আমরা কি হেরে যাচ্ছি? by হাসান ফেরদৌস
আবারও
চলন্ত গাড়িতে বোমা। আবারও নিহত নিরীহ মানুষ। তাঁদের কেউ ঘরে ফিরছিলেন
স্বজনের কাছে, কেউ স্বজনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ঘর ছেড়ে ঢাকায় আসছিলেন
জরুরি কাজে। দিনদুপুরে গাড়ি-বাসে চলা নিরাপদ নয়, সে কথা জেনে ভেবেচিন্তে
তাঁরা মধ্যরাতের পরিবহন বাসে ভ্রমণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁরা
জানতেন না ভয়াবহ ঘাতক ওত পেতে বসে ছিল তাঁদেরই জন্য। পেট্রলবোমায় পুড়ে গেল
তাদের দেহ, ঝলসে গেল অসম্পূর্ণ জীবন। এর জবাবে আমরা কী করছি? সরকার বাহাদুর
বিরোধী দলের ওপর দোষ চাপিয়ে নিজের দায়িত্ব পালন শেষ করছে। বুদ্ধিজীবীরা
কলাম লিখে আহাজারি করছেন। কেউ কেউ আবার বোমাবাজদের কাছে বিনীত অনুরোধ
রাখছেন, ‘প্লিজ, বাসের ওপর পেট্রলবোমা ফেলবেন না। নিরীহ বাসের কী দোষ?’
রাজনৈতিকভাবে খুব প্রণোদিত যাঁরা, দল বেঁধে শহীদ মিনারে এসে তাঁরা মিনমিনে
গলায় স্লোগান ধরছেন। সম্ভবত গানও।
সত্যি কি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আমরা হেরে গেছি? বিনীত অনুরোধ অথবা মিনমিনে গলায় ‘প্লিজ, বোমা ছুড়বেন না’ বলে অনুরোধ ছাড়া আমাদের করার আর কিছুই নেই?
নিউইয়র্কে বাস করেন শিল্পী তাজুল ইমাম। দেশজুড়ে অব্যাহত সন্ত্রাসের জবাবে তিনি নিজের রংতুলি হাতে তুলে নিয়েছেন। একের পর এক ছবি এঁকে এই নিষ্ঠুর ও বর্বর সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মানচিত্র নির্মাণ করে চলেছেন। প্রতিটি ছবিতেই দেখি হতাহত, অগ্নিদগ্ধ মানুষ, তাদের বুকফাটা ক্রন্দন। তাঁকে আমি জিজ্ঞেস করি, এই ছবি কি আসলে আমাদের পরাজয়ের বিবরণ? ওরা পেট্রলবোমা ছুড়বে, আর আমরা হতাহত ব্যক্তিদের বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদব। ব্যস, এই পর্যন্তই?
তাজুল ভাই দ্বিমত প্রকাশ করে বলেন, চোখে কান্না, কিন্তু সেই কান্নার পেছনে আছে ক্রোধের আগুন। বুক ভেঙে আসছে বেদনায়, কিন্তু সে একই সঙ্গে ফুঁসছে বিদ্রোহে।
আমার মন সাড়া দেয় না। যদি বুকে থাকে সেই বিদ্রোহের আগুন, তার প্রকাশ কই? আমাদের সম্মিলিত প্রত্যাখ্যানের পরেও এমন নির্বিচারে বোমাবাজি চলে কীভাবে? যাঁরা বোমাবাজির পক্ষে সাফাই গান, তাঁরাই বা কীভাবে এমন অনায়াসে নিজেদের সমাজের সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে জায়গা দখল করে থাকেন? কীভাবে বিবিসি সংলাপে সদম্ভে প্রশ্ন করেন, ‘এখন আবার কিসের পরীক্ষা?’ সেখানে সম্মেলনে কি এমন একজনও ছিলেন যিনি লজ্জায় সে কক্ষ ত্যাগ করেছেন?
