বিক্ষোভের দিনগুলিতে প্রেম by
বাঁশের শুকনো পাতা ঝরে পড়ে বাঁশতলা ছেয়ে আছে। বাবার কবরটার বাঁশের বেড়া পুরোনো হয়ে গেছে বেশ। কবরের ওপরেও ঝরা বাঁশপাতার পুরু স্তর। সে কবর জিয়ারত করে। দোয়া করে আল্লাহপাকের দরবারে, ‘হে আল্লাহ, আমার বাবাকে বেহেশত নসিব করো।’ বিকালে শওকত বের হয়। মাকে কিছু বাজার-সদাই করে দেওয়া দরকার। মার জন্য সে এবার কিছুই আনতে পারেনি। ইউনিভার্সিটি হঠাৎই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ক্লোজড সিনে ডাই। ‘এরশাদের ঘোষণা, ছাত্রসমাজ মানে না’ স্লোগান দিতে দিতে তারা চলে আসে বাসটার্মিনালে, রেলস্টেশনে। মার জন্য কিছু যে একটা কিনবে, উপায় ছিল না। বাবু মিয়ার দোকানে আসে শওকত। মুদির দোকান। বটগাছের নিচে। টংয়ে বসে আছে কয়েকজন যুবক। তারা শওকতকে দেখে বিড়ি লুকোনোর প্রয়াস পায়। শওকত কাছে যেতে তারা সালাম দেয়। একজন বলে, ‘ভাইজান, কখন আসলেন?’
‘এই তো সকালে।’ ‘ঢাকার সব স্কুল-কলেজ বন্ধ করিয়া দিছে, বাহে?’
‘হ্যাঁ।’ ‘কালকা কী হইবে?’ আরেকজন জিগ্যেস করে। কথার সঙ্গে সঙ্গে তার মুখ থেকে বেরিয়ে এল সিগারেটের ধোঁয়া। ‘কালকা তো ঢাকা অবরোধ। সারা দেশ থেকে মানুষ যাবে ঢাকা। আমাদেরকে তো হল থেকে বাইর করি দিল। আর ঢাকাত যাওয়ার রাস্তাঘাটও সব বন্ধ করি দিছে।’ ‘তাইলে কি অবরোধ হবে না?’ একজন জিগ্যেস করে। ‘ঢাকাতেই তো ৫০ লাখ মানুষ আছে। তারা বাইর হইলেই হবে,’ শওকত জবাব দেয়। ‘সরকার এত ভয় পাইছে ক্যান?’ আরেকজন প্রশ্ন করে। ‘মনে হয়, হাসিনা আর খালেদা মিটিং করাতেই এরশাদ ভয় পায়া গেছে,’ শওকত জবাব দেয়। শওকত রাজনীতির খোঁজ কখনোই নিত না। কিন্তু অকারণে পুলিশের পিটুনি খেয়ে পা ভাঙার পর থেকেই সে তীব্র এরশাদ-বিরোধী হয়ে পড়েছে। এখন খোঁজখবর নেয়। বিরোধীদের আন্দোলন দেখলেই সে আগ্রহ বোধ করে। তার মনের মধ্যে একটা প্রতিশোধস্পৃহা জেগে ওঠে। ‘দুই নেত্রী মিটিং করলে কী হয়?’ একজন যুবক দুই হাত একত্র করে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে শুধোয়। ‘শাহ মোয়াজ্জেম তো বলেই দিছে, দুই মহিলা মিলিত হলে কিছুই উৎপাদিত হয় না’—শওকত বলে। ছেলেরা হেসে ওঠে হো হো করে। শওকত চায়ের পাতা কেনে। মার জন্য কী কিনবে তা-ই ভাবতে থাকে। এই দোকানে মার জন্য কিছু পাওয়া যাবে না। মাইল খানেক দূরে একটা বাজার আছে, সেখানে যেতে হবে। মার জন্য একটা শাড়ি কেনাই ভালো। তাহলে বোধ হয় রংপুর যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে। আপাতত সে মার জন্য কিছু জিলাপি কিনে নিলেই পারে। সে আরেকটু হেঁটে বাজারের জিলাপির দোকান পর্যন্ত যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। বাঁশের খাঁচাড়িতে করে জিলাপি নিয়ে ফেরে শওকত। বাড়ির দাওয়ায় আসতে আসতে সন্ধ্যা নেমে আসে চরাচরে। গরুর পাল ফিরছে ধূলি উড়িয়ে, গোধূলি কথাটাকে সার্থক প্রমাণ করার জন্য। ছেলেপুলের দলও ধান উঠে যাওয়া খেতে ফুটবল খেলে এক হাঁটু ধুলা নিয়ে যার যার ঘরে ফিরছে হইচই করতে করতে। পশ্চিম আকাশে মেঘের রঙিন আস্তরণ। এই সময়টাকে বলা হয় কনে দেখা ক্ষণ। এই আলোটাকে বলা হয় কনে দেখা আলো। এই হলুদ আলোয় সবকিছুকে উজ্জ্বল বলে বোধ হয়!
