ-আন্দোলনের সূচনা করে, তখন আওয়ামী লীগ নিয়মতান্ত্রিক পথ অনুসরণ না করে দুই ধরনের নেতিবাচক কর্মপন্থা গ্রহণ করে। প্রথমত তারা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবসহ প্রায় সব শীর্ষ নেতাকে গ্রেফতার করে। পুলিশ, বিজিবি ও র্যাব মোতায়েন করে নয়াপল্টন অফিসসহ সর্বত্র ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) ১৪৪ ধারা জারি করে বিএনপির জনসভা ভণ্ডুল করে দেয়। দ্বিতীয়ত আওয়ামী লীগ বিএনপির জনসভার বিপরীতে ২২টি স্থানে সমাবেশসহ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মহাসমাবেশের ঘোষণা দেয়। তারা প্রকাশ্যে প্রতিরোধের কথা বলে। তাদের ছাত্রলীগ বিএনপি নেতাদের নেড়িকুত্তার মতো পিটুনির কথা বলে। সর্বত্র যুদ্ধংদেহি পরিবেশ পরিলক্ষিত হয়। সাধারণ মানুষ বিচলিত হয়ে ওঠে।
বেগম খালেদা জিয়া ৫ জানুয়ারি অবরুদ্ধ অবস্থায় অনির্দিষ্টকালের জন্য অবরোধ ঘোষণা করেন। অবরোধে সারা দেশ অচল হয়ে পড়ে। সড়ক, নৌ ও রেলপথ একরকম বন্ধ হয়ে যায়। বেসরকারি বা ব্যক্তিগত যানবহন সীমিত হয়ে পড়ে। ব্যবসাবাণিজ্য মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমদানি-রফতানি ব্যাহত হয়। শিক্ষাব্যবস্থা তথা পরীক্ষা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। সর্বত্র খাদ্যশস্যসহ সব ধরনের সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হয়। সীমান্ত বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যায়। দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ প্রান্তিকপর্যায়ে পৌঁছায়। এককথায় বিএনপি তথা ২০ দলীয় জোটের আহূত রাজনৈতিক কর্মসূচি সফল হয়। যদিও জনসাধারণকে ভোগান্তিতে পড়তে হয় তবুও মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় আন্দোলনের অপরিহার্যতায় তাদের এ ত্যাগ স্বীকার করতে হয়।
অবরোধের ব্যাপকতা পত্রপত্রিকা এবং চ্যানেলগুলোর প্রতিবেদনে দৃশ্যমান হয়। কিন্তু সরকার অবরোধকে ব্যর্থ বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করে। আওয়ামী লোকেরা প্রতিদিন ঢাকা শহরের কেন্দ্রস্থলে ‘শান্তির মহড়া’ দেয়। সব ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সাথে আওয়ামী লীগ এবং এর সহযোগী সংগঠনকে অবরোধ শক্তিকে প্রতিরোধ করতে দেখা যায়। এখন বাহিনীগুলোর প্রধানেরা রাজনীতির ভাষায় কথা বলছেন। এ ভাষা এ দেশে এর আগে এভাবে কেউ বলতে পারেনি। প্রকাশ্যে দেখামাত্র গুলি করা হচ্ছে। তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধের নামে অথবা র্যাবের গাড়ি থেকে পালানোর নামে সম্ভাবনাময় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্মূল করা হচ্ছে। অবশেষে প্রধানমন্ত্রীও খুনের লাইসেন্স রিনিউ করলেন।
সন্দেহ নেই বিরোধী দলের ‘সব কটা জানালা’ বন্ধ করে দেয়ার পর আন্দোলন সহিংসতা রূপ নিচ্ছে। এ দেশে যেকোনো সংক্ষুব্ধতার প্রকাশ ঘটে গাড়ি ভাঙচুরের মধ্য দিয়ে। অবরোধ আন্দোলনের শেষ দিকে পেট্রলবোমার আমদানি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে শত্রু বানানোর অপকৌশল বলে বিরোধী পক্ষ অভিযোগ করছে। কারণ এখন পর্যন্ত পেট্রলবোমা নিক্ষেপকারী কেউ হাতেনাতে ধরা পড়েনি। অথচ পুলিশের বেষ্টনীর মধ্যেই এই হামলা হচ্ছে। সুতরাং কারা বোমা নিক্ষেপ করছে তা নিয়ে সঙ্গতভাবেই প্রশ্ন তোলা যায়। যেকোনো সাধারণ লোকের এটা বোঝার কথা যে, এই নির্মমতা, নৃশংসতা এবং পোড়ামুখ কি গণ-আন্দোলনে সহায়ক হবে? নিশ্চয়ই না। অতীতে যারা মানুষ মারার রাজনীতি করেছে তারাই এসব করছে বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করে। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া সুস্পষ্ট ভাষায় এসব সহিংসতার নিন্দা করেছেন। বিরোধী নেতৃবৃন্দ অভিযোগ করছেন এসব সরকারের এজেন্সিগুলোর কারসাজি! সে যাই হোক, বিরোধী অথবা সরকার যারাই এসব হত্যাকাণ্ড করছে তারা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করছে। আর এতে সাধারণ মানুষ নিদারুণ উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা এবং চরম উত্তেজনায় বসবাস করছে।
সরকার এবং তার নির্দেশিত গণমাধ্যম চলমান আন্দোলনকে সহিংস প্রমাণ করতে সদাব্যস্ত। অথচ এর উৎসমূল হচ্ছে মানুষের মৌলিক অধিকারকে পদদলিত করা। ‘অবৈধ সরকার’-এর পুনর্বার নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে বিএনপি যখন রাজনৈতিক উপায়ে প্রতিবাদ করতে চাইল, তখন সে স্বাভাবিক আন্দোলনকে কারা অস্বাভাবিকতার দিকে ধাবিত করল? আর ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনী তামাশার মাধ্যমে গণমানুষের চিরায়ত গণতান্ত্রিক অধিকারকে যেভাবে অস্বীকার করা হয়েছে এবং ছলেবলে-কলেকৌশলে ‘বিজয়’ হাইজ্যাক করা হয়েছে তাতে গণতান্ত্রিক আন্দোলন কি সতত স্বাভাবিক নয়?
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করেছিলেন। রাজনীতির ভাষায় কথা বলেছিলেন। তার বিনিময়ে জুলফিকার আলী ভুট্টো অস্ত্রের ভাষায় কথা বলেছিলেন। অবশেষে পাকিস্তানের নির্বোধ জেনারেলরা অস্ত্র প্রয়োগও করেছিলেন। আমাদের স্বৈরাচারও ১৯৯০ সালে অনিবার্য পতন ঠেকানোর জন্য অস্ত্র প্রয়োগ করেছিলেন। স্বতঃসিদ্ধ এই যে, এ ধরনের অস্ত্রের প্রয়োগ কোনো স্বৈরাচারের পতন ঠেকাতে পারে না। সুতরাং জনগণের কাক্সিত উচ্চারণ সহিংসতা নয়, সংলাপ। একটি রাজনৈতিক সরকার সংলাপের আহ্বান নিয়ে যত শিগগির এগিয়ে আসবে, তত শিগগিরই দেশে শান্তি, স্বস্তি ও স্বাভাবিকতা ফিরে আসবে।
No comments