ক্রসফায়ার- ২৪ ঘণ্টায় ৩, ৭ দিনে ১২ জন বিচারবহির্ভূত হত্যা
গাণিতিক
নয়, বিচারবহির্ভূত হত্যা বাড়ছে জ্যামিতিক হারে। প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও
কেউ শিকার হচ্ছেন ক্রসফায়ারের। বেশির ভাগই রাজনৈতিক কর্মী। আবার কারও কারও
রাজনীতির সঙ্গে কোন যোগ নেই। বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতেই বিচারবহির্ভূত
হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন তিনজন। রাজশাহীতে পুলিশের কথিত বন্দুকযুদ্ধে
বিশ্ববিদ্যালয় শাখা শিবিরের তথ্যবিষয়ক সম্পাদক শাহাবুদ্দিন (২৪) নিহত
হয়েছেন। কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে নিহত হয়েছেন উপজেলা শিবিরের সভাপতি সাহাব
পাটোয়ারী (২৪)। আর যশোরে নিহত হয়েছেন শহীদুল ইসলাম নামে এক জামায়াতকর্মী।
গত সাতদিনে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন অন্তত এক ডজন ব্যক্তি।
এর মধ্যে সরাসরি ক্রসফায়ারের শিকার হয়েছেন অন্তত ৮ জন। বাকি চার জনের
মধ্যে দু’জনের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। আর দু’জন পুলিশের গাড়ি থেকে
পালাতে গিয়ে ট্রাকচাপায় নিহত হয়েছে বলে দাবি করছে পুলিশ। যদিও তাদের
পরিবারের দাবি আগেই গ্রেপ্তার করা হয়েছিল তাদের।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হিসাব অনুযায়ী, বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০দলীয় জোটের ডাকা টানা অবরোধে গত ৫ই জানুয়ারি থেকে গতকাল পর্যন্ত ঢাকাসহ সারা দেশে বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছেন ১৬ জন। যদিও মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের হিসাব অনুযায়ী, জানুয়ারি মাসেই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ১৭ জন। এর বাইরে চলতি মাসে আরও অন্তত ১০ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র বলছে, ৫ই জানুয়ারি থেকে গতকাল পর্যন্ত অন্তত ২২ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন।
মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বলেন, এক বাক্যে বলতে গেলে বলতে হবে এই পরিস্থিতিটা মানবাধিকার বা গণতন্ত্রের দৃষ্টিকোন থেকে বাদ দিয়ে আদিম যুগের হিসাবে বিবেচনা করলেও গ্রহণযোগ্য হতো না। তিনি বলেন, গত কিছুদিন ধরে কিছু মানুষের বক্তব্য-বিবৃতি যা শুনছি তা মুক্তিযুদ্ধের সময়ের সামরিক জান্তাদের কথার প্রতিধ্বনি। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত এই মানবাধিকারকর্মী বলেন, আমার দুর্ভাগ্য যে এ ধরনের ‘কমেন্ট’স করতে আমি বাধ্য হচ্ছি। একদিকে যেমন পেট্রলবোমা দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারা হচ্ছে। তেমনি তা দমনে নির্বিচারে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চলছে।
সাবেক আইজিপি মোহাম্মদ নূরুল হুদা বলেন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে সন্দেহ করা যেতে পারে তবে নিশ্চিত করে বলা যাবে না যে এগুলো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। কারণ, কেউ একজন অস্ত্রধারী যদি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালায় তাহলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলি করা ছাড়া উপায় থাকে না। তা না হলে তাকেই মরতে হবে। তিনি বলেন, দেশে উত্তপ্ত অবস্থায় এরকম ঘটনা ঘটে। তবে এসব ঘটনার অনুসন্ধান জরুরি। সরকারি বা বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠনগুলো এসব ঘটনার অনুসন্ধান করে দেখতে পারে।
রাজশাহী থেকে স্টাফ রিপোর্টার জানিয়েছেন, পুলিশের গুলিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রশিবিরের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক শাহাবুদ্দিন নিহত হওয়ার পাশাপাশি সংগঠনের আরও দুই নেতা গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। বৃহস্পতিবার গভীর রাতে কাটাখালির সমসাদীপুরে এ ঘটনা ঘটে। নিহত শিবির নেতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর শ্রেণীর শিক্ষার্থী ও নাটোর জেলার ছাতনী এলাকার রফিকুল্লাহর ছেলে। অপর দুই নেতা- হলেন বিনোদপুর আবাসিক এলাকার সভাপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের স্নাতকোত্তর শ্রেণীর শিক্ষার্থী মফিজুর রহমান এবং হবিবুর রহমান হল শাখা শিবিরের সভাপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত গণিত বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী হাবিবুর রহমান। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তাদের পুলিশ হেফাজতে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। রামেক’র পুলিশ বক্সের দায়িত্বে থাকা উপ-পরিদর্শক (এসআই) বদিউজ্জামান জানান, বৃহস্পতিবার রাত দেড়টার দিকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তিনজনকে কে বা কারা মেডিক্যালে নিয়ে আসে। পরে চিকিৎসক শাহাবুদ্দিনকে মৃত ঘোষণা করেন। আহত অপর দুই জনের মধ্যে মফিজুরের দুই পায়ে এবং হাবিবুরের ডান পায়ে হাঁটুর নিচে গুলি লেগেছে। তাদেরকে পুলিশি হেফাজতে রেখে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। নিহতের পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার রাত ৯টার দিকে ব্যক্তিগত কাজ শেষ করে কাটাখালি বাজার দিয়ে ফেরার পথে পুলিশ তাদেরকে আটক করে অজ্ঞাতস্থানে নিয়ে যায়। পরে পরিবারের সদস্যসহ বন্ধু-বান্ধবরা বারবার তাদের অবস্থান জানতে চাইলে পুলিশ আটক করার কথা অস্বীকার করে। রাত ১টার দিকে খবর আসে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তাদের ভর্তি করা হয়েছে এবং শাহাবুদ্দিন মারা গেছে। সকালে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে স্বজনরা তার গুলিবিদ্ধ লাশ পায়। পুলিশ পরিকল্পিতভাবে তাকে হত্যা করেছে বলে অভিযোগ নিহতের পরিবারের। স্বজনরা বলেন, ভেবেছিলাম আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে আমাদের সন্তানরা নিরাপদেই আছে। কারণ আমাদের জানা মতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাউকে হত্যা নয় বরং অভিযুক্তকে আইনের হাতে তুলে দেয়। পুলিশ যে নৃশংস অমানবিক হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে, তাতে আমরা বাকরুদ্ধ। আইনের রক্ষকেরা যদি বেআইনিভাবে এমন নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালায় তাহলে সাধারণ নাগরিকরা যাবে কোথায়? আমরা এ হত্যার উপযুক্ত বিচার চাই। যাতে আর কোন মা-বাবার বুক এভাবে খালি না হয়।
এদিকে মতিহার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আলমগীর হোসেন দাবি করেছেন, কাটাখালি পৌরসভার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় সেখানে দায়িত্বরত পুলিশের উপর তারা ককটেল নিক্ষেপ করে। এ সময় মাহবুব নামের এক কনস্টেবলকে পেছন থেকে রড দিয়ে আঘাত করে। দুর্বৃত্ত বুঝতে পেরে পুলিশ তৎক্ষণাত গুলি করে। তখন একজন সেখানে মারা যায়, আর বাকি দুজন গুলিবিদ্ধ হয়। তাদেরকে রামেকে ভর্তি করা হয়েছে। তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং ক্যাম্পাসের আশপাশের অনেক নাশকতার সঙ্গে জড়িত।
কুমিল্লা থেকে স্টাফ রিপোর্টার জানান, কুমিল্লায় পুলিশের সঙ্গে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ চৌদ্দগ্রাম উপজেলা শিবিরের সভাপতি শাহাব উদ্দিন পাটোয়ারী নিহত হয়েছেন। ঘটনাস্থল থেকে অস্ত্র, গুলি ও পেট্রলবোমা উদ্ধার করার দাবি করেছে পুলিশ। কুমিল্লার পুলিশ সুপার টুটুল চক্রবর্তী সাংবাদিকদের জানান, পুলিশের উপর হামলার পর পাল্টা গুলিতে শিবির নেতা নিহত হয়। চৌদ্দগ্রাম থানার ওসি উত্তম কুমার চক্রবর্তী জানান, এ ঘটনায় হত্যা ও অস্ত্র আইনে পৃথক ২টি মামলা হয়েছে। নিহত শাহাব উদ্দিনের বিরুদ্ধে হত্যা, সন্ত্রাসবিরোধী আইনসহ বিভিন্ন অপরাধে ২০টি মামলার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে। এদিকে হাসপাতালের মর্গে আসা নিহত শাহাব উদ্দিন পাটোয়ারীর বোন ফারজানা আক্তার সাংবাদিকদের জানান, বৃহস্পতিবার বিকাল ৫টার দিকে চৌদ্দগ্রাম পৌর এলাকার চান্দিশকরা গ্রামের নিজ বাড়ির সামনে থেকে পুলিশ পরিচয়ে সাদা পোশাকধারী একদল লোক আমার ভাইকে ধরে নিয়ে যায়। পরে জানতে পেরে আজ (শুক্রবার) মর্গে এসে আমার ভাইয়ের লাশ দেখতে পাই। নিহত শাহাব উদ্দিন চৌদ্দগ্রাম পৌরসভা এলাকার চান্দিশকরা গ্রামের মাওলানা জয়নাল আবেদীন পাটোয়ারীর পুত্র এবং তিনি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অনার্স ৪র্থ বর্ষের ছাত্র ছিলেন।