যাঁরা আজকের সন্ত্রাসের পেছনে মদদ জোগাচ্ছেন, তাঁদের ন্যায্য রাজনৈতিক দাবিদাওয়া নেই, এ কথা আমি বলি না। কিন্তু রাজনৈতিক দাবি আদায় করতে হয় রাজনৈতিকভাবে, সন্ত্রাসের মাধ্যমে নয়। মানুষের কল্যাণের স্বার্থেই তো রাজনীতি।
তাহলে এ কেমন রাজনীতি, যার ফলে বলি হয় নিরীহ মানুষ? ভাড়াটে খুনি দিয়ে হয়তো নিরীহ মানুষ হত্যা করা যায়, কিন্তু রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জিত হয় না। যাঁরা এই সন্ত্রাসের রাজনীতিকে নিজেদের সঠিক রণকৌশল ভেবে আত্মতুষ্ট, তাঁদের কাছে প্রশ্ন, কবরের ওপর কোন মিনার আপনারা নির্মাণ করবেন?
দিনের পর দিন একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। ব্যাপারটা এখন এত নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে পড়েছে যে সম্ভবত একধরনের ক্লান্তি এসে গেছে আমাদের। সংবাদপত্রে শিরোনাম পড়েই অন্য খবরে মন দিই। টেলিভিশনে অগ্নিদগ্ধ মানুষের ছবি দেখলে চ্যানেল বদলাই। এক বুদ্ধিমান বন্ধু বললেন, এ হচ্ছে ‘হরতাল ফ্যাটিগ’, হরতালজনিত শ্রান্তি বা অবসাদ।
আসলে নিজেদের ‘ভিকটিম’ বা ঘটনার শিকার হিসেবে দেখে আমরা বরাবর তৃপ্ত। আমাদের প্রতিটি প্রতিবাদের গান অথবা বিদ্রোহের কবিতার বিষয়বস্তু শহীদের প্রতি স্তবগাথা। ‘আম্মা, এই নামটি বলে আর কেউ ডাকবে না’—এমন কথা বলে আমরা নিজেদের বেদনার ক্ষতে প্রলেপ দিই। তারপর একসময় সব ভুলে যাই। আমরা যদি সত্যিই এই সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে, তাহলে ঢাকার রাস্তায় লাখো লোকের হরতালবিরোধী মিছিল নেই কেন? প্রতিটি পেট্রলবোমা নিক্ষেপকারীকে হাতেনাতে ধরে ফেলার জন্য কেন অপেক্ষায় নেই ১০ জন স্বেচ্ছাসেবক, যাঁরা রাত জেগে সড়ক পাহারা দেবেন? এই গ্রাম ও জনপদ আমার, সন্ত্রাসীর কবল থেকে তাকে তো ছিনিয়ে আনতে হবে আমাকেই।
আজকের যে লড়াই, তা বাংলাদেশের আত্মার লড়াই। এর আগে কখনো এমন স্পষ্টভাবে শুভ ও অশুভের লড়াই প্রকাশিত হয়নি। এ হয়তো মুক্তিযুদ্ধ নয়, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অর্জনের বিরুদ্ধে এ যে প্রবল আক্রমণের চেষ্টা, তাতেও কোনো ভুল নেই। এতে যাদের জিত হবে, তারাই নির্ধারণ করবে বাংলাদেশ ও বাঙালির আত্মপরিচয়। এখন সময় এসেছে প্রশ্ন করার, এই লড়াইয়ে আপনার অবস্থান কী?