এমনি কুহেলিময় এক প্রদোষে শওকত দেখে, তাদের বাড়ির দাওয়ায় একটা অপূর্ব নারীমূর্তি দাঁড়িয়ে। উজ্জ্বল কমলা রঙের শাড়ি, দিঘল কেশ, পিতলের মূর্তির মতো মুখশ্রী।
শওকতের বুকটা কেঁপে ওঠে।
তাকে দেখামাত্রই সেই নারীমূর্তি অন্তর্হিত হয় রান্নাঘরে।
শওকত এগিয়ে যায়।
ব্যাপার কী?
মেয়েটা কে?
শওকত আরেকটু এগোয়। বারান্দায় ওঠে। ইটের গাঁথুনি দেওয়া প্লিনথ। মেঝেতে মাটি। দেয়ালে ইট। প্লাস্টার আছে। চুনকাম করা হয়নি।
শওকত বারান্দার টেবিলে রাখে জিলাপির ঠোঙা।
মাকে ডাকে, ‘মা, মা।’
সেই নারীমূর্তি এগিয়ে আসে।
বলে, ‘চাচিআম্মা নামাজে বসছে।’
মার এ আবার কোন ভাইঝি? শওকত মনে মনে হিসাব কষে। হিসাবের কোনো ফল ফলছে না।
‘আপনি চা-পাতি আনছেন? দেন। চাচিআম্মা আপনাকে চা বানায়া দিতে বলছে।’ শওকত টেবিলের ওপরে রাখা জিলাপির ঠোঙার পাশ থেকে চায়ের পাতার প্যাকেট তুলে নিয়ে বলে, ‘এই যে চা-পাতি। জিলাপিও আছে।’ শওকত বারান্দার বেঞ্চে বসে। ঘরের দরজার গোড়ায় কেরোসিনের লন্ঠন জ্বালানো হয়েছে। তবে সলতে উসকে দেওয়া হয়নি। এখনো অন্ধকার প্রবল নয়। আলোই এখনো কর্তৃত্ব করছে অন্ধকারের ওপরে। কিন্তু কেরোসিনের গন্ধ ছড়িয়ে আছে বাতাসে। মা নামাজ পড়বেন অনেকক্ষণ ধরে। নামাজ শেষে পড়বেন দোয়াদরুদ। চায়ের গন্ধ আসছে রান্নাঘরের ভাঙা বেড়ার ফাঁক দিয়ে। শওকতের শরীর চায়ের জন্য উন্মুখ হয়ে ওঠে। কিন্তু তার মনটা কাঙ্ক্ষা করছে ওই কমলা শাড়ি নারীটিকে। হাতে চায়ের কাপ নিয়ে মেয়েটি আসে। আরেক হাতে জিলাপি। টেবিলে সেসব রেখে সে বলে, ‘আমি পানি আনতেছি এখনই।’ সে চলে যায় রান্নাঘরে। কাঁসার গেলাসে পানি ঢেলে ফিরে আসে চটপট। তার হাতে একগাছা সোনার চুড়ি!