যশোর থেকে স্টাফ রিপোর্টার জানান, যশোর সদর উপজেলার রামনগর পিকনিক কর্নারে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে শহিদুল ইসলাম নামে এক জামায়াত নেতা নিহত হন। গত রাত ৩টার দিকে এই ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটে বলে যশোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আরিফুল হক জানিয়েছেন। নিহত শহিদুল ইসলামের বাড়ি সাতক্ষীরা সদরে। যশোরের পুলিশ সুপার আনিসুর রহমান জানান, গত বুধবার শার্শা থেকে শহিদুল ইসলাম ও আবদুল মজিদ নামে ২ জনকে আটক করে পুলিশ। আটক দু’জনই সাতক্ষীরার বাসিন্দা। আবদুল মজিদ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল সাতক্ষীরা পৌর শাখার সাবেক সভাপতি। বর্তমানে তিনি জেলা বিএনপির সদস্য। আর শহিদুল ইসলাম। বর্তমানে তিনি জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে যুক্ত। শহিদুল ইসলাম সাতক্ষীরা ও কলারোয়া থানায় হত্যা, নাশকতাসহ পাঁচটি মামলার আসামি। এসপি আরও জানান, যেহেতু যশোরের কোন থানায় এই দু’জনের বিরুদ্ধে মামলা নেই, তাই পুলিশ এদের দণ্ডবিধির ৫৪ ধারায় আটক দেখিয়ে বৃহস্পতিবার দুপুরে আদালতে নিয়ে যাচ্ছিল। পথে ঝিকরগাছার গাজীর দরগাহ এলাকা থেকে এরা পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যায়। আসামি পালানোর ঘটনায় তিন পুলিশকে লাইনে ক্লোজ করা হয়। এ ঘটনায় কোতোয়ালি থানায় মামলাও করে পুলিশ। এদিকে পুলিশ হেফাজত থেকে পালিয়ে যাওয়া আসামিকে ধরতে গতকাল বিকাল থেকে যশোরের পুলিশ সাঁড়াশি অভিযান শুরু করে। পরে রাত ৩টার দিকে পুলিশ জানতে পারে শহিদুল ইসলাম রামনগরে তার এক আত্মীয়ের বাড়িতে অবস্থান করছে। খবর পেয়ে পুলিশ সেখানে অভিযান চালায়। পুলিশ শহিদুল ইসলামকে আটক করে ফেরার পথে রামনগর পিকনিক কর্নারের কাছে পৌঁছালে স্থানীয় জামায়াত শিবিরের ক্যাডাররা পুলিশের ওপর আক্রমণ করে। এ সময় পুলিশও পাল্টা আক্রমণে যায়। এই সংঘর্ষ চলাকালে শহিদুল ইসলাম ফের পালানের চেষ্টা করলে পুলিশের ক্রসফায়ারে তার মৃত্যু হয়। সকালে নিহত শহিদুল ইসলামের মৃতদেহ উদ্ধার করে যশোর জেনারেল হাসপাতালের মর্গে পাঠিয়েছে কোতোয়ালি পুলিশ।
নোয়াখালী থেকে স্টাফ রিপোর্টার জানান, নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের লক্ষ্মীনারায়ণপুর গ্রামে পিচ্চি সোহেলের (৩০) গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। বৃহস্পতিবার রাত পৌনে ৮টার দিকে ইউনিয়নের লক্ষ্মীনারায়ণপুরের ৭নং ওয়ার্ডের আবু তাহের মেম্বার বাড়ির পার্শ্ববর্তী দিঘির পাশ থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। নিহত পিচ্চি সোহেল উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের লক্ষ্মীনারায়ণপুর গ্রামের মেকার বাড়ির হাবিব উল্লার ছেলে। লক্ষ্মীনারায়ণপুরের ৭নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য রহমত উল্লা বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, নিহত সোহেল স্থানীয় বিএনপির একজন সক্রিয় কর্মী। স্থানীয়রা জানায়, বৃহস্পতিবার রাত পৌনে ৮টার দিকে লক্ষ্মীনারায়ণপুরের আবু তাহের মেম্বার বাড়ির পার্শ্ববর্তী দিঘির পাশে পরপর কয়েকটি গুলির শব্দ শুনতে পায় এলাকার লোকজন। পরে তারা কিছুক্ষণ পর ঘটনাস্থলে গিয়ে পিচ্চি সোহলকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে সেখান থেকে উদ্ধার করে স্থানীয় লাইফ কেয়ার হসপিটালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। বেগমগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আইনুল হক জানান, নিহতের লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য নোয়াখালী আবদুল মালেক উকিল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত সাত দিনে সারা দেশে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে অন্তত এক ডজন ব্যক্তি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। রাজশাহী, কুমিল্লা, যশোর ও নোয়াখালীতে চার জন নিহত হওয়া ছাড়াও বুধবার দিবাগত রাত তিনটার দিকে কাজীপাড়া এলাকায় অজ্ঞাত এক যুবক পুলিশের কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়। এর একিদন আগেই মঙ্গলবার রাতে যাত্রাবাড়ীর মাতুইয়ালে র্যাবের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় মুজাহিদুল ইসলাম জিহাদ ও সাখাওয়াত হোসেন রাহাত নামে দুই যুবক নিহত হয়। নিহত দু’জনই গত মাসের ২১শে জানুয়ারি থেকে নিখোঁজ ছিলেন বলে পরিবারের সদস্যরা জানিযেছে। দু’জনের গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুর জেলায়। একই দিন রাজধানীর ভাষানটেক বালুর মাঠ থেকে আলামীন (৩০) নামে এক যুবকের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ভাই বিল্লাল হোসেন জানান, আলামীন ৭ দিন আগে গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলের সদর থানা টিলাবাড়ির এলাকা থেকে নিখোঁজ হয়।