সরকার বা বিরোধী দল আমরা বুঝি না। যাঁরা রাজনীতি করেন, তাঁদের প্রত্যেকের কাছে আমাদের দাবি, আপনারা সুস্পষ্ট ভাষায় হত্যার রাজনীতির বিপক্ষে আপনাদের অবস্থানের কথা জানান। আপনাদের কেউ না কেউ ভাড়াটে খুনি লাগিয়েছেন। স্পষ্টভাবে সেসব খুনির উদ্দেশে বলুন, এই হত্যার রাজনীতি আপনারা চান না। তা করতে ব্যর্থ হলে আপনাদেরই আমরা প্রতিটি খুনের জন্য দায়ী করব।
একাত্তরে বঙ্গবন্ধু ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ার কথা বলেছিলেন। ঘরে ঘরে নয়, আজ চাই পাড়ায় পাড়ায় সেই দুর্গ। এই ঘর, এই পাড়া, এই শহর আমার। তার ওপর নজরদারির দায়িত্ব আমার। যারা জামার নিচে বা কাগজের পুঁটলিতে পেট্রলবোমা লুকিয়ে রাখে, সে বোমা ছোড়ার আগেই তাকে আমরা ধরে ফেলব। না, সে শুধু একজন দুষ্কৃতকারী নয়। তার নাম-ধাম আছে, তার পেছনে ছাতা ধরে থাকা নেতা আছেন। তাঁদের পরিচয় উদ্ঘাটন আমরাই করব।
না, আমরা পরাজয় মানব না।
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷
সত্যি কি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আমরা হেরে গেছি? বিনীত অনুরোধ অথবা মিনমিনে গলায় ‘প্লিজ, বোমা ছুড়বেন না’ বলে অনুরোধ ছাড়া আমাদের করার আর কিছুই নেই?
নিউইয়র্কে বাস করেন শিল্পী তাজুল ইমাম। দেশজুড়ে অব্যাহত সন্ত্রাসের জবাবে তিনি নিজের রংতুলি হাতে তুলে নিয়েছেন। একের পর এক ছবি এঁকে এই নিষ্ঠুর ও বর্বর সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মানচিত্র নির্মাণ করে চলেছেন। প্রতিটি ছবিতেই দেখি হতাহত, অগ্নিদগ্ধ মানুষ, তাদের বুকফাটা ক্রন্দন। তাঁকে আমি জিজ্ঞেস করি, এই ছবি কি আসলে আমাদের পরাজয়ের বিবরণ? ওরা পেট্রলবোমা ছুড়বে, আর আমরা হতাহত ব্যক্তিদের বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদব। ব্যস, এই পর্যন্তই?
তাজুল ভাই দ্বিমত প্রকাশ করে বলেন, চোখে কান্না, কিন্তু সেই কান্নার পেছনে আছে ক্রোধের আগুন। বুক ভেঙে আসছে বেদনায়, কিন্তু সে একই সঙ্গে ফুঁসছে বিদ্রোহে।
আমার মন সাড়া দেয় না। যদি বুকে থাকে সেই বিদ্রোহের আগুন, তার প্রকাশ কই? আমাদের সম্মিলিত প্রত্যাখ্যানের পরেও এমন নির্বিচারে বোমাবাজি চলে কীভাবে? যাঁরা বোমাবাজির পক্ষে সাফাই গান, তাঁরাই বা কীভাবে এমন অনায়াসে নিজেদের সমাজের সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে জায়গা দখল করে থাকেন? কীভাবে বিবিসি সংলাপে সদম্ভে প্রশ্ন করেন, ‘এখন আবার কিসের পরীক্ষা?’ সেখানে সম্মেলনে কি এমন একজনও ছিলেন যিনি লজ্জায় সে কক্ষ ত্যাগ করেছেন?
যাঁরা আজকের সন্ত্রাসের পেছনে মদদ জোগাচ্ছেন, তাঁদের ন্যায্য রাজনৈতিক দাবিদাওয়া নেই, এ কথা আমি বলি না। কিন্তু রাজনৈতিক দাবি আদায় করতে হয় রাজনৈতিকভাবে, সন্ত্রাসের মাধ্যমে নয়। মানুষের কল্যাণের স্বার্থেই তো রাজনীতি।
তাহলে এ কেমন রাজনীতি, যার ফলে বলি হয় নিরীহ মানুষ? ভাড়াটে খুনি দিয়ে হয়তো নিরীহ মানুষ হত্যা করা যায়, কিন্তু রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জিত হয় না। যাঁরা এই সন্ত্রাসের রাজনীতিকে নিজেদের সঠিক রণকৌশল ভেবে আত্মতুষ্ট, তাঁদের কাছে প্রশ্ন, কবরের ওপর কোন মিনার আপনারা নির্মাণ করবেন?