মেয়েটি দরজার মুখ থেকে লন্ঠনটা তুলে আনে। আলোর তেজ বাড়িয়ে দেয় চাবি ঘুরিয়ে। তার মুখখানা আবারও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সে লন্ঠন রাখে টেবিলে।
শওকত বলে, ‘তোমার নাম কী?’
‘আমার নাম সোনিয়া।’
‘কোন বাড়ি তোমার?’
‘তালুকদার বাড়ি। আমি নুরুল বিএসসির মেয়ে।’
‘তুমি নুরুল স্যারের মেয়ে। নুরুল স্যারের কাছে অঙ্ক পড়ছিলাম। খুব ভালো বুঝাইতেন। স্যার কেমন আছেন?’
‘জি, ভালো আছেন।’
‘তুমি কী পড়ো?’
‘আমি বদরগঞ্জ কলেজে আইএসসি পড়ি।’
‘বাহ্।’
‘আমার স্ট্যাটিকস বুঝতে অসুবিধা হয়। আব্বা বলছেন, আপনি আসলে আপনার কাছ থেকে বুঝায়া নিতে।’ ‘তা তোমার আব্বা ভালোই বলছেন। আমাদের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়ায় তো খালি এই স্ট্যাটিকস।’ শওকতের মা আসেন। বলেন, ‘সোনিয়া, চা দিছ মা তোমার ভাইজানক?’
‘দিছি চাচিআম্মা। আপনার জন্য ভাইজান জিলাপি আনছে। নেন, খান।’
‘তুমি খাইছ?’
‘আপনি না খাইলে ক্যামন করি খাই, চাচি আম্মা’, সোনিয়া বলে। ‘যাও। তাইলে নিয়া আসো পাকঘর থাকিয়া।’ সোনিয়া রান্নাঘরের দিকে যায়। মা গলা উঁচিয়ে বলেন, ‘পাকঘরত ল্যাম্পোটা আছে। জ্বালেয়া ন্যাও, মা।’ তারপর ফিসফিস করে বলেন, ‘এই রকম মেয়ে আর হয় না। এই বাড়িতে আমি একলা একলা থাকি। এই মেয়েই আসিয়া আমার খোঁজখবর নেয়। নিজের বেটিও এই রকম খোঁজখবর করে না।’ এক হাতে ল্যাম্প আরেক হাতে জিলাপিভরা থালা নিয়ে সোনিয়া ফেরে। টেবিলে রেখে বলে, ‘চাচিআম্মা, নেন, খান।’ ‘তুমি খাও, মা।’ ‘আমি পরে খাব।’
‘কেন, পরে খাবা কেন?’
‘না, পরে খাব,’ বলে সে সামনে থেকে চলে যায়। মা বলেন, ‘দেখলা কী রকম আদব। তোমার সামনে খাবে না। তাই খাইল না।’ শওকতের মনে পড়ছে বহ্নির কথা। বহ্নি তার পায়ের ফোলা জায়গায় তর্জনী বুলিয়েছিল। রাত্রি পৌনে আটটা এই গ্রামে অনেক রাত। সবার খাওয়া হয়ে গেছে। শওকত বলে, ‘রেডিওটা কই আমাদের?’