গত ৩১শে জানুয়ারি শনিবার রাত সোয়া ১১টায় রাজধানীর রূপনগর এলাকার বেড়িবাঁধ এলাকায় পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে এমদাদ উল্লাহ ওরফে জুনায়েদ (২২) নামে এক শিবির নেতা নিহত হন। তিনি ৯৮ নম্বর ওয়ার্ডের সভাপতি ছিলেন। পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ, মেস থেকে মেধাবী এই ছাত্রকে সন্দেহমূলকভাবে আটক করে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। এর একদিন আগে ৩০শে জানুয়ারি শুক্রবার সকাল ১১টায় রূপনগর থানাধীন বেড়িবাঁধের চটবাড়ি এলাকায় এক যুবকের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পরে জানা যায়, ওই যুবকের নাম আরিফুল ইসলাম মুকুল। তিনি তেজগাঁও থানার জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কর্মী ছিলেন। নিহতের মামা তৌহিদুল ইসলাম জানান, আরিফুলকে গত ২৯শে জানুয়ারি বিকালে সদরঘাটে লঞ্চ থেকে ডিবি পুলিশের পরিচয় দিয়ে তাকে আটক করে নিয়ে যাওয়া হয়। পুলিশ তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে বলে তিনি দাবি করেছেন। গত ২৭শে জানুয়ারি ভোরে রাজশাহীতে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন স্থানীয় জামায়াত নেতা অধ্যাপক নূরুল ইসলাম শাহীন। পরিবারের অভিযোগ, তাকে আটক করার পর ‘পরিকল্পিতভাবে হত্যা’ করেছে ডিবি পুলিশ। নিহত নূরুল ইসলাম শাহীন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বিনোদপুর এলাকার ইসলামীয়া কলেজের ইসলাম শিক্ষা বিষয়ের অধ্যাপক ছিলেন। একই সময়ে সাতক্ষীরার পাটকেল ঘাটায় পুলিশের সঙ্গে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ রফিকুল ইসলাম নামে অপর এক ব্যক্তি নিহত হন। পুলিশের দাবি, পাটকেলঘাটা থানার কুমিরা ইউনিয়নের অভয়তলায় একদল ডাকাত ডাকাতির প্রস্তুতি নিচ্ছে এমন খবর পেয়ে ভোরে পুলিশ সেখানে যায়। এ সময় ডাকাতরা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ে। পুলিশও পাল্টা গুলি চালালে গুলিবিদ্ধ হন রফিকুল। তবে নিহত রফিকুলের স্ত্রী অভিযোগ করেছেন, তার স্বামীকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে ‘বন্দুকযুদ্ধের’ নাটক সাজিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। গত ২৬শে জানুয়ারি রাজধানীর রামপুরায় র্যাবের সঙ্গে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ আবুল কালাম ও সুলতান নামে দুই যুবক নিহত হন। ২৩শে জানুয়ারি কুমিল্লার দাউদকান্দিতে র্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন লক্ষ্মীপুরের সাবেক ছাত্রদল নেতা সোলাইমান উদ্দিন জিসান (২৮)। ২০শে জানুয়ারি রাজধানীতে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সঙ্গে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন খিলগাঁও থানা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নুরুজ্জামান ওরফে জনি। কারাগারে আটক ছোট ভাইকে দেখা করতে গেলে সেখান থেকে সোমবার ডিবি তাকে আটক করে। পরদিন জোড়াপুকুরপাড় এলাকায় তাকে নিয়ে অভিযান চালানোর সময় সহযোগীরা পুলিশের ওপর হামলা চালায় বলে দাবি করা হয়। এ সময় সহযোগীদের গুলিতেই জনি নিহত হন বলে দাবি করেন পুলিশ কর্মকর্তারা। নূরুজ্জামান জনির স্ত্রী মুনিয়া পারভীন মনীষা অভিযোগ করেন, ছাত্রদলের খিলগাঁও থানার সম্পাদকের দায়িত্বে থাকার কারণেই তাকে ক্রসফায়ারের নামে হত্যা করা হয়েছে। ১৯শে জানুয়ারি মতিঝিলের এজিবি কলোনিতে পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন নড়াইল পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ইমরুল কায়েস। তিনি জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। নিহতের পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, তিনি এক সপ্তাহ আগে ঢাকায় যান। নিহত হওয়ার চার দিন আগে থেকে তিনি নিখোঁজ ছিলেন। তাদের অভিযোগ, ডিবি থেকে তাকে আটক করে বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যা করেছে। এছাড়া গত ১৬ই জানুয়ারি যৌথবাহিনীর অভিযানের মধ্যে র্যাবের হাতে আটকের পর চাঁপাই নবাবগঞ্জের কানসাটে কথিত বন্দুকযুদ্ধে ছাত্রদল নেতা মতিউর রহমান নিহত হন। নিহত মতিউর রহমান শিবগঞ্জ উপজেলার শ্যামপুর ইউনিয়ন ছাত্রদলের সহসভাপতি ছিলেন। মতিউরকে নিয়েও মধ্যরাতে অভিযানে গিয়েছিল র্যাব। এ সময় মতিউরের সহযোগীরা র্যাবের ওপর গুলি ছুড়লে র্যাবও পাল্টা গুলি ছুড়ে। এতেই মতিউর গুলিবিদ্ধ হয় বলে র্যাবের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়।