দিনের পর দিন একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। ব্যাপারটা এখন এত নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে পড়েছে যে সম্ভবত একধরনের ক্লান্তি এসে গেছে আমাদের। সংবাদপত্রে শিরোনাম পড়েই অন্য খবরে মন দিই। টেলিভিশনে অগ্নিদগ্ধ মানুষের ছবি দেখলে চ্যানেল বদলাই। এক বুদ্ধিমান বন্ধু বললেন, এ হচ্ছে ‘হরতাল ফ্যাটিগ’, হরতালজনিত শ্রান্তি বা অবসাদ।
আসলে নিজেদের ‘ভিকটিম’ বা ঘটনার শিকার হিসেবে দেখে আমরা বরাবর তৃপ্ত। আমাদের প্রতিটি প্রতিবাদের গান অথবা বিদ্রোহের কবিতার বিষয়বস্তু শহীদের প্রতি স্তবগাথা। ‘আম্মা, এই নামটি বলে আর কেউ ডাকবে না’—এমন কথা বলে আমরা নিজেদের বেদনার ক্ষতে প্রলেপ দিই। তারপর একসময় সব ভুলে যাই। আমরা যদি সত্যিই এই সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে, তাহলে ঢাকার রাস্তায় লাখো লোকের হরতালবিরোধী মিছিল নেই কেন? প্রতিটি পেট্রলবোমা নিক্ষেপকারীকে হাতেনাতে ধরে ফেলার জন্য কেন অপেক্ষায় নেই ১০ জন স্বেচ্ছাসেবক, যাঁরা রাত জেগে সড়ক পাহারা দেবেন? এই গ্রাম ও জনপদ আমার, সন্ত্রাসীর কবল থেকে তাকে তো ছিনিয়ে আনতে হবে আমাকেই।
আজকের যে লড়াই, তা বাংলাদেশের আত্মার লড়াই। এর আগে কখনো এমন স্পষ্টভাবে শুভ ও অশুভের লড়াই প্রকাশিত হয়নি। এ হয়তো মুক্তিযুদ্ধ নয়, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অর্জনের বিরুদ্ধে এ যে প্রবল আক্রমণের চেষ্টা, তাতেও কোনো ভুল নেই। এতে যাদের জিত হবে, তারাই নির্ধারণ করবে বাংলাদেশ ও বাঙালির আত্মপরিচয়। এখন সময় এসেছে প্রশ্ন করার, এই লড়াইয়ে আপনার অবস্থান কী?
সরকার বা বিরোধী দল আমরা বুঝি না। যাঁরা রাজনীতি করেন, তাঁদের প্রত্যেকের কাছে আমাদের দাবি, আপনারা সুস্পষ্ট ভাষায় হত্যার রাজনীতির বিপক্ষে আপনাদের অবস্থানের কথা জানান। আপনাদের কেউ না কেউ ভাড়াটে খুনি লাগিয়েছেন। স্পষ্টভাবে সেসব খুনির উদ্দেশে বলুন, এই হত্যার রাজনীতি আপনারা চান না। তা করতে ব্যর্থ হলে আপনাদেরই আমরা প্রতিটি খুনের জন্য দায়ী করব।
একাত্তরে বঙ্গবন্ধু ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ার কথা বলেছিলেন। ঘরে ঘরে নয়, আজ চাই পাড়ায় পাড়ায় সেই দুর্গ। এই ঘর, এই পাড়া, এই শহর আমার। তার ওপর নজরদারির দায়িত্ব আমার। যারা জামার নিচে বা কাগজের পুঁটলিতে পেট্রলবোমা লুকিয়ে রাখে, সে বোমা ছোড়ার আগেই তাকে আমরা ধরে ফেলব। না, সে শুধু একজন দুষ্কৃতকারী নয়। তার নাম-ধাম আছে, তার পেছনে ছাতা ধরে থাকা নেতা আছেন। তাঁদের পরিচয় উদ্ঘাটন আমরাই করব।
না, আমরা পরাজয় মানব না।
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷
No comments