মা বলেন, ‘তোর বাবা মরার পর তো সেইটার কোনো খোঁজখবর নাই।’ ‘আরে বিবিসি শোনা দরকার ছিল। কালকা ঢাকায় ঘেরাও। কী হয় না-হয় শুনি।’ ‘যা, তোর নুরুল বিএসসি স্যারের বাড়ি যা। অরা খুব খবর শোনে। সোনিয়ার সাথে যা। সোনিয়া, ও সোনিয়া। ভাইজানক বাড়িত নিয়া যাও। ভাইজান রেডিওতে খবর শুনিবে।’ ঝিঁঝি ডাকছে। জোনাকি জ্বলে উঠেছে এদিক-ওদিক। শেয়ালের ডাক আসছে কাশবনের দিক থেকে। গৃহস্থ বাড়িগুলো থেকে আসছে কুকুরের ঘেউ ঘেউ রব। সোনিয়ার হাতে একটা টর্চলাইট। তার পেছন পেছন হাঁটছে শওকত। সোনিয়ার গা থেকে একটা বুনো গন্ধ আসছে। শওকতের মাতাল মাতাল লাগছে। মাথার ওপরে বাঁশঝাড়। কী যেন নড়ে ওঠে বাঁশঝাড়ে। শওকতের বুক কাঁপে। সে সোনিয়ার নিকটবর্তী হয়। সোনিয়ার শরীর থেকে কেরোসিনের গন্ধ আসে। শওকতের কেমন যেন লাগে।
‘এই তো সকালে।’ ‘ঢাকার সব স্কুল-কলেজ বন্ধ করিয়া দিছে, বাহে?’
‘হ্যাঁ।’ ‘কালকা কী হইবে?’ আরেকজন জিগ্যেস করে। কথার সঙ্গে সঙ্গে তার মুখ থেকে বেরিয়ে এল সিগারেটের ধোঁয়া। ‘কালকা তো ঢাকা অবরোধ। সারা দেশ থেকে মানুষ যাবে ঢাকা। আমাদেরকে তো হল থেকে বাইর করি দিল। আর ঢাকাত যাওয়ার রাস্তাঘাটও সব বন্ধ করি দিছে।’ ‘তাইলে কি অবরোধ হবে না?’ একজন জিগ্যেস করে। ‘ঢাকাতেই তো ৫০ লাখ মানুষ আছে। তারা বাইর হইলেই হবে,’ শওকত জবাব দেয়। ‘সরকার এত ভয় পাইছে ক্যান?’ আরেকজন প্রশ্ন করে। ‘মনে হয়, হাসিনা আর খালেদা মিটিং করাতেই এরশাদ ভয় পায়া গেছে,’ শওকত জবাব দেয়। শওকত রাজনীতির খোঁজ কখনোই নিত না। কিন্তু অকারণে পুলিশের পিটুনি খেয়ে পা ভাঙার পর থেকেই সে তীব্র এরশাদ-বিরোধী হয়ে পড়েছে। এখন খোঁজখবর নেয়। বিরোধীদের আন্দোলন দেখলেই সে আগ্রহ বোধ করে। তার মনের মধ্যে একটা প্রতিশোধস্পৃহা জেগে ওঠে। ‘দুই নেত্রী মিটিং করলে কী হয়?’ একজন যুবক দুই হাত একত্র করে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে শুধোয়। ‘শাহ মোয়াজ্জেম তো বলেই দিছে, দুই মহিলা মিলিত হলে কিছুই উৎপাদিত হয় না’—শওকত বলে। ছেলেরা হেসে ওঠে হো হো করে। শওকত চায়ের পাতা কেনে। মার জন্য কী কিনবে তা-ই ভাবতে থাকে। এই দোকানে মার জন্য কিছু পাওয়া যাবে না। মাইল খানেক দূরে একটা বাজার আছে, সেখানে যেতে হবে। মার জন্য একটা শাড়ি কেনাই ভালো। তাহলে বোধ হয় রংপুর যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে। আপাতত সে মার জন্য কিছু জিলাপি কিনে নিলেই পারে। সে আরেকটু হেঁটে বাজারের জিলাপির দোকান পর্যন্ত যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। বাঁশের খাঁচাড়িতে করে জিলাপি নিয়ে ফেরে শওকত। বাড়ির দাওয়ায় আসতে আসতে সন্ধ্যা নেমে আসে চরাচরে। গরুর পাল ফিরছে ধূলি উড়িয়ে, গোধূলি কথাটাকে সার্থক প্রমাণ করার জন্য। ছেলেপুলের দলও ধান উঠে যাওয়া খেতে ফুটবল খেলে এক হাঁটু ধুলা নিয়ে যার যার ঘরে ফিরছে হইচই করতে করতে। পশ্চিম আকাশে মেঘের রঙিন আস্তরণ। এই সময়টাকে বলা হয় কনে দেখা ক্ষণ। এই আলোটাকে বলা হয় কনে দেখা আলো। এই হলুদ আলোয় সবকিছুকে উজ্জ্বল বলে বোধ হয়!