এর বাইরে গত ২৭শে জানুয়ারি র্যাবের হাতে গ্রেপ্তারের পর এক শিবির নেতা ও গত সোমবার রাতে পুলিশের হাতে আটকের পর দুই বিএনপি সমর্থক মারা গেছেন। র্যাব ও পুলিশের দাবি, পালাতে গিয়ে ট্রাক চাপায় নিহত হয়েছেন তারা। যদিও নিহতদের পরিবারের সদস্যরা দাবি করেছেন, তাদের মারধর করে পরে ট্রাকচাপা দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এছাড়া ঢাকার মিরপুর রূপনগর বেড়িবাঁধ থেকে আরেক ছাত্রদল নেতার গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। স্বজনদের ধারণা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাই তাকে হত্যার পর লাশ ফেলে এসেছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হিসাব অনুযায়ী, বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০দলীয় জোটের ডাকা টানা অবরোধে গত ৫ই জানুয়ারি থেকে গতকাল পর্যন্ত ঢাকাসহ সারা দেশে বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছেন ১৬ জন। যদিও মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের হিসাব অনুযায়ী, জানুয়ারি মাসেই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ১৭ জন। এর বাইরে চলতি মাসে আরও অন্তত ১০ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র বলছে, ৫ই জানুয়ারি থেকে গতকাল পর্যন্ত অন্তত ২২ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন।
মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বলেন, এক বাক্যে বলতে গেলে বলতে হবে এই পরিস্থিতিটা মানবাধিকার বা গণতন্ত্রের দৃষ্টিকোন থেকে বাদ দিয়ে আদিম যুগের হিসাবে বিবেচনা করলেও গ্রহণযোগ্য হতো না। তিনি বলেন, গত কিছুদিন ধরে কিছু মানুষের বক্তব্য-বিবৃতি যা শুনছি তা মুক্তিযুদ্ধের সময়ের সামরিক জান্তাদের কথার প্রতিধ্বনি। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত এই মানবাধিকারকর্মী বলেন, আমার দুর্ভাগ্য যে এ ধরনের ‘কমেন্ট’স করতে আমি বাধ্য হচ্ছি। একদিকে যেমন পেট্রলবোমা দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারা হচ্ছে। তেমনি তা দমনে নির্বিচারে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চলছে।
সাবেক আইজিপি মোহাম্মদ নূরুল হুদা বলেন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে সন্দেহ করা যেতে পারে তবে নিশ্চিত করে বলা যাবে না যে এগুলো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। কারণ, কেউ একজন অস্ত্রধারী যদি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালায় তাহলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলি করা ছাড়া উপায় থাকে না। তা না হলে তাকেই মরতে হবে। তিনি বলেন, দেশে উত্তপ্ত অবস্থায় এরকম ঘটনা ঘটে। তবে এসব ঘটনার অনুসন্ধান জরুরি। সরকারি বা বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠনগুলো এসব ঘটনার অনুসন্ধান করে দেখতে পারে।
রাজশাহী থেকে স্টাফ রিপোর্টার জানিয়েছেন, পুলিশের গুলিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রশিবিরের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক শাহাবুদ্দিন নিহত হওয়ার পাশাপাশি সংগঠনের আরও দুই নেতা গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। বৃহস্পতিবার গভীর রাতে কাটাখালির সমসাদীপুরে এ ঘটনা ঘটে। নিহত শিবির নেতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর শ্রেণীর শিক্ষার্থী ও নাটোর জেলার ছাতনী এলাকার রফিকুল্লাহর ছেলে। অপর দুই নেতা- হলেন বিনোদপুর আবাসিক এলাকার সভাপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের স্নাতকোত্তর শ্রেণীর শিক্ষার্থী মফিজুর রহমান এবং হবিবুর রহমান হল শাখা শিবিরের সভাপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত গণিত বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী হাবিবুর রহমান। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তাদের পুলিশ হেফাজতে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। রামেক’র পুলিশ বক্সের দায়িত্বে থাকা উপ-পরিদর্শক (এসআই) বদিউজ্জামান জানান, বৃহস্পতিবার রাত দেড়টার দিকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তিনজনকে কে বা কারা মেডিক্যালে নিয়ে আসে। পরে চিকিৎসক শাহাবুদ্দিনকে মৃত ঘোষণা করেন। আহত অপর দুই জনের মধ্যে মফিজুরের দুই পায়ে এবং হাবিবুরের ডান পায়ে হাঁটুর নিচে গুলি লেগেছে। তাদেরকে পুলিশি হেফাজতে রেখে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। নিহতের পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার রাত ৯টার দিকে ব্যক্তিগত কাজ শেষ করে কাটাখালি বাজার দিয়ে ফেরার পথে পুলিশ তাদেরকে আটক করে অজ্ঞাতস্থানে নিয়ে যায়। পরে পরিবারের সদস্যসহ বন্ধু-বান্ধবরা বারবার তাদের অবস্থান জানতে চাইলে পুলিশ আটক করার কথা অস্বীকার করে। রাত ১টার দিকে খবর আসে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তাদের ভর্তি করা হয়েছে এবং শাহাবুদ্দিন মারা গেছে। সকালে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে স্বজনরা তার গুলিবিদ্ধ লাশ পায়। পুলিশ পরিকল্পিতভাবে তাকে হত্যা করেছে বলে অভিযোগ নিহতের পরিবারের। স্বজনরা বলেন, ভেবেছিলাম আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে আমাদের সন্তানরা নিরাপদেই আছে। কারণ আমাদের জানা মতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাউকে হত্যা নয় বরং অভিযুক্তকে আইনের হাতে তুলে দেয়। পুলিশ যে নৃশংস অমানবিক হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে, তাতে আমরা বাকরুদ্ধ। আইনের রক্ষকেরা যদি বেআইনিভাবে এমন নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালায় তাহলে সাধারণ নাগরিকরা যাবে কোথায়? আমরা এ হত্যার উপযুক্ত বিচার চাই। যাতে আর কোন মা-বাবার বুক এভাবে খালি না হয়।
এদিকে মতিহার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আলমগীর হোসেন দাবি করেছেন, কাটাখালি পৌরসভার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় সেখানে দায়িত্বরত পুলিশের উপর তারা ককটেল নিক্ষেপ করে। এ সময় মাহবুব নামের এক কনস্টেবলকে পেছন থেকে রড দিয়ে আঘাত করে। দুর্বৃত্ত বুঝতে পেরে পুলিশ তৎক্ষণাত গুলি করে। তখন একজন সেখানে মারা যায়, আর বাকি দুজন গুলিবিদ্ধ হয়। তাদেরকে রামেকে ভর্তি করা হয়েছে। তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং ক্যাম্পাসের আশপাশের অনেক নাশকতার সঙ্গে জড়িত।
কুমিল্লা থেকে স্টাফ রিপোর্টার জানান, কুমিল্লায় পুলিশের সঙ্গে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ চৌদ্দগ্রাম উপজেলা শিবিরের সভাপতি শাহাব উদ্দিন পাটোয়ারী নিহত হয়েছেন। ঘটনাস্থল থেকে অস্ত্র, গুলি ও পেট্রলবোমা উদ্ধার করার দাবি করেছে পুলিশ। কুমিল্লার পুলিশ সুপার টুটুল চক্রবর্তী সাংবাদিকদের জানান, পুলিশের উপর হামলার পর পাল্টা গুলিতে শিবির নেতা নিহত হয়। চৌদ্দগ্রাম থানার ওসি উত্তম কুমার চক্রবর্তী জানান, এ ঘটনায় হত্যা ও অস্ত্র আইনে পৃথক ২টি মামলা হয়েছে। নিহত শাহাব উদ্দিনের বিরুদ্ধে হত্যা, সন্ত্রাসবিরোধী আইনসহ বিভিন্ন অপরাধে ২০টি মামলার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে। এদিকে হাসপাতালের মর্গে আসা নিহত শাহাব উদ্দিন পাটোয়ারীর বোন ফারজানা আক্তার সাংবাদিকদের জানান, বৃহস্পতিবার বিকাল ৫টার দিকে চৌদ্দগ্রাম পৌর এলাকার চান্দিশকরা গ্রামের নিজ বাড়ির সামনে থেকে পুলিশ পরিচয়ে সাদা পোশাকধারী একদল লোক আমার ভাইকে ধরে নিয়ে যায়। পরে জানতে পেরে আজ (শুক্রবার) মর্গে এসে আমার ভাইয়ের লাশ দেখতে পাই। নিহত শাহাব উদ্দিন চৌদ্দগ্রাম পৌরসভা এলাকার চান্দিশকরা গ্রামের মাওলানা জয়নাল আবেদীন পাটোয়ারীর পুত্র এবং তিনি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অনার্স ৪র্থ বর্ষের ছাত্র ছিলেন।
যশোর থেকে স্টাফ রিপোর্টার জানান, যশোর সদর উপজেলার রামনগর পিকনিক কর্নারে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে শহিদুল ইসলাম নামে এক জামায়াত নেতা নিহত হন। গত রাত ৩টার দিকে এই ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটে বলে যশোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আরিফুল হক জানিয়েছেন। নিহত শহিদুল ইসলামের বাড়ি সাতক্ষীরা সদরে। যশোরের পুলিশ সুপার আনিসুর রহমান জানান, গত বুধবার শার্শা থেকে শহিদুল ইসলাম ও আবদুল মজিদ নামে ২ জনকে আটক করে পুলিশ। আটক দু’জনই সাতক্ষীরার বাসিন্দা। আবদুল মজিদ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল সাতক্ষীরা পৌর শাখার সাবেক সভাপতি। বর্তমানে তিনি জেলা বিএনপির সদস্য। আর শহিদুল ইসলাম। বর্তমানে তিনি জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে যুক্ত। শহিদুল ইসলাম সাতক্ষীরা ও কলারোয়া থানায় হত্যা, নাশকতাসহ পাঁচটি মামলার আসামি। এসপি আরও জানান, যেহেতু যশোরের কোন থানায় এই দু’জনের বিরুদ্ধে মামলা নেই, তাই পুলিশ এদের দণ্ডবিধির ৫৪ ধারায় আটক দেখিয়ে বৃহস্পতিবার দুপুরে আদালতে নিয়ে যাচ্ছিল। পথে ঝিকরগাছার গাজীর দরগাহ এলাকা থেকে এরা পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যায়। আসামি পালানোর ঘটনায় তিন পুলিশকে লাইনে ক্লোজ করা হয়। এ ঘটনায় কোতোয়ালি থানায় মামলাও করে পুলিশ। এদিকে পুলিশ হেফাজত থেকে পালিয়ে যাওয়া আসামিকে ধরতে গতকাল বিকাল থেকে যশোরের পুলিশ সাঁড়াশি অভিযান শুরু করে। পরে রাত ৩টার দিকে পুলিশ জানতে পারে শহিদুল ইসলাম রামনগরে তার এক আত্মীয়ের বাড়িতে অবস্থান করছে। খবর পেয়ে পুলিশ সেখানে অভিযান চালায়। পুলিশ শহিদুল ইসলামকে আটক করে ফেরার পথে রামনগর পিকনিক কর্নারের কাছে পৌঁছালে স্থানীয় জামায়াত শিবিরের ক্যাডাররা পুলিশের ওপর আক্রমণ করে। এ সময় পুলিশও পাল্টা আক্রমণে যায়। এই সংঘর্ষ চলাকালে শহিদুল ইসলাম ফের পালানের চেষ্টা করলে পুলিশের ক্রসফায়ারে তার মৃত্যু হয়। সকালে নিহত শহিদুল ইসলামের মৃতদেহ উদ্ধার করে যশোর জেনারেল হাসপাতালের মর্গে পাঠিয়েছে কোতোয়ালি পুলিশ।
নোয়াখালী থেকে স্টাফ রিপোর্টার জানান, নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের লক্ষ্মীনারায়ণপুর গ্রামে পিচ্চি সোহেলের (৩০) গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। বৃহস্পতিবার রাত পৌনে ৮টার দিকে ইউনিয়নের লক্ষ্মীনারায়ণপুরের ৭নং ওয়ার্ডের আবু তাহের মেম্বার বাড়ির পার্শ্ববর্তী দিঘির পাশ থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। নিহত পিচ্চি সোহেল উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের লক্ষ্মীনারায়ণপুর গ্রামের মেকার বাড়ির হাবিব উল্লার ছেলে। লক্ষ্মীনারায়ণপুরের ৭নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য রহমত উল্লা বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, নিহত সোহেল স্থানীয় বিএনপির একজন সক্রিয় কর্মী। স্থানীয়রা জানায়, বৃহস্পতিবার রাত পৌনে ৮টার দিকে লক্ষ্মীনারায়ণপুরের আবু তাহের মেম্বার বাড়ির পার্শ্ববর্তী দিঘির পাশে পরপর কয়েকটি গুলির শব্দ শুনতে পায় এলাকার লোকজন। পরে তারা কিছুক্ষণ পর ঘটনাস্থলে গিয়ে পিচ্চি সোহলকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে সেখান থেকে উদ্ধার করে স্থানীয় লাইফ কেয়ার হসপিটালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। বেগমগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আইনুল হক জানান, নিহতের লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য নোয়াখালী আবদুল মালেক উকিল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত সাত দিনে সারা দেশে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে অন্তত এক ডজন ব্যক্তি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। রাজশাহী, কুমিল্লা, যশোর ও নোয়াখালীতে চার জন নিহত হওয়া ছাড়াও বুধবার দিবাগত রাত তিনটার দিকে কাজীপাড়া এলাকায় অজ্ঞাত এক যুবক পুলিশের কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়। এর একিদন আগেই মঙ্গলবার রাতে যাত্রাবাড়ীর মাতুইয়ালে র্যাবের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় মুজাহিদুল ইসলাম জিহাদ ও সাখাওয়াত হোসেন রাহাত নামে দুই যুবক নিহত হয়। নিহত দু’জনই গত মাসের ২১শে জানুয়ারি থেকে নিখোঁজ ছিলেন বলে পরিবারের সদস্যরা জানিযেছে। দু’জনের গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুর জেলায়। একই দিন রাজধানীর ভাষানটেক বালুর মাঠ থেকে আলামীন (৩০) নামে এক যুবকের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ভাই বিল্লাল হোসেন জানান, আলামীন ৭ দিন আগে গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলের সদর থানা টিলাবাড়ির এলাকা থেকে নিখোঁজ হয়।
গত ৩১শে জানুয়ারি শনিবার রাত সোয়া ১১টায় রাজধানীর রূপনগর এলাকার বেড়িবাঁধ এলাকায় পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে এমদাদ উল্লাহ ওরফে জুনায়েদ (২২) নামে এক শিবির নেতা নিহত হন। তিনি ৯৮ নম্বর ওয়ার্ডের সভাপতি ছিলেন। পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ, মেস থেকে মেধাবী এই ছাত্রকে সন্দেহমূলকভাবে আটক করে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। এর একদিন আগে ৩০শে জানুয়ারি শুক্রবার সকাল ১১টায় রূপনগর থানাধীন বেড়িবাঁধের চটবাড়ি এলাকায় এক যুবকের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পরে জানা যায়, ওই যুবকের নাম আরিফুল