এমনি কুহেলিময় এক প্রদোষে শওকত দেখে, তাদের বাড়ির দাওয়ায় একটা অপূর্ব নারীমূর্তি দাঁড়িয়ে। উজ্জ্বল কমলা রঙের শাড়ি, দিঘল কেশ, পিতলের মূর্তির মতো মুখশ্রী।
শওকতের বুকটা কেঁপে ওঠে।
তাকে দেখামাত্রই সেই নারীমূর্তি অন্তর্হিত হয় রান্নাঘরে।
শওকত এগিয়ে যায়।
ব্যাপার কী?
মেয়েটা কে?
শওকত আরেকটু এগোয়। বারান্দায় ওঠে। ইটের গাঁথুনি দেওয়া প্লিনথ। মেঝেতে মাটি। দেয়ালে ইট। প্লাস্টার আছে। চুনকাম করা হয়নি।
শওকত বারান্দার টেবিলে রাখে জিলাপির ঠোঙা।
মাকে ডাকে, ‘মা, মা।’
সেই নারীমূর্তি এগিয়ে আসে।
বলে, ‘চাচিআম্মা নামাজে বসছে।’
মার এ আবার কোন ভাইঝি? শওকত মনে মনে হিসাব কষে। হিসাবের কোনো ফল ফলছে না।
‘আপনি চা-পাতি আনছেন? দেন। চাচিআম্মা আপনাকে চা বানায়া দিতে বলছে।’ শওকত টেবিলের ওপরে রাখা জিলাপির ঠোঙার পাশ থেকে চায়ের পাতার প্যাকেট তুলে নিয়ে বলে, ‘এই যে চা-পাতি। জিলাপিও আছে।’ শওকত বারান্দার বেঞ্চে বসে। ঘরের দরজার গোড়ায় কেরোসিনের লন্ঠন জ্বালানো হয়েছে। তবে সলতে উসকে দেওয়া হয়নি। এখনো অন্ধকার প্রবল নয়। আলোই এখনো কর্তৃত্ব করছে অন্ধকারের ওপরে। কিন্তু কেরোসিনের গন্ধ ছড়িয়ে আছে বাতাসে। মা নামাজ পড়বেন অনেকক্ষণ ধরে। নামাজ শেষে পড়বেন দোয়াদরুদ। চায়ের গন্ধ আসছে রান্নাঘরের ভাঙা বেড়ার ফাঁক দিয়ে। শওকতের শরীর চায়ের জন্য উন্মুখ হয়ে ওঠে। কিন্তু তার মনটা কাঙ্ক্ষা করছে ওই কমলা শাড়ি নারীটিকে। হাতে চায়ের কাপ নিয়ে মেয়েটি আসে। আরেক হাতে জিলাপি। টেবিলে সেসব রেখে সে বলে, ‘আমি পানি আনতেছি এখনই।’ সে চলে যায় রান্নাঘরে। কাঁসার গেলাসে পানি ঢেলে ফিরে আসে চটপট। তার হাতে একগাছা সোনার চুড়ি!
মেয়েটি দরজার মুখ থেকে লন্ঠনটা তুলে আনে। আলোর তেজ বাড়িয়ে দেয় চাবি ঘুরিয়ে। তার মুখখানা আবারও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সে লন্ঠন রাখে টেবিলে।
শওকত বলে, ‘তোমার নাম কী?’
‘আমার নাম সোনিয়া।’
‘কোন বাড়ি তোমার?’
‘তালুকদার বাড়ি। আমি নুরুল বিএসসির মেয়ে।’
‘তুমি নুরুল স্যারের মেয়ে। নুরুল স্যারের কাছে অঙ্ক পড়ছিলাম। খুব ভালো বুঝাইতেন। স্যার কেমন আছেন?’