ইসলাম মুকুল। তিনি তেজগাঁও থানার জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কর্মী ছিলেন। নিহতের মামা তৌহিদুল ইসলাম জানান, আরিফুলকে গত ২৯শে জানুয়ারি বিকালে সদরঘাটে লঞ্চ থেকে ডিবি পুলিশের পরিচয় দিয়ে তাকে আটক করে নিয়ে যাওয়া হয়। পুলিশ তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে বলে তিনি দাবি করেছেন। গত ২৭শে জানুয়ারি ভোরে রাজশাহীতে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন স্থানীয় জামায়াত নেতা অধ্যাপক নূরুল ইসলাম শাহীন। পরিবারের অভিযোগ, তাকে আটক করার পর ‘পরিকল্পিতভাবে হত্যা’ করেছে ডিবি পুলিশ। নিহত নূরুল ইসলাম শাহীন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বিনোদপুর এলাকার ইসলামীয়া কলেজের ইসলাম শিক্ষা বিষয়ের অধ্যাপক ছিলেন। একই সময়ে সাতক্ষীরার পাটকেল ঘাটায় পুলিশের সঙ্গে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ রফিকুল ইসলাম নামে অপর এক ব্যক্তি নিহত হন। পুলিশের দাবি, পাটকেলঘাটা থানার কুমিরা ইউনিয়নের অভয়তলায় একদল ডাকাত ডাকাতির প্রস্তুতি নিচ্ছে এমন খবর পেয়ে ভোরে পুলিশ সেখানে যায়। এ সময় ডাকাতরা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ে। পুলিশও পাল্টা গুলি চালালে গুলিবিদ্ধ হন রফিকুল। তবে নিহত রফিকুলের স্ত্রী অভিযোগ করেছেন, তার স্বামীকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে ‘বন্দুকযুদ্ধের’ নাটক সাজিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। গত ২৬শে জানুয়ারি রাজধানীর রামপুরায় র্যাবের সঙ্গে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ আবুল কালাম ও সুলতান নামে দুই যুবক নিহত হন। ২৩শে জানুয়ারি কুমিল্লার দাউদকান্দিতে র্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন লক্ষ্মীপুরের সাবেক ছাত্রদল নেতা সোলাইমান উদ্দিন জিসান (২৮)। ২০শে জানুয়ারি রাজধানীতে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সঙ্গে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন খিলগাঁও থানা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নুরুজ্জামান ওরফে জনি। কারাগারে আটক ছোট ভাইকে দেখা করতে গেলে সেখান থেকে সোমবার ডিবি তাকে আটক করে। পরদিন জোড়াপুকুরপাড় এলাকায় তাকে নিয়ে অভিযান চালানোর সময় সহযোগীরা পুলিশের ওপর হামলা চালায় বলে দাবি করা হয়। এ সময় সহযোগীদের গুলিতেই জনি নিহত হন বলে দাবি করেন পুলিশ কর্মকর্তারা। নূরুজ্জামান জনির স্ত্রী মুনিয়া পারভীন মনীষা অভিযোগ করেন, ছাত্রদলের খিলগাঁও থানার সম্পাদকের দায়িত্বে থাকার কারণেই তাকে ক্রসফায়ারের নামে হত্যা করা হয়েছে। ১৯শে জানুয়ারি মতিঝিলের এজিবি কলোনিতে পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন নড়াইল পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ইমরুল কায়েস। তিনি জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। নিহতের পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, তিনি এক সপ্তাহ আগে ঢাকায় যান। নিহত হওয়ার চার দিন আগে থেকে তিনি নিখোঁজ ছিলেন। তাদের অভিযোগ, ডিবি থেকে তাকে আটক করে বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যা করেছে। এছাড়া গত ১৬ই জানুয়ারি যৌথবাহিনীর অভিযানের মধ্যে র্যাবের হাতে আটকের পর চাঁপাই নবাবগঞ্জের কানসাটে কথিত বন্দুকযুদ্ধে ছাত্রদল নেতা মতিউর রহমান নিহত হন। নিহত মতিউর রহমান শিবগঞ্জ উপজেলার শ্যামপুর ইউনিয়ন ছাত্রদলের সহসভাপতি ছিলেন। মতিউরকে নিয়েও মধ্যরাতে অভিযানে গিয়েছিল র্যাব। এ সময় মতিউরের সহযোগীরা র্যাবের ওপর গুলি ছুড়লে র্যাবও পাল্টা গুলি ছুড়ে। এতেই মতিউর গুলিবিদ্ধ হয় বলে র্যাবের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়।
এর বাইরে গত ২৭শে জানুয়ারি র্যাবের হাতে গ্রেপ্তারের পর এক শিবির নেতা ও গত সোমবার রাতে পুলিশের হাতে আটকের পর দুই বিএনপি সমর্থক মারা গেছেন। র্যাব ও পুলিশের দাবি, পালাতে গিয়ে ট্রাক চাপায় নিহত হয়েছেন তারা। যদিও নিহতদের পরিবারের সদস্যরা দাবি করেছেন, তাদের মারধর করে পরে ট্রাকচাপা দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এছাড়া ঢাকার মিরপুর রূপনগর বেড়িবাঁধ থেকে আরেক ছাত্রদল নেতার গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। স্বজনদের ধারণা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাই তাকে হত্যার পর লাশ ফেলে এসেছে।
No comments