‘জি, ভালো আছেন।’
‘তুমি কী পড়ো?’
‘আমি বদরগঞ্জ কলেজে আইএসসি পড়ি।’
‘বাহ্।’
‘আমার স্ট্যাটিকস বুঝতে অসুবিধা হয়। আব্বা বলছেন, আপনি আসলে আপনার কাছ থেকে বুঝায়া নিতে।’ ‘তা তোমার আব্বা ভালোই বলছেন। আমাদের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়ায় তো খালি এই স্ট্যাটিকস।’ শওকতের মা আসেন। বলেন, ‘সোনিয়া, চা দিছ মা তোমার ভাইজানক?’
‘দিছি চাচিআম্মা। আপনার জন্য ভাইজান জিলাপি আনছে। নেন, খান।’
‘তুমি খাইছ?’
‘আপনি না খাইলে ক্যামন করি খাই, চাচি আম্মা’, সোনিয়া বলে। ‘যাও। তাইলে নিয়া আসো পাকঘর থাকিয়া।’ সোনিয়া রান্নাঘরের দিকে যায়। মা গলা উঁচিয়ে বলেন, ‘পাকঘরত ল্যাম্পোটা আছে। জ্বালেয়া ন্যাও, মা।’ তারপর ফিসফিস করে বলেন, ‘এই রকম মেয়ে আর হয় না। এই বাড়িতে আমি একলা একলা থাকি। এই মেয়েই আসিয়া আমার খোঁজখবর নেয়। নিজের বেটিও এই রকম খোঁজখবর করে না।’ এক হাতে ল্যাম্প আরেক হাতে জিলাপিভরা থালা নিয়ে সোনিয়া ফেরে। টেবিলে রেখে বলে, ‘চাচিআম্মা, নেন, খান।’ ‘তুমি খাও, মা।’ ‘আমি পরে খাব।’
‘কেন, পরে খাবা কেন?’
‘না, পরে খাব,’ বলে সে সামনে থেকে চলে যায়। মা বলেন, ‘দেখলা কী রকম আদব। তোমার সামনে খাবে না। তাই খাইল না।’ শওকতের মনে পড়ছে বহ্নির কথা। বহ্নি তার পায়ের ফোলা জায়গায় তর্জনী বুলিয়েছিল। রাত্রি পৌনে আটটা এই গ্রামে অনেক রাত। সবার খাওয়া হয়ে গেছে। শওকত বলে, ‘রেডিওটা কই আমাদের?’
মা বলেন, ‘তোর বাবা মরার পর তো সেইটার কোনো খোঁজখবর নাই।’ ‘আরে বিবিসি শোনা দরকার ছিল। কালকা ঢাকায় ঘেরাও। কী হয় না-হয় শুনি।’ ‘যা, তোর নুরুল বিএসসি স্যারের বাড়ি যা। অরা খুব খবর শোনে। সোনিয়ার সাথে যা। সোনিয়া, ও সোনিয়া। ভাইজানক বাড়িত নিয়া যাও। ভাইজান রেডিওতে খবর শুনিবে।’ ঝিঁঝি ডাকছে। জোনাকি জ্বলে উঠেছে এদিক-ওদিক। শেয়ালের ডাক আসছে কাশবনের দিক থেকে। গৃহস্থ বাড়িগুলো থেকে আসছে কুকুরের ঘেউ ঘেউ রব। সোনিয়ার হাতে একটা টর্চলাইট। তার পেছন পেছন হাঁটছে শওকত। সোনিয়ার গা থেকে একটা বুনো গন্ধ আসছে। শওকতের মাতাল মাতাল লাগছে। মাথার ওপরে বাঁশঝাড়। কী যেন নড়ে ওঠে বাঁশঝাড়ে। শওকতের বুক কাঁপে। সে সোনিয়ার নিকটবর্তী হয়। সোনিয়ার শরীর থেকে কেরোসিনের গন্ধ আসে। শওকতের কেমন যেন লাগে।
